লকডাউনের ভবিষ্যৎ এবং হার্ড ইমিউনিটি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/০৪/২০২০ - ১১:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হবার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একে একে লকডাউন ঘোষণা করছে। দেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব, চিকিৎসা ব্যবস্থা, অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের সচেতনতা, নেতৃত্ব ইত্যাদি অনেক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে লকডাউন কতটা কঠোর হবে সেটা নির্ধারিত হচ্ছে। লকডাউনের কারনে অনেক দেশ খুব কম সময়ে ভাল ফলাফল পেয়েছে আবার কোন কোন দেশে সেটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। লকডাউনের কারনে অর্থনীতি সাঙ্ঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং অনিশ্চয়তার কারনে মানুষ দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে। সবদিক বিচার করে সকল দেশের নেতাদের খুব সাবধানে ভাবতে হচ্ছে লকডাউন কতদিন চলবে নাকি লকডাউন থেকে সরে আসবে নাকি লকডাউন শিথিল করে অর্থনীতি কিছুটা সচল করবে। যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়া এখন অসম্ভব রকম কঠিন কারন যে পথই বেছে নেয়া হোক না কেন ক্ষতির সম্ভাবনা কিন্তু কমানো যাচ্ছেনা। লকডাউন খুলে দিলে অর্থনীতি সচল হবে কিন্তু তার সাথে অনেক প্রাণ ঝড়ে যাবার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।

লকডাউনের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
উন্নত বিশ্বের যেসব দেশ মহামারি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পেরেছে সেসব দেশে এখন জোড় বিতর্ক চলছে কবে এবং কিভাবে অর্থিনীতি সচল করা যায়। কিন্তু সহসাই লকডাউন তুলে সবকিছু খুলে দেয়া সম্ভব না। কারন লকডাউন তুলে নিলে খুব দ্রুতই কোভিড-১৯ আবার ছড়িয়ে পড়বে সেসব দেশে। তাই উন্নত দেশগুলো কোভিড-১৯ টেস্ট করার এর সামর্থ্য অনেক বাড়িয়ে সীমিত আকারে অর্থনীতি সচল করার চেষ্টা করে যাবে এখন পর্যন্ত এটুকুই ধারনা করা সম্ভব। আগামী কয়েক মাসে উন্নত অনেক দেশ সপ্তাহে লক্ষ লক্ষ লোকের টেস্ট করার সামর্থ অর্জন করতে চায় এবং এভাবে আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আলাদা করতে পারবে। অনেক দেশ ভাবছে তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে খুলে দিবে এবং সেই ক্ষেত্রে সকল কর্মীদের তিন দিন পরপর বা প্রতি সপ্তাহে টেস্ট করা সম্ভব কিনা ভেবে দেখছে। কিন্তু এত পরিমাণ টেস্ট করার জন্য বিশ্বের কোন দেশ এখন প্রস্তুত না এবং টেস্ট করার প্রযুক্তি এতটা সহজলভ্য হয়নি এখনো। উন্নত দেশে সরকারী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে হয়তো টেস্ট করার যেই বাধা সেটা অতিক্রম করতে পারবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। টেস্ট করার ব্যবস্থা প্রস্তুত না রেখে সবকিছু খুলে দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই কোন প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও সেটা হবে নিয়ন্ত্রিত, হয়তো নতুন জরুরি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। মহামারির প্রথম দফার ধাক্কা সামলানোর পর দ্বিতীয় দফায় দেশগুলো আরও সচেতন হবে এবং প্রস্তুতি বাড়াবে।

