হ্রদ লেমানের মুক্তা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২০/০৬/২০২০ - ৬:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেবানিজ রেস্তোরাঁটা থেকে বেরিয়ে হ্রদ লেমানের তীরের দিকে হাঁটছি আমরা। হাঁটছি আর দেখছি চনচন করা রোদে জৌলুশ ছড়াচ্ছে জেনিভা শহর। তীরে পৌঁছে জায়গা খুঁজে নিয়ে বসলাম। জিরিয়ে নেব।

শুকনো পাতার ঝিরঝির শব্দের মতো শব্দ পাচ্ছি লেমানের জলে আর বাতাসে। তবে শহরে বেশ শোরগোল। ঝকঝকে দিন। তাই মনেহয় এতো ভিড়। ভাবলাম, এর থেকে বেরিয়ে বরং লেমানের জলে ফেরি ভ্রমনটাই করি।

ভাবছি কোথাও বেড়িয়ে আসব। এই ধরো বন বাদাড়ে। ঘরদোর অবিরত বেখেয়ালে। এই গ্রীষ্মে ঘুরতে যাব। সাদাবুক চিল উড়বে, আকাশে মেঘ সাথী হবে। কোনো এক হ্রদের দেশে আমরা তখন। দুদণ্ড গল্প করব, চা খাব। তারপর একসময়, হয়তো বিকেল। রোদটুকু আড়ি নেবে। মেঘগুলো টুপ করে বৃষ্টি হতেও পারে হ্রদের বুকে। এমন একটা হ্রদ হলো হ্রদ লেমান (Lake Geneva)।

লেমানের সবুজাভ নীল জলের দুপাড়ে মুখোমুখি তাকিয়ে আছে সুইটজারল্যান্ড আর ফ্রান্স।

বিশ্রাম শেষে টিকেট কেটে নিয়ে আমরা ফেরিঘাটের দিকে এগোলাম।

ফেরি না বলে এটাকে প্রমোদতরী বলাই ভালো। তরীখানা প্রথমে নাইয়োন (Nyon) এ থামবে, তারপর যাবে ইভোয়ার (Yvoir)। তারপর এগিয়ে যাবে আরো সামনে। আমরা ইভোয়ার এ নামব। আকাশের অবস্থা দেখে একবার মনে হলো বৃষ্টি হবে। আবার একটু পরই উঠলো ঝিকিমিকে রোদ। খোলা ডেকে দমকা বাতাস এসে লাগছে।

এক ঘণ্টা পর তীরে একটু একটু করে উদ্ভাসিত হতে দেখলাম আল্পসের পাদদেশের ফরাসী গ্রাম ইভোয়ার। ফেরিতে থাকতেই তীরে ভেড়ানো ইয়টের সারি আর মাছ ধরার নৌকাগুলোর পেছনে দাঁড়ানো দূর্গটাকে (শ্যাত্যো, Château d'Yvoire) দূর থেকে দেখতে দেখতে আসছিলাম। কাছাকাছি আসতেই দেখলাম স্ফটিক স্বচ্ছ সবুজাভ নীল জলের ধারে দাঁড়িয়ে আছে স্থির, একলা, পুরাতন দুর্গটা।

নামতে হবে। এই ফেরি চলে যাবে আরো সামনের পয়েন্টে। ফেরার ফেরি আসবে দু ঘন্টা পর।

আমরা মনোহর ইভোয়ারের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ফেরি থেকে নেমে এলাম এক এক করে।

ঘাটটা থেকে কাঠের সেতুর ধরে এগিয়ে গেলাম। চত্বরের মত একটা জায়গা। সেখান থেকে বাম দিকে একটা রাস্তা একটু বাঁক নিয়ে খাড়া হয়ে উঠে গেছে গ্রামের দিকে। আস্তে আস্তে ওদিকে হাঁটা দিলাম আমরা।

চড়াই উতরাই পথের দুপাশে বর্নিল ফুলের সারি। মধ্যযুগীয় বাড়িগুলো দেখলে কেমন যেন মনে হয়। মনে হয়, এখনি কোনো বিস্মৃত পুঁটলি খুলে বেরিয়ে আসবে সময়।

একটা অথবা অনেক ফুলের মিলমিশ গন্ধ এসে নাকে লাগছে খানিক পরপর। প্রিয় শণের গন্ধের মত শান্তিময়। আবার মনে হলো লতা-পাতা-ফুলের দল থেকে ঝুমঝুমি শব্দ আসছে, সে শব্দ বিবর্ণ অথচ মধুর। পাথরের দেয়ালের পাড় ধরে চাষ করা ফুলে খুঁজে পেলাম সহসা আবিষ্কৃত কিছু রং যাদের আগে কখনো দেখিনি!

