শূন্য কড়চা ।। একটি কলকব্জা নিরপেক্ষ গল্প

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৭/২০০৭ - ২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

পুর্বপাঠের পুনরালোচনা:
ব্লগে গল্প লেখালেখির নতুন ধারার পৌষমাস শুরু হয়েছে । শুরু করেছেন মাননীয় ব্লগার শোহেইল মতাহির চৌধুরী । তিনি লিখছেন গল্প 'কলকব্জা সহ' । এর পরপর ই দেখলাম সম্মানিত ব্লগার সুমন রহমান আরেকটি গল্প পাঠের সুযোগ দিলেন পাঠককুলকে এবং ঘোষিত হলো ইহা 'কলকব্জা ছাড়া' গল্প ।

এ তো বড়ো রংগ যাদু!
অনলাইন ম্যাগাজিন বীক্ষণের আধিকারিক মহান কনফুসিয়াস এর অনুমতিক্রমে তাঁর কাগজে প্রকাশিত একটি গল্প এনে ছেড়ে দিলাম সচলায়তনে- এই সুযোগে ।

কোন কৌশলী পাঠক যদি এবার প্রশ্ন করেন- ইহা কোন পদের গল্প? আমি তবে বিনীত কন্ঠে জানাই ইহা 'কলকব্জা নিরপেক্ষ' জনাব । আপনি যদি মনে করেন ইহাতে উহা আছে,তাহলে আছে । যদি মনে করেন নাই ,তাহলে নাই ।

------------------------------------------------------------------------------------------------------

'দ্যাজ ইট্‌। তোর কোন প্রব্লেম নেই আসলে '
যেনো রায় ঘোষনা করলো অরুনা।
মেয়েটা আজকাল চশমা পড়ছে। আমি চোখ তুলে ওর চোখে চোখ রাখতে চাইলাম।
না! কেবল দৃষ্টি বিনিময়। ওর দৃষ্টিতে সবকিছু বোঝে ফেলার এক প্রবল আত্নবিশ্বাস।

আমি ঠোঁটের কোনে সেই বাঁকা হাসিটা ফোটাতে চাইলাম। বছর কয়েক আগে এই হাসি বিভ্রান্ত করতো কাউকে কাউকে। অরুনা কি ছিল তাদের একজন?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। রিলাক্স মুডে।

'আমার তাহলে কোনো প্রব্লেম নেই। দ্যাজ গুড-'
--' নো, দ্যাজ নো গুড। দ্যাজ দ্যা রিয়েল প্রব্লেম ইনফ্যাক্ট। ডাক্তার বলছে তুই মেন্টালি, ফিসিক্যালি একদম ফিট। বাট ইচ্ছে করে কিছু সমস্যা তৈরি করছিস। ভয়াবহ সব সমস্যা। কিন্তু তুই পাগল ও না, ড্রাগ এডিক্ট ও না'
অরুনার কপালে ভাঁজ। আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এ সস্‌ মাখাই।
বাইরে মৃত আলো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেঁস্তোরায় গুমোট সময়।

ওর হাত আমার হাত স্পর্শ করে। বন্ধুর হাত। একসময় পালকের মতো প্রীতিময় ছিলো। আজ কেনো জানি বেশ ভারী মনে হয়।
--'তোর মতো ছেলের এসব পাগলামী মানায়না। যা হবার হয়ে গেছে। ইউ হ্যাভ টু রিভাইভ। খালাম্মা ভীষন কষ্ট পাচ্ছেন।'
মেয়েটাকে এবার আমার অসহ্য লাগে।

এই মেয়েটা, আমি-আমরা ক'জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর গুলোতে বুনো হাঁসের পালকের মতো সন্নিহিত ছিলাম।
হায় পাখী উড়ে যায়! ছায়া যায়! এক সময় পড়ে থাকা পালক ও হারিয়ে যায়।
অরুনা ইংল্যান্ড গিয়েছিল এম.বি.এ করতে। ফিরে এসে মাষ্টারি করছে একটা বেসরকারি(বেদরকারি!) বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাঝে মাঝে হয়তো শরীর ফিরে আসে। সময় ফেরেনা কখনোই।
তবু বহুদিন পর আমি আর অরুনা আবার।

