অরুন্ধতী পাঠ-০১ ।। 'দশ বছর পর... '

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ২৪/০৬/২০০৮ - ৬:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

.

'Shape of the Beast' তার ২১টি সাক্ষাৎকারের সংকলন ।
সব শেষেরটি মার্চ ২০০৮ এ নিয়েছেন সোমা চৌধুরী,যিনি তেহেলকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং সম্পাদক ও বটে ।
বাকী ২০টি সাক্ষাৎকার নানা ইস্যুকে ঘিরে তার স্পষ্ট উচ্চারন । কিন্তু শেষেরটি একেবারেই ব্যক্তি অরুন্ধতিকে নিয়ে , সে কারনেই যেনো কিছুটা অন্তর্মুখী
বেশীর ভাগ প্রশ্নই করা হয়েছে দশ বছর আগে 'দ্যা গড অফ স্মল থিংকস' এর জন্য পাওয়া বুকার পুরস্কার,পুরস্কারের অনুভূতি,মুল্যায়ন, পুরস্কার পাওয়ার পর ফিকশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে পুরোদমে একটিভিষ্ট হয়ে পড়া, পরবর্তী ফিকশন লেখার সম্ভাবনা- এইসব নিয়ে ।



সোমা চৌধুরী এক প্রশ্নে জানতে চান
বুকার জয় তার জন্য কতোটকু জরুরী অর্জন? এই অর্জন তাকে কতোটুকু প্রভাবিত করেছে?

অরুন্ধতী জবাবে বলেনঃ-

'
।চারদিক যখন অভিনন্দন ও হাততালিতে ফেটে পড়ছে তখনো আমি বিব্রত ছিলাম,আমার দ্বিধা ছিলো । পুরস্কারের জন্য আমি নিজ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাইনি ।

তুমি জানো - আমি কোন থিতু পরিবার থেকে আসিনি । আমার কোন স্থিরতা ছিলোনা । যে সব সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল তার বেশীরভাগেই আমি নিজেকে বাধ্য করেছি । ছন্নছাড়া,উদ্দেশহীন ছিলাম । এর মধ্যেই হঠাৎ করে এইসব সাফল্য,পুরস্কার,মিডিয়া-এগুলো আমার উপর বোঝা হয়ে চেপে বসল এবং সমস্ত হিসেব নিকেশ পালটে দিল ।

দেখা গেলো আমি যা বলতে চাই,যা বলছিলাম ভারতের পারমানবিক বিস্ফোরনের প্রতিবাদে , সবকিছু প্রভাবিত হতে লাগলো কেননা তখন আমার পৃথিবীই বদলে গেছে,আমার চেনা চারপাশ খুব দ্রুত ভয়ংকর রকম ঘুরপাক খাচ্ছে ।
একদিন স্বপ্নে দেখলাম প্রবল ঘূর্নির মধ্যে একটা হাত আমাকে অনেক উপরে তুলে ধরে বলছে-‘বলো তুমি কি চাও?’ আর আমি মিনতি করে বলছি-দয়া করে আমাকে ছেড়ে দাও,আমি কিচ্ছু চাইনা’

এসব কিছু শুধু আমার উপর নয়, আমার শিল্প সাহিত্যের বন্ধুদের উপর ও চাপ সৃষ্টি করছিল অথচ এরা আমার অনেক পুরনো,অনেক বেছে নেয়া কাছের মানুষজন । আমাকে বন্ধুকের গুলীর মতো তীব্র গতিতে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল কিন্তু আমি আমার নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পেরেছি ।
আমি কোনদিনই লসএঞ্জেলস এ থাকার স্বপ্ন দেখিনি ।

ঠিক একই সাথে বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্কের একটা নতুন জগত সৃষ্টি হয়ে গেলো ।অনেক মানুষের সাথে নতুন করে পরিচয়, মত বিনিময় । এর মধ্য থেকে প্রকৃত মানুষজন বেঁচে নেয়া-সবমিলিয়ে নিজের সাথে হিসেবনিকেশটা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ালো । এর মাঝে যদি তোমার নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন থাকে তাহলে সমস্যাটা আরো বেশী । অন্যদের পছন্দের মত করে তুমি নিজেকে প্রদর্শন করতে পারোনা ।

আর একজন লেখক হিসেবে জটিলতা আমার জন্য আরো তীব্র ছিলো ।

তুমি ভাবো, একজন লেখক কি করেন? প্রথমে নিজের মধ্যে ডুব দেন,নিজের ভাবনাকে শানিত করেন,যতোটুকু সম্ভব স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র করে তোলেন । তারপর চারদিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখেন-অন্য সব মানুষের মধ্যে কি ঘটছে?
লেখক নিজেকে ঐ সহস্র মানুষের মধ্যে খোঁজে পান । তিনি যা ভাবছেন,মানুষ তাই উচ্চারন করছে । তখন লেখকের ভাবনার জগত আর তার নিজস্ব নেই । এখন এই দুটো বিষয়-তোমার নিজস্ব নির্জনতা এবং সহস্র মানুষ, দুটোকে তুমি একই সাথে কিভাবে ধারন করবে? এটি একেবারেই মৌলিক একটা প্রশ্ন ।

সে কারনেই অনেক লেখক রাজনীতিকে এড়িয়ে যান । সহস্রের উচ্চারনকে ধারন করার ঝুঁকি তারা নিতে চাননা, সন্দেহ নেই একজন আত্নমগ্ন(লেখকমাত্রই কি নয়?) লেখকের জন্য এটা বড় ঝুঁকি অবশ্যই এবং আমি সেই ঝুঁকি নিয়েছি ।