লকডাউন তুলে নিলে সফলতার সম্ভাবনা কম
বাংলাদেশের প্রসঙ্গে যদি বলি তাহলে শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের কোন দেশই হয়তো আগের মত হতে পারবেনা ভেকসিন বা টিকা ছাড়া এটাই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। বাংলাদেশে যেহেতু কোভিড-১৯ কিছুটা পরে ছড়িয়েছে তাই বাংলাদেশের সুযোগ হয়েছে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর এবং এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবার। বেশিরভাগ দেশ লকডাউনের পক্ষে গেলেও কিছু দেশ এর বিকল্প খুঁজছে। বিকল্প উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও লকডাউনে না গিয়ে অর্থনীতি সচল রাখা। উদাহরণ হিসেবে সুইডেনের কথা বলা যায়। কোভিড-১৯ মহামারি প্রতিরোধে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে লকডাউনের বিকল্প পদ্ধতি বেছে নিয়েছে সুইডেন। সুইডেনের সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট ও স্কুল খোলা রেখেছে। কিন্তু জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছে অসুস্থ হলে বাসায় থাকতে ও সম্ভব হলে বাসায় থেকে কাজ করতে। সুইডেনের এই নীতিকে অনেকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছে কারন সুইডেন সবকিছু খোলা রেখে কোভিড-১৯ এর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় এপ্রিলের ২২ তারিখ পর্যন্ত সুইডেনে মৃত্যুহার ১২% এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ডেনমার্কে তা ৫% ও নরওয়েতে ২.৫%। ডেনমার্কে ও নরওয়েতে লকডাউনে চলার কারনে সর্বমোট মৃত্যুর সংখ্যা সুইডেনের চেয়ে ৫-১০ গুন কম। বলে রাখা দরকার এই তিন দেশের জনসংখ্যা যেমন কম তেমনি তারা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও ভাল। যদিও সুইডেনে জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার এখনো ইটালি, স্পেন ও ব্রিটেনের চেয়ে কম। অনেকে সুইডেনের লকডাউনে না যাবার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে কারন সুইডেন আসলে ধীরে ধীরে তার জনগোষ্ঠীর কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা বা হার্ড ইমিউনিটি (herd immunity) তৈরি করে ফেলবে যা আসলে একটি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধান হতে পারে এই ধরনের মহামারির ক্ষেত্রে। যদিও সুইডেন সরকার হার্ড ইমিউনিটির পথ বেছে নেবার কথা অস্বীকার করেছে বরং তারা শিথিল পদ্ধতি বেছে নিয়েছে বলে দাবি জানিয়েছে। তাহলে দেখে নেয়া যাক হার্ড ইমিউনিটি বা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা কি, কিভাবে তা অর্জন করা সম্ভব এবং তাতে ঝুঁকি বা ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু।

