চিত্রকর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৯/০১/২০২১ - ৬:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটি ছবি আঁকার অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে ছবির মূল বিষয়বস্তকে দীর্ঘ সময় কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘ দিন ধরে দেখাকে ইন্দ্রজিৎ ছবি আঁকার খুব গুরুত্তপূর্ণ একটি ধাপ বলে গণ্য করে, যা কিনা না হলেই নয়। ওর মতে ছবির বিষয়বস্তু যদি জটিল কিছু হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে তা সম্পর্কে পড়াশোনা করা এবং ভালো জানাশোনা থাকাটাও একজন চিত্রশিল্পীর জন্যে অবশ্য কর্তব্য। যদিও বর্তমানে এসব ব্যাপার নিয়ে কেউ আর খুব একটা চিন্তিত নয়। একটি বড়সড় কাগজের উপর ইচ্ছেমত কিছু রঙ ছিটিয়ে দিয়েই আজকাল আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই চিত্রশিল্পী হয়ে যাচ্ছে।

এসব ব্যাপারে বেশ খুঁতখুঁতে হওয়ায় বন্ধুমহলে ইন্দ্রজিৎ একজন বদ্ধ পাগল হিসেবে পরিচিত, এতে অবশ্য ওর খুব একটা আপত্তি নেই। কারণ নিয়মিত অকারণে মানুষের হাসি ঠাট্টার পাত্র হওয়া, প্রতিনিয়ত বুলিং এর শিকার হওয়া এগুলো ওর আজন্ম সঙ্গী।

তবে সময় পাল্টেছে, ইন্দ্রজিৎ কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার আগে মানুষ এখন দুবার ভেবে নেয়। সম্প্রতি একটি তথাকথিত নামকরা আর্ট ফেস্টিভ্যালে ওর একটি ছবি সেরা মনোনীত হয়েছে বিধায় শিল্পী মহলে ইন্দ্রজিৎ এর এখন বেশ নাম ডাক। যদিও পুরস্কারটি জেতার পর আনন্দের পরিবর্তে ও বেশ বিরক্তি বোধ করেছিল। ছবিটি ছিল রীতিমত অযত্ন অবহেলা করে আঁকা এবং ওর মতে ওর আঁকা সব ছবির মাঝে খুব সহজেই নিকৃষ্ট তকমা পাবার যোগ্য, আর ওটাই কিনা সেরা ছবির পুরস্কার পেল। একালের শিল্পী সমাজের রুচির উপর ইন্দ্রজিৎ এর যা আস্থা ছিল তা একেবারেই উঠে গেল আর বারবারই সত্যজিৎ রায়ের পুরস্কার গল্পটি ঘুরেফিরে মাথায় আসতে লাগল।

তবে হ্যাঁ, ছবিটার বিশেষত্ত ছিল ওটাতে ব্যবহার করা লাল রঙটি। ওটা সবার খুব চোখে লেগেছে, ইন্দ্রজিৎ এর নিজেরও ভীষণ পছন্দের। সবার একটাই প্রশ্ন ইন্দ্রজিৎ কোথায় এমন চোখে লেগে থাকার মত লাল রঙ পেল, বা কোন কোন রঙের মিশ্রণে সে এটা বানিয়েছে। ও সবিনয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতেও এড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। এই রঙ ওর অনেক দিনের গভীর চিন্তা আর সে চিন্তার অতিশয় বিপজ্জনক বাস্তবায়নের ফল।

এমন এক বিশেষ লাল রঙ তৈরি করার চিন্তার উৎস ইন্দ্রজিৎ এর একটি সূর্যাস্তের ছবি আঁকার একান্ত ইচ্ছায়, ইন্দ্রজিৎ হাজার রঙে রঙিন এমন এক জীবন্ত সূর্যাস্ত ওর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চায় যা হবে রীতিমত অদ্বিতীয়, মাস্টারপিস। ওটাই হবে ওর শিল্পী সত্তার সেরা অর্জন। ওর স্বপ্নের ছবি।

কল্পনাতে ইন্দ্রজিৎ যে সূর্যাস্ত ধারণ করে রেখেছে তা কোনো সাধারণ সূর্যাস্ত নয়। ওটা শেষ বিকেলের বৃষ্টির পর অসংখ্য নাম না জানা রঙে রঙিন এক সূর্যাস্ত। কিন্তু এমন বিশেষ সূর্যাস্ত প্রতিদিন দেখা যায় না কারণ প্রতিদিন বিকেলেই তো আর ইন্দ্রজিৎ এর ইচ্ছে অনুযায়ী বৃষ্টি হয় না। আর সেই দৃশ্য নিজ চোখে সময় নিয়ে না দেখে ছবি আঁকার কোনো মানে নেই।

আজ তেমনই এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে ইন্দ্রজিৎ বাসার ছাদে বসে আছে আর গভীর মনোযোগে পুরো আকাশের সব কটি রঙকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বৃষ্টিস্নাত সূর্যাস্তের আকাশে কমলা রঙের যে বিশেষ প্রাধান্য থাকে এই তাত্তিক জ্ঞান ওর আগেই ছিল, তবে সেই কমলা রঙ আর তার অগণিত শেডের তীব্রতা আজই ও প্রথম সুক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করল। এই সূর্যাস্ত এবং তার চোখধাঁধানো রঙ এ সবই পদার্থবিজ্ঞানের বিচারে নিতান্তই নিয়মিত সাধারণ ঘটনা হলেও এর অসামান্য শৈল্পিক দিক একমাত্র উপযুক্ত দর্শকের দৃষ্টিতেই ধরা দেয়।

যাবতীয় প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সূর্যটা ডুবে গেল, কিন্তু এখনো আকাশে তার রেশ রয়ে গেছে। প্রতিটি মুহূর্তই ইন্দ্রজিৎ এর সেই স্বপ্নের ছবির জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিটি সেকেন্ডের সাথে আকাশের রঙের পরিবর্তন ও যতটা সম্ভব ওর মাথায় গেঁথে রাখছে। তবে আজ একদিন দেখাই যথেষ্ট নয়, ওকে আরও বেশ কটি এমন বিকেলের অপেক্ষায় থাকতে হবে।

পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর ইন্দ্রজিৎ নিচে নেমে এল। এসেই দেখল যে মিলো খিদেয় ঘেউ ঘেউ করছে আর ইন্দ্রজিৎ এর প্যান্ট ধরে কামড়াচ্ছে। ইদানিং মাথায় খালি সূর্যাস্ত ঘোরায় ইন্দ্রজিৎ এর নিজের কিংবা মিলো কারোর খাবারের সময়ই মনে থাকে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত মিলো ছুটোছুটি শুরু করে ইন্দ্রজিৎ নিজেও খায় না মিলোকেও খেতে দেয় না।

গত চার পাঁচ দিন ধরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের খেলনা নিয়ে না খেলে মিলো বার বার শুধু দোতলার বাঁশঝাড় লাগোয়া ঘরটার দিকে ছুটে যায় আর ঘরটার আশে পাশে ঘোরাঘুরি করে। ওকে দেখেই বোঝা যায় যে ওখানে ঢোকবার জন্যে মিলোর মন বড়ই আনচান করে, কিন্তু মিলোর সে ঘরে ঢোকা বারণ কাজেই ঘরের আশ পাশে এদিক ওদিক ঘুরেই মিলো দুধের সাদ ঘোলে মেটায়।

ইন্দ্রজিৎ আর মিলো তিনতলায় থাকে, ইন্দ্রজিৎ ছবি আঁকা থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাজ তিনতলায় করলেও বিভিন্ন রঙ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্যে দোতলার ঐ ঘরটা ব্যবহার করে। ওটা রীতিমত যেন এক গুদাম ঘর। ঘরটা দোতলার ফ্ল্যাটের একেবারে কোনায় কাজেই কোনরকম শব্দ নেই বললেই চলে, নীরবে কাজ করার জন্যে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। এখানে ইন্দ্রজিৎ হরেক রকমের রঙ এবং অন্যান্য আরও উপাদান এনে ভরে রেখেছে, যেগুলো ব্যবহার করে ও ওর কল্পনাপ্রসূত বিভিন্ন রঙ তৈরির চেষ্টা করে, কিন্তু কখনোই ওর কল্পনার আশপাশেও যেতে পারে না। তবে এবার ইন্দ্রজিত বিশেষ একটি জিনিস যোগাড় করেছে, যার ব্যবহার প্রচণ্ড বিপজ্জনক কিন্তু ও খুব আত্মবিশ্বাসী।

মিলোকে সরিয়ে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ ঘরটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, গত কদিন যাবত কোনো কাজ না থাকলেও ইন্দ্রজিৎ নিয়মিত ঘরটায় সব ঠিক আছে কিনা একবার এসে দেখে যায়। আদতে ওখানে রাখা অতি মুল্যবান জিনিসটিই ওকে টেনে আনে, বারবার মনে হয় এই বুঝি গেল হাত ফসকে, তাহলে যে মস্ত বড় ফ্যাসাদ !

দোতলায় সব ঠিকঠাক করে ওপরে এসে ইন্দ্রজিৎ মিলোকে টিভি ছেড়ে দিল। মিলো টিভির পাগল, ওকে টিভির সামনে বসিয়ে দিয়েই মূলত ইন্দ্রজিৎ যাবতীয় কাজকর্ম করে নাহলে ও বড় জ্বালাতন করে, কোনো বাচ্চার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তবে হাজার হোক মিলোই ইন্দ্রজিৎ এর একাকী জীবনের একমাত্র সঙ্গী, বিশ্বস্ত বন্ধু যে কিনা তার মনিবকে নিয়ে কখনো হাসি ঠাট্টা করে না, অপমান করে বিকৃত হাসি হাসে না। ইন্দ্রজিৎ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে মিলোর মনে ওর জন্য রয়েছে শুধুই ভালোবাসা, একবারে নিঃস্বার্থ নিখাদ ভালোবাসা।

মিলোকে টিভির সামনে বসিয়ে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ কদিন আগে অনেক কষ্টে যোগাড় করা বইটা নিয়ে বসলো, বেশ বিরল জাতের বই। বইটাতে মুঘল চিত্রকলায় পারস্য এবং ভারতীয় চিত্রশিল্পের প্রভাবের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। দুনিয়ার যত দুর্লভ বই, সবসময় ফুটপাত থেকেই পাওয়া যায়, এটা এখন পর্যন্ত ইন্দ্রজিৎ এর জীবনের অন্যতম গুরুত্তপূর্ণ পর্যবেক্ষণ।

বিকেল সাড়ে চারটায় ইন্দ্রজিৎ চোখ খুলল। আশেপাশে মোবাইলটা খুজে না পেয়ে শেষমেষ পায়ের কাছে বিছানায় খুজে পেল। রাতে ঘুমোবার আগে সবসময়ই মোবাইলটা মাথার কাছে রাখে ইন্দ্রজিৎ, তবু কিভাবে যেনো ওটাকে বেশিরভাগ সময় পায়ের কাছেই পাওয়া যায়, অদ্ভুত।

সময় দেখে ওর খুব মেজাজ খারাপ হলো, আজকের দিনটাও বরবাদ। বেশ কিছুদিন ধরেই ও সকাল সকাল উঠে দিন গুলোর পরিপূর্ণ সদব্যাবহার করবে ভেবে আসছে, তবে ভাবা পর্যন্তই। এখনো একটা দিনও সকালে সময়মত উঠতে পারেনি, মোবাইলের অ্যালার্ম নিজের মত বেজে গেছে কিন্তু ইন্দ্রজিৎ কে আর জাগাতে পারেনি।

ইন্দ্রজিৎ শোয়া অবস্থাতেই সিলিঙের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলো আর ভাবতে লাগলো যে কি বাজে ভাবেই না দিনগুলোকে নষ্ট করছে ও। ওর উচিত আরও বেশি সক্রিয় হওয়া, ছবি নিয়ে পড়াশোনা করা এবং আরও ছবি আঁকা।

এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় আধ ঘণ্টা পর ইন্দ্রজিৎ বিছানা ছেড়ে উঠলো। ঘুম থেকে সজাগ হওয়া আর বিছানা থেকে ওঠার মধ্যকার এই আধ ঘণ্টার ব্যবধান খুবই সামান্য সময়, কেননা ইন্দ্রজিৎ এর বেলায় সময় ভেদে ওটা ঘণ্টাও ছাড়িয়ে যায়।

দাঁত ব্রাশ করতে করতে দোতলায় গিয়ে মিলোর দেখা মিললো। যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে, ঐ কোণার ঘরটার আশপাশে বেশ উৎসুক ভাবে ঘোরাঘুরি করছে আর যা পাচ্ছে তাই শুঁকছে। জোরে একটা ধমক দেয়াতেই মিলো সুরসুর করে দোতলায় চলে গেলো আর এমন ভাব করলো যেন কিছুই হয়নি।

ব্রাশ করতে করতেই বাঁশঝাড়টা কে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল ইন্দ্রজিৎ। বেশ ঘন, ওটা ভেদ করে কিছু দেখা যাবার কথা নয়, তাও একটা পর্দার ব্যবস্থা করা দরকার যাতে ওর রঙ বিষয়ক গবেষণাগারটি বাইরে থেকে দেখা না যায়। ইন্দ্রজিৎ এর আবার যেকোনো বিষয়েই প্রাইভেসির বড় বাতিক।

তিনতলায় ফিরে ডাইনিং টেবিলে বসে কাঠের মত শক্ত কয়েকটা পাউরুটি চিবুতে চিবুতে ইন্দ্রজিৎ সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিভিন্ন বয়সের কিছু পোর্টরেট দেখছিল। ইতিহাসের দিকে তাকালে লোকটাকে যতটা কঠোর বলে মনে হয় ছবিতে মোটেও তেমন লাগছে না, নাকি সব ছবি এক পাশ থেকে আঁকা বলেই হয়ত মনে হচ্ছে, কে জানে।

পাউরুটি চিবুতে গিয়ে ইন্দ্রজিৎ এর মুখের সবগুলো পেশি যখন মোটামুটি ক্লান্ত ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। রুদ্রের কল দেখে ইন্দ্রজিৎ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলো যে ধরবে কিনা, কারণ এই ব্যাটা সহজে ফোন ছাড়বে না।

রুদ্র ইন্দ্রজিৎ এর স্কুল, কলেজ এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ইউনিভার্সিটিরও সহপাঠী। সম্প্রতি আর্ট ফেস্টিভ্যালের পুরষ্কারটা জেতার পর এসব পঙ্গপাল বেশ যোগাযোগ করা শুরু করেছে, দেখা করতে চাইছে, তথাকথিত ‘রিইউনিওন’। রুদ্র ছাড়াও আরও কটা আছে যেমন সুমন, অভ্র, অনিক ইত্যাদি।

একসময় এরা ইন্দ্রজিৎ কে পাত্তাই দিত না, বরং বিশ্রী ভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। ও বাবা! সে কি ভাব ছিল প্রত্যেকের, যেন একেকজন নিউটন, রুশো কিংবা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আদতে সবকটাই গণ্ডমূর্খ। ভালো ভাবে বই মুখস্ত করে পরীক্ষায় ঠিকমত বমি করতে পারত দেখেই সবাই মাথায় তুলে নাচত।

“কিরে ইন্দ্র? কেমন আছিস? আসছিস তো রিইউনিওনে?”, ফোনের ওপার থেকে রুদ্রের জিজ্ঞাসা।

“আমি ভালো, হ্যাঁ আসব অবশ্যই, বাকিরা সব আসছে তো?”

নিজের মনে ইন্দ্রজিৎ স্বগতোক্তি করল যে না গিয়ে আর উপায় কি, না গেলে তো ফোন করে করে কান ঝালাপালা করে দেবে।

“সবাই আসবে, তবে সিদ্ধার্থের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না হঠাৎ, কল রিসিভ করছে না, মেসেজেরও কোনো রিপ্লাই দেয় না। তোর সাথে এর মাঝে কথা হয়েছে?”

“না তো, সবকিছু তো তোর মাধ্যমেই হচ্ছিলো, মানে রিইউনিওনের আয়োজন, আমার সাথে আসলে আর কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ হয়নি”, ইন্দ্রজিৎ উত্তর দিলো।

“আচ্ছা রুদ্র, কিছু মনে করিস না আমাকে একটু রাখতে হচ্ছে, চুলাতে ডাল বসিয়ে এসেছি, বোধ হয় উপচে পড়ছে, তুই আমাকে কি হল না হল জানিয়ে দিস”, ফোন রেখে দিল ইন্দ্রজিৎ।

ডাল ইন্দ্রজিৎ দুচোখে দেখতে পারে না, ও কিনা আবার যাবে ডাল রাঁধতে? তবে ফোনটা এখন রাখতেই হত। রুদ্র যেকোনো প্রসঙ্গকেই চুইংগামের মত টানতে থাকে, সিদ্ধার্থের ব্যাপারে ঐ টানাটানি এখন ইন্দ্রজিৎ এর একেবারেই পোষাবে না। তবে হ্যাঁ, সিদ্ধার্থ নামটা ইন্দ্রজিৎ এর জীবনে যথেষ্ট গুরুত্ত বহন করে, আর দশটা নামের মত কোনো ফেলনা নাম নয়।

