লোকজ সংস্কৃতি || বিনাশ ও বিন্যাসের নাগরিক গাজোয়ারী

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শনি, ২৩/০৬/২০০৭ - ৭:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

[ পড়ছিলাম সুমন রহমানের সাম্প্রতিক লেখা । মনে পড়লো, সামহোয়ারে দেয়া নিজের একটা লেখা । সেই লেখাটা উসকে দিয়েছিলেন-আনোয়ার সাদাত শিমুল । কৃতজ্ঞতা তার প্রতি । পুরনো লেখা নিয়ে এলাম নিজের ব্লগে ]

১।।

'আমাদের' অনেকেরই হয়তো লালন শোনা হতোনা , যদিনা প্রথমত: ফরিদা পারভীন, তারপর আরো কেউ কেউ এবং শেষে আনুশেহ লালনের গান না গাইতেন ।
'আমাদের' আমাদের ব্যাপক ভাবে হাছন শোনা হতোনা , যদিনা গায়ক সেলিম চৌধুরী, নাট্যকার হুমায়ুন জুটি হাছনের প্রতি আগ্রহী হতেন ।
'আমরা' হয়তো আব্দুল করিমকে চিনতাম না, যদিনা হুমায়ুন আহমেদ একুশে টিভিতে তার কিছু গান নিয়ে একটা অনুষ্ঠান না করতেন । মনে আছে সেই অনুষ্ঠানে মডেল হয়েছিলো বিবি রাসেলের প্রোডাকশনের বেশ কিছু ফুলকুমারী ।
তারপর আরো অমুক তমুক, হাবিব নামের সুদর্শন তরুন আমাদেরকে আরো ভালো করে চিনিয়েছেন আব্দুল করিম ।
'বন্ধু তোর লাইগারে' 'তারে ভাবলে কি আর জুড়ায়রে প্রান, না দেখলে নয়নে' গানের কল্যানে কিছুটা চেনা হয়েছে সৈয়দ শাহনুর কে
হুমায়ুন আহমদের 'শ্রাবন মেঘের দিন' এর কল্যানে 'আমরা' চিনেছি উকিল মুন্সীকে ।

এই 'আমরা ' কারা?
যারা নগরবাসী, সেই অর্থে নাগরিক । এদেশের নাগরিক কেবল আমরাই, কেবল আমরাই ধারন করি গোটা দেশের সংস্কৃতি । তাই লালন, হাছন, করিম, শাহনুরদের সৌভাগ্য আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার । আমরা নাগরিক ব্যস্ততার ফাঁকে এদের গান শুনি মাঝে মাঝে আর বেশ শ্লাঘা অনুভব করি, বাহ লোকজ সংস্কৃতি একেবারে হারিয়ে যাচ্ছেনা!

এই 'আমরা' , আমরা ক'জন? আমরা ক'জন যদি লালন, হাছন না শুনতাম তাহলে হারিয়ে যেতো সেই সব ? এক যুগ আগেও তো আমরা নাগরিকরা শাহ করিমকে চিনতাম না, শাহনুরকে এখনো তেমন চিনিনা, একেবারেই চিনিনা রহমতুল্লাহ মুন্সী, কামাল পাশা, কালা শাহ , শফিকুন্নুরদের । 'আমরা' চিনিনা বলেই কি তারা বিলুপ্ত প্রায়?

একধরনের আগ্রাসী সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠি বলে নাগরিক আলোচনা আর মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়াকেই আমরা সংস্কৃতির টিকে থাকার শর্ত বলে মানি ।
বিশেষ করে 'বাউল গান' তো কেবল গান নয়, 'বাউল' একটা জীবন দর্শন , বাউলরা গানের মাধ্যমে তাদের প্রার্থনা প্রেম ও জীবনযাপন কে প্রকাশ করেন । ফরিদা পারভীন কিংবা আনুশেহ তো সে জীবনের নয়, তারা তো 'খেলকা' পরিধান করেননা, তারা 'ভিক্ষা' মাগেননা , পুরুষ বাউলের 'প্রেমের আঁধার' হননা । তারা লালনের গান গান নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য । ' নগর বাউল' কিংবা 'নাগরিক কবিয়াল' এই সব সস্তা স্ট্যান্টবাজি । আমাদের মতো নাগরিক গনের কাছে লালনের গান এসে না পৌঁছালে ও লালনকে ধারন ও বহন করে যেতো 'খেলকা'ধারী বাউলেরা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা,মেদেনীপুর, মালভুমে ।