টিকা বা প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ রাতারাতি অর্জন করা সম্ভবনা
আমরা কোন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে আমাদের শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা সেই জীবাণুকে ধ্বংস করার জন্য এন্টিবডি তৈরি করে সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। একবার কোন জীবাণু দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে সেই জীবাণুটাকে শ্বেত রক্তকণিকা তার স্মৃতিতে রেখে দেয় এবং পরবর্তিতে একই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত নতুন এন্টিবডি তৈরি করে জীবাণুকে ধ্বংস করতে পারে। এই প্রক্রিয়াতে শ্বেত রক্তকণিকাগুলো আমাদের শরীরে যেসব ভাইরাস প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে তাদের ধ্বংস করে থাকে এবং আমাদের অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করে। কোভিড-১৯ নতুন একটি ভাইরাস তাই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই নতুন ভাইরাসের সাথে পরিচিত না এবং দ্রুত তার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনা। কোন ব্যক্তি একবার কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার শ্বেত রক্তকণিকা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে স্মৃতিতে রেখে দিবে। পরবর্তিতে সেই ব্যক্তির শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস পুনরায় প্রবেশ করলে তার শ্বেত রক্তকণিকাগুলো দ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এর কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে যেমন দক্ষিণ কোরিয়াতে অনেকেই সুস্থ হবার পর দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এইসব ব্যতিক্রমের সংখ্যা খুবি নগণ্য এবং বেশিরভাগ রোগী দ্বিতীয়বার আবার আক্রান্ত হবেননা। এখন যদি এমন হয় কোন দেশের বেশিভাগ মানুষ প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলেছে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হবার মাধ্যমে, তাহলে সেটাকে বলা হবে হার্ড ইমিউনিটি (herd immunity) বা জনগোষ্ঠীর রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা। হার্ড ইমিউনিটি দুইভাবে অর্জন করা সম্ভব - টিকা অথবা প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে। টিকা আসলে ভাইরাসের কোন না কোন অংশ দিয়ে তৈরি কিন্তু সেটা রোগ তৈরি করতে পারেনা। তাই কোভিড-১৯ ভাইরাসের টিকা দিলে আমাদের শ্বেত রক্তকণিকা যেই এন্টিবডি তৈরি করবে সেটা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ধ্বংস করে দিবে। টিকা আসতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগবে অর্থাৎ সামনের বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ ভাইরাসের টিকা এসে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। হিসেব করে দেখলে কার্যকর টিকা আবিষ্কার, সারা বিশ্বের ৮ বিলিয়ন মানুষের জন্য উৎপাদন ও প্রয়োগ আসলে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। অতীতে অন্যান্য টিকা প্রয়োগ করতে দশক লেগে গেছে। কিন্তু এই সময়টা হয়তো কোভিড-১৯ ভাইরাসের ক্ষেত্রে অর্ধেকে নেমে আসবে প্রযুক্তিগত উন্নতি ও সারাবিশ্ব এটাকে অগ্রাধিকার দিবার জন্য। তাই দেখা যাচ্ছে টিকাও দ্রুত কোন সমাধান নিয়ে আসবেনা। বলা বাহুল্য টিকাই হচ্ছে এই মহামারি প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। অনেক উন্নত দেশ তাই অসংখ্য মানুষের কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়মিত টেস্ট করে সনাক্ত করার পর তাদের আলাদা করে, সীমিত লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় কড়াকড়ি আরোপ করে টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাবে। এই সময়ের মধ্যে অনেকেই প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে আক্রান্ত হবার মাধ্যমে। যেসব ব্যক্তি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে তারা যেমনি নিজেরা আক্রান্ত হবেনা তেমনি অন্যকে সংক্রামিতও করবেনা। আসলে এখন পর্যন্ত যত দেশ যত সংখ্যা প্রকাশ করেছে তার চেয়েও অনেক বেশি লোক কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষা করার সীমাবদ্ধতার জন্য শুধুমাত্র গুরুতর অসুস্থ বা যাদের পরিষ্কার উপসর্গ আছে তাদের বেছে বেছে পরীক্ষা করা হয়েছে। আর যাদের কোন উপসর্গ ছিলনা তারা পরীক্ষা বা চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছেন। বৈশ্বিক মৃত্যুহার এখন ৫% এর একটু বেশি। যেহেতু মোট আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানে জানা আক্রান্তের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি তাই মৃত্যুহার আসলে ২% এর কাছাকাছি বলে ধারনা করা হচ্ছে। লকডাউন তুলে নিলে ভাইরাস কতজনকে আক্রান্ত করবে এবং কত মানুষ মারা যাবে তার আগে থেকে সঠিক ধারনা করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সের সম্পাদকীয়তে লকডাউন তুলে দেয়াকে সাঙ্ঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে [১]। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি কোভিড-১৯ এ ১% মানুষও মারা যায় সেটা ১.৬ মিলিয়ন বা ১৬ লাখের বেশি মানুষ। গত শতাব্দীতে ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মহামারিতে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ লোক আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ৫ কোটি মানুষ যার একটি বড় অংশ (৩০-৪০%) ছিল এই ভারতীয় উপমহাদেশে।

