।। দ্যা আউটসাইডার ।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৭/২০০৯ - ৩:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব


..
তিন
দুই
এক


আজ সারাদিন অফিসে অনেক কাজ করলাম। বস খুশী। একবার এসে জিজ্ঞেস করলো আমি ক্লান্ত কিনা, আরেকবার মায়ের বয়স জানতে চাইলো। বললাম- প্রায় ষাট। ভারমুক্ত মনে হলো তাকে, মায়ের মৃত্যুর প্রসংগটি ফুরোলো।

টেবিলজুড়ে ফাইলের পাহাড়, তার ভেতরে অসংখ্য বিল, অগণন হিসেব-নিকেশ। একটানা সব দেখে শেষ করলাম। তারপর দুপুরের বিরতিতে বের হবার আগে হাত ধুয়ে পরিস্কার করলাম। মধ্যাহ্ণ বিরতিতেই আমি হাত ধুয়ে মুছে ফেলি। সন্ধ্যেবেলা আর হাত মুছিনা। একটামাত্র তোয়ালে অফিসের বাথরুমে। সন্ধ্যেবেলা ভিজে চুপচুপে হয়ে থাকে অতোগুলো লোকের হাতের ময়লায়। একবার বসকে এ বিষয়ে বলেছিলাম। উত্তরে বলেছিলো- এটা তেমন বড় কোন বিষয় নয়।

একটু দেরীতে, সাড়ে বারোটার দিকে ইমানুয়েলের সাথে বের হলাম। ও অন্য সেকশনে কাজ করে।অফিসের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়, আমরা কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল রোদের মধ্যে সমুদ্র ভাসমান নৌকা দেখলাম।
একটা লরী এলো ধুলি উড়িয়ে। ইমানুয়েল বললো- চলো যাই
আমরা দৌড়ালাম। লরীটা আমাদের না পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছে অফিসের গেট পেরিয়ে, ধুলো উড়ছে প্রবল, মাথার উপর কড়কড়ে রোদ। আমি দৌড়াচ্ছি, লরীটাকে ধরবো বলে এবং… লরীর হাতল আমি আঁকড়ে ধরলাম। হাত বাড়িয়ে ইমানুয়েলকে ও টেনে তুললাম।

পরিচিত রেষ্টুরেন্ট এ গিয়ে যখন ঢুকেছি তখন আমরা দুজনই ধুলোয় ধুসর, ঘামে স্যাঁতসেতে। রেঁস্তোরার মালিক জানতে চাইলো আমি ঠিক আছি তো?। পেট ভর্তি ভীষন ক্ষুধা- এ ছাড়া ঠিক আছি, আমি ঠিকই আছি- কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানান দিলাম। খুব দ্রুত খেয়ে নিলাম।
বাড়ি ফিরে একটা হাল্কা ঘুম। ঘুম ভাঙ্গার পর ক্লান্ত লাগছিলো, কিন্তু আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে। দ্রুত বের হয়ে ট্রাম ধরলাম।

অফিস শেষে সন্ধ্যার দিকে সাগর পাড়ে হাঁটলাম কিছুক্ষন। ঘননীল আকাশ তখন, মৃদু বাতাস । ভালো লাগছিলো।
সূর্য ডোবার পর ঘরে ফিরে এলাম। কিছু আলু সেদ্ধ করবো রাতের খাবারের জন্য।

সিঁড়িতে দেখা হলো বুড়ো সলোমনের সাথে, সাথে তার বিমর্ষ কুকুর। গত চার বছর সলোমন আর তার স্পেনিয়াল একসাথে আছে। কুকুরটার চর্মরোগ- শরীরের সব লোম ঝরে গেছে, লাল খসখসে চামড়া দেখা যায়। একসাথে দীর্ঘবাসের কারনেই হয়তো এরা দুজন পরস্পরের কিছু বৈশিষ্ট বিনিময় করেছে। বুড়ো সলোমনের ও মাথার প্রায় সব চুল ঝরে গেছে, তার চামড়া ও কেমনে খসখসে লালচে হয়ে উঠছে আর স্পেনিয়ালটা ও তার প্রভূর মতো কপাল কুঁচকে ঘাড় বাড়িয়ে চলতে শিখেছে।

