তক্ষক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৬/০৭/২০২০ - ১২:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তক্ষকটা প্রত্যেক বিকেলে আসে। পাঁচটা কিংবা তার আশেপাশে। আগেও হয়তো আসতো। কিন্তু খেয়াল করার সময় পাইনি। অতিমারীর কারণে, এই তিন মাসের ক্রমপ্রসারমান ঘরবন্দী জীবন। আশেপাশের আসবাব, দেয়ালের রং, পাখার গতি, সবকিছু খুব আপন । সেই সাথে তক্ষক। সময়ের বুদবুদে ডুবে সময় হারিয়ে ফেলা আমাকে, প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয় বিকেল পাঁচটা বেজে গেছে। এমন না যে, তাকে ভয় লাগে না আমার। প্রথম প্রথম গা গুলিয়ে আসতো তাকাতে। কী বিশ্রী একটা সরীসৃপ। ভয় পেতাম। সে ও আমাকে। তারপর ও আসতো সে। বিকেলে ঘুরোঘুরি শুরু করতো আর ডাকতো। প্রজননের ডাক। জিন ছড়িয়ে দেয়ার ডাক। তার ডাকটা শুরু হতো একটা, দুটো করে। তীব্র হয়ে উঠতো ক্রমশ। শেষ হতে হতে আস্তে আস্তে ধীর হয়ে যেতো।আমার ও কী ডাকতে ইচ্ছে হয়? এই যে আড়ম্বর, গল্প, কাব্য, গান, নৃত্য, ঝকঝকে গাড়ি, মুরগির মাংসে কামড় সবকিছু কী ডাক? সবকিছুই কী পরত পরানো ক্ষিদে? সময়ের ক্ষিদে?
রাত যতো বাড়তো, পুরো দোতলা, যেন তক্ষকটার রাজত্ব। নির্ভয়ে নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াতো। আমাকে দেখলে মুখ লুকোয়। আমি মুখ লুকিয়ে রাখি। কেউ কাওকে বুঝে উঠতে পারি না। সে তার সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে, কীনা কে জানে। ডাকে। বোধহয় পায়নি। এক সময় একে অপরের অস্তিত্বে অভ্যস্ত হয়ে পরি আমরা। সম্মানজনক একটা সমীহ অর্জিত হয় পরস্পরের প্রতি। বিব্রত হওয়া থামেনা তবু। একে অপরকে দেখে হকচকিয়ে উঠি মাঝেমাঝেই। নকশার ইতিহাস। নির্বাচনের ইতিহাসে আত্বীয়তা দূরে সরে গেছে। সেই কারণে? জানি না। অতীতে অনিশ্চয়তা আছে, ভবিষ্যতেও। বর্তমানটাই নিশ্চিত শুধু।
আমি আমার ছাদে, এক রুম থেকে অন্যরুমে বারবার হাঁটি। কখন বের হতে পারবো জানি না। বের হলেও ফিরে আসতে পারবো কীনা জানিনা। অনেকেই বের হচ্ছে। আর ফিরে আসছেনা। একেবারে যে বের হচ্ছি না, তা নয়। প্রতিদিন ঘরে বাইরে হচ্ছে। চারকোনা বাকশে মানুষের জীবন দেখছি। মৃত্যু দেখছি। বিবাহ দেখি। বিচ্ছেদ ও দেখি। মৃত্যুর আধিপত্য বেশি আপাতত। নীল দেয়াল জুড়ে মৃত্যু আর মৃত্যু। মৃতদের নিয়ে বেশ ভালো বানিজ্য চলছে। পিঠ চাপড়ে দেয়ার। কখন শুক্রবার যায়। কখন শনিবার। রবি। সোম। বুধ। বার গুলোর যে আলাদা মানে আছে। রং আছে সেটাই ভুলে গিয়েছি। নাকি এটাই স্বাভাবিক ? কৃত্তিম ভাবে আমরাই রং চড়িয়ে দিয়েছি এদের গায়ে। জানিনা। তক্ষক টা রোজ বিকেলে নিয়ম করব আসে। আর সময়ের জন্ম দেয়। না হলে, দেহ ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই সময় দেয় না বলে। তক্ষকটার আদি নিবাস কোথায় ছিলো কে জানে। সে হঠাত এভাবে সাহসীই বা হয়ে উঠলো কেন? সেটা অবশ্য বুঝতে পারি কিছুটা। তাদের নিবাস তো এখন আমাদের