লকডাউন প্রত্যাহার করার আগে যা যা ভাবতে হবে
মানুষের জীবনের কস্ট এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে কিন্তু যত সময় যাবে মানুষ তত অর্থনৈতিক কষ্টের মধ্যে পড়বে। সারা বিশ্বে লক্ষলক্ষ মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কৃষিকাজ ব্যহত হতে পারে ও এর জন্য খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক মন্দার সাথে সাথে। লকডাউনের কারনে অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক দেশের জন্য সামাল দেয়া সম্ভব না, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলো চাইলেই তার জনগণকে মাসের পর মাস বসিয়ে খাওয়াতে পারবেনা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিয়ে যেতে পারবেনা। অপরদিকে লকডাউন না থাকলে এই মহামারিতে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হবে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। মানুষ তখন কোভিড-১৯ কিংবা সাধারণ রোগের চিকিৎসা পাবেনা। অর্থনৈতিক হতাশার পাশাপাশি মাহামারি অনিয়ন্ত্রিত হলে গেলে আমরা সবাই কমবেশি পরিবারের সদস্য, নিকট আত্মীয় বা পরিচিত মানুষকে হারাবো। বেশিরভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্যুর শোকে সামিল হবে। পুরো সমাজ একটা অনির্দিস্ট সময়ের জন্য এই শোকের মধ্যে দিয়ে যাবে। মানুষ হারিয়ে ফেলতে পারে সাহস এবং দেখা দিবে হতাশার রোগ, পারিবারিক কলহ ও আত্মহত্যার মত ঘটনা।

লকডাউন তুলে নিলে হয়তো টেকসই প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (হার্ড ইমিউনিটি) গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু হার্ড ইমিউনিটি কতটা কার্যকর হবে কোভিড-১৯ এর জন্য এই বিষয়েও সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করা যাচ্ছেনা। কোভিড-১৯ ভাইরাসকে প্রতিরোধে মানুষের সক্ষমতা যদি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হয় তাহলে প্রতি বছর বা কয়েক বছর পরপর সেটা ফিরে আসবে আর যদি সেটা দীর্ঘ মেয়াদি হয় তাহলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সেটি বিদায় নিবে পৃথিবী থেকে - এমনটাই দেখানো হয়েছে সাম্প্রতিক গবেষণায় [২]। মাহামারি শুরু হবার পর ৫০০ জনের অধিক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লিখিতভাবে সরকারকে জানিয়েছে হার্ড ইমিউনিটির পথ কতটা ভয়ঙ্কর - প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে এই এই পথ বেছে নিলে। সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় [৩] দেখা গেছে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ৬০-৭০% মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হতে হবে। অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে আপনার পরিবারের ১০ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৬-৭ জনকে আক্রান্ত হতে হবে যার মধ্যে ২% এর মারা যাবার সম্ভাবনা থাকবে ও বাকিদের সুস্থ হতে হবে। শুধু আপনার পরিবার না, দেশের প্রতিটি পরিবার এর মধ্যে দিয়ে গেলে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে। এতে কত সময় লাগতে পারে তার কোন ধারনা কারো নেই, সেই সাথে হার্ড ইমিউনিটি কত শক্তিশালী বা সফল হবে সেটাও গ্যারান্টি দিয়ে কেউ বলতে পারবেনা। তাই এই পথটিও কোন সহজ পথ নয়, এই মহামারির আসলে কোন শর্টকাট বা সহজ সমাধান নেই। বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন উপায় বেছে নিবে এবং তাদের সিদ্ধান্তগুলো একেক রকম হবে। বাংলাদেশের সাথে যেমন সুইডেনের তুলনা করা যাবেনা তেমনি কানাডা-নিউজিল্যান্ডের তুলনা করাও বাস্তব সম্মত নয়। সুইডেনের জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব হচ্ছে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৫ জন। তাই তারা চাইলেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারে এবং লকডাউনের শিথিলতা থাকলেও মানুষে মানুষে ছড়ানোর সুযোগ কম। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এক হাজারের বেশি লোক বাস করে। তাই বাংলাদেশের মত জনবহুল কোন দেশের পক্ষে সম্ভব না উন্নত দেশগুলোর হুবুহু নকল করা। আমাদের দেশের সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে আমাদের নিজের সম্পদ ও সামর্থ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই সময় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না যেখানে নিশ্চিত জয় আছে কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভাল সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ সবসময় আছে।