যেনো দুজনই দুজনের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অথচ তারা পরস্পরকে ঘৃণা করে। দিনে দুবার সলোমন কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়। ঠিক একই পথে তারা হাঁটে, হাঁটছে গত আটবছর ধরে। কোন বদল নেই, কোন বৈচিত্র নেই। শুরুতে কুকুরটা সামনে থেকে সলোমনকে টেনে নিয়ে যায় যতোক্ষন না বুড়ো হোঁচট খেয়ে থেমে না যায়। হোঁচটের পর পরই শুরু হয় তার গালাগালি আর স্পেনিয়ালটাকে পিটানো। তীব্র পিটুনিতে কুকুরটা আর্তনাদ করতে করতে পেছনে ছুটতে থাকে আর বুড়ো তখন শুরু করে সামনে থেকে টানা।
কিছুক্ষন পর কুকুরটা ব্যথা ভুলে যখনই প্রভূর পাশাপাশি হাঁটা শুরু করে তখনই আবার শুরু হয় গালাগালি আর পিটুনি। এইভাবে চলতে চলতে একসময় রাস্তার পাশে ফুটপাথের উপর তারা দুজনেই থামে। কুকুরটা ত্রাসে আর প্রভূ তার ঘৃণায়।

এইভাবে প্রতিদিন। কুকুরটা মুত্রত্যাগ করতে চাইলে সলোমন না থেমে টানতে টানতে নিয়ে যায় ঘরে দিকে, রাস্তার উপর পড়ে থাকে মুত্রের ভেজা দাগ। ঘরের ভেতর কখনো সে ত্যাগ করলেই শুরু হয় আবার পিটুনি আর গালিগালাজ। এইভাবেই গত আটবছর।

সিঁড়ির মুখে যখন সলোমনের সাথে দেখা, তখন সে স্পেনিয়ালটাকে শাপ-শাপান্ত করছে ‘নোংরা জঘন্য জানোয়ার’, আর স্পেনিয়ালটা শুধু কুঁইকুঁই করছে। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম ‘শুভ সন্ধ্যা’ কিন্তু উদ্ভট বুড়ো প্রতিউত্তর না দিয়ে বিড়বিড় করতে থাকলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কুকুরটা কি করেছে। এর ও কোন উত্তর না দিয়ে সে বলতে থাকলো ‘নোংরা জঘন্য জানোয়ার’। তারপর কুকুরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো ঘরের ভেতর।

এরপর আমার আরেক প্রতিবেশী বেরিয়ে এলো। লোকজন তাকে বেশ্যার দালাল বলে জানে। অবশ্য জিজ্ঞেস করলে বলে কোন এক গুদামে নাকি কাজ করে। প্রায় কেউই তাকে পছন্দ করেনা অথচ আমার সাথে যেচে যেচে কথা বলে।আপত্তি করিনা। নানান বিষয় নিয়ে কথা বলে। শুনি, শুনতে আমার ভালোই লাগে।
তার নাম রেমন্ড। কিছুটা খাটো, পেটানো শরীর, মুষ্ঠিযোদ্ধাদের মতো। পোষাক-আশাকে সবসময় ফিটফাট। বুড়ো সলোমন আর তার কুকুর রেমন্ডের দু চোখের বিষ। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো- ‘এই জঘন্য বুড়ো আর নোংরা কুকুর তোমার অসহ্য লাগেনা?’ আমি বলেছিলাম- ‘না’

