চাঁদমারীতে যখন বাঙ্গালীত্ব

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বুধ, ০২/০৩/২০১১ - ১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

একটা ছোট্ট,পুরনো সংবাদ
২০০৫ সালের জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ।যুক্তরাজ্যের উইটশায়ারের কোন এক জায়গায় একটি জন্মদিনের পার্টি।পার্টির থিম পোষাক ‘কলোনিয়াল এন্ড নেটিভ’।বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে হাজির হলেন কনিষ্ঠ রাজপুত্র হ্যারি- জার্মান ‘ডেসার্ট’ পোশাক পড়ে,বাহুতে আটকানো নাৎসী স্বস্তিকা চিহ্ণ।
পরদিন পত্রিকায় জন্মদিন পার্টির ছবি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে গোটা যুক্তরাজ্য জুড়ে শুরু হলো তুমুল হৈচৈ, নিন্দা জ্ঞাপন, ক্ষমা প্রার্থনার দাবী। ২০ বছরের তরুন হ্যারি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করলেন জনগনের কাছে।
ঘটনাটিকে বৃটিশরা এক সদ্য তরুনের অনিচ্ছাকৃত খামখেয়ালী হিসেবে মেনে নেয়নি কারন এই চিহ্নের সাথে জড়িয়ে আছে গনহত্যার দুঃসহ বেদনা, জাতি হিসেবে তাদের টিকে থাকার যুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি। এই স্বস্তিকাচিহ্নবাহীদের যদি শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করা না যেতো তাহলে কোন পরিনতি তাদের নির্ধারিত ছিলো সেটি বিস্মৃত হয়নি বলেই পৃথিবীর অন্যতম উদার রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও এই চিহ্ন, চিহ্নের পেছনের রাজনৈতিক দর্শন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

রাজপুত্র হ্যারীর দুর্ভাগ্য-জন্ম তার বঙ্গে নয়।এখানে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীরা বুদ্ধিজীবির মর্যাদা পায় যারা মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতার নামে নিজেদের অর্জন ও ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে, বিকল্প পাঠের অজুহাতে জ্বলজ্যান্ত সত্যকে আড়াল করতে পারে অশ্লীল ফ্যান্টাসীর মোড়কে।
‘মেহেরজান’ এই অশ্লীলতার স্রোতের সাম্প্রতিক সংযোজন হলেও একমাত্র কিংবা নতুন নয়। এর আগে মাহফুজ আনাম কন্যা ইংরেজী উপন্যাস লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, যেখানে যুদ্ধের স্মৃতিচারন আছে অথচ দালালদের কোন উল্লেখ নেই।মুক্তিযুদ্ধ যদি সত্য হয়ে থাকে,যদি সত্য হয়ে থাকে মুক্তিযোদ্ধা ও আক্রমনকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাহলে অনিবার্য সত্য ছিলো তাদের সহযোগী দেশীয় দালাল, আলবদর- রাজাকারেরা। এই চরিত্রের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের কোন সত্য বয়ান লিখিত হতে পারেনা, যদি হয় সেটি অসম্পূর্ণ, উদ্দেশ্য প্রনোদিত।
কিন্তু প্রথম আলো- ডেইলী স্টারের প্রচারনার সুবাদে আমরা জেনেছি তাহনিমা আনামের এই উপন্যাসখানি আমাদের মুক্তির যুদ্ধকে বিশ্বসাহিত্যের বিশাল পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করেছে। হ্যাঁ, অন্তর্ভুক্ত করেছেই তো- অসম্পূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে।
এর সমালোচনা হওয়া দরকার ছিলো, প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ কোন ফ্যান্টাসী নয় যে, যার যেমন ইচ্ছে তেমন ফর্ম বা শেইপ দিয়ে এটি নিয়ে উপন্যাস লিখবেন, সিনেমা বানাবেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বমানের উপন্যাস হয়নি, সিনেমা হয়নি- না হোক, কোন একদিন হবে, না হলে ও মুক্তিযুদ্ধ মিথ্যে হয়ে যাবেনা। কিন্তু অসম্পূর্ণ, বিকৃত কোন কিছুর বিনিময়ে বিশ্বস্বীকৃতির কোন দায় নেই মুক্তিযুদ্ধের।
গোল্ডেন এজ নিয়ে যা হয়নি, মেহেরজান নিয়ে তা হয়েছে। এই ‘হওয়া’টা অত্যন্ত প্রয়োজ়নীয়, জরুরী এবং দিক নির্দেশক।যদি আমার ভুল না হয় এর শুরু আমাদের সচলায়তন থেকেই, সচলায়তন থেকেই প্রথম এই ফোক ফ্যান্টাসী বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে এবং সরকার এই সিনেমাটি নিষিদ্ধ করেনি-দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, পরিবেশকরা প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ না করাটা হয়তো কৌশলগত ভাবে ঠিক কিন্তু নীতিগত ভাবে আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। অশ্লীল সিনেমার ছাড়পত্র না দেয়াই সেন্সর বোর্ডের কাজ, মেহেরজানকে ছাড়পত্র দিয়ে সেন্সর বোর্ড তার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেনি।