মধ্যযুগের দালান আর বাঁকা ফুল কাটা রাস্তাগুলো রূপকথার মত।

গাছপালায় ঠাঁসা সব সরু সরু রাস্তা, পাথরের দেয়াল, কাঠের ঝুল বারান্দা। একটু পরপর স্যুভেনিরের দোকান। জাদু জাদু ব্যাপার। উজ্জ্বল ফুলের থোকা থোকা গাছ সিঁড়িগুলোতে, ঝুলবারান্দায়, জানালায় আর যেখানে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা থাকার কথা ছিল, সেখানেও!

কোনো গ্রাম কখনো এত মিষ্টি হয়! একবার দেখেছিলাম উইন্ডারমিয়ারের মোহিনী গ্রাম গ্রাসমিয়ার। সে কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে! ইভোয়ারের কথাও! পরে অবশ্য জেনেছি দক্ষিণ-পূর্ব ফ্রান্সের এই মনোরম মধ্যযুগীয় গ্রাম ইভোয়ার কে নাকি বলা হয় ফ্রান্সের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম!

খানিক্ষন সবাই ছবি টবি তুললাম। ছবি তুললেই হতাশ হয়ে যাই। ক্যামেরায় কোন সৌন্দর্যই ধরা পড়েনা। প্রজ্ঞা আমাদের ছবি তোলা দেখলে বিরক্ত হয়। সবাই এতো হামলে পড়ে নিজের ছবির তোলে, এই ব্যাপারটা ওর কাছে অমূলক মনে হয়। ও আশে পাশে থাকলে তাই আমরা একটু তাড়াতাড়ি ছবির কাজটা সেরে ফেলি।

খাড়া, পাক খাওয়া রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছি। এ গ্রামের উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে পাথরের দালানগুলো আর আছে বহু পুরাতন একটা গীর্জা।

প্রতিটা বাড়ি, রেস্তোরাঁ সব ফুলে ফুলে মায়াময় হয়ে সেজে গুজে আছে।

বাতাসটা ভীষণ মজা। একটু পর পর বাতাস আসে। একটা নোনা গন্ধ সে বাতাসে, আবার ফুলেরও। আমি হাঁটতে হাঁটতে দূর্গ টার কাছে এসে পড়লাম। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। দূর্গকে ঘিরে বাস করছে উঁচু উঁচু আবার কিছু থোকা থোকা গাঢ় আর হালকা সবুজ বৃক্ষরাজি। ওদের কেউ প্রাচীন, কেউ কচি, কেউ কেউ নবমুকুলিত। ভর দুপুরের রোদে পান্নার মত জ্বলজ্বল করতে করতে এই গাছগুলো বাতাসে এ ওর গায়ে হেলে দুলে পড়ছে। আর এই সব কেচ্ছা কাহিনীর ছায়া ভাসছে টলটলে জলে।

পানির খোঁজ করতে করতে একটা জলের কল পেলাম দূর্গের পাশের দেয়ালে। বোতলটা ভরিয়ে নিলাম। সুইটজারল্যান্ডেও জায়গায় জায়গায় খাবার পানির ঝরনা আর নয়তো কল দেখেছি।

আমার দলের লোকজন দেখলাম পেছনে একটা দোকানের সামনে আটকে আছে। রোদে বেশ তাপ। ঘোরাঘুরিতে সবাই কিছুটা ক্লান্ত। বাচ্চা, বড় সবার হাতে আইসক্রিম।

আরো কিছুক্ষণ পর...

আমাদের ফেরি চলে আসবে। বাচ্চারা ঘাট মত জায়গাটায় অল্প জলে খেলছিল। ওদের আমরা গুছিয়ে নিলাম।

ভোঁতা একটা হর্ন দিতে দিতে আসছে ফেরিটা।

ফেরার বেলা আমরা নেমে যাব নাইওন এ। ওখান থেকে জুরিখের ট্রেন ধরব।

ইঞ্জিন রূমের পাশ দিয়ে এসে একটাই বড় ক্যাবিন। যাত্রী বলতে আমাদের দলটা আর চার পাঁচ জন। আসার সময়ই বেশি লোক ছিল মনে হয়। জিনিসপত্র রেখে সবাই মোটামুটি ফেরির ডেকে এসে বসলাম। এখন রোদের তেজ অনেকটা কমে গেছে।

