অপরিকল্পিত

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/০১/২০২২ - ৬:২৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তপন বাবু হালকা গড়নের ছোটোখাটো একজন লোক। চেহারাটা বেশ ধাঁরালো, বিশেষ করে নাকটা। তাঁর চোখ দুটি একেবারে অমায়িক, সবসময় হাসিহাসি একটা ভাব। তাঁকে কেউ কখনো খুব রাগতে দেখেছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া বেশ রসিক লোকও বটে, তা নাহলে কি আর অফিসে নিজের বাড়ন্ত ভুঁড়ি নিয়ে সহকর্মীদের সাথে নিজেই হাসি ঠাট্টায় মেতে ওঠেন?

দীর্ঘ তিন দশক ধরে তপন বাবু একটি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেছেন, এখন অবসরের দ্বারপ্রান্তে। এই তিন দশকের কর্মজীবনে অফিসে একটি দিনও দেরিতে আসেননি কিংবা সময়ের আগে অফিস ছেড়ে যাননি। কাজের প্রতি তাঁর যে নিষ্ঠা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি এ যুগে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। কর্মক্ষেত্রে তিনি পেশাদারিত্বের যে উদাহরণ তৈরী করে যাচ্ছেন, মনে হয় না ভবিষ্যতে কেউ তার আশপাশ দিয়েও যেতে পারবে। লোভ লালসা কিংবা সীমাহীন বস্তুবাদী আকাঙ্খা এগুলোই তো শেষমেশ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়? এর কোনোটাই কখনো তপন বাবুর মাইল খানেকের মধ্যেও ঘেঁষতে পারেনি।

তপন বাবুদের ব্যাংকে গত বছর বড়কর্তা থেকে শুরু করে একেবারে নিচ পর্যন্ত সবাই মিলে কয়েক হাজার কোটি টাকা হরিলুট করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই তপন বাবুর টেবিলেও প্রস্তাব গিয়েছিলো। স্বভাবতই তপন বাবুর এমন গর্হিত কোনো প্রস্তাব গ্রহণের প্রশ্নই আসে না।

তবে যা হয়েছিল তা হলো, এই পুরো ব্যাপারটাতে তপন বাবু খুব ব্যথিত হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন বেশ মনোকষ্টে ভুগেছিলেন। কারণ একটাই, যাদের টাকাগুলো লুট করা হলো তিনি তাদের জায়গায় নিজেকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন, দেখলেন তিনি তো তাদেরই একজন যারা কিনা দিন রাত খেঁটে এক টাকা দু টাকা করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে, স্ত্রী সন্তানের জন্যে সঞ্চয় করেন। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে গুটি কয়েক স্যুট টাই পরিহিত ভদ্রলোক কিনা তাদের সবকিছু এভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিলো? এমন জঘন্য ডাকাতি করার পরও কিনা এরা এমন হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

কিন্তু তপন বাবুর ভাগ্য নিতান্তই সুপ্রসন্ন বলতেই হয়। ঐ ডাকাত গুলোর সাথে আর বেশি দিন একই অফিসে কাজ করতে হবে না কারণ তপন বাবুর অবসরের আদেশ হয়ে গেছে। তপন বাবুর বারণ সত্ত্বেও আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে অফিসে তাঁর সম্মানে একটা বিদায়ী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওটাই শেষ, আর কখনো ওদের মাঝে যেতে হবে না।

তপন বাবু ছোট থেকেই বেশ গোছানো স্বভাবের, ঠিকমত পরিকল্পনা না করে কখনোই কিছু করেন না। টাকা পয়সার ব্যাপারে তাঁর সচেতনতা অন্য মাত্রার। প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত এক পয়সাও কখনো খরচ করেন না। এক্ষেত্রে তিনি বেশ ভাগ্যবান তার স্ত্রী এবং সবচেয়ে ভালো বন্ধু প্রমীলাও তারই মত। যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে তারা দুজন হাজার বার ভেবে পা ফেলেন।

