ছুঁয়ে আসা সোমেশ্বরী

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: শনি, ২১/০৬/২০০৮ - ৭:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পুরনো পোস্ট আবারও। স্টকে আর ভ্রমন্থন নেই, যদিও টাঙ্গুয়ার হাওর আর সাঙ্গুনদী ধরে থানচি থেকে রুমাযাত্রা নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিলো। এই লেখাটি নেত্রকোণার বিরিশিরি-দুর্গাপুর যাত্রার ওপর লেখা, ২০০৩ সালে।

১.

শরতে বাংলাদেশের কোথায় ঘোরা যায় বলুন তো? কোথায় আমাদের অজান্তে একগুচ্ছ বুনো কাশ বাতাসে মাথা দুলিয়ে যায়, আকাশে কয়েক মুঠো পথ হারানো মেঘ বিস্তীর্ণ নীলকে আমাদের সামনে আরো প্রস্ফূট করে তোলে, কোথায় সোনালী রোদে আরো সোনারঙের বালি আর রূপোর মত জল ঝিকমিক করে ওঠে, কোথায় দামাল বাতাস হঠাৎ এসে চুরি করে চুলে হাত বুলিয়ে যায়?

অনেক জায়গায়, সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীকে অক্টোবরের শুরুতে এক ঝলক দেখে না এলে হয়তো অনেক বড় একটা অতৃপ্তি থেকে যাবে আমাদের মাঝে।

EXPLORERS' CLUB OF BANGLADESH-এর সদস্যরা বেশ কয়েকদিন কোন নূতন অভিযান বা ভ্রমণে বের হননি। ইতিমধ্যে তাঁরা জয় করেছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ (কেওকারাডং, যদিও মাত্র ৩১৭২ ফিট উঁচু), পায়ে হেঁটে পার হয়েছেন পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত (টেকনাফ থেকে কক্সবাজার, কম নয়, ঝাড়া ১০৮ কিমি), তবে এমন মারদাঙ্গা কিছু করার উদ্দেশ্য তাঁদের এখন আপাতত নেই; কিন্তু এই শরতের মোলায়েম হাতছানিকে কি তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেন কখনো? হাতে দুর্গাপূজোর তিন-তিন দিন ছুটি, পকেটেও যৎসামান্য টাকাপয়সার উষ্ণতা, আর এই ধোঁয়াধূলোয় আচ্ছন্ন ঢাকার বাতাসের কানমলা তো আছেই। কাজেই, বেরিয়ে পড়লেন বাছারা।

তবে এবার বাছারা সংখ্যায় কম, মাত্র ছ'জন। এবার দলপতি সোহেল ইকবাল, সাথে শাহেদ ভাই, পুতুল আপা, শিলা আপা, হিমু, আর ক্লাবের নূতন সদস্য শামীম খান মিলন। এবার উদ্দেশ্য নিখাদ ভ্রমণ, তবে পায়ে হেঁটে। সবার পা সচল হয়ে উঠবে নেত্রকোণার দুর্গাপুরে, বিরিশিরিতে গিয়ে। হাঁটাহাঁটির জন্যে দুর্গাপূজোর ছুটিতে দুর্গাপুরই প্রশস্ত জায়গা।

তৃতীয়া অক্টোবর, শুক্রবার সবাই গুটিগুটি পায়ে মহাখালির বাসস্ট্যান্ডে হাজির হলেন। সাতটা চলি্লশে বিরিশিরির বাস স্ট্যান্ড ত্যাগ করলো। সকালের হালকা রোদ আস্তে আস্তে কড়া হতে লাগলো, পথের দু'পাশে একটু একটু করে শহর মুছে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগলো গ্রাম। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যা-ও একটু ছিরিছাঁদ ছিলো রাস্তায়, ময়মনসিংহ পার হবার পর শুরু হলো বিচ্ছিরি পথ। রাস্তার এমন বেহাল দশা এর পর একেবারে সেই সীমান্তবর্তী বিজয়পুর পর্যন্ত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যাত্রীবাহী বাস এ রাস্তায় চলাচল করে রীতিমতো ফিফটি-ফিফটি নিরাপত্তা নিয়ে। একটু পরপরই প্রাণটা গলার কাছে এসে ধুকধুক করতে থাকে, এই বুঝি উল্টে খাদে পড়লো বাসটা!