২।
মেহেরজান প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ার পর এর প্রতিবাদে মুলধারার মিডিয়ায় সরব হয়েছেন সুপ্রতিষ্ঠিত, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠাঅভিলাসী বুদ্ধিজীবিগন।মেহেরজানের প্রদর্শনী বন্ধের বিরোধীতায় তারা সহমত তো বটেই, আরেকটি বিষয়ে তাদের মতাদর্শিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। সিনেমাটির যারা সমালোচনা করেছেন,বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন তাদের সকলকেই তাঁরা জাতীয়তাবাদী গুন্ডাপাণ্ডা বলে চিহ্নিত করেছেন। না,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল( বিএনপি)র নয়- এরা চিহ্নিত হয়েছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তথা আওয়ামী গুন্ডাপান্ডা হিসেবে।
অথচ রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান নেই, আওয়ামী গুন্ডাপান্ডারা ব্যস্ত আছে দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতায়- তাদের পূর্বসূরীদের মতোই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অপমানিত হলে আও য়ামী গুন্ডাপান্ডারা আহত হয় এমন দাবী ঘোরতর আওয়ামী লীগাররা ও এখন আর দাবী করার সাহস করবেননা। অতএব মেহেরজান সিনেমা নিয়ে আওয়ামী দলীয় লোকজনের প্রতিবাদ করার কোন কথা নয় বিশেষতঃ নির্মাতার পিতৃ পরিচয় জানার পর।

তবু মেহেরজানের বিরোধীতাকারীদের ট্যাগিং করা হয়েছে জাতীয়তাবাদী গুন্ডা হিসেবেই। বন্ধু ফারুক ওয়াসিফ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফাহমিদুল হক এটি করেছেন। ফরহাদ মজহার তো আছেনই। এই ট্যাগিং এর সর্বশেষ আয়োজন বিডিনিউজে গৌতম দাস নামে একজনের লেখা। পরিচয় দেয়া হয়েছে অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক।অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক গৌতম দাসের লেখার শিরোনাম হচ্ছে 'জাতীয়তাবাদী মনের অসুখ'
লেখার শুরুতেই তিনি দাবী করেছেন ‘মেহেরজান সিনেমা নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মনের অসুখ খোলাখুলি বাইরে এসে পড়েছে।‘ । অসুখটি কী? অসুখটি হচ্ছে জোরজবরদস্তি, গুন্ডামী। তিনি অনুযোগ করছেন মেহেরজানকে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা চিন্তার মুরোদ দিয়ে গলা ও কলমের জোরে নিকেশ করতে পারতো কিন্তু তা না করে তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী গায়ের জোরে সিনেমাটি বন্ধ করে দেবার বীরত্ব দেখিয়েছে।
গৌতম দাসের লেখা পড়লে মনে হবে যেনো একদল সশস্ত্র গুন্ডাপান্ডা সিনেমা হলে গিয়ে হলভর্তি দর্শককে মারপিট করে বের করে দিয়ে তালা মেরে দিয়েছে হলগেটে।শুরু থেকে শেষপর্যন্ত অনলাইনে যে প্রবল লেখালেখি হলো এর বিরোধীতায়- গৌতম দাস সেটি সমালুম চেপে গেলেন। নাকি অনলাইনে লেখায় কলম ব্যবহৃত হয়না বলে এর কোন বুদ্ধিবৃত্তিক মুল্য নেই?

ধৈর্য্য ধরে পুরো লেখাটি পড়তে পারলে বুঝা যায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে লেখকের গভীর সমস্যা। থাকতেই পারে। তাত্বিকভাবে জাতীয়বাদ অবশ্যই একটি সংকীর্ণ ধারনা মাত্র- হোক সেটা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ কিংবা ভাষাভিত্তিক।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রো-এশিয়ার প্রায় সকল দেশই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদের ধারাতেই। উপনিবেশিকগুলো ফুরিয়েছে জাতীয়তাবাদের উত্থানেই। গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে জাতীয়তাবাদ।জাতীয়তাবাদ তাই আধুনিক পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্রেরই ঘটমান বাস্তবতা। এর সমালোচনা করা যায়, অস্বীকার করা যায়না।
গৌতম সাহা বাঙালি জাতীয়তাবাদের নিন্দাচর্চা করতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদ যখন উগ্র হয়ে উঠে তখন সেটি আগ্রাসী। ন্যাশনালিজম আর জিঙ্গোইজম পার্থক্য রেখাটা জানা জরুরী। শুধু জাতীয়তাবাদ কেনো, যে কোন মতবাদই তো আগ্রাসী হয়, হতে পারে।
মানব ইতিহাসের আধুনিক পর্যায়ে সমাজতন্ত্রের সফল প্রয়োগ হয়েছিলো যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের, সেটি ও শেষ পর্যন্ত রুশজাতীয়তাবাদী আগ্রাসন হিসেবেই পূর্ব ইউরোপের মানুষের কাছে চিহ্ণিত হয়েছে।আবার এই আগ্রাসন থেকে পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো মুক্ত ও হয়েছে জাতীয়তাবাদের চেতনাতেই।