ইন্দ্রজিৎ এর আঁকা বেশ প্রশংসিত ছবিগুলোর সাথে মিউজিকের একটা সম্পর্ক রয়েছে। ঠিক সরাসরি নয়, বরং বলা চলে ছবি আঁকাআঁকি সংক্রান্ত যেকোনো কাজ করবার সময় ওর মস্তিষ্কের সৃজনশীল অংশ মিউজিকের প্রভাবনে থাকে। মিউজিক ছাড়া ছবি আঁকা ইন্দ্রজিৎ এর কাছে রীতিমত এক অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয়। ফ্রেডরিক চপিন থেকে শুরু করে রবীন্দ্র সংগীত কিছুই বাদ যায় না। নিজের সংগীত রুচি সম্বন্ধে ইন্দ্রজিৎ খুব উচ্চ ধারণা রাখে। ফরাসি চিত্রশিল্পী ইউজিন দোলাখোয়াও আঁকার সময় মিউজিকে মগ্ন থাকতেন, এটা ভেবে ইন্দ্রজিৎ খুব ভালো বোধ করে। কার্যত যেকোনো সংগীতই বিশেষ এক ধরণের আবহ তৈরি করে যা ইন্দ্রজিৎ এর সৃজনশীলতাকে এক ভিন্ন স্তরে নিয়ে যায়, যখন সবকিছুই কেমন যেন সহজ বলে মনে হয়।

এখন দোতলায় রঙের পরীক্ষাগারে চপিনের ওয়ালটজ এ মাইনর বাজছে, মিলো বাইরে অপেক্ষমাণ। ইন্দ্রজিৎ পিয়ানোর সুরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে আর ডিমের হলুদ অংশটা কে এই হাত ঐ হাত করে কিছুটা শুকাবার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে মিলোকে বাইরে রেখে এসেছে ও, মিলোও খানিকটা অবাক। সাধারণত ইন্দ্রজিৎ এর ছবি আঁকা বা রঙ নিয়ে কাজ করার সময় মিলো ওর সাথেই থাকে, চুপচাপ একদিকে বসে থাকে। তবে আজ ব্যাপারটা একটু ভিন্ন, মিলো থাকলে ঝামেলা বাড়াতো, কাজের কাজ কিছুই হত না।

গত কদিন ধরে সিদ্ধার্থের ব্যাপার নিয়ে রুদ্র এবং অন্যদের ফোন রিসিভ করতে করতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আরে বাবা, সিদ্ধার্থকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাতে ইন্দ্রজিৎ কি করতে পারে, যারা রিইউনিয়ন আয়োজন করছে খোঁজাখুঁজি করাও তাদেরই দায়িত্ব।

সিদ্ধার্থের নাম আসলেই ইন্দ্রজিৎ এর শরীরে এক রকম বিদ্যুতায়নের মত হয়, কি যেন একটা করতে ইচ্ছে করে কিন্তু সেটা কি তা ও বুঝে উঠতে পারে না। ডিমের হলুদ অংশ রাখা বাটিটাতে ভিনেগার দেয়ার সময় সিদ্ধার্থের কথা ভেবে হঠাৎ শরীরটা কেমন যেন করে উঠল, অসঙ্গায়িত এক অনুভূতি।

ডিস্টিল ওয়াটারের বোতলটা নেয়ার সময় ইন্দ্রজিৎ এর হঠাৎ অতীতের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো। অনেক আগে একবার স্কুলের এক চিত্র প্রদর্শনীর জন্য ইন্দ্রজিৎ অনেক পরিশ্রম করে একটা ছবি এঁকেছিল। যেটা ও এঁকেছিল ডাচ শিল্পী রেমব্রন্টের কিছু ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ছবিটায় ইন্দ্রজিৎ ওর মন প্রাণ একেবারে উজাড় করে দিয়েছিল, মনে মনে আশা করছিল ওর ছবিটাই প্রথম পুরস্কার পাবে। তবে ও যখন ওটা প্রদর্শনী কক্ষের দেয়ালে টাঙ্গাবার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিল, এই সিদ্ধার্থ আর তার কিছু সাঙ্গোপাঙ্গো ওর পথ আটকে দাড়ায়। ওরা ছবিটা ছোঁ মেরে নিয়ে এক পলক দেখে হাসতে হাসতে মাঠের কাদায় ছুঁড়ে ফেলে, তারপর ওটার উপর লাথি দিয়ে জুতার ছাপ বসিয়ে দেয়। বরাবরের মত কিছু বলা তো দূরের কথা ইন্দ্রজিৎ কোনো রকম প্রতিক্রিয়াই দেখাতে পারেনি।

এবার আসল কাজ। পানি, ভিনেগার আর ডিমের হলুদ অংশের দ্রবণটা প্রায় হয়ে গেছে। সাধারণত এখন নির্দিষ্ট রঙয়ের পিগমেন্ট দেয়ার কথা, তবে পিগমেন্টের বদলে ইন্দ্রজিৎ বিশেষ এক তরল ব্যবহার করতে যাচ্ছে যা ভেবেই ওর শরীরজুড়ে একরকম শিহরণ বয়ে গেল। ইনজেকশানটা হাতে নিতেই ইন্দ্রজিৎ এর মুখটা আপনাতেই হাসি হাসি হয়ে উঠলো। এটাই হবে ওর স্বপ্নের ছবির বাজিমাত করা বৈশিষ্ট, ডুবন্ত সূর্যের এমন চোখরাঙ্গানো লাল রঙ আর কেউই কখনো ব্যবহার করতে পারবে না। কেউ বুঝবে না কোথায় ইন্দ্রজিৎ এমন লাল রঙ পেল। অতিরিক্ত উত্তেজনায় ওর এর হাত থেকে ইনজেকশানটা পড়ে গেল। যাহ্‌! সবটাই বেরিয়ে গেল। তবে ইন্দ্রজিৎ বিশেষ বিচলিত হল না কারণ এমন আরো অনেকগুলো ইনজেকশান ও ভরে রেখেছে পুরো ছবির কথা বিবেচনা করে।

ইনজেকশান থেকে বেশ কিছু পরিমাণ বাটিতে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ একটা চিকন তুলি দিয়ে মেশাতে শুরু করল। যতই মেশাচ্ছে ততই যেন রঙটা রীতিমত চোখ রাঙ্গাচ্ছে, ইন্দ্রজিৎ এর চোখ মুখ একই সাথে জ্বলজ্বল করে উঠছে। রঙে এমন উপাদান ব্যবহার ওর আবিষ্কার।

