নগরী ঢাকা - ০৯

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৪/০৪/২০২২ - ৩:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকার যানজট :
সম্প্রতি ঢাকার এক অংশের মেয়র বলেছেন, ‘রাজধানীর যানজট নিরসন এক দিনের বিষয় নয়। এ যানজট আমাদেরই সৃষ্টি। পরিকল্পনা ছাড়া প্রকল্পভিত্তিক কাজ করতে গিয়ে রাজধানীতে এই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি অন্যত্র আবার বলেছেন, ‘এখন বনানীর সামনে এসে বিশাল যানজটের মধ্যে আটকে থাকতে হয়। আমরা নিজেরাই সেখানে সেতু ভবন করেছি। এর পাশে আবার বিআরটিএ ভবনও করে ফেলেছি।’
ভদ্রলোক বারবার ‘আমরা’ শব্দটা ব’লছেন। এই ‘আমরা’ ব’লতে ঠিক কাদেরকে বুঝিয়েছেন সেটা কিন্তু আমি ঠিক বুঝিনি। পাঠকেরা কেউ বুঝলে আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন। আমি যতদূর জানি রাজধানীর যানজট কেউ একদিনে নিরসনের দাবিও করেনি। কারণ আমরা সবাই জানি ঢাকার যানজট চাইলে মুহূর্তেই নিরসন করা সম্ভব। একদিন শহরের সমস্ত স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট আর হাসপাতালগুলো বন্ধ রাখলেই সেদিনের জন্য রাস্তার যানজট নিরসন করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করলে তো আবার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী নাখোশ হবেন। যিনি মনে করেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে এবং ওনাদের সরকার আর এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে উপজেলায়ও ট্রাফিক জ্যাম হবে।
এদিকে আর একজনের চোখে বোধহয় সাবওয়ে পড়েছে। একবার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীর চোখে একটা শাড়ি পড়ায় ভানুর পকেট থেকে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে গিয়েছিলো। এখন আমাদের পকেট বা সরকারের তহবিল থেকে যে কত টাকা বেরিয়ে যাবে সেটাই দেখার বিষয়। তবে সেই সাবওয়ে যে উনি নিজ চোখে দেখে যেতে পারবেন তা মনে হয় না। কারণ আজ তার সম্ভাব্যতা-যাচায়ের কাজ শুরু করলেও সেই কাজ শেষ করতে অন্তত বছর কুড়ি লাগতেই পারে। ভুলে যাবেন না আমাদের বিখ্যাত আমলাদের কথা, যাদের হাতে নিশ্চিতভাবেই থাকবে সেই প্রকল্পের পরিচালনার দায়িত্বভার। ফলে নিশ্চিতভাবেই আশা করা যায় আরো অন্তত বছর কুড়ি ঢাকার যানজট কমার সম্ভবনা নেই।

ঢাকার বাইরের অবস্থা :
সিলেট, চট্টগ্রামের রাস্তার যানজটের খবরও ইদানিং জাতীয় দৈনিকে আসতে শুরু করেছে। আমাদের স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় তাতে উল্লসিত হ’তেই পারেন। জাজিরা, দৌলতদিয়া আর পাটুরিয়া ঘাটের যানজটের একটা সমাধান হয়তো হবে কিছু দিনের ভেতরেই, নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু চালুর কারণে। কিন্তু গাবতলী থেকে যে বাসগুলো ছেড়ে গিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে যানজট তৈরী করতো তারা তখন পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে যাবে কোন্ পথ দিয়ে তা আজও নিশ্চিত ক’রে বলা হয়নি। এখন যে লোকগুলোকে পাটুরিয়াঘাটে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তখন তাদেরকে হয়তো সেই সময়টা ব্যয় করতে হবে ঢাকার ভেতরের রাস্তায় যানজটে, কেরানিগঞ্জ যাওয়ার পথে। সেখানে নতুন কোনো বাসস্ট্যান্ড হচ্ছে কিনা তাও আমরা জানি না। যদি হয় সেটার কাজ কবে শুরু হবে বা কবে শেষ হবে সেই প্রশ্ন না হয় না-ই করলাম।