’৪৭ এ ধর্মকে জাতি সৃষ্টির নিয়ামক মেনে পাকিস্তান নামের যে রাষ্ট্র তৈরী হলো, সেখানে পাকিস্তানী নামের নতুন জাতি সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম জাতি সৃষ্টির প্রয়াসের গভীরে কিন্তু ভাষা,সংস্কৃতি ও নৃতত্ব ভিত্তিক সহজাত জাতিগোষ্ঠীগুলো থেকে গেলো।পাকিস্তানী জাতি সেই পাঞ্জাবী, সিন্ধী,বেলুচি, বাঙ্গালীই থেকে গেলো।ভৌগোলিক বাস্তবতার কারনে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সমস্যা স্বত্বেও ন্যুনতম যে সাদৃশ্য থাকলো তাদের , পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী থেকে গেলো তার থেকে যোজন যোজন দূরে। এই দূরত্ব আর কখনোই ঘুচলোনা।
ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ভাষাভিত্তিক জাতিপরিচয়ের উন্মেষ ঘটলো, মুক্তিযুদ্ধের সফলতার মাধ্যমে তা পূর্ণতা’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মপর্বে এর দায়িত্ব নেবার ভূমিকা সকলের জন্যই উন্মুক্ত ছিলো। সমাজতন্ত্রী কিংবা ধর্মপন্থীরা ও পারতেন এই দায়িত্ব নিতে পারতেন। কেনো তাদের দ্বারা এটি সম্ভব হয়নি যা সম্ভব হলো জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা সে নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে কিন্তু ঘটে যাওয়া সত্য হলো এই নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বেই। তাই তাত্বিকভাবেই যতো সমালোচনা করা হোক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য
এ ক্ষেত্রে আবারো রুশ-পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমুহের উদাহরন টানা যায়। জাতীয়তাবাদকে রাশানরা ব্যবহার করেছে আগ্রাসন হিসেবে, পূর্ব ইউরোপিয়ানরা আগ্রাসন থেকে মুক্তি হিসেবে। পাকিস্তানীরা আক্রমনকারী হিসেবে আর আমরা প্রতিরোধযোদ্ধা হিসেবে। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ ও বটে।

অপারেশন সার্চলাইটের শুরুতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সদম্ভ ঘোষনা একটি প্রামান্য দলিল।পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে মরতে হবে কারন তার পরিচয় বাঙ্গালী,সে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, মানসিকতায় সে কমিউনিষ্ট এবং সে সাচ্চা মুসলমান নয়!
’৭১ এর গনহত্যা তাই চরিত্রগত ভাবে বসনিয়া, রুয়ান্ডার সাথে মিলে যায়- জাতিগত শোধন। এটি স্রেফ যুদ্ধ নয়, দুটো দেশের মধ্যে নয়, নয় দুটো সেনাবাহিনীর মধ্যে। একটা নিরস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর পুরুষদের পৃথিবী থেকে মুছে দেয়ার আর ধর্ষনের মাধ্যমে নারীদের গর্ভে নিজ জাতির সন্তান জন্ম দেয়া ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পষ্ট এজেন্ডা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাঁদমারিতে ছিলো বাঙ্গালীত্ব।বাঙ্গালীত্ব চাঁদমারিতে আছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিদের যারা হিংস্র হায়েনা ও নিরীহ মেষশাবককে একই নিক্তিতে মাপেন, আত্নরক্ষায় মেষশাবকটি সশস্ত্র হলে তারা অহিংস বানী শুনান, স্বজনের খুন নিয়ে ফ্যান্টাসীর প্রতিবাদ হলে তারা ‘ঘৃনাচর্চা’র অভিযোগ তুলেন এবং তারা সকলেই ঘাতকদের সাথে ‘রিকনসিলেশন’ এর মহিমা প্রচার করেন।

গৌতম দাস ও তার আলোচ্য কলামে তাই করেন। তিনি বলেন- প্রেম যদি সব দূরত্ব-বাধা ভেদী সর্বগামী এবং সার্বজনীন বলে মানি তবে পাকিস্তানী-বাঙালির মধ্যে প্রেম হতে না পারার কোন কারণ নাই। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেও কী সম্ভব? সাথে ধর্ষণ যখন প্রকট সত্য হয়ে হাজির? এটা নির্ভর করে কীভাবে উপস্থাপন করছি। চিত্রনাট্য, দৃশ্যকল্প, অভিনয় ইত্যাদি ও সর্বোপরি পরিচালকের মুন্সিয়ানায় যদি ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য,লজিক ও শক্ত জাষ্টিফিকেশন খাড়া করে উপস্থাপন করা যায়, ঘটনা ও চরিত্রের প্রতি দর্শকের সহানুভূতি আকর্ষণ করাতে সমর্থ হয় – তবে সেখানেও প্রেম সম্ভব ও ন্যায্য।

পাকি প্রেমের অপার মহিমায় উদ্বেলিত হতে হতে বাঙ্গালীত্বকে আরো পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে তিনি জানান- ‘পাকি’, ‘পাঞ্জাবী’, ‘সিন্ধী’ এসব শব্দে জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে আমোদ জাগানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বাইরে কোন নতুন চিন্তা, ঘটনাকে ভিন্নভাবে ভিন্ন কোণ থেকে দেখা, সমাজের নতুন কোন সমস্যা দ্বন্দ্ব সংঘাতের দিকে নজর কারা—সবকিছুকেই “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে দমনের পাকিস্তানী রাস্তা বেছে নিচ্ছে।
এবং শেষ করেন তিনি এই বলে- বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গঠনে গৃহীত রাজনৈতিক পরিচয় “বাঙালি” বাংলাদেশের অনেককে পাকিস্তানবিদ্বেষী রেসিস্ট জায়গায় নিয়ে গেছে।