রাস্তার বদনাম যতটা সহজে করা হলো, রাস্তার দু'পাশে দৃশ্য সম্পর্কে তেমনটা করা পাপ হবে। চমৎকার সবুজে ছাওয়া পথের দু'ধার, দিগন্ত পর্যন্ত বাতাসে দুলছে ধানগাছ, একটু পর পর পথের পাশে ডোবা, তাতে দল বেঁধে সাঁতরে চলছে সুখী চেহারার পাতিহাঁস, উদাস মুখে কয়েকটা গরু রাস্তার পাশে বসে জাবর কাটছে, তাদের কাঁধের ওপর বসে থাকা ধ্যানী পাখি, ছোট্ট ছাগলছানারা খেলে চলছে আপনমনে --- সব মিলিয়ে মনে হয়, এই বুশ-শ্যারন-লাদেনদের পঙ্কিলতা ছেড়ে অন্য কোন গ্রহে চলে এসেছি, যেখানে বাতাসে শান্তি ফিসফিস করে জানিয়ে দিচ্ছে সবাইকে, দ্যাখো, আমি এমনই।

একসময় ঝাঞ্জাইল বাজার পেরিয়ে বারোটা নাগাদ হঠাৎ থেমে পড়লো বাস। সামনে রাস্তা ভাঙা, আর এগোবে না বাস। বাকিটা পথ নৌকো করে পার হয়ে একটু এগিয়ে রিকশা অথবা বাসে চেপে পৌঁছুতে হবে বিরিশিরিতে। কী আর করা, বাস কন্ডাক্টরের কাছ থেকে জরিমানা হিসেবে কিছু টাকা আদায় করে একটা নৌকোতে চড়ে বসলেন ছ'জন। যদিও ECB সদস্যদের সাঁতার জানা বাধ্যতামূলক, কিন্তু এবার ৬৭% অভিযাত্রীই সাঁতারে অপটু, কেবল শাহেদ ভাই আর মিলন ভাই পানির পোকা। সামান্য আড্ডার সূত্রপাত হতেই এই টেনশন কেটে গেলো, গল্পগুজবে সময় পার করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই জলা পার হয়ে বড় সড়কে উঠে পড়লেন সবাই। ওপারে আবার স্থানীয় জারিয়া-দুর্গাপুর রুটের বাসে চড়ে বিরিশিরি ওয়াইএমসিএ-তে পৌঁছে গেলেন ছ'জন। বিরিশিরি থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ে মেঘালয়ের অংশের গারো রেঞ্জ, দিগন্তে মেঘের নীচে গাঢ় নীল রঙের একটা পোঁচ।

ওয়াইএমসিএ-তে তখনও রুম খালি হয়নি, ইয়ুথ কনফারেন্সের অংশগ্রহণকারিণী তরুণীগণ সব ঘর আগলে রেখেছেন। কাজেই ব্যাগেজ একটা রুমে রেখে হাত মুখ ধুয়ে খাবারের খোঁজে বেরোলেন সবাই, দুপুর আড়াইটা বাজে, সবার পেট খিদেয় চোঁ চোঁ করছে। মূল সড়কের দুপাশে ভাতের হোটেল মাত্র দুটি, খানিকটা খোঁজখবর করে শান্তি হোটেল-এ হানা দিলেন অভিযাত্রীরা। শান্তি হোটেলের সর্বেসর্বা প্রবীর, হাঁসের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করতে চাচ্ছিলেন তাঁদের, কিন্তু শাহেদ ভাইয়ের পরামর্শ মতো নিজের বাড়ি থেকে সদ্য রান্না করা মোরগের মাংস আনতে ছুটলেন তিনি। সারা সকাল খালি পেটে কাটানোর পর সেই সুস্বাদু ঝালঝাল চিকেনফ্রাই খেয়ে একেকজনের জিভ উলু দিয়ে ওঠার যোগাড়। কিন্তু সেখানে পানি নিরাপদ নয়, তাই ঢাকা থেকে বয়ে আনা পানি আর কোলা দিয়ে পিপাসা মারতে হলো সবাইকে। কোলাবিক্রেতা ভদ্রলোক, স্থানীয় গারো তিনি, হিসেবে ভুল করে কিছু কম টাকা ফেরত দিয়েছিলেন, পরে আবার মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে সে টাকা কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিয়ে গেলেন।

প্রবীরের খাবারের অকুন্ঠ প্রশংসা করে আবার ওয়াইএমসিএ-তে ফিরলেন অভিযাত্রীরা। এবার রুম শুন্য, দোতলায় তিনটা ঘর দখল করলেন তাঁরা। পনেরো মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোবেন সবাই।