সাধারণ ভাবে নগরের যানজট:
পৃথিবীর সব বড় শহরেই যানজট দেখা যায়। প্রশ্নটা সবসময় যানজটের মাত্রা নিয়ে। আমরা যদি শহরের হাসপাতালগুলো এমন জায়গাতে নির্মাণ করি যার সামনের রাস্তাগুলোতে পিক-আওয়ারে যানজট লেগে থাকে তাহলে আমরা অনেক রুগীকেই বাঁচাতে পারবো না।
আমরা যদি আমাদের বাচ্চাদের স্কুলগুলো আমাদের থাকার জায়গা থেকে অনেক দূরে দূরে তৈরী করি তাহ’লে তাদের অনেকটা সময় রাস্তাতে থাকতেই হবে। আমরা যদি স্কুলের জন্য আলাদা ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা গড়ে না তুলতে পারি তবে তাদের বাবা-মায়েরা ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থা করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেনই।
ফলে শুধু রাস্তার পরিমাণ আর গাড়ির সংখ্যা দিয়ে যানজটকে বোঝা যায় না। তাকে নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। একটা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে সেই শহরের বেড়ে ওঠার ধরণ আর নাগরিক ইতিহাসের সম্পর্ক খুব নিবিড়। প্রশাসনিক শহর আর শিল্প-কারখানা নির্ভর শহরের যানজটের প্রকৃতি একরকম হয় না কখনো। যানজটের উপর শহরের গ্রোথ-রেট বা বড় হওয়ার প্রকৃতিও ব্যাপক প্রভাব থাকে। ফলে শুধু কিছু ফ্লাই-ওভার কিংবা আন্ডারপাস কিংবা মেট্রো বানিয়ে বর্ধনশীল একটা শহরের যানজটকে নিয়ন্ত্রনে আনা যায় না। শহর পরিকল্পনা একটি রাজনৈতিক বিষয় নয়। আবার এটাকে পুরোপুরি নগর পরিকল্পকদের হাতেও ছেড়ে দেওয়া যায় না।

যানজটের বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের রাস্তায় প্রায় কেউই নিয়ম মানে না। আমি এত বেশিবার ঢাকার রাস্তাতে বিচারকদের গাড়ি রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে যেতে দেখেছি যে এই ব্যাপারটাতে হতাশ না হ’য়ে পারিনি। ছেলে-মেয়েদেরকে স্কুলে দিতে আসার সময় প্রায় সব বাবা-মা রাস্তার নিয়ম ভাঙে। এই ছেলে-মেয়েগুলো একটু বড় হ’য়ে যখন তিতুমির কলেজ, বাংলা কলেজ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটে ভর্তি হয় ততদিনে তারা জেনে গেছে এখানে নিয়ম ভাঙাটাই প্রথম নিয়ম। বিচারপতির গাড়ি রাস্তার নিয়ম নামে না। পুলিশের গাড়ি রাস্তার নিয়ম মানে না। থানার সামনের রাস্তায় জমতে থাকে দুর্ঘটনায় পড়া গাড়ির স্তুপ। ছোট্ট একটা উদাহরণ ঢাকার আদাবর থানা। সেখানে দিনেদিনে একটু একটু ক’রে রাস্তা সরু হ’তে থাকে। রাস্তার জায়গা দখল করে বানানো হয় ধর্মীয় ভবন, পুলিশ বক্স। ফুটপাথগুলো সব হ’য়ে ওঠে মার্কেট।
শুনলে অবাক হবেন ঢাকার মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে টয়লেট আছে। আমাদের প্রকল্পগুলোর খরচ যে কেন বাড়তে থাকে তা বুঝতেই পারছেন। সেই টয়লেটগুলোর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আর প্রশ্ন করছি না এখানে।
যেখানে রাজধানীর পাসপোর্ট-অফিসে সেবাগ্রহীতাদের বসার জায়গাও থাকে না, সেখানে গাড়ি পার্কিঙের সুবিধা নেই কেন- সে প্রশ্ন করাটা বড্ড বেশি ছোট মুখে বড় কথা বলা হ’য়ে যাবে। আমাদের এলজিইডি ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে পরিমাণ গাড়ি ব্যবহার করেন তার পার্কিং ব্যবস্থা সেই ভবনে নেই। তারা তাই আশপাশের রাস্তা দখল করে সেখানে গাড়ি রাখেন। আমাদের রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান অফিসে গাড়ি নিয়ে গেলে সেখানে গাড়ি পার্কিঙের সুবিধা পাওয়া যায় না। জানি না আমাদের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ একটা ভবনের জন্য কতগুলো পার্কিং সুবিধা দরকার সেই হিসাব করতেও অক্ষম কিনা।
যে গুলশান এলাকা পরিকল্পনা করা হয়েছিলো আবাসিক এলাকা হিসেবে সেখানে দেদারসে বাণিজ্যিক ভবন তৈরীর অনুমতি দিলে সেখানকার রাস্তায় যানজট লাগবেই। তারউপর পরিকল্পনার শুরুতে সেখানকার ভবনের উচ্চতার একটা সীমাবদ্ধতা দেওয়া ছিলো। ২০০৮ সালে নিয়ম পাল্টে সেখানকার সব ভবনেরই উচ্চতা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। ফলাফল তো এতদিনে সবাই দেখছেন।