সবার সচেতনতা কোভিড-১৯ ভাইরাস মোকাবেলার সহজ উপায়
ভাইরাস দ্রুত বংশবিস্তার করে বলে তার জেনেটিক উপাদানের দ্রুত পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনের কারনে সামনে ভাইরাসটি আরও অনেক শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে এবং একই সাথে এই সম্ভাবনাও আছে ভাইরাস আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে যাবে। যেহেতু ভাইরাসের ভবিষ্যৎ ভাইরাস নিজেই নির্ধারন করবে তাই ভাইরাস সম্পর্কে আগামী কালের ভবিষ্যৎবাণীও ভুল হতে পারে। তাই আজ নিজে সচেতন থাকা ও অন্যকে সচেতন করা এবং সরকারী নির্দেশনাগুলো মেনে চলাই সবচেয়ে নিরাপদ সিদ্ধান্ত হবে প্রতিটি নাগরিকের। কোভিড-১৯ ভাইরাস মানুষের শরীরের বাইরে বাঁচতে পারেনা। তাই এটা বেঁচে থাকার জন্য একজন থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়ায়। লকডাউন আরোপ করলে এই ভাইরাসের মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর সুযোগ কমে যায়। আশা করা হয় যদি নতুন কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে তাহলে ভাইরাসটি কোন নির্দিস্ট্য এলাকা থেকে বিদায় নিবে বা তার প্রকোপ কমে যাবে। সাধারণত কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কোন ব্যক্তি ১৪ দিনের মধ্যেই শরীর থেকে ভাইরাসটিকে পরিষ্কার করে ফেলতে পারে তার প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে, এর ব্যতিক্রম হলে মৃত্যু হয়। তাই কোন এলাকার সকল মানুষ একসাথে লকডাউনে গেলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু একেকজন যদি একেক সময় আক্রান্ত হয় তাহলে লকডাউন কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস এমনকি বছর পর্যন্ত চলতে পারে। লকডাউনের সময় কোন জনগোষ্ঠীর এক অংশ কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন আবার অন্য অংশ অসচেতন থাকলে লকডাউনের সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আবার সবাই একসাথে লকডাউন মেনে চললে যে খুব দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিন ইত্যাদি। এইসব দেশ লকডাউনের মাধ্যমে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসলেও সহসাই লকডাউন পুরোপুরি তুলে দিতে পারছে না। কারন লকডাউন তুলে দিলে আবার ভাইরাসের সংক্রামণ আগের অবস্থায় চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এইসব দেশ কোভিড-১৯ টেস্টিং ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে ধীরে ধীরে অর্থনীতি সচল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে, কোভিড-১৯ ভাইরাসকে সচেতনতা দিয়ে দূরে রাখা সম্ভব এবং বাঁচানো সম্ভব হাজার হাজার প্রাণ। সবার সাধ্যমত চেষ্টা করে গেলে আমরা কমাতে পারবো আপনজনের মৃত্যু এবং চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে পারবো এই প্রাণঘাতী ভাইরাসকে।

বিদ্রঃ সকল তথ্য ২৩ এপ্রিল ২০২০ এর আগে নেয়া হয়েছে।

তথ্যসূত্রঃ
১. Kai Kupferschmidt, Science, Apr. 14, 2020: DOI:10.1126/science.abc2507.
২. Kissler SM et al, Science, 14 Apr 2020: DOI: 10.1126/science.abb5793.
৩. Kwok KO et a., Journal of Infection, Mar 21 2020: DOI: 10.1016/j.jinf.2020.03.027.

রাশেদুল ইসলাম (রনি)


মন্তব্য

নৈ ছৈ এর ছবি

সচলে এমন একটা লেখার অপেক্ষায় ছিলাম। ধন্যবাদ।

সুজন চৌধুরী এর ছবি

ধন‌্যবাদ রাশেদুল ইসলাম (রনি), বিষয়টা বিস্তারিত লিখবার জন্য।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

চমৎকার লেখা। আরো লিখুন।

সামান্য তথ্য শুধরে দেই, ভাইরাস এবং রোগের নাম মিলে গেছে। ভাইরাসটির নাম সার্স করোনাভাইরাস ২ (SARS CoV-2), রোগের নাম করোনাভাইরাস ডিজিজ-১৯ (COVID-19)।