ফিরে আসি শুরুতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ীশক্তি যুদ্ধের পরে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকেনি পরাজিত শক্তির দিকে। জার্মান, জাপান, ইতালী, যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স- নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কিন্তু বিনামূল্যে নয়। পরাজিত শক্তিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরন দিতে হয়েছে চড়ামূল্যে, ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছে নিঃশর্তে এবং প্রতিটি পরাজিত শক্তিকে নিশ্চয়তা দিতে হয়েছে যেনো তৎকালীন রাজনৈতিক মতাদর্শ তাদের দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, যেনো কখনোই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ভূমিকাকে কেউ গ্রহনযোগ্য করার চেষ্টা না করে।এবং পরাজিত অক্ষের রাষ্ট্রসমুহ এবং তাদের জনগন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনি।
তবু প্রিন্স হ্যারিকে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয় কারন বৃটিশরা জার্মানদের ক্ষমা করেছে কিন্তু ভুলে যায়নি। জার্মানীর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে কিন্তু স্বস্তিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ কারন এটি ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলে, দুঃসহ স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। কোন বিনির্মান, বিকল্প পাঠের সুযোগে স্বস্তিকা চিহ্ণকে ভিন্নরূপে উপস্থাপনের সুযোগ নেই। যেমন সুযোগ নেই কোন অজুহাতে একজন পাকিস্তানী সৈনিককে প্রেমের অবতার হিসেবে দেখানোর কারন এটি স্বস্তিকার মতোই ভয়াবহ স্মারক যা শুধুমাত্র জাতিহত্যা ও গনধর্ষনকেই প্রতিনিধিত্ব করে, অন্য কিছুকে নয়।

আর ক্ষতিপূরন দূরে থাক, ক্ষমাপ্রার্থনাই করেনি পাকিস্তান রাষ্ট্র কিংবা তার জনগন। বিশ্বাস করতে আপত্তি নেই কবি ফয়েজের মতো দুচারজন ছিলেন কিংবা আছেন সেই দানব রাষ্ট্রে, তাতে আমাদের রক্তের দাগ শুকায়না।গনহত্যা চলাকালীন সময়ে কিংবা তারপরের দীর্ঘবছর গুলোতে পাকিস্তানের কোন নাগরিক উদ্যোগ তার সেনাবাহিনীর গনহত্যার দায় মোছন করতে পারেনি।শুধু ’৭১ নয়, পরবর্তী সময়গুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাকিস্তানী ধান্দা থেমে থাকেনি- ইতিহাস স্বাক্ষী।

তাহলে রিকনসিলিয়েশন এর একতরফা ঠেকা আমাদের কেনো?
যারা অতি উদার ও মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ, আঞ্চলিক সহমর্মিতায় উদ্বুদ্ধ তারা তাহলে উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেনো? তাদের উদ্যোগে পাকিস্তান রাষ্ট্র একাত্তুরের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করুক, ক্ষতিপূরন দিক, ’৭১ পূর্ববর্তী সময়ের পাওনা ফিরিয়ে দিক, তাদের খুনে বাহিনীর বিচার করুক- তারপর না হয় আমরা লাহোরের রুপালী পর্দায় আমাদের সিনেমা নিয়ে যাবো।

তার আগ পর্যন্ত এই কথিত ‘জাতীয়বাদী গুন্ডামী’ অব্যাহত থাকবেই কেননা এই দেশটার জন্ম হয়নি কোন তত্বকপচানো সুশীল রোমান্টিকতায় বরং এর পরতে পরতে জমা আছে মৃত স্বজনের করোটি- সেখানে দ্রোহ আছে, আছে অবারিত স্বপ্ন ও প্রেম।


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

জাতীয়তাবাদী গুন্ডামীর আগে কেউ কেউ "উগ্র" শব্দটাও ব্যবহার করেছে দেখলাম

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পৃথ্বী এর ছবি

তবু মেহেরজানের বিরোধীতাকারীদের ট্যাগিং করা হয়েছে জাতীয়তাবাদী গুন্ডা হিসেবেই। বন্ধু ফারুক ওয়াসিফ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফাহমিদুল হক এটি করেছেন। ফরহাদ মজহার তো আছেনই

আগে জানতাম এই ব্যক্তি সাম্রাজ্যবাদ দেখতে পারেন না, এখন দেখি উনি জাতীয়তাবাদও দেখতে পারেন না। উনি দেখেনটা কি?

হিমু এর ছবি

এই গৌতম দাস তো মনে হচ্ছে ফরহাদ মগবাজারের গেলমানবাহিনীর আরেকটি ছাগু। ঢ়ৈষূ এইভাবে খোঁয়াড়ের ছাগুগুলিকে একের পর এক বিডিনিউজে তুলছে, পত্রিকাটার জন্য মায়াই লাগে। আশা করি দুইদিন পর ছাগুরাম তিরিভুজও বিডিনিউজের অন্যতম প্রাবন্ধিক হিসেবে আবির্ভূত হবে।

বি.দ্র. লেখায় দাস সাহা হয়ে গেছে কয়েক জায়গায়।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জিপির যন্ত্রনাদায়ক নেটে বসে একবারে লিখা। দাস হয়ে গেছেন সাহা হাসি

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লেখা।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আ গোল্ডেন এইজ পড়তে হবে সময় করে। অনেক আলোচনা পড়েছি পত্রিকায় কিন্তু মূল বইটাই পড়া হয়নি এখোনো।