আমি আর সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এলাম। শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেবো এমন সময় রেমন্ড তার ঘরে গিয়ে পুডিং আর কফি খাওয়ার আমন্ত্রন জানালো। ভাবলাম রাতের রান্নার ঝামেলাটা মিটলো।
ছোট্ট ঘর । কোন জানালা নেই।বিছানা বালিশ এলোমেলো।দেয়ালে সিনেমার নায়িকাদের অর্ধ-নগ্ন ছবি সাঁটা। এই প্রথম খেয়াল করলাম রেমন্ডের হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। জানতে চাইলো বললো কার সাথে যেনো মারামারি করেছে।
একটু থেমে নিজ থেকেই বলতো লাগলো- ‘আমার কোন দোষ নেই জানো। ছেলেটা আমাকে ট্রাম থেকে নামতে বললো। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলাম।কিন্তু সে আমাকে কাপুরুষ বলে গালি দিলো।তারপর আমি নামলাম ট্রাম থেকে। সে ও নামলো। বললাম-বাদ দাও এবার।তবু সে আঘাত করতে চাইলো, তখন আমি এক ঘুষিতে শোইয়ে দিলাম। যখনই আবার হাত বাড়ালাম টেনে তুলতে তখন আবার আঘাত করলো, আমি ও করলাম, তার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেলো। কি করবো বলো, আমি তো ঝামেলা করতে চাইনি।‘

এরপর আর কোন কথা না বলে সে টেবিলে ছুরি চামচ প্লেট পুডিং এবং দুই বোতল ওয়াইন এনে রাখলো। টেবিলে বসতে বসতে বললো আমাকে সে বন্ধু ভাবে এবং বন্ধু ভেবেই একটা ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে চায়। রেমন্ড আবার জিজ্ঞেস করলো আমি তাকে বন্ধু ভাবি কিনা? বললাম- হয়তো
এতেই তাকে বেশ সন্তুষ্ট দেখালো। তারপর স্বভাবসুলভ নাটকীয় ভঙ্গীমায় একটি মেয়ের কথা জানালো। মেয়েটা তার রক্ষিতা।এবং মেয়েটির ভাইয়ের সাথেই তার মারামারি হয়েছে। আমি কিছুই বললামনা। সে আবার তড়িঘড়ি করে বললো- ‘জানি লোকজন পেছনে আমাকে নিয়ে কি কথা বলে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি গুদামরক্ষকের কাজই করি’

তারপর সে আবার তার গল্প শুরু করলো। মেয়েটাকে কিছুদিন ধরেই সে সন্দেহ করছিলো। সে তার ঘরের ভাড়া ছাড়া ও খাবার খরচ হিসেবে প্রতিদিন বিশ ফ্রাঁ দেয়। প্রায়ই পোশাক আশাক ,এটা সেটা কিনে দেয়। রেমন্ডের সাথে শোয়া ছাড়া সে আর কোন কাজ করেনা অথচ খরচের হাত প্রশস্ত। বন্ধুদের নিয়ে দামী রেঁস্তোরায় আড্ডা দেয়, লটারীর টিকেট , গহনা কিনে -সবই রেমণ্ডের টাকায়। এতো খরচ নিয়ে অনেকবার সতর্ক করে দেয়ার পর ও তার কোন ভ্রু-ক্ষেপ নেই। এইসব নিয়ে খিটমিট লেগেই ছিলো। কয়দিন আগে দরজা বন্ধ করে রেমন্ড তাকে আচ্ছা মতো পিটিয়েছে।
এই পিটুনির প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই সে তার ভাইকে পাঠিয়েছিলো।

রেমন্ড বলে চলে- মেয়েটার উপর সে আরো কড়া প্রতিশোধ নিতে চায়, তাকে চরম শিক্ষা দিতে চায়। একবার পরিকল্পনা করেছিলো কোন হোটেল ঘরে তাকে নিয়ে তুলবে, আগেই পুলিশকে খবর দেয়া থাকবে। পুলিশ এসে খদ্দের সহ পতিতা গ্রেপ্তার করবে। পরে মনে হলো-নাহ শিক্ষাটা আরো জুতসই হতে হবে।
‘একটা নতুন পরিকল্পনা করছি’- রেমণ্ড বলতে থাকে- ‘ভাবছি ইনিয়ে বিনিয়ে ক্ষমা চেয়ে মেয়েছেলেটাকে একটা চিঠি দেবো। চিঠি পেয়ে যেনো সে গলে যায়।আবার আমার কাছে ছুটে আসে। তারপর যখন সে আমার সাথে শুবে, উত্তেজনার চরমে পৌঁছে যাবে, চোখ বন্ধ করে কাতরাতে থাকবে তখন তার মুখে আমি একদলা থুথু নিক্ষেপ করবো’