কিন্তু কখনো কখনো এটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কারন চারদিকে প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু ঘটছে, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমাকে আরেকটু বেশী করে দায়িত্ব নেবার সাহস করতে হবে ।

যেমন ভারতীয় সংসদে আক্রমন বিষয়ে লেখা শুরু করার আগে নিজের সাথে আমার দীর্ঘযুদ্ধ করতে হয়েছে । শতবার আমার নিজের কাছেই বাধা পেয়েছি-দরকার নেই এটা, বরং অন্য কিছু নিয়ে লিখি ।
কিন্তু টেলিভিশন ও পত্রিকাগুলোতে যখন একতরফা সংবাদ দেখেছি, সাধারন মানুষের কথা শুনেছি-জমজমাট আলোচনা চলছে অভিযুক্ত মোহাম্মদ আফজালকে কোন দড়িতে ঝুলানো হবে,সেই দড়ি কোথাকার বানানো,কতোটুকু শক্ত ইত্যাদি, তখন আমার তীব্র বিবমিষা জেগেছে । কারন আমি জেনেছি এই সব মিথ্যে আসলে,এই মামলা পুরোটাই সাজানো হয়েছে অন্য কিছু আড়াল করার জন্য । আমার মনে হয়েছে-তারা যদি সত্যি সত্যিই এই নিরীহ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলায়, এবং তারা ঝুলাবেই- তাহলে আমি নিজের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকবো ।

জন বার্গার/ বার্জারএকবার আমাকে বলেছিলো-আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে ক্রমশঃ আরো বেশী করে অন্ধকার গ্রাস করছে কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যে ও দানবের হাত থেকে বাঁচার পথ খুঁজে নিতে হবে ।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি পারিনি । এটা আমার জন্য বড় সংকট । অনেক,অনেক বড় সংকট । আমি জানি এসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে হয়,কার্যকরী হস্তক্ষেপ । তারপর লেগে থাকতে হয় শেষপর্যন্ত ।

কিন্তু আমি হেরে গিয়েছিলাম ।
'


মন্তব্য

s-s এর ছবি

দুর্দান্ত এই জায়গাটা -
লেখকের ভাবনার জগত আর তার নিজস্ব নেই । এখন এই দুটো বিষয়-তোমার নিজস্ব নির্জনতা এবং সহস্র মানুষ, দুটোকে তুমি একই সাথে কিভাবে ধারন করবে?
কিন্তু , খুব দ্রুত শেষ করে দিলেন, তৃষ্ণা রয়েই গ্যালো -

===========================
জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

শেষ হয়ে গেল??

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

থিতু শব্দটা লাগসই হয়েছে

---------------------------------------------------------
আমাকে ডাকে আকাশ, বোঝে মাটি হাওয়া জল
বোঝে না মানুষ আর বিনাশী মুদ্রার ছল

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

কনফুসিয়াস এর ছবি

হাসান ভাই অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অরুন্ধতীর কথা ও কাজের বিরাট ফ্যান আমি। সাক্ষাৎকারগুলো আপনার অনুবাদে পড়তে পাবো জেনেও ভাল লাগছে!

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ হাসান মোরশেদ ।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা সকলে আর সকলেরই জ্ঞাতার্থেঃ-
এটি কিন্তু পুরো সাক্ষাৎকার নয় । এক একটি সাক্ষাৎকার বেশ দীর্ঘ,অনেক বিষয় নিয়ে আলাপচারীতা । সবটুকু অনুবাদ বেশ সময় ও সাধনা সাপেক্ষ

আমি কেবল পড়তে গিয়ে চুম্বক অংশটুকু নিজের ব্লগে লিখে রাখছি ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

অরূন্ধতি, প্রিয় অরুন্ধতি, ক্ষমতার মুখের ওপর সত্য বলা অরূন্ধতিকে পুনঃ পুনঃ অভিবাদন।

অনুবাদটা চালিয়ে যান মোর্শেদ। ভাষাটা স্বাদু ও যথাযথ হয়েছে।
আর জন বার্গার বার্জার হবে মনে হয়।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জন বার্গার/ বার্জার সাহেবকে লিংকায়িত করে দিলাম ।
এই সিরিজে একটু চোখ রাইখেন ।
-------------------------------------
বালক জেনেছে কতোটা পথ গেলে ফেরার পথ নেই,
-ছিলো না কোন কালে;

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চোখ তো এই সিরিজেই রাখতে হবে। লোভ তো এদিকেই গড়ায়। অসংখ্য ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য। যা দেন তাই লুটেপুটে খাই।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আরিফ জেবতিক এর ছবি

-দীর্ঘ রচনা না হোক , ভালোলাগার টুকটাক টুকে গেলেই চলে ।----------------------------
কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।

গৌতম এর ছবি

বাংলায় অনূদিত অরুন্ধতী রায়ের দ্য গড অব স্মল থিংস পড়া শুরু করেছি মোট ৬ বার। কোনো বারই অর্ধেক পর্যন্ত যেতে পারি নি। প্রমিত হোসেনের অনুবাদ আমার কাছে এতো দুর্বোধ্য লাগে! আবার শুরু করতে হবে। মনে করতে হবে, আমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে যে, এই বইটি পড়তে হবে। আমার অপরাধ- এর আগে ৬ বার পড়ার চেষ্টা করেছি।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

কিঙ্কর আহসান এর ছবি

উজ্জ্বল হোসেনের অনুবাদটা মোটামুটি ভালো লাগছে হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।