তাহনিমা আনামের এই উপন্যাসখানি .......................................।

তাসনিম আনাম হবে। আমি একসময় উনার আম্মা, শাহিন আনামের একজন কনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলাম।

মেহেরজান প্রদর্শনী বন্ধ হওয়ার পর এর প্রতিবাদে মুলধারার মিডিয়ায় সরব হয়েছেন সুপ্রতিষ্ঠিত, লব্ধ প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিষ্ঠাঅভিলাসী বুদ্ধিজীবিগন।মেহেরজানের প্রদর্শনী বন্ধের বিরোধীতায় তারা সহমত তো বটেই, আরেকটি বিষয়ে তাদের মতাদর্শিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। সিনেমাটির যারা সমালোচনা করেছেন,বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন তাদের সকলকেই তাঁরা জাতীয়তাবাদী গুন্ডাপাণ্ডা বলে চিহ্নিত করেছেন। না,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল( বিএনপি)র নয়- এরা চিহ্নিত হয়েছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তথা আওয়ামী গুন্ডাপান্ডা হিসেবে।
অথচ রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোন বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান নেই, আওয়ামী গুন্ডাপান্ডারা ব্যস্ত আছে দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতায়- তাদের পূর্বসূরীদের মতোই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অপমানিত হলে আও য়ামী গুন্ডাপান্ডারা আহত হয় এমন দাবী ঘোরতর আওয়ামী লীগাররা ও এখন আর দাবী করার সাহস করবেননা। অতএব মেহেরজান সিনেমা নিয়ে আওয়ামী দলীয় লোকজনের প্রতিবাদ করার কোন কথা নয় বিশেষতঃ নির্মাতার পিতৃ পরিচয় জানার পর।

বার দশেক পড়েও এই অনুচ্ছেদটুকুর মর্ম্মোদ্ধার করতে পারলাম না। আবার ঠান্ডা মাথায় পড়তে হবে। ততক্ষণ অন্যদের কমেন্ট পড়তে থাকি।

ধন্যবাদ হাসান ভাই।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জিপির নেটের যন্ত্রনায় একটানে লিখতে গিয়ে আমি ও ভুল করেছি ওর নামে। তবে তাসনিম আনাম নন, ইনি তাহমিমা আনাম
এখানে দেখুন তাহমিমা আনাম

উদ্বৃত অংশটি আশা করি বোধগম্য ইতিমধ্যে। যদি না হয়, জানাবেন। চেষ্টা করবো আবার।

আপনাকে ও ধন্যবাদ।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আপনিই সঠিক হাসান ভাই, উনি তাহমিমা আনাম। আমি স্মৃতিভ্রষ্ঠ হয়েছিলাম। বোঝেনইতো, স্ত্রী সাথে থাকেননা আর চারপাশে 'তেনারা' ঘুরঘুর করে বেড়ান। মাথা-মুথা আউলায়ে যায় প্রায়ই।

আর ওই অংশটা রাতে আবার পড়বো।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

আর একটা কথা, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এই বোজর্গৌতম বাবুর নাম এই প্রথম শুনলাম। উনি কি বাংলাদেশের কোনও বিখ্যাত লেখক?

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রাতমজুর এর ছবি

গৌতম দাস
জন্ম ১৯৬২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী দিনাজপুরে। বুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন
১১ বছর যাবত আফ্রিকার নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তিরাশির ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক। অনুবাদ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র বিষয়ক লেখালেখি করছেন।
প্রকাশিত বই: কার্ল মার্কসের জর্মান ভাবাদর্শ(অনুবাদ), আগামী প্রকাশনী
একদেশে সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবে কৃষকের ভূমিকার প্রশ্নে, প্রতিপক্ষ প্রকাশনী

ডাটা সোর্স: http://bit.ly/gCgukD

এরকম ভাড়াটে বুদ্ধিবেশ্যা (সুশিল মতে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি) বাংলার আকাশে হ্যালির ধুমকেতুর মতই দূর্লভ। তিরাশির ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক কিভাবে নিজের মস্তিষ্ক ভাড়া দেন তার একটা উজ্জ্বল উদাহরন। এনাকে ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখা দরকার। আফ্রিকাতে কিসের খোঁজে ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছেন সে সম্পর্কিত কিছু আওয়াজ পেলে জীবন ধন্য হতো আমার মতন নাদান নাবালকের, আফসোস, সেসব কিছুই নেই, উনি এলেন, লিখলেন, এবারে বোধহয় হারিয়েও যাবেন লুংগী মাজহার, ব্যার্থ ঢ়াঈষু আর পার্হাদ মগবাজারের সাথে হাসি

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

মার্ক্সের চ্যালা আফ্রিকায় কি করে! চিন্তিত

আজব তো!!!