--' আমি লন্ডন থেকে ব্যাক করার আগে চৈতির বাসায় গিয়েছিলাম। জানিস তো মনে হয় ওর একটা ছেলে হয়েছে। কি ভীষন কিউট একটা ছেলে '
মেয়েটা আমাকে স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে। বেশ চালাক হয়ে গেছে দেখছি।
--' আচ্ছা চৈতির সাথে তোর সমস্যাটা কি হয়েছিল বলতো? এতো বছর প্রেম করে বিয়ে করলি অথচ বছর পেরোবার আগেই সেপারেশন! ও তবু আবার বিয়ে করলো, লন্ডন গেলো আর তুই? চাকরী বাকরী সব ছেড়ে দিলি। আমি ওকে ও জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিচ্ছু বললোনা। আর তুই তো আমার একটা মেইলের ও রিপ্লাই দিলিনা'
আমি মুরগির ভাজা ঠ্যাং এ কামড় দেই।
অরুনা আমার হাতে চিমটি কাটে
--'কিরে কথা বলিস্ না কেনো?'

আমার ইচ্ছে করেনা। না অরুনা, না অন্য কারো সাথে। আমার যত শব্দ বুনন এখন কেবলি নিজের সাথে।
'চৈতির সাথে সত্যি কি কোনো সমস্যা হয়েছিলো আমার? ও তো ভীষন ভালো একটা মেয়ে । বিছানায় এবং ভালোবাসায়। তবু কেনো যে একদিন আমার মনে হলো-- এই তবে ঘর সংসার,বিয়ে ভালোবাসা! কেমন একঘেঁয়ে অর্থহীন সম্পর্কের জটিলতা। অপ্রয়োজনীয় সন্তান উৎপাদন। পৃথিবীর প্রতিটি নারী-পুরুষ তো আর কবিতা লেখেনা, মাঝরাতে বাঁধ ভেংগে গেলে সবাই তো আর প্রতিরোধে আসেনা, প্রত্যেকে তো আর ভালোবেসে জল ঢালেনা বৃক্ষের শিকড়ে। তাহলে প্রতিটি নারী-পুরুষের কি প্রয়োজন জনক জননী হবার?'

আমার নৈঃশব্দে অরুনা বিরক্ত হয়। অরুনা বেদনার্ত হয় আমার জন্য। অরুনা উপহাস করে আমাকে
--'তুই যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকিস কারো সাথে কিছু শেয়ার করবিনা, এ রকম মৌন হয়ে থাকবি তাহলে পাহাড় জংগলে চলে যা। গৌতম বুদ্ধ হয়ে বসে বসে ধ্যান করগে, যা '

হা হা হা। আমার হাসি পায়। অরুনার বিরক্তিতে আমার ভীষন হাসি পায়। হাসতে হাসতে আমি আমার নৈঃশব্দের ভাষায় ওকে বলি-
' অরুনারে কতো বুদ্ধ, কতো মুহম্মদ, কতো যীশু এলেন গেলেন। সমুহ বিপন্নতা থেকে তবু মানুষের পরিত্রান হলো কই? কতো দর্শন, কতো ধর্ম, কতো তন্ত্র! তবু হত্যা, তবু ধবংস তবু হাহাকার।'

রেঁস্তোরা ফাঁকা ছিলো এতক্ষন। হইহই করে এসে ঢুকলো একদল রংগিন ছেলে মেয়ে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো অনেকটুকু জায়গা নিয়ে। এরা বেঁচে আছে এখনো। আছে অর্থহীন বন্ধুতা ও ভালোবাসায়। আছে ক্লান্তিকর প্রেমে ও যৌনতায়।