হিসেব করে সংসার চালিয়ে যাবতীয় শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে তারা তাদের দুই সন্তান দীপন আর সুমিত্রাকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করিয়েছেন। এই তো দীপন কদিন হলো ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে আর সুমিত্রা অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে।

তপন বাবু নিজের সন্তানদেরকেও একই শিক্ষাই দিয়েছেন। সর্বদা পরিকল্পনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া। আসল কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শখ আহ্লাদ, আনন্দ ফূর্তিতে গা ভাসিয়ে না দেয়া।

যেমন ধরা যাক দীপন আর সুমিত্রার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে তাদের বন্ধুরা যখন এখানে ওখানে বেড়াতে যেত, তখন তপন বাবু তাদের জন্য পরবর্তী ক্লাসের বই নিয়ে আসতেন। আর ওরা তখন থেকেই পরবর্তী ক্লাসে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবার জন্য পড়াশোনা শুরু করে দিত। তাদেরকে তপন বাবু বোঝাতেন যখন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব শেষ হয়ে যাবে তখন ওরা যত খুশি ঘোরাঘুরি করতে পারবে, কিন্তু এখন ঠিকমত পড়াশোনা করাই মুখ্য।

দীপন আর সুমিত্রাও খুব বাধ্য এবং বড় মিষ্টি। মা বাবার কথাকে প্রচন্ড সম্মান করে এবং তাদের পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করে না।

তপন বাবু যে শিক্ষা তার সন্তানদের দিয়েছেন তিনি নিজে কিন্তু বড় হয়েছেন তার প্রায় উল্টোটা শুনে। তপন বাবুর বাবা প্রয়াত স্বপন বাবু ছিলেন বেশ আমুদে প্রকৃতির একজন মানুষ। জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করাই ছিল তার কাছে একমাত্র সত্য। যখন খুশি পাহাড়ে, সমুদ্রে, জঙ্গলে ঘুরতে চলে যেতেন, সাধ্যের মধ্যে তার শখের জিনিস যা পাওয়া যেত আগে পিছে না ভেবে কিনে ফেলতেন। স্বপন বাবু তার জীবনটা একেবারে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন। স্বপন বাবুর দৃষ্টি থেকে দেখলে এটা অনস্বীকার্য যে তিনি একটি পুরোপুরি স্বার্থক জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বরাবরই তপন বাবুর সব বিষয়ে অতিপরিকল্পনার স্বভাবটা একদমই পছন্দ করতেন না।

তিনি প্রায়ই বলতেন, "শোন তপন, আগামীকাল কি হবে তা তোর হাতে নেই, আর গতকাল এরই মধ্যে ইতিহাস হয়ে গেছে, আমরা সবাই বর্তমানে বাঁচি, কাজেই এতো বেশি হিসেব নিকেশ না করে মুহূর্তটা উপভোগ কর না হলে একটা সময় আসবে যখন তুই নিজেই পস্তাবি বলে রাখলাম"

"তার মানে তুমি বুঝাতে চাচ্ছো যে আমি কচুরি পানার মত জীবন যাপন করি?", জবাব দিতেন তপন বাবু।

"এর মধ্যে আবার কচুরি পানা এলো কোথা থেকে?"

"কচুরি পানা যেমন নদী যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যায়, নিজের কোনো সিদ্ধান্ত বা হিসেব নিকেশ করার ক্ষমতা নেই"

"আরে! হিসেব নিকেশ, পরিকল্পনা এগুলো একেবারে বাদ দিতে তো আর কেউ বলেনি, ভবিষ্যতে কি করবি তার ব্যাপারে একটা খসড়া ধারণা তো অবশ্যই রাখবি। কিন্তু তাই বলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানটাকে প্রতিনিয়ত অর্থহীন নিরস ইতিহাসে পরিণত করার কি কোনো মানে আছে? তাছাড়া তুইই বা এতো নিশ্চিত কি করে হোস যে ভবিষ্যতে সবকিছু তোর পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলবে? তুই কি জ্যোতিষী নাকি ঈশ্বর? দেখা গেলো যে, যে সময়টার জন্য তুই অপেক্ষা করে বসে আছিস তখন নতুন কোনো উৎপাত এসে হাজির হয়েছে তারপর তোর সেই অতিকাঙ্খিত আদর্শ ভবিষ্যতের আর দেখাই পেলি না", স্বপন বাবু এভাবেই বলতেন।