উপনিবেশ। আমরা তাদের দেশকে আমাদের উপনিবেশ বানিয়ে নিয়েছি। তাদেরকে করেছি ঘর ছাড়া। আর এখন আমাদের দেশে ওরা ক্ষিদে নিয়ে আসে। ওরা বেচে থাকতে আসে। আমরা ভয় পেয়ে যাই। পিটিয়ে মারি ওদের। আমার জায়গায় আমার প্রজাতির অন্য কেউ হলে, এতোক্ষণে আরেকটা বিষয় নিয়ে যজ্ঞ বাধিয়ে দিতো। লোভের যজ্ঞ। কিছু সময় আগে, একটা গুজব রটিয়ে দেয়া হয়েছিলো, একটা ভালো ওজনের তক্ষক নাকি অনেক দামে বিক্রি হয়। উপকথা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তক্ষক ভক্ষণ করলে পুরুষত্ব আর জীবনীশক্তি বাড়ে। সময়ের সাথে হারিয়ে যাবার ভয়, নাকি জগতের আনন্দযজ্ঞে প্রভাবশালী হয়ে শামিল হতে না পারার ভয়? নিশ্চিত বলা যায় না । কিন্তু কিছু মানুষের নিজের পুরুষত্ব নিয়ে ভীষণ সন্দেহ হয়। কিছুদিন পর এক একটা প্রানীকে নির্ধারণ করা হয় পুরুষত্ব ফিরে পেতে। বাদুড় আর অন্যান্য প্রাণীরা এবার সহজে মেনে নেয় নি। অদৃশ্য মিত্রের সাথে ভাই পাতিয়ে আমাদের প্রজাতিকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে খুব করে। যাই হোক আমার বর্তমান প্রতিবেশী তক্ষকের কথা বলছিলাম। তক্ষকের আপেক্ষিক মূল্য বেড়ে গেছে।
ব্যাস আর কী। আমেরিকার গোল্ড রাশের মতন তক্ষক রাশ শুরু হয়ে গেলো। সবাই তক্ষক ধরা আর পোষার জন্য পাগল হয়ে গেলো। কেউ কেউ তক্ষক সংরক্ষক সেজে, তাদের জামাই আদরে পুশতে লাগলো। ভালো ওজন হলে, ফার্মের মুরগীর মতন বিক্রি করা হবে। সব রাশের মতন, এই রাশের উত্তেজনাও একসময় থিতিয়ে এলো। কিন্তু ভয় আর লোভ রয়ে গেছে। আমার প্রতিবেশি এই তক্ষকের কথা শুনলেও, অনেক সুযোগ সন্ধানী ছুটে আসবে। আমি কাওকে বলি না। কতদিন গোপন রাখতে পারবো জানি না। তক্ষক নিজেকে গোপন রাখতে পারে না। নিজেদের টিকিয়ে রাখতেই চিতকার করে অস্তিত্বের জানান দিতে হয় তাদের। আমরা অবশ্য অন্য ধাঁচের প্রজাতি। আমরা অস্তিত্বের জন্য চিতকার করি না। চিতকারের জন্যেই অস্তিত্ব আমাদের। সেই চিতকার মাঝেমধ্যে খুব তীব্র হয়ে ওঠে। খেতের আইল। উঠোনের ঝগড়া। পিঠের ভাগাভাগি নিয়ে। আমাদের চিতকারের জন্য প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কোন বালাই নেই। তারপর বর্তমানের মতন সময় আসে। নিজের চিতকার গিলে ফেলতে হয় নিজেকে। ঘরের বারান্দা, ছাদে চক্রাকারে ঘুরতে হয়। অনেকে অবশ্য তারপরও চিতকার করতে থাকে। নকশার ভেতর চিতকার আছে। তক্ষকটা গায়ের রং যেভাবে বদলে ফেলে মাঝেমধ্যে। আমরা ভয় পেয়ে যাই আরো। ওকে আমাদের শত্রু মনে হয়। আমরা জানি না, আমাদের ভয় পেয়েই রং বদলায় ও। ভয় দেখাতে নয়। আমাদের সহানুভূতি বোধ করার কথা। আমাদের রং তো কম নয়। লাল, নীল, কালো, সাদা। অবশ্য ভয় পেয়ে রং বদলায় না আমাদের। ছোট বেলায় ভয় দেখাতে বলা হতো, এই রং বদলায় নাকি আমাদের রক্ত চুষে খেতে। সেই রক্ত চোষা বন্ধ করতে ওদের ঢিল মেরে রক্তাক্ত করা হতো। ওরা কী ভাবতো কে জানে। বড় হয়ে আরো অনেক রক্তচোষা দেখেছি। কিন্তু