হঠাৎ ওর মনটা কেমন যেন খচখচ করে উঠল। ও কি পাশের ঘরগুলোর সব জানালা বন্ধ করেছে বা পর্দা নামিয়ে রেখেছে? যেমন বসার ঘরের ঘুরানো জানালাটা? ওটা তো বেশ বড়। রঙের পরীক্ষাগারের দরজা জানালা বন্ধ কাজেই বাইরে থেকে কেউ কিছু দেখার বা বোঝার কথা নয়, তবু সাবধানের মার নেই।

ইন্দ্রজিৎ দেরি না করে রঙ এর বাটি টেবিলে রেখে সব কিছু আরেকবার দেখে নেয়ার জন্য রঙের ঘর থেকে বের হল। বাইরে মিলো মন খারাপ করে বসেছিল, মনিবকে দেখে বেশ জোড়ে সোড়ে লেজ নাড়তে থাকল। দোতলায় বসার ঘর থেকে শুরু করে বাকি সব ঘরের পর্দা নামানো, এমনকি জানালাও বন্ধ। সব দেখে ফেরার সময় মনে হল তিনতলাটা তো দেখা হয়নি। ইন্দ্রজিৎ কাজ করছে দোতলায়, কাজেই তিনতলার জানালা নিয়ে চিন্তা থাকার কথা না তবুও নিশ্চিন্ত হবার জন্যে ও সিড়ি অভিমুখে রওয়ানা হল, মিলো পিছু নিতে ভুল করল না।

তিনতলায় পা রাখতে না রাখতেই ঠাণ্ডা বাতাস মুখে এসে লাগলো, বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। তার মানে ইন্দ্রজিৎ তিনতলার কোনো জানালাই বন্ধ করেনি। গিয়ে দেখা গেল জানালা বন্ধ তো দূরের কথা পর্দাগুলোও টেনে রাখেনি। তবে বাইরে তাকিয়ে বাতাসে বাঁশঝাড়ের এদিক ওদিক দুলুনি দেখে ইন্দ্রজিৎ এর মনটা বেশ প্রশান্ত হয়ে গেল, অন্য কিছু আর মাথায় রইল না।

এক প্রকার শান্ত এবং সন্তুষ্ট মন নিয়ে ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল ইন্দ্রজিৎ,, সামনে বাঁশঝাড় আর উপরে কালো হয়ে আসা মেঘ সাথে ঝড়ো বাতাস। যদিও বৃষ্টির আশা ইন্দ্রজিৎ করছে না, গত কদিন ধরেই এমন মেঘ করছে, পরে গিয়ে দেখে যায় বৃষ্টির আশায় গুড়েবালি। মিলো ইজি চেয়ারের পাশে এসে বসল। বৃষ্টি মিলোরও খুব পছন্দ। আগে মিলো আর ইন্দ্রজিৎ দুজনেই ছাদে গিয়ে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতো। পরে দুজনই বারবার একই সাথে ঠাণ্ডায় কাবু হওয়ায় এখন আর যায় না।

মিলোর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ইন্দ্রজিৎ গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ল। ছোট বেলা থেকেই ইন্দ্রজিৎ ওর মনের ভাব প্রকাশ করে আসছে ওর আঁকা যাবতীয় ছবির মধ্য দিয়ে, কথায় ইন্দ্রজিৎ কখনোই ভালো ছিল না, এখনো নেই। যাদের দেখার চোখ ছিল তারা ওর ছবিগুলো দেখে অনেককিছুই হয়ত ধরতে পেরেছে বাকিরা পারেনি। ইন্দ্রজিৎ এর ধারণা শেষ দলের মানুষই বেশি, যারা এখনো সেখানেই আছে। হাত বুলানোর কারণে মিলোর চোখগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে দেখে ইন্দ্রজিৎ হেসে উঠল, আর তাতে মিলো বেশ অপ্রস্তুত বোধ করলো।

ইন্দ্রজিৎ এর আজীবন ইচ্ছা এমন সব ছবি আঁকার যেগুলো দেখা মাত্রই দৃষ্টিসম্পন্ন দর্শকের চোখে মুহূর্তেই এক অনন্য প্রশান্তি নেমে আসবে। ইন্দ্রজিৎ এর ধারণা এমন অনন্য ছবির জন্যে প্রয়োজন অনন্য রঙ, যা ইতিমধ্যেই ওর হস্তগত হয়ে গেছে। আর কোনো বাধা নেই, এখন শুধুই ক্যানভাসটায় হাত দেয়ার পালা। এসব ভাবতে ভাবতেই ইন্দ্রজিৎ এর চোখ বন্ধ হয়ে আসলো এবং মিলো আর ইন্দ্রজিৎ দুজনই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল।

মুঘল সম্রাটেরা পারস্য থেকে মীর সাইয়িদ আলি, ফররুখ বেগ এদের মত অসাধারণ চিত্রশিল্পীদের নিয়ে এসেছিলেন। যারা ভারতীয় চিত্রশিল্পের সংস্পর্শে এসে তার সাথে পারস্য চিত্রকর্মের ধারার সংস্মিশ্রণ ঘটান। দুইয়ের মিশ্রণে গড়ে উঠে মুঘল চিত্রকলা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতীয় উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশের কব্জায় তখন আবার আরেক নতুন ধারার আত্মপ্রকাশ, ‘কোম্পানি স্টাইল’। এই ধারার শুরুর দিককার শিল্পীদের মাঝে অন্যতম স্যার থমাস মেটকাফের নিয়োগপ্রাপ্ত শিল্পী মাজহার আলী খান। তিনি ছিলেন মুঘল প্রশিক্ষিত আবার ইউরোপীয় চিত্রকর্মের সাথেও পরিচিত ছিলেন, তাছাড়া ব্রিটিশ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হবার কল্যাণে ছবি আঁকার জন্যে পেয়েছিলেন ইউরোপীয় সরঞ্জামাদি। চিত্রশিল্পের এক ক্রম বিবর্তনশীল ধারা।