একটানে পরিকল্পনা পেশ করে সে আমার মতামত জানতে চায়। বললাম- ভালোই
এবার সে আমার আরো কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো- এই কাজে তোমার সহযোগীতা লাগবে। আমি চিঠি-ফিটি লিখতে জানিনা। তুমি চিঠি লিখে দাও।

আমার ওয়াইনের বোতল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সিগারেট নেই। রেমন্ডের দেয়া সিগারেট টানতে টানতে বললাম- দেবো লিখে ।
ও উঠে দাঁড়ালো, ঘরের আরেক প্রান্ত থেকে কাগজ আর কলম এনে হাতে ধরিয়ে দিলো- ‘এখনই লিখে ফেলো, প্রতিশোধ নিতে হয় দ্রুত ‘

মেয়েটার নাম জেনে বুঝলাম সে আরব, মুসলমান। না দেখে মেয়ে- চিঠি লিখলাম আমি। ইতস্ততঃ, অগোছালো, যাচ্ছেতাই। পড়ে শুনালাম। রেমণ্ড খুশীতে লাফিয়ে উঠলো। ওয়াইনের গ্লাস শেষ করতে করতে বললো আবার পড়ার জন্য। পড়লাম। তারপর আবার।
আনন্দে সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো- ‘আমি জানতাম তোমাকে দিয়েই হবে, এখন থেকে তুমি আমার সত্যিকারের বন্ধু।‘ ওর উল্লাস আমাকে স্পর্শ করেনা। বলি- ‘অনেক রাত হয়ে গেছে। ‘ । সে মাথা ঝাঁকায়।

ওয়াইনের বোতল উপুড় করে আমি উঠে দাঁড়াতে চাই কিন্তু চারপাশ টলে উঠে। রেমন্ড আমার হাত ধরে। মায়ের মৃত্যুর সংবাদে শোক প্রকাশ করে বলে- এ এমন এক অভিজ্ঞতা যা সবাইকেই পেতে হয় দুদিন আগে কিংবা পরে।

আমি বের হয়ে আসি। সে শেষ বারের মতো আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলে- ‘দ্যাখো একজন পুরুষই কেবল আরেকজন পুরুষের দুঃখ বুঝতে পারে’

রেমণ্ডকে পিছনে ফেলে করিডোরে অন্ধকারে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষন। দেয়াল বেয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে স্পর্শ করে আমাকে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। দুপাশের দেয়ালে ভর করে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। বুড়ো সলোমনের নোংরা কুকুরটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।


মন্তব্য

দময়ন্তী এর ছবি

পড়ছি ....................
--------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

ব্যস্ত আর নষ্ট সময়েরই ঘোরে আছি কেমন একটা!
তাই আধাখ্যাঁচড়া ক'রে পড়ার জন্য এখন পড়ছি না এটা।
সবটা এসে সারুক। এক টানে প'ড়ে ফেলবো বইয়ের মতোই।
এটা এমনিতে আমার জন্য সর্ট অব প্রেসক্রাইব্ড ছিল এক সুহৃদের দ্বারা।
এমন কাজের একটা ভালো পোস্টের জন্য অগ্রিম সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানায়া রাখলাম মোরশেদ ভাই। হাসি ভালো থাকেন।
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জাহেদ সরওয়ার এর ছবি

পড়ছি।

*********************************************
আমার আত্মা বোমায় দু'হাত উড়ে যাওয়া কোনো আফগান শিশুকন্যা।

*********************************************

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।