মিডিয়ার কল্যানে আমরা চেনার বহু আগে থেকেই শাহ করিম শাসন করেন সিলেট সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ নেত্রকোনা কিশোরগঞ্জের বিশাল ভাটিবাংলার গ্রামীন সংস্কৃতি । পুর্বসুরী সৈয়দ শাহনুর, রাধা রমন,কালা শাহ, সমসাময়িক কামাল পাশা, মুন্সী রহমতুল্লাহ র্দুবিন শাহ , শাহ শফিকুন্নুর, পরবর্তী(সম্প্রতি প্রয়াত) শি ষ্য রুহীঠাকুর, ক্বারী আমির উদ্দীন এদেরকে নিয়ে ভাটি বাংলার গানের সম্রাট আব্দুল করিম প্রায় সত্তুর বছর ধরে ।

এঁদের কারো কারো গান ভুল সুরে, ভুল কথায়, ভুল পরিবেশনায় বাজারজাত হয় । আমরা নাগরিকগন আপ্লুত হই । বাজারজাতকারীগন ( আমি শিল্পী বলিনা) ও নিজেকে বেশ সাধুবাদ জানাই । তারা বাজারজাত করে, আর আমরা শুনে বাঁচিয়ে ফেললাম লোকজ শাহ আব্দুল করিমদের ।

২।।

প্রায়শ: এরকম অভিজ্ঞান হয় লোকজ গান/ সংস্কৃতি সংরক্ষন করতে হবে । নাগরিকগনের অপার বদান্যতা, মেট্রোপলিস লাইফে থেকে ও লোকজ হাড় কংকাল তারা সংরক্ষন করতে চান ।
সংরক্ষনের স্বরুপটা কেমন হয়?
আমাদের ড্রয়িংরুমে লালনের পোট্টেট থাকে, শো-পিস হিসাবে একতারা ঝুলে , টিভি স্টুডিও চারকোন ঘরের ভেতর আমরা মাঝে মাঝে ধরে আনি বাউল হিরু শাহ, মন্টু শাহ, আব্দুল করিমদের ।
বাউল গান শুনি কিন্তু বাউলের তত্ব, সাধনা, পাঞ্জাতন, খেলকায় আমরা যাইনা, যেতে পারিনা । সংরক্ষন টা আমরা আমাদের মতো করি । আব্দুল করিম গান গাইতেন একটা একতারা কিংবা বেহালা হাতে । সেই গান আমরা শুনছি যখন এটা পরিবেশিত হচ্ছে গীটার, ড্রাম, কি-বোর্ড সহযোগে , আমাদের পরিচিত ঘরানায় । একতারা বেহালা হাতে সত্তুর বছর ধরে গান গেয়ে চললেও আমরা কোনদিন তাকে খুঁজে ও দেখিনি!

অর্থ্যাৎ লোকজ সংস্কৃতি কে আমরা আমাদের রুচি অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করছি, বনসাই করে দিচ্ছি । তার আসল যে রুপে সেই রুপ আমরা গ্রহন করছিনা ।

আমি তাই এ রকম সংরক্ষনের পক্ষপাতি নই ।

তবে কি নাগরিকের কোনো দায়িত্ব নেই?
নাগরিকের করার আছে, যদি সে সত্যি কিছু করতে চায় । আর সেটা হলো লোকজ সংস্কৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে বিকাশের সুযোগ করে দেয়া ।
স্বাভাবিক গতিতে বিকাশ বাধা পায় কেনো? অনেক অনেক কার্যকারন জড়িয়ে আছে সেই সাথে ।