ঢাকার সড়ক নিয়ে পরিকল্পনা:
২০০৪/২০০৫ এ ঢাকার জন্য স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) করা হয়েছিলো। জাপানি টাকায়। জাপানি প্রতিষ্ঠান দিয়ে তাদেরই তদারকিতে। কিছুদিন যেতেই টের পাওয়া গেলো সেই প্ল্যান দিয়ে আর ঢাকার যানজটের সমাধান করা যাবে না। ২০১৫/১৬ তে গিয়ে তাদেরকে দিয়েই আবার এসটিপি রিভাইস করা হলো। ২০২১ এ এসে আবিস্কার করা গেলো যে আরএসটিপি দিয়েও আর হচ্ছে না। অথচ আরএসটিপি করা হ’য়েছিলো বিশ বছরের কথা মাথায় রেখে, অর্থাৎ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত। এখন এই রিভাইজড স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি) কে আপডেট করার জন্য টিওআর ছাড়া হ’য়েছে। সেটা যে আবার কত বছরের কথা মাথায় রেখে করা হবে কে জানে। অবশ্য আমাদের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কার মাথায় যে কি থাকে তা বোঝা শক্ত।
মেয়র সাহেব অন্তত একটা কথা ব’লে ফেলেছেন যে ঢাকাতে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করা হয়েছে গত প্রায় দেশ দশক। তিনি যেটা বলেননি তা হ’লো অনেকগুলো প্রকল্প করা হয়েছে যা এসটিপির সাথে সাংঘর্ষিক। আবার এসটিপি করার সময় ঢাকা বা দেশের যাতায়াত সম্পর্কিত যে সব প্রজেকশন করা হয়েছিলো তার প্রায় সবগুলোই পরবর্তীতে সঠিক হয়নি ব’লে টের পাওয়া গেছে। এরপরও যদি আমরা আমাদের শহর সম্পর্কিত পরিকল্পনাগুলো করার জন্য সেই সব প্রতিষ্ঠানের উপরই নির্ভর করি তবে তা নিয়ে আশাবাদি হওয়া কঠিন। খুবই কঠিন।

(রাজীব রহমান)
কোনো তথ্যের জন্যই কোনো লিংক দিলাম না সময়ের অভাবে। ব্যাপারগুলো যে কেউ চাইলেই অন-লাইনে যাচাই ক'রে নিতে পারেন। এসটিপি এবং আরএসটিপি সম্পর্কিত বিষয়গুলো অনলাইনে সহজেই পাওয়া যায়। আর কর্তাব্যক্তিদের কথাগুলো তো গত কয়েকদিনের প্রায় সব সংবাদপত্রেই এসেছে।


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ক্যাটেগরিতে যদি আপনার নাম দিয়ে রাখেন তাহলে সেখানে ক্লিক করলে আপনার সবগুলো লেখা একসাথে পাওয়া যেত। এখন একজন পাঠকের পক্ষে সিরিজটির সবগুলো পর্ব খুঁজে বের করে পরা কঠিন হয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ । কিন্তু আপনার অন্য লেখাগুলোর লিঙ্ক খুজে পাইনি । ধন্যবাদ ।

নাজমুছ ছাকিব

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা কতটা প্রযুক্তি নির্ভর হলাম? সপ্তাহে অন্তত ২ দিন যদি অনলাইনে অফিস আদালতের কার্যক্রম চালু করা হয় তাহলে অনেকটা যানজট কমবে!

-ইশতিয়াক আবীর

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।