এসব সাম্রাজ্যেবাদের কারণে যদি বিভিন্ন দেশের শিল্প সংস্কৃতি মিলে মিশে নিত্য নতুন ধারা তৈরি করতে পারে তবে তা মন্দের ভালো হিসেবে খুব একটা খারাপ না, বই পড়তে পড়তে এটাই ভাবছিল ইন্দ্রজিৎ। বাস্তবতা যে ভিন্ন ইন্দ্রজিৎ তা ভালোই জানে। শুধু শিল্প সংস্কৃতির জন্যে বিদেশী শক্তির হাতে শত বছর ধরে মার খাওয়া পোষায় না।

ইন্দ্রজিৎ ওর সূর্যাস্তের ছবির প্রাথমিক ফাউন্ডেশানটা শেষ করে ক্যানভাসটাকে শুকাতে দিয়েছে, ঠিক মত না শুকানোর আগ পর্যন্ত আর এগোনো যাবে না। ইন্দ্রজিৎ আর মিলো দোতলার বসার ঘোরে বসে আছে, ইন্দ্রজিৎ বই পড়ছে আর মিলো ভাবনার জগতে বিচরণ করছে। ছবি আঁকা কিংবা রঙের পরীক্ষাগারের দরজা যথারীতি বন্ধ, তারপরও ইন্দ্রজিৎ এর এক চোখ ওদিকটায় কঠোরভাবে নজর রাখছে।

হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠলো। মিলো বেশ বিরক্ত হলো, বিরক্ত হলে ও নাক দিয়ে বিশেষ একটা শব্দ করে। ছোটবেলা থেকে ইন্দ্রজিৎ এর সাথে থাকতে থাকতে বাসায় মানুষ আসা মিলোও পছন্দ করে না। মিলো নিজেও ওর মনিবের মত নিভৃতচারী হয়ে গেছে। মিলো যেখানে বিরক্ত হতে পারে, সেখানে ওর মনিবের কথা আলাদা করে না বললেও চলে।

বই পড়তে পড়তে ইন্দ্রজিৎ মনোযোগ এবং চিন্তার একটা বিশেষ স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল, কলিং বেলটা বেজে দিলো সব শেষ করে। দরজাটা না খুলে ওরা দুজন আরো কয়েকবার বেল বাজার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল। এটা ইন্দ্রজিৎ প্রায়ই করে থাকে। আগন্তুক কয়েকবার বেল বাজিয়ে না পেলে হয়ত ফিরে যেতে পারে, তবে তিনি যদি একান্তই ধৈর্যশীল হন তাহলে গিয়ে দরজাটা খুলতেই হবে।

দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার বেল বাজার পর ইন্দ্রজিৎকে উঠতেই হল, সাথে মিলোও উঠলো যা না হলেই নয়। ইন্দ্রজিৎ নিচে নেমে সদর দরজাটা খুলে দেখল পুলিশের পোশাক পড়া একজন দাড়িয়ে। লোকটা একটু মোটা করে, সামনের দিকে পেটটা খানিকটা বেরিয়েছে। ইনি যদি সত্যিই পুলিশের লোক হয়ে থাকেন, উনাকে যদি কখনো চোর ধরতে হয় আর সেখানে যদি দৌড়াদৌড়ি করার প্রয়োজন হয় তাহলে চোর সহজেই পালিয়ে যাবার কথা।

“গুড ইভনিং, আমি ইন্সপেক্টর সুহাস, এটা কি ইন্দ্রজিৎ সাহেবের বাড়ী?”, ইন্দ্রজিৎ যাবতীয় ব্যাপার ভাবতে ভাবতেই লোকটা প্রশ্ন করল।

“আমিই ইন্দ্রজিৎ, হঠাৎ পুলিশের আমাকে কেন দরকার হল? সম্প্রতি কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ করেছি বলে তো মনে পড়ছে না”, ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিল ইন্দ্রজিৎ যদিও ওর সন্দেহ হচ্ছে এই লোক আদৌ পুলিশ কিনা।

“না না, আপনার সাথে একটা বিষয়ে কিছু কথা বলার ছিল, আপনি যদি একটু ভেতরে আসার অনুমতি দিতেন তাহলে সবকিছু খুলে বলতাম”, হাসিমুখে বললেন ইন্সপেক্টর সুহাস।

ইন্দ্রজিৎ এর মাথাটা এখনো ঠাণ্ডা থাকলেও লোকটা ভেতরে আসতে কেন চায় এটা নিয়ে ও কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়েছে, “যদি কিছু মনে না করেন, ইদানিং পুলিশের নাম করে অনেকেই অনেক কিছু করছে, আপনি কি আমাকে আপনার আইডি কার্ড বা ওরকম কিছু দেখাতে পারেন?”

“নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, সরি আমারই ভুল, আমারই শুরুতে ওটা দেখানো উচিৎ ছিল, এই যে…”, আইডি কার্ডটা বের করে ইন্দ্রজিৎ এর মুখের সামনে তুলে ধরলেন ইন্সপেক্টর সুহাস।

এখন তো আর কিছু বলার নেই, কথা বাড়ালে বরং প্যাঁচ লাগতে পারে, “ভেতরে আসুন…”, ইন্সপেক্টর সুহাস ঢুকলে দরজাটা বন্ধ করল ইন্দ্রজিৎ। পাশে মিলোকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো মিলো নেই অথচ দরজা খোলার সময় সাথেই ছিল। পুলিশ দেখে পালিয়ে গেল কিনা? যাহ্‌, মিলোটা আর সাহসী হলো না, একেবারে ভীতুই রয়ে গেলো।

ইন্দ্রজিৎ ইন্সপেক্টর সুহাসকে দোতলার বসার ঘরে নিয়ে যাবার সময় মনে মনে আফসোস করছিল এই ভেবে যে বসার ঘরটা তিনতলায় হলেই ভালো হত। এই লোককে তিনতলায় বসতে দেবার মত কোনো চেয়ার নেই, কাজেই আর কিছু করার নেই।

ইন্সপেক্টর সুহাস বসার ঘরে গিয়ে জানালার পাশের সিঙ্গেল সোফাটাতে বসতে যাচ্ছিলেন, ইন্দ্রজিৎ ওটা দেখে সাথে সাথে পাশের বড় সোফাটা দেখিয়ে বলল,