আরেকটা প্রসঙ্গ, আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশনের হার সাধারণত বেশি। যেমনটা আপনি বলেছেন। কিন্তু মিউটেশনের কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়া ভাইরাস টিকে থাকার বা সেটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবণা কম। বরং অপেক্ষাকৃত বেশি সংক্রামক স্ট্রেইন টিকে থাকবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে এমন হবে।

অবশ্য, ভাইরাসটি যে দুর্বল হয়ে যেতে পারেনা তা সত্যি নয়। ভেবে দেখলাম, কোন অধিক সংক্রামক অথচ (রোগ সৃষ্টিতে) কম শক্তিশালী ভাইরাসের স্ট্রেইন যদি ছড়িয়ে পড়ে এবং কাছাকাছি সকল স্ট্রেইন থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দেয়, তাহলে সেটি বরং বর্তমানের বেশি ক্ষতিকর ভাইরাসটি থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে দেবে, একটি প্রাকৃতিক টিকার মতো।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার কমেন্টের জন্য। লিখা জমার দিবার সময় আমি জানতাম ভাষাগত কিছু হেরফের থাকতে পারে আমার লিখায় কারন সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ করে লিখা ও বাংলায় লিখার কারনে। অবশ্যই ভবিষ্যতে আরও সচেতন থাকবো এইসব ব্যাপারে। আপনার তথ্যকে সামান্য শুধরে দেই।

১। "ভাইরাস এবং রোগের নাম মিলে গেছে।" আমি আসলে কোথাও ভাইরাস এবং রোগের নাম গুলিয়ে ফেলেনি (আপনার চোখে পড়লে quote করবেন দয়াকরে)। একটু পরিষ্কার করে বলি। "কোভিড-১৯" হচ্ছে রোগের নাম। আর "কোভিড-১৯ ভাইরাস" হচ্ছে যেই ভাইরাসের আক্রমণে কোভিড-১৯ রোগ হয়। আমি অবগত ভাইরাসটির নাম SARS CoV-2। কোভিড-১৯ ভাইরাস বলা সহজ কিন্তু ভুল না। এমনকি WHO অনেক জায়গায় "কোভিড-১৯ ভাইরাস" শব্দটি ব্যবহার করেছে। দেখতে পারেন এখানে- "WHO and UNICEF to help fund global efforts to contain the COVID-19 virus". Link: https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/events-as-they-happen

২। আপনি বলেছেন- "কিন্তু মিউটেশনের কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়া ভাইরাস টিকে থাকার বা সেটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবণা কম। বরং অপেক্ষাকৃত বেশি সংক্রামক স্ট্রেইন টিকে থাকবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে এমন হবে।"

আপনার এমন interprepation আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, একটু পরিষ্কার করলে ভাল হয়। কারন আমি বলেছি - "এই (জেনেটিক উপাদানের) পরিবর্তনের কারনে সামনে ভাইরাসটি আরও অনেক শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে এবং একই সাথে এই সম্ভাবনাও আছে ভাইরাস আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে যাবে।" আমার লিখা লাইনটি তথ্যগত দিক থেকে সঠিক, আমি শুধু সম্ভাবনার দিকটা তুলে ধরেছি। মিউটেশন একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া সেটি সবসময় ভাইরাসকে টিকে থাকার শক্তি দিবে এমন না, ভাইরাসকে বিলুপ্তও করে দিতে পারে লিথাল মিউটেশনের মাধ্যমে। "Lethal mutagenesis is a form of extinction. Most basically, it requires that deleterious mutations are happening often enough that the population cannot maintain itself, but it is otherwise no different from any other extinction process in which fitness is not great enough for one generation of individuals to fully replace themselves in the next." সূত্রঃ DOI: 10.1128/JVI.01624-06

ধন্যবাদ!
রাশেদুল ইসলাম (রনি)
https://sites.google.com/view/rashedul-islam/

সুমন চৌধুরী এর ছবি

খুবই ভালো লাগলো। জরুরি পোস্ট।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।