দিগন্তের ত্রিপলে সবুজ পাহাড়, লেমানের তীরে গাঢ় ঘন গাছের সারি, রঙ্গিন রোদ সব পাশ কেটে আমরা ফিরে যাচ্ছি। চারদিকের সবুজাভ জল কেটে তরীখানা এখন দ্রুত এগিয়ে চলছে। আর পেছনে, বিস্তর সৌন্দর্যকে সাথে করে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে, “হ্রদ লেমানের মুক্তা”, ইভোয়ার।

জে এফ নুশান

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

রকিব এর ছবি

লেমান (উচ্চারণ সম্ভবত লেমঁ) হ্রদ নিয়ে আপনার লেখাটা পড়ে ভাল লাগল। ইংরেজিতে আগে 'লেক' লিখে পরে তার নাম লেখা হয়। বাংলায় আগে নাম, পরে 'হ্রদ' বা 'ঝিল' লেখা হয় (যেমন আমরা হ্রদ কাপ্তাই বলি না, কাপ্তাই হ্রদ বলি)।

সচলায়তনে ভ্রমণ নিয়ে অনেক লেখা আসে। বেশিরভাগ লেখার শেষে একগুচ্ছ ছবি পরপর থাকে, যেগুলো দেখে অনেক সময় বোঝার উপায় থাকে না, ছবির সাথে লেখার যোগ কোথায়। যদি কষ্ট করে ছবিগুলো লেখার মাঝে শিরোনাম বা সংক্ষিপ্ত বর্ণনাসহ দিতেন, তাহলে ভাল হত। হয়ত আপনাকে দেখে অন্য যারা ভ্রমণ নিয়ে লেখেন, তারাও এ ধারা অনুসরণ করতে উৎসাহ পাবেন।

জে এফ নুশান এর ছবি

রকিব, আপনার মন্তব্য পড়ে ভালো লাগল। হ্যাঁ, ফরাসী উচ্চারণে লেমঁ/লিমঁ ই হবে। কাপ্তাই হ্রদ/হ্রদ কাপ্তাই এর উদাহরণটা চমৎকার, এভাবে কখনও ভাবিইনি! অনেক ধন্যবাদ।

তারেক অণু এর ছবি

ভালো লাগল, ঘুরেই এলাম আপনার সাথে।

"একটা অথবা অনেক ফুলের মিলমিশ গন্ধ এসে নাকে লাগছে খানিক পরপর। প্রিয় শণের গন্ধের মত শান্তিময়। আবার মনে হলো লতা-পাতা-ফুলের দল থেকে ঝুমঝুমি শব্দ আসছে, সে শব্দ বিবর্ণ অথচ মধুর। পাথরের দেয়ালের পাড় ধরে চাষ করা ফুলে খুঁজে পেলাম সহসা আবিষ্কৃত কিছু রং যাদের আগে কখনো দেখিনি!"- চমৎকার হয়েছে কিছু কিছু জায়গার বর্ণনা

জে এফ নুশান এর ছবি

তারেক অণু, আপনার মন্তব্যটি ভালো লাগলো। ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা কতকাল চলবে কে জানে। জীবনপাত্র থেকে গতবছরের একদিনের কিছু অনুভুতিকে এখানে শব্দাক্ষর দান করবার ছোট্ট চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ আপনাকে।

এক লহমা এর ছবি

বাঃ চমৎকার ঘুরে এলাম।
কতকাল কোথাও যাই না। কতদিনের পরিকল্পনা ছিল এই গ্রীষ্মে ইয়োরোপ যাব, হিমু না ডাকতেই ওর বাড়ির দরজায় গিয়ে টোকা দিয়ে আসব। কোথায় কি, আর বোধহয় হবে না কোনদিন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

জে এফ নুশান এর ছবি

এক লহমা, হবে, নিশ্চয়ই হবে।
পড়ার এবং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

কর্ণজয় এর ছবি

মনে হলো ঘুরে এসে
আমিই লিখছি
এতটাই দেখা গেল।

জে এফ নুশান এর ছবি

পড়ার ও এতো সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, কর্ণজয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আচ্ছা, লেমান হ্রদ থেকেই কি loch lomond? মানে ক্যাপ্টেন হ্যাডক যেটি খেতেন? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জে এফ নুশান এর ছবি

সাক্ষী সত্যানন্দ, হ্যাঁ ওই জিনিস পরবর্তীতে বাস্তবেও পাওয়া যায় তবে স্কটল্যান্ডের লখ লোমেন্ডের (লোমেন্ড হ্রদের) নামে নাম। আপনার প্রশ্নের কারনে জানা হলো। 

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আরো ঘুরে বেড়ান, আর পোস্টান! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।