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

মঈন উদ্দীন এর ছবি

চমতকার নয় শুধু প্রচন্ড চমতকার একটি লেখা। যে চিহ্ন বৃটিশদের প্রিয়জনের ঘাতকের শরীরে আঁকা ছিল তা তাদের পক্ষে নিশ্চয়ই সহ্য করা সম্ভব নয়। যে নাম এবং পরিচয় একাত্তরে আমাদের প্রিয়জনের ঘাতকের সাথে সম্পর্কিত ছিল সেই নাম এবং পরিচয় আজও আমরা সহ্য করতে পারবনা। এটাই স্বাভাবিক। আর একাত্তরের ইতিহাস শুধু অস্ত্রের ঝলকানি মাখা জয়ের নয়, বরং সেই সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে অসংখ্য প্রিয়জনের ত্যাগের ইতিহাস। সেই ত্যাগ তিতিক্ষার ইতিহাসকে ভুলে একাত্তরের জয় পূর্নাঙ্গ নয়, হতে পারেনা। শহীদদের ভূলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস আমাদের নিজেদের কে স্বার্থপরে পরিণত করবে। আমরা শহীদদেরকে হয়ত তাদের উপযুক্ত সম্মান দিতে পারিনি, তাই বলে তাদের ভুলে যাবার মত পাপ আমরা নিশ্চয়ই করতে পারিনা।

ধ্রুব বর্ণন এর ছবি

বেশ লাগলো লেখাটা। তীক্ষ্ণ কোন শব্দ ব্যবহার করেন নি, কিন্তু পুরো লেখাটা তীরের ফলার মত তীক্ষ্ণ। ক্রিটিক্যাল লেখা যখন এরকম নিরাবেগ আবেশে যুক্ত হয়, যুক্তি ও চিন্তা দিয়ে তাকে পাঠ করা সম্ভব হয়। জাতীয়তাবাদের পক্ষে তার বাস্তবতাঘনিষ্ঠ আদলটিকে আপনি নিজে জাতীয়তাবাদী আবেগটাকে কণ্ঠে উচ্চারণ না করেই লিখলেন। কোন বিশেষ -বাদের ক্রিটিক্যাল শক্তিটাকে বোঝাতে যে আবেগের বাইরে এসে যুক্তি-চিন্তার শক্তি ব্যবহার করতে হয়, সেটাই দেখালেন। সাধুবাদ জানাই।

লেখায় আসি। যথার্থ বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক সমালোচনা যথেষ্ট সহজ হলেও এর বাস্তবতা অস্বীকার ততোধিক কঠিন। পশ্চিম যে জাতীয়তাবাদের শক্তিতে বলীয়ান, তত্ত্বে তাকে সহজে কচুকাটা করা গেলেও তার মুখোমুখি বিশ্বকে হতে হয় প্রতিনিয়তই। তবে জাতীয়তাবাদ চূড়ান্তভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে জার্মানির হত্যাযজ্ঞের কারণে। ধর্মও এত বিপদগ্রস্ত হয় নি মনে হয় কখনো। তখন থেকে জাতীয়তাবাদকে বিনম্র রাখার জন্যে উদারপন্থার স্থান সমুন্নত হয়।

আর মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বলি। ঠিকই বলেছেন যে মুক্তিযুদ্ধ দুটো সেনাবাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। তবে বলছেন যে, এটা ছিল দুটো জাতির যুদ্ধ। বা অন্তত আক্রমণের বিপক্ষে প্রতিরোধের বা দাঁড়ানোর মানসটা তৈরি করে দিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এখানে সম্ভবত বলতে চাচ্ছেন, ৫২ থেকে ৭১-এ ধীরে ধীরে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে, সেটাই প্রতিরোধের শক্তিটা দিয়েছে। এখন, আমার প্রশ্ন এ জায়গাটাতে, জাতীয়তাবাদে বলীয়ান নয় এমন কারও উপরে আক্রমণ হলে জাতীয়তাবোধহীনতার দরুণ তার পক্ষে প্রতিরোধ করা কি অসম্ভব? নাকি মুক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণার কারণেই সে প্রতিরোধ যুদ্ধে যেতে সম্ভব। গ্রামবাংলার যে হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধে গেছে, তাদের অনেকের মধ্যেই, বিশেষত যারা রাজনীতি-সচেতনতাবিচ্ছিন্ন ছিল, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ যে খুব সুগঠিত ছিল, তা কিন্তু বলা যায় না। কিন্তু তারা প্রতিরোধে, মুক্তির জন্যে যুদ্ধে গেছে। তবে সংগঠনে হয়তো জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত সচেতন যোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আগ্রাসনে যেমন জাতীয়তাবাদের কুফল টের পাওয়া যায়, প্রতিরোধে তার প্রয়োজনীয়তা টের পেতে খুব কষ্ট হয় না। এখন প্রতিরোধকে জাতীয়তাবাদ বলীয়ান করলে প্রতিরোধের যুদ্ধের চেতনা আর জাতীয়তাবাদ সমার্থক হয় কিনা (আপনি তেমন দাবী করছেন, তা বলছি না)? আমার কাছে মুক্তির জন্যে যুদ্ধের চেতনাটা হল মানবতাবোধেরই। যেটা আগ্রাসনের বিপক্ষে, নিজের ও অন্যের অধিকার আর মুক্তির পক্ষে। সেখানে জাতীয়তাবোধ তাকে শক্তি জোগায়, সফল করে। কিন্তু প্রতিরোধযোদ্ধা মূলত অধিকারবাদী, মুক্তিকামী মানুষ। ওটাই তার মূল চেতনা!