কিন্তু তপন বাবু তার বাবার ঐ কথা গুলোকে কখনোই বিশেষ গুরুত্ব দেননি, তিনি তার নিজের রাস্তাতেই হেঁটেছেন। প্রতিটা পদক্ষেপের আগে হাজার বার ভেবেছেন।

যেমন ধরা যাক তপন বাবুর তরুণ বয়স থেকেই ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছে। তবে অযথা টাকা খরচ হবে ভেবে সেই ইচ্ছেটাকে বেশি লাই দেননি। সব সময় ভেবে এসেছেন একদিন না একদিন তো অবসরে যাবেন, এরপরই না হয় যাবতীয় ইচ্ছেপূরণ করবেন। নিজের ইচ্ছের চেয়েও টাকা পয়সা বাঁচিয়ে যথাসাধ্য সঞ্চয় করে নিজের পরিবারের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ তৈরি করাই সবসময় তপন বাবুর প্রাধান্যের তালিকায় সবার উপরে স্থান পেয়েছে।

তপন বাবুর সেই ভবিষ্যৎ আজ প্রায় দরজায় কড়া নাড়ছে। অবসরের সময় এসে যাওয়ায় এখন তপন বাবু আর প্রমীলা এবার পুরো পরিবার নিয়ে হিমালয় দেখতে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।

তারা কখনো কোথাও তেমন ঘুরতে যাননি বলে তপন বাবু, প্রমীলা, দীপন, সুমিত্রা সবার মাঝে ইদানিং বেশ উত্তেজনা কাজ করছে। রিসোর্টে স্যুট বুক করা, বিমানের টিকিট কাটা এই সব নিয়ে তারা সবাই বেশ রোমাঞ্চিত। প্রতিদিন খাবার টেবিলেই বেড়াতে গিয়ে কখন কোথায় কি করবেন তা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা চলছে, একই কথাই ঘুরে ফিরে বারবার বলা, তারপরও এর মধ্যে ওরা যে আনন্দটা পাচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের মন রীতিমত উদ্বেলিত। যাবার আরো কিছুদিন বাকি থাকলেও ইতিমধ্যে সবাই নিজ নিজ ব্যাগে কে কি নেবে তা ভরতে শুরু করে দিয়েছেন। প্রথম বিদেশ সফর বলে কথা, এমন প্রবল উদ্দীপনা না থাকলেই বরং তা অস্বাভাবিক ঠেকতো।

*

অফিসে বিদায়ী সংবর্ধনার দিন যত এগিয়ে আসছে তপন বাবুর ততই অস্বস্তি লাগছে। ওখানে গিয়ে ভালো না লাগলেও মুখে একটা আলগা হাসি ধরে রাখতে হবে আর এমন একটা ভাব দেখাতে হবে যেন অবসরের পর সহকর্মীদের প্রতিদিন না দেখতে পেয়ে তপন বাবু বেশ দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবন কাটাবেন। আদতে তো ব্যাপারটা পুরোই উল্টো।

এরই মধ্যে দীপন জানালো যে টিকিট কাটা হয়ে গেছে, ওর ইমেইলে নাকি টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। এটা শুনে সবাই মহাখুশি। তপন বাবু, প্রমীলা, সুমিত্রা সবাই একসাথে গেলেন দীপনের ইমেইলে পাঠানো টিকিটটা দেখতে।

"আচ্ছা দীপন, আমার জন্য বিমানে জানালার পাশে সিট বুক করেছিস তো?", প্রমীলা জিজ্ঞাসা করলেন কারণ বাসে বা ট্রেনে জানালার পাশে সিট না হলে প্রমীলার চলেই না।