আমি তবু ঝরাপাতার কান্না শুনি। যেনো হাঁটছি এক বিশাল শালবনের ভেতর দিয়ে। চরাচরে গভীর শুন্যতা। প্রান্তর জুড়ে অগনন ঝরা পাতা। ঝরছে আরো অবিরাম। আমি ইতঃস্তত হাঁটছি। পায়ের নীচে পাতা ভাঙছে।
স্মৃতি কাঁদছে। আমি ভাবলেশহীন।
কফির ধোঁয়া উড়ছে।

মুখোমুখি গন্তব্যহীন আমি ও অরুনা।


মন্তব্য

ফারুক হাসান এর ছবি

পড়তে উমাদেয় হইছে।
কলকব্জা বিষয়ে,
শুরুতে কলকব্জা থাকার যে একটা অমিত সম্ভাবনার উঁকি ছিল, উহারা পরে ঝুঁকি নিয়া আর সামনে খাড়ায় নাই। এটা কি লেখকের সচেতনভাবে ডিজিটাল ঘড়ি উতপাদনের ইচ্ছায়, না কি পাঠককূলকে যা বুঝার বুইঝা নেও জাতীয় রেললাইনে তুইলা দেওনের চেষ্ঠায়, তা বোধগম্য নয়।

লেখক বোধকরি কলকব্জায় নিরাসক্ত কিংবা যন্ত্রে কিছুটা অবিশ্বাসী।

তবে গল্পের শিরোনামে আর উপক্রমণিকাতে লেখকের বক্তব্যে তার দুই নৌকা থিউরীতে বিশ্বাস স্থাপনের লক্ষণ বিশেষ সুবিধার মনে হইতেছে না।

--------------------------
জানেনিতো, ইহা নিতান্তই নিজস্ব মতামত

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ইহা দুই নৌকা ও হইতে পারে আবার নৌকাবিহীন ও হইতে পারে চোখ টিপি

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুমন চৌধুরী এর ছবি

অরুণার কথা আরেক্টু ডিটেলসে দেন..চোখ টিপি
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

অরূপ এর ছবি

এইবার একটা "গরম ভাতে ঘি" টাইপের গল্প দর্কার
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

অপালা এর ছবি

সুমন আর কি জানতে চাও?!!!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

অরূপ কি জানি কয়?
দেখেন আপনার পুরানা বান্ধবী কাউরে গল্প বলতে ডাকবেন নাকি?
ডাকলে ডাকেন। শুনতে ভালোই লাগে।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এমন 'কলকব্জা নিরপেক্ষ' গল্প কিছু কিছু পাঠকের ভেতরের কলকব্জা নাড়িয়ে যায়। এটা সুপ্রিয় হাসান মোরশেদ পারেন বরাবরই। বাই দ্য ওয়ে, 'তক্ষক'এর কমেন্টে একটা আব্দার করেছিলাম!
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

নজমুল আলবাব এর ছবি

পাঠ করা হইয়াছে।

তারেক এর ছবি

ভাল লেগেছে। হাসি
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

??? এর ছবি

পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির নরম পালক
কঠিন মাটিতে পড়ে থাকা ঠিক নয়
এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলে....

--- মনে পড়ল কেন??

(হা হা হা ... ফান করলাম হাসান মোরশেদ। গল্প ভাল্লাগছে)

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দেরি হলো পড়তে। ভালো লাগা নিয়েও বলি, কেন যেন অসম্পূর্ণ লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

লোকজন তো দেখি খালি ডিটেইলস জানতে চায় । সব কওনে যে গুরুর মানা আছে হাসি

মনে পড়লো নাকি মনে পড়াইলেন?@সুমন রহমান চোখ টিপি (হাহাহা ফান অবশ্যই)

পাঠক ইশ্বরে অসীম ভরসা,তিনিই সম্পুর্ণ করে নেবেন তাঁর মতো @জুবায়ের ভাই
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ঝরাপাতা এর ছবি

গল্পের শেষ প্যারার জন্য আমার হাজির হওয়া আবশ্যক যদিও লেট করায় দেরী হয়ে গেলো হাসি
গল্পের জন্য দিলাম জাঝা.


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।