এবার আসি যুদ্ধ পরবর্তী দেশ পরিচালনায় জাতীয়তাবাদের ভূমিকা নিয়ে। প্রতিরোধে বা আত্মপ্রকাশে জাতীয়তাবাদের গুরুত্বটা যত পরিষ্কারভাবে আপনার লেখায় এসেছে, ততটা আসে নি যুদ্ধপরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে। জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনৈতিকতাটাকে আবেগের সাথে পাহারা দিয়ে রাখতে সক্ষম হয় বটে। সেখানে সে বিকল্পহীন, দুর্দমনীয়। কিন্তু প্রতিরোধের যুদ্ধের, মুক্তির যুদ্ধের যে মূল চেতনা - অধিকারবাদিতা, মুক্তিকামীতা, যা সবসময় নিপীড়িত মানুষের পক্ষে থাকে, অত্যাচার অবিচারে ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়, দেশ গঠনের পর জাতীয়তাবাদের পক্ষে সে চেতনা ধারণ করা কিন্তু মৌলিকভাবে আর আবশ্যক থাকে না। এটা জাতীয়তাবাদের দুর্বলতম দিক। তার পক্ষে নিপীড়ন অদেখা অসম্ভব নয়। এই দুর্বলতাকে ইঙ্গিত করা মানে কিন্তু আবার জাতীয়তাবাদের আমূল বিরোধিতা নয়। এটা বরং জাতীয়তাবাদটাকেই উপকার করা। জাতির উপকার করা। জাতীয়তাবাদী আর সক্রিয় বিনির্মাণবাদীদের এই যুদ্ধে রাষ্ট্রনৈতিকতার জয় হলে গেলেও কিন্তু মুক্তিকামিতা চেতনা ভুলবার নয়। সেটা চর্চার বিষয়।

মোদ্দাকথা, মুক্তিকামিতাকে জাতীয়তাবোধ সাহায্য করলেও, মুক্তিকামী হতে জাতীয়তাবাদী হওয়া লাগে না। বরং জাতীয়তাবাদী তার আত্মপ্রকাশের যুদ্ধে মুক্তিকামীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। কিন্তু আত্মপ্রকাশের পর সে মুক্তিকামী হবার দায়বদ্ধতা হারায়। দেশ গঠনে জাতীয়তাবাদ যদি প্রয়োজনীয় হয়, তা হলে একাধিক জাতিতে পূর্ণ এবং মারাত্মক আর্থসামাজিক, শ্রেণীবৈষম্যপূর্ণ রাষ্ট্রে মুক্তিকামিতায় পুনরুজ্জীবিত জাতীয়তাবাদই কাম্য।

এরকম লেখা আরও আরও লিখুন। পাঠককে চিন্তার সুযোগ দিন। হাসি

হাসান মোরশেদ এর ছবি

পয়েন্ট ধরে আমরা আলোচনা করি তাহলে।
১।

অজাতীয়তাবাদী কারও উপরে আক্রমণ হলে জাতীয়তাবোধহীনতার দরুণ তার পক্ষে প্রতিরোধ করা কি অসম্ভব? নাকি মুক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণার কারণেই সে প্রতিরোধ যুদ্ধে যেতে সম্ভব। গ্রামবাংলার যে হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধে গেছে, তাদের অনেকের মধ্যেই, বিশেষত যারা রাজনীতি-সচেতনতাবিচ্ছিন্ন ছিল, তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ যে খুব সুগঠিত ছিল, তা কিন্তু বলা যায় না। কিন্তু তারা প্রতিরোধে, মুক্তির জন্যে যুদ্ধে গেছে।

গ্রামবাংলার যে হাজার হাজার মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে অবশ্যই রাজনৈতিক তত্বে তারা প্রশিক্ষিত ছিলোনা কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের ছিলোনা এমন বলাটা বোধ করি অন্যায্য হবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রত্যন্ত বহু হাট-বাজারের নাম স্বতস্ফুর্ত ভাবে 'জয়বাংলা বাজার' কিংবা 'বাংলা বাজার' হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ কিন্তু কোন তাত্বিক দ্বিধাদ্বন্ধে না ভোগে, সহজাত ভাবেই নিজেদের বাঙ্গালী বলেই জানে।
মুক্তির স্বতস্ফুর্ত প্রেরনায় অবশ্যই তারা যুদ্ধে গেছে কিন্তু ৬৬ থেকে ৭১ এই সময়ে প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও কমিউনিষ্টদের সাংগঠনিক তৎপরতা যদি খেয়াল করেন, দেখবেন- একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এদের সাংগঠনিক ভিত্তি বিস্তৃত হয়েছে। একটা উদাহরন দেই। সে সময় ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে যাওয়া ছিলো দুদিনের কাজ। শেখ মুজিব গিয়েছেন ৭০ এর নির্বাচনের আগে। নৌকার সাথে নৌকা বেঁধে হাওরে মঞ্চ বানানো হয়েছে। ভয়াবহ দুর্গম অঞ্চলের মানুষেরা ও সরাসরি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছে।
আমার ধারনা এখনকার মেট্রোপলিস মানুষদের তুলনায় ষাট দশকের একজন সাধারন কৃষকের রাজনৈতিক চেতনার জায়গাটি স্পষ্ট ছিলো।

২।

প্রতিরোধে বা আত্মপ্রকাশে জাতীয়তাবাদের গুরুত্বটা যত পরিষ্কারভাবে আপনার লেখায় এসেছে, ততটা আসে নি যুদ্ধপরবর্তী সময়ের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে।