"সিট সম্পর্কে তো দেখছি এখানে কিছুই লেখা নেই, কি ব্যাপার?", দীপন কিছুটা অবাক হলো।

"আমি আমাদের অফিসের একজনের কাছে শুনেছি সিট নাকি এয়ারপোর্টে গিয়ে এই টিকিট দেখালে তারপর দেয়, মানে বিমানের ব্যাপারটা নাকি বাস ট্রেনের মত না", বললেন তপন বাবু।

"তুমি নিশ্চিত তো বাবা? আর তোমার অফিসের ঐ লোকই বা যে ঠিক বলছে তা অত নিশ্চিত হচ্ছে কি করে?", সুমিত্রা তার বাবার কথায় খুব একটা আশ্বস্ত হলো না।

"আরে! ঐ লোক জানবে না তো কে জানবে? এমন কোনো সরকারি ছুটি নেই যখন সে তার পুরো চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে বিদেশে বেড়াতে যায় না, বুঝলি না সুমিত্রা, টাকা টেবিলের নিচ দিয়েও তো আসে", বলে একটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন তপন বাবু।

"আচ্ছা শোনো, তোমাকে যে বললাম পাশের বাসার প্রতিবেশীদের একটু জানিয়ে রাখতে যে আমরা এক সপ্তাহ থাকব না, যাতে বাসাটার দিকে একটু নজর রাখে, বলেছিলে?", প্রমীলা তপন বাবুকে বললেন। প্রমীলা বরাবরই এইসব বিষয় নিয়ে সদা চিন্তিত।

"হ্যাঁ, আরে তাই তো। কিন্তু পাশের বাসার জসীম ভাই এত বেশি কথা বলেন, যে উনাকে কিছু বলতে গেলে কমপক্ষে ঘন্টাখানেকের জন্য আটকে যেতে হয়, এজন্য আমি ভয়ে ওনাদের বাসার আশপাশ দিয়েই যাই না, কখন না আবার দেখে ফেলে কথা শুরু করে দেয়", প্রতিবেশী জসীম সাহেবের ব্যাপারে বললেন তপন বাবু।

প্রতিবেশী জসীম সাহেব যদিও খুব বাচাল প্রকৃতির কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি এবং তার স্ত্রী খুব ভালো এবং নির্ভরযোগ্য। সমস্যা একটাই জসীম সাহেবের সাথে কোনো কথা শুরু করলে ওটা কখন শেষ হবে তার কোনো ঠিক থাকে না। এমন না যে তিনি এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে যান, সেটা হলেও চলত। কিন্তু না, তিনি একটি বিষয় নিয়েই লেগে থাকবেন, তপন বাবুর মাঝে মাঝে মনে হয় জসীম সাহেবের এ এক অনন্য দক্ষতা।

যেমন একবার জসীম সাহেব বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরছিলেন। তপন বাবুও একই সময় বাসায় ফিরছিলেন আর খেলেন ধরা জসীম সাহেবের কাছে। এরপর ঐ এক ইলিশ মাছ নিয়ে জসীম সাহেব টানা একটি ঘণ্টা কথা বলে গেলেন তাও রাস্তায় দাড়িয়ে। তপন বাবুর ধারণা ছোট বেলায় বাংলা রচনায় জসীম সাহেবের নম্বর কাটার সাধ্য কোনো শিক্ষকেরই কখনো হয়নি।

কিন্তু আজকের ব্যাপারটা জরুরী, যেহেতু তপন বাবুর এক সপ্তাহ থাকবেন না কাজেই এটা জসীম সাহেবকে জানানো দরকার। তাই তপন বাবু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে জসীম সাহেবের বাসায় যাবার জন্য বেরিয়ে পড়লেন।