“আপনি দয়া করে এটায় বসুন, ওই সোফাটায় সাধারণত আমি বসি”, বলে ইন্দ্রজিৎ একটু ভদ্রতার হাসি হাসলো।

ডাহা একটা মিথ্যা কথা। ঐ সিঙ্গেল সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসা যায় না বলে ওটায় না বসতে বসতে রীতিমত ধুলো জমে গেছে। আসল ব্যাপারটা হল ওখানে বসলে রঙের গবেষণাগার পরিষ্কার দেখা যায়, ঐ সোফাটার অবস্থান ঐ ঘরের দরজার একেবারে উল্টো দিক বরাবর।

“নিশ্চয়ই…”, ইন্সপেক্টর সুহাস সরে গিয়ে বড় সোফাটায় বসলেন।

ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ কি ঘটছে পুরো ব্যাপারটা একটু বুঝে নিতে চেষ্টা করল। মনোবিজ্ঞান আর মানুষের বিহেভিয়র নিয়ে এক সময় ইন্দ্রজিৎ বেশ পড়াশোনা করত, এখন যদি ঐ জ্ঞান শেষমেশ কোনো কাজে লাগে তো লাগলো। পাশে মিলো থাকলে ভালো হত কিন্তু ব্যাটা তো পুলিশ দেখে এক দৌড়ে তিনতলায় গিয়ে বসে আছে। যাই হোক এখন ইন্দ্রজিৎ এর যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকতে হবে আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।

“এবার আসল কথায় আসা যাক”, বলে ইন্সপেক্টর পকেট থেকে একটা ডাইরি বের করলেন।

“আপনার বন্ধু ফারহান খান থানায় একটা ডাইরি করেছেন…”,

“ফারহান খান নামে তো আমার কোনো বন্ধু নেই”, কিছুটা অবাক হল ইন্দ্রজিৎ।

“কি বলছেন? আপনি উনাকে চেনেন না? তবে উনার কাছ থেকেই তো আমরা আপনি সহ আপনাদের আরো কজন বন্ধুর নাম পেলাম, সম্ভবত আপনারা সহপাঠী ছিলেন”

“আচ্ছা, যার কথা বলছেন তার অন্য কোনো নাম জানেন কি? এই ধরুন ডাকনাম”

“ও হ্যা, রুদ্র, ফারহান খান রুদ্র”, ডাইরি খুঁজে বললেন ইন্সপেক্টর।

“আচ্ছা, হ্যা আমরা সহপাঠী ছিলাম তবে বন্ধু বললে ভুল হবে, বন্ধু হলে নিশ্চয় ভালো নাম দিয়েই চিনতে পারতাম”, আকর্ণ বিস্তৃত একটা হাসি হাসলো ইন্দ্রজিৎ। আর হেসেই বুঝলো এই হাসিটা পরিস্থিতির সাথে একদমই যায়নি। ইন্সপেক্টর সুহাস ইন্দ্রজিৎ এর চেহারার দিকে সেকেন্ড খানেক তাকিয়ে আবার ডাইরির পাতা উল্টাতে লাগলেন।

“আপনাদের এক বন্ধু সিদ্ধার্থ, বন্ধু বা সহপাঠী যাই বলুন এক সপ্তাহ ধরে গায়েব, কোনো খবর নেই, একারণেই মূলত রুদ্র সাহেব পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন, আপনার সাথে নিশ্চয় এ ব্যাপারে কথা হয়েছে কারণ উনার দেয়া তথ্যমতে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আপনাদের একটা পার্টি হওয়ার কথা”,

ইন্দ্রজিৎ এর শরীরে কেমন যেন একটা বৈদ্যুতিক প্রবাহ চলে গেল, আবার সিদ্ধার্থ। এরা ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে যেন ঐ একজন ছাড়া রিইউনিওন একেবারে অসম্ভব। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ইন্দ্রজিৎ সোজা ছবি আঁকার ঘরটার দিকে একবার দেখলো। এরপর ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল,

“সিদ্ধার্থ? ও আচ্ছা, স্কুলে পড়ত আমার সাথে, কই ওর ব্যাপারে তো রুদ্র কিছু বলেনি আর আপনি যে পার্টির কথা বলছেন ওখানে যে সিদ্ধার্থরও আসার কথা এটা আমার জানা ছিল না, আর সত্যি বলতে এদের কারো সাথেই আমার বিশেষ কোনো যোগাযোগ নেই, কালে ভদ্রে কথা হয় কাজেই মনে হয় না আমার কাছ থেকে আপনি বিশেষ কোনো তথ্য পাবেন”

“তার মানে তাকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই ব্যাপারটা আপনি আমার কাছেই প্রথম শুনেছেন”, ডাইরিতে লিখতে লিখতে বললেন ইন্সপেক্টর সুহাস।

ইন্দ্রজিৎ কথাটা ঠিক শুনতে পায়নি, ওর দৃষ্টি ছবির ঘরের দরজায় আবদ্ধ। মাথাটা কেমন যেন হালকা হয়ে আসছে আর একটু শীত শীত ভাবও লাগছে ইন্দ্রজিৎ এর। মনে হচ্ছে ঘরের আলোটা আপনা আপনি কমে যাচ্ছে।

“আচ্ছা, আপনি কি চিত্রশিল্পী? দেয়ালে অনেক ছবি টাঙ্গানো আবার এদিক ওদিক অনেক ক্যানভাস দেখতে পাচ্ছি”, আশপাশে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন ইন্সপেক্টর সুহাস।

ইন্দ্রজিৎ ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো তারপর উত্তর দিল, “হ্যা, আমাকে চিত্রশিল্পী বলতে পারেন”, বলে ও হাসার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করল।

ইন্সপেক্টর লোকটাকে ইন্দ্রজিৎ এর সোফা থেকে অনেক দূরে মনে হচ্ছে, একটু আগেও মনে হয় আরো কাছে ছিল। মনে হচ্ছে লোকটার কথাগুলো কেমন যেন অনেক দূর থেকে আসছে । ইন্দ্রজিৎ এর এখন খুব শীত লাগছে, হাতের তালু হঠাৎ বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

“সিদ্ধার্থ সাহেবের পরিবার আর রুদ্র সাহেব সবাই বললেন যে মানুষ হিসেবে উনি বেশ রেস্পন্সিবল, এভাবে গায়েব হয়ে যাবার লোক তিনি নন, উনার ফোনটা আমরা পেয়েছি হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের পাশে যে ঝিলটা আছে ওটার পাড়ে, উনার ওখানে যাতায়াত ছিল?”