গত শতকে ও বাউলদের একতারা ভেংগে দেয়া হয়েছে, বে-শরা ঘোষনা দিয়ে দাড়ি উপড়ে ফেলা হয়েছে । কাজটা করেছেন সে সময়ের 'নাগরিক ' পুজারী ব্রাম্মন ও কট্টর শরীয়তপন্থীরা । লালনের আখড়া পাকা করে দেয়ার চেয়ে বাউল সমপ্রদায় কেনো বিলুপ্ত হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা জরুরী ।
গত শতকে যা হয়েছে, তা হচ্ছে এ সময়ে ও । ক' বছর আগে ও সিলেটের গ্রামে মোল্লারা ঘেরাও করেছেন বাউল শিল্পী ক্বারী আমির উদ্দীনের বাড়ি, জ্বালিয়ে ফেলার হুমকী দিয়েছেন। ফলাফল আমীর উদ্দীন এখন রাজনৈতিক আশ্রয়ে ইংল্যান্ড!
মুন্সী রহমতুল্লাহর দুর্লভ গান গুলো সংগ্রহ করা যায়নি কারন তাঁর ছেলেরা কট্টর মাওলানা হয়েছেন , বাপের কাজগুলো তাদের কাছে বেদাতি!
বাউল শফিকুন্নুর তাঁর গ্রামে সংগীত বিদ্যালয় তৈরী করেছিলেন । প্রতি সন্ধ্যাবেলা সেখানে বসতো বাউল গানের আসর। আশে পাশের কয়েকগ্রামের মানুষ আসতেন । মাঝে মাঝে এসে গান করতেন আব্দুল করিম, রুহী ঠাকুরেরা । শফিকুন্নুরের মৃতু্যর পর সে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে । তাঁর ছেলেরা প্রবাসী । কয়েক বছর পর দেশে ফিরলে তারা শহরে ' শফিকুন্নুর সংগীত সন্ধ্যা' আয়োজন করেন । আমরা অডিটোরিয়ামের নিয়ন্ত্রীতে শীতাতপে বসে অন্যদের কণ্ঠে তার গান শুনি । কিন্তু যে মানুষদের প্রেরনায় শফিকুন্নুর 'সুজন বন্ধু' রচনা করেছিলেন সেই 'জগদল' গ্রামের মানু ষ তার থেকে বঞ্চিত হয় ।
রিক্সা চড়ে যাচ্ছি কোথাও । রিক্সাওয়ালার আনমনে গেয়ে উঠা ভাওয়াইয়া সুর শুনে চমকে উঠি! নদীভাঙ্গা এই মানুষটা হয়তো কুড়িগ্রামের ধরলা নদীর পাড়ে বসে এই গান গাইতো একদিন!

লোকজ সংস্কৃতি বিকাশের সহজাত পরিবেশ যদি তৈরী করা যায়, তবে তা টিকে থাকবে তার অন্ত:স্থ গুঢ়তার জোরে । সংরক্ষনের নামে বিকৃতির উৎসব শুরু করে বরং আমরা নাগরিকরা তার বিলুপ্তি নিশ্চিত করছি প্রবল উৎসাহে ।


মন্তব্য

অরূপ এর ছবি

যথারীতি আগুন
-------------------------------------
রামছাগলের সামনে, খচ্চরের পেছনে আর নিবোর্ধের ধারেকাছে না থাকাই শ্রেয়!

ঝরাপাতা এর ছবি

হুমম।
_______________________________________
পোড়াতে পোড়াতে ছাই, ওড়াতে ওড়াতে চলে যাই . . .


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

কিছু কিছু পুরানা লেখা বারবার পড়া দরকার।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আপনার কথাগুলো পড়ে নিজের ভাবনা-ধারণা পাল্টেছিল। মূল লেখার লিংকটি শেয়ার করেছি বেশ কয়েকজনের সাথে।
আবারও ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।