*

"আজ এক বড় দুঃখের দিন, আজ আমরা যা হারাতে চলেছি তা দ্বিতীয় বার ফিরে পাবার নয়। আজ আমাদের অফিসের তপন বাবু অবসরে যাচ্ছেন যিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে সততা এবং নিষ্ঠার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা থেকে আমরা সবাই প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হই", তপন বাবুর ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তার বক্তব্য কখন যে শেষ হবে তা বোঝার কোনো উপায় নেই।

এদিকে তপন বাবু মনে মনে কথা বলে যাচ্ছেন, "ব্যাটা মানুষের টাকা চুরি করে আবার সততার কথা বলিস, এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও যে স্যুটটা পড়েছিস আর গলায় টাই নামক যে দড়িটা ঝুলিয়েছিস ওগুলো তো আমার মত লোকেদের টাকা মেরে দিয়েই কিনেছিস"

হঠাৎ তপন বাবু খেয়াল করলেন যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়াও আরো কিছু হর্তাকর্তা আছে, ওরাও নাকি বক্তব্য রাখবে, হায় হায় বলে কি! এদের কেউই যে মাইক হাতে পেলে ছাড়তে চায় না। তপন বাবু নিজেকে আশ্বস্ত করতে থাকলেন এই বলে যে আগামীকালই তো তপন বাবু পরিবার সহ সবাই মিলে বেড়াতে চলে যাবেন, কাজেই গৎবাঁধা বক্তব্য গুলোতে তেমন কর্ণপাত না করে আগামীকালের কথাই ভাবতে থাকলেন, শুধু প্রত্যেকের বক্তব্য শেষে ভদ্রতার খাতিরে হাততালিটা দিতে ভুললেন না।

একে একে সবার বক্তব্য যখন শেষ হলো, সবার কথার সারমর্ম থেকে তপন বাবু প্রথম বারের মত উপলব্ধি করলেন যে জীবিত মানুষকে সামনে রেখেও এমন বক্তব্য দেয়া যায়, ওগুলো কোনো সাধারণ বক্তৃতা ছিল না, মনে হচ্ছিল তপন বাবু মারা গেছেন আর তার অন্ত্যেষ্টি গাঁথা শোনানো হচ্ছে।

কেক কাটাকাটি, খাওয়া দাওয়া, কমপক্ষে একশো ছবি তোলা এই সব কিছুর পর তপন বাবু যখন তার সংবর্ধনা নিয়ে অফিস থেকে বের হলেন, তখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস তপন বাবুর এতক্ষণের বিরক্তি মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে গেলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আজ রিকশা নেবেন না, হেঁটেই বাসায় ফিরবেন, এতো সুন্দর আবহাওয়া তো আর রোজ রোজ থাকে না।

হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে তপন বাবুর মনটা হঠাৎ পেছনে ফিরে গেলো। তার চাকরি জীবনের শুরু, প্রমীলার সাথে বিয়ে, দীপন আর সুমিত্রার জন্ম আরো কত কি। নিজেকে বেশ সফল মনে হচ্ছিলো তপন বাবুর, তাছাড়া চারপাশের সুন্দর আবহাওয়াটাও তার মনকে বেশ প্রভাবিত করছিল। তপন বাবু গর্ববোধ করছিলেন যে পরিকল্পনামাফিক ভেবে চিন্তে সব কিছু করেছেন বলেই আজ তিনি সফল হয়েছেন।

তপন বাবু প্রায় বাসার গেটের কাছে পৌঁছে গেছেন এরই মধ্যে বেশ বড়সড় ঝড় আর রীতিমত বজ্রপাত শুরু হয়ে গেলো । তপন বাবু যখন বাসার গেটে পা রাখবেন ঠিক তখনই গেটের সাথে লাগোয়া ট্রান্সফরমাটাতে ভয়াবহ শব্দ করে একটা বজ্রপাত আঘাত হানলো।

মুহূর্তেই তপন বাবুর সদা পরিকল্পিত জীবনটা একটি অপরিকল্পিত সমাপ্তিতে মিলিয়ে গেল।

রত্নদীপ তূর্য


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।