“আমাদের রিইউনিওনটা হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে হবার কথা, তাই না?”, ইন্দ্রজিৎ একটা অসংলগ্ন প্রশ্ন করে বসল তবে প্রশ্নটার অসংলগ্নতা অনুধাবন করার মত অবস্থা ওর এখন নেই। মিনিট খানেকের মাঝে ওর মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে গেছে।

“সিদ্ধার্থ সাহেব কি এটার আয়োজনের দায়িত্তে ছিলেন? মানে আপনার কি মনে হয় উনি ওখানে এজন্যেই গিয়েছিলেন”, প্রশ্ন করার পর ইন্সপেক্টর সুহাস লক্ষ্য করলেন ইন্দ্রজিৎকে কেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, অনেকটা রক্ত শুন্যতার রোগীর মত।

ইন্দ্রজিৎ সোজা তাকিয়ে খেয়াল করল রঙের গবেষণাগারের দরজার নিচে ফাক দিয়ে কি যেন বেরিয়ে আসছে। অনেক কষ্টে দেখতে হচ্ছে কারণ ইন্দ্রজিৎ এর দুচোখে এখন ভয়াবহ ঘুম আর ক্লান্তি। দরজার ফাক দিয়ে যা বের হচ্ছে তা আর কিছুই নয়, রঙ, ইন্দ্রজিৎ এর তৈরি চোখ ধাঁধানো লাল রঙ। গড়িয়ে গড়িয়ে প্রায় বসার ঘর পর্যন্ত চলে আসছে। আর একটু! ইন্সপেক্টর কি খেয়াল করছেন? উনি কি দেখছেন ওদিকে?

“আপনি কি বলতে পারেন ঐ যে, ঐ ঘরটার দরজার ফাক দিয়ে লাল রঙের ওটা কি বের হচ্ছে? এই তো প্রায় এসে গেছে আপনার পায়ের কাছে, দেখুন, এই যে”, ইন্দ্রজিৎ এর মুখে কথা জড়িয়ে আসছে, গলা কাপছে, শরীরও শীতে কাপছে।

উত্তর শোনার জন্য ইন্দ্রজিৎ আর অপেক্ষা করতে পারলো না, ওর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো।

“কিরে তুই ঠিক আছিস তো? কাপছিস কেন? হাতও দেখি ঠাণ্ডা”, সিদ্ধার্থ ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

ইন্দ্রজিৎ তাকিয়ে দেখলো সামনে সিদ্ধার্থ বসা, টেবিলের ওপাশে বসে অনিক আর রুদ্র কথা বলছে। কি ব্যাপার ইন্সপেক্টর সুহাস কোথায় গেলেন? ইন্দ্রজিৎ আবার হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে কখন আসলো?

সামনে রাখা পেস্ট্রি, পুডিং, ডোনাট যাবতীয় খাবার দেখা মাত্র ইন্দ্রজিৎ কিছুটা দৃষ্টিকটুভাবে খাওয়া শুরু করল। একটার পর একটা পেস্ট্রি, পুডিং খেয়েই যাচ্ছে। দেখে সিদ্ধার্থ কিছুটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, “কি ব্যাপার ইন্দ্র, তোর ব্লাড সুগারের সমস্যা নাকি রে? সুগার কমে গিয়েছিলো তখন?”

অ্যাপেল জুসটা শেষ করে সিদ্ধার্থের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ না সূচক মাথা নাড়ল। সিদ্ধার্থের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ এর খেয়াল হল ছেলেটার গায়ের রঙ একদম নষ্ট হয়নি। এখনো আগের মতই হলুদ ফরসা, কপালের পাশ দিয়ে শিরা উপশিরা সব পরিষ্কার দেখা যায়। ঐ শিরা গুলো দিয়ে নিশ্চয় চোখ ধাঁধানো লাল রঙ উপরে নিচে প্রবাহিত হচ্ছে সারা দিন সারা রাত, বাহ! ইন্দ্রজিৎ তাকিয়ে থাকল।

রিইউনিওন শেষ হয়ে সবাই যার যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ী ফিরে গেল। তবে সিদ্ধার্থ লাপাত্তা।

রত্নদীপ তূর্য


মন্তব্য

ফারহান এর ছবি

গল্প পড়ার পথে ভুল বানানগুলো একটু পীড়া দিল।

রত্নদীপ তূর্য  এর ছবি

গল্পটা পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ | অভ্র বিভিন্ন বানানকে প্রায়ই এদিক ওদিক করে দেয়, আমার উচিত ছিল আরো মনোযোগ সহকারে প্রুফরিড করা | আপনার অসুবিধার জন্যে যারপরনাই দুঃখিত | ভালো থাকবেন |

সত্যপীর এর ছবি

ড়হস্যময় কামরায় সন্দেহজনক আওরঙ্গজেবের পোর্ট্রেটের কথায় ভাবলাম আচমকা বুঝি একদিন ছবি থেকে নেমে আলমগীর বাদশা একটা চড় দিয়ে দাঁতটাত নামিয়ে দেবে ছবি আঁকার মত বেদাতী কার্যক্রমের জন্য। শেষটায় দেখি মোগল ছবি রেড হেরিং মাত্র মন খারাপ

..................................................................
#Banshibir.

রত্নদীপ তূর্য  এর ছবি

আপনি গল্পটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন দেখে খুব আনন্দিত হলাম, অনেক ধন্যবাদ | ভালো থাকবেন |

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।