ঢিল মারতে পারিনি। কী অদ্ভুত এই প্রাণীগুলো। আমার নিজেকে মহান মনে হয়। আমি জানি একটা তক্ষক আমার দেওয়ালে হাটে। আমি কিছু বলিনি কাওকে তবু। এখানে আসলে আমি স্বার্থহীন নই। তক্ষকটা আমার সময়। সারাদিন গ্রহ নক্ষত্রের মতন এ ঘর ও ঘর পাক খেতে খেতে, সময় মাত্রা ভুলে গেছি আমি। সময় কী, এর লৌকিক অবয়ব আমি আরো আগে ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু শুক্র আর শনিবার মনে পরতো। তার আগে সকাল থেকে সন্ধ্যা। কাগজ আর কাগজের ভীড়ে কখন রাত নেমে যেতো, টের পেতাম শুধু ঘুমাতে যাওয়ার সময়। বাকীটা কেটে যেতো চতুস্কোন একটা দেওয়ালের মধ্যে আটকে যাওয়া বিশ্বের ভেতর। সময়ের প্রাকৃতিক কোন অস্তিত্ব ছিলো না আমার কাছে। সময় মানে শুধু, দিনের শেষ, মাসের শেষ। আর কড়কড়ে কিছু নোট। এর বাইরে সময় বলতে যে একটা বিষয় আছে, প্রকৃতিতে, সেটা এই তক্ষকটাই মনে করিয়ে দিলো। আইনস্টাইন অবশ্য ভেবেছিলেন অনেক সময় নিয়ে। স্থান কাল সব এক হয়ে গেছে তারপর। তাতে কী আসে যায়। সেই সময় মৃত। তার গন্ধ, শব্দ, দৃশ্য কেউ পায়না। তক্ষকটা যেভাবে পায়। চক্রাকারে পায়। আর আমার ভেতর ছড়িয়ে দেয়।
ঘড়িটা বেশিদিন টিকিয়ে রাখা গেলো না। আমার মা, দোতলায় আসেন প্রতিদিন সন্ধ্যায়। একদিন দেওয়ালে ঝুলে থাকতে দেখলেন তাকে। চিতকার করে উঠলেন ভয়ে। সবাই ছুটে এলো। চোখ চকচক করে উঠলো কয়েকজনের। মা কে আমি দোষ দিতে পারি না। মাকড়সা দেখলে আমি ভয় পেয়ে যাই। উচিত অনুচিত মনে থাকেনা। নকশার ভুল। আমরা কেউ কারো ভাষা জানিনা। প্রত্যোকের ভিন্ন ভিন্ন গ্রহে অনুপ্রবেশকারী। এভেঞ্জাররা একত্রিত হয়।
তক্ষকটাকে ধরার চেষ্টা চলে।
মানুষ ধরপাকড় এবং শিকারে বিফল হয় নি কোনদিন।
আমি আবার একা হয়ে যাই। দোতলার ঘরে বাইরে পায়চারি করি। একটু পর পর জাদুর গালিচায় করে আর স্ফটিক পাথরের স্বচ্ছ গোলকে ডুব দেই। পৃথিবীটাকে দেখি। সুখ শোক, সব মিলিয়ে একাকার। নিরাপদ দূরত্বে। অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে। মুখোশবাদী, মুখোশ বিবাদী রেহাই পাচ্ছেনা কেউ।
আমি সময় গুণতে থাকি। যত দ্রুত গোনা যায়, তত দ্রুত এই অসহ্য সময় শেষ হয়ে যেতে পারে।
শুনতে পাই না। গন্ধ পাইনা সময়ের।
বিকেলের দিকে মনটা খুব ছটফট করে। সময়টা যদি একটু শুনতে পাই। একটু গন্ধ পাই যদি। তক্ষকটা একবার ডেকে উঠে যদি।
তক্ষকটা ডাকে না। মূল্যবান বলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো সংগ্রাহকেরা।
সবার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে,
মরে গেছে সময় নিয়ে।


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

লেখকের নাম ছাড়া পোস্ট প্রকাশিত না হওয়ার কথা জানতাম।

যাই হোক ভবিষ্যতে দয়া করে পোস্টের সাথে নিজের নামটা স্পষ্ট করে লিখবেন।

গল্প ভালো হয়েছে।

ধন্যবাদ।

এক লহমা এর ছবি

ভালো লেগেছে। আরো আসুক।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।