ইচ্ছে করেই আনিনি। আমার মাথায় ছিলো যদিও। এতে লেখাটা আরো বড় হয়ে যেতো, আমার ধৈর্য্য নিয়ে নিজেই বিরক্ত। জাতীয়তাবাদের অনেক সমস্যা আছে, জটিলতা আছে- যেটা আপনি নিজে ও উল্লেখ করেছেন। এই সমস্যাগুলো উদারতা দিয়ে গার্ড দিতে হয়।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরনায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিলো এটা অস্বীকার করা বাতুলতা। নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে এর উল্লেখ থাকতে পারতো রেফারেন্স হিসেবে কিন্তু রাষ্ট্রটিকে শুধু বাঙ্গালীর রাষ্ট্র বলে ঘোষনার সংকীর্ণতার দরকার ছিলোনা। হতে পারে বাঙ্গালী ৯৯% কিন্তু বাকী ১% অবাঙ্গালী তার কেনো সমানাধিকার থাকবেনা মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রে?
আরেকটা প্যারাডক্স দেখুন।
পাকিস্তান আমলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ মুক্তির স্মারক। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে? পাহাড় থেকে অবাঙ্গালীদের উচ্ছেদ করে বাঙ্গালী বসতি স্থাপনের জোরজবস্তি যে সামরিক শাসকরা করেছে তারাই আবার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মুছে দিতে চেয়েছে। তাহলে কি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে এই আগ্রাসনের জন্য দায়ী করা যেতে পারে? আমি নিশ্চিত নই।

আমার অবস্থান নিশ্চিত ভাবেই আপনার খুব কাছাকাছি। যদি ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্র তবু এই রাষ্ট্র সকল জাতিগোষ্ঠীর। সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত থাকতে হবে, কিন্তু এটি সম্ভব নয় বাঙ্গালী, চাকমা, মনিপুরী সকলের জাতিগত পরিচয় মুছে দিয়ে নতুন পরিচয় সৃষ্টির মাধ্যমে। বরং সকলের পরিচয়কে স্বীকৃতি দিয়ে, প্রত্যেকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে কল্যানকামী রাষ্ট্র হিসেবে পরিবর্তিত করা সম্ভব।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দ্রোহী এর ছবি

তার আগ পর্যন্ত এই কথিত ‘জাতীয়বাদী গুন্ডামী’ অব্যাহত থাকবেই কেননা এই দেশটার জন্ম হয়নি কোন তত্বকপচানো সুশীল রোমান্টিকতায় বরং এর পরতে পরতে জমা আছে মৃত স্বজনের করোটি- সেখানে দ্রোহ আছে, আছে অবারিত স্বপ্ন ও প্রেম।

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

নীলকান্ত এর ছবি

অপারেশন সার্চলাইটের শুরুতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সদম্ভ ঘোষনা একটি প্রামান্য দলিল।পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে মরতে হবে কারন তার পরিচয় বাঙ্গালী,সে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, মানসিকতায় সে কমিউনিষ্ট এবং সে সাচ্চা মুসলমান নয়!
’৭১ এর গনহত্যা তাই চরিত্রগত ভাবে বসনিয়া, রুয়ান্ডার সাথে মিলে যায়- জাতিগত শোধন। এটি স্রেফ যুদ্ধ নয়, দুটো দেশের মধ্যে নয়, নয় দুটো সেনাবাহিনীর মধ্যে। একটা নিরস্ত্র জাতিগোষ্ঠীর পুরুষদের পৃথিবী থেকে মুছে দেয়ার আর ধর্ষনের মাধ্যমে নারীদের গর্ভে নিজ জাতির সন্তান জন্ম দেয়া ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পষ্ট এজেন্ডা।

গুরু গুরু

আফসোসের বিষয় এই কথাগুলো এখনো আমাদের প্রজন্মকে বলে বোঝাতে হয়। আসলে এই প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ করা উচিত ছিল। হয়তো তাহলে স্বাধীনতার মূল্য বুঝতো।


অলস সময়

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

লেখায় গুরু গুরু

পাকজারজের দল সব!‌

মডুদের কাছে পাকিপ্রেম বোঝাতে "মেহের্জান" ইমো এবং "ঘৃণা" ইমো দাবী করে গেলাম!

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

আজ পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র মাফ চাইলো না।একাত্তর পূর্ববর্তী দেনাও মিটালো না।বিহারি ইস্যুটাকে কি রকম এক শয়তানি কৌশলে কাঁধ থেকে নামিয়ে ফেললো প্রায়! নানা প্রকারে বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপ তো আছেই।

অন্যদিকে বাঙ্গালিদেরই একদল 'ঘৃণা নয়, প্রেম', রিকন্সিলেশন ইত্যাদি জপতে জপতে চোখের জল- নাকের পানি এক করে ফেলছে। মারটা তো আমরাই খেয়েছি, ধর্ষিত তো আমরাই হয়েছি, খুন তো হয়ে গিয়েছি আমরাই! এখন কি আবার সন্ধি পাতাতে আমাদেরই ছুটতে হবে? খুন-ধর্ষণ-নিপীড়ন ভুলে পাকিপ্রেম্ভাবে মজে বগল বাজাতে হবে? কি এতো ঠেকা আমাদের?

এইসব 'উদারমানবতাপন্থী' আবালদের প্রতি ঘেন্না...

রব

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর লেখা। পড়ে ভালো লাগলো। মোরশেদ ভাই, আরো অনেক বেশি বেশি লেখা চায় আপনার কাছ থেকে!

শায়ের আমান,

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।