একটা ক্ষুদে সিয়েস্তা উপভোগ করে পৌনে চারটার দিকে মোড়ের দিদির চায়ের দোকানে বসলেন অভিযাত্রীরা। দোকানের লাগোয়া মোবাইল ফোনের বন্দোবস্ত, সেখান থেকে ঢাকায় ফোন করে উদ্বিগ্ন পরিবারকে আশ্বস্ত করলেন কয়েকজন। গারো দিদির চা অসাধারণ, চুমুক দিয়েই সবার মেজাজ খোশ হয়ে উঠলো। কয়েক পা এগোলেই বিরিশিরির আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সেখানে গিয়ে দেখা গেলো সদর দরজায় খুবই অবান্ধবোচিত ভাষায় নানা সতর্কবাণী লেখা। তবে এই সতর্কবাণীগুলো মেনে না চললে অতি আগ্রহী টু্যরিস্টরা এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির বারোটা বাজিয়ে ফেলতে পারেন। সাতপাঁচ ভেবে সবাই বুক ঠুকে ঢুকে পড়লেন। পরিচালক কবি রফিক আজাদ ঢাকায়, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উত্তম রিছিল উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন আমাদের। নিজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন গোটা কেন্দ্র। এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার আদিবাসী, যথাক্রমে গারো ও হাজং, তাঁদের সাংস্কৃতিক নিদর্শনের রক্ষণ-লালন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, স্থাপিত হয়েছে ১৯৭৭ সালে। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রয়েছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, অডিটোরিয়াম, স্টাফ ডরমিটরি, পুকুর, বাগান এবং চমৎকার বাগান ঘেরা পরিচালকের ছিমছাম বাসভবন। সেই বাসভবনের বারান্দায় বসে বাইরের বৃষ্টি দেখতে না পারার জন্যে শিলা আপা ঘন্টাখানেক ধরে আফসোস করলেন।

উত্তমদা গারোদের সম্পর্কেও জানালেন অনেক কিছু। এককালের দুই বর্ধিষ্ণু আদিবাসী সমপ্রদায়, গারো আর হাজং-দের ক্ষীণ একটি ধারা এখন বাংলাদেশে বাস করছে। যুগে যুগে ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচারে তাঁদের মূল সংস্কৃতি ও জীবনধারা ব্যাহত হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে দেশত্যাগ করেছেন দুই সমপ্রদায়ের বহু লোক, নিহতও হয়েছেন অনেকে। শতকরা একশো ভাগ গারো বাধ্য হয়েছেন তাঁদের প্রকৃতিপূজারী ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টীয় ধর্ম গ্রহণ করতে। তবে হাজং সমপ্রদায় মিশনারিদের কাছে নত হন নি, তাঁদের সনাতন ধর্ম ত্যাগ করেননি কিছুতেই। ১৮৯০ সালে বিরিশিরিতে স্থাপিত হয়েছে প্রথম ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, রাণীক্ষং-এ ১৯১২ সালে চালু হয়েছে ক্যাথলিক সেন্ট জোসেফ'স চার্চ।

আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পুকুরপাড়ে গারোদের ওয়াচটাওয়ার বা "বোরাং" রয়েছে। জুম চাষের সময় গাছের ওপর গাদা বন্দুক নিয়ে পাহারায় বসেন তাঁরা, হাতি বা ভালুক ক্ষেতে হানা দিলে বন্দুকের শব্দ করে ভয় দেখান। প্রায়ই নাকি মেঘালয় থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে দলে দলে হাতি, সীমানা পেরিয়ে ক্ষেতের ফসল মুড়িয়ে খেয়ে রেখে চলে যায়। তবে এই হাতিদের তাড়ানো খুব মুশকিল, তাদের সম্বোধন করতে হয় মামা বলে, আপনি-আজ্ঞে করে বিনীত ভাবে বিদায় হবার অনুরোধ পেশ করতে হয়। আদবে একটু নড়চড় হলে এ মামারা বড্ড নাখোশ হন। আর গালিগালাজ করা খুবই বোকামির একটা কাজ। বাংলা আর গারো, দুটি ভাষাই তারা বোঝেন, গালি দিলে ঘুরে এসে গালিদাতা ভাগ্নের জীবননাশ করে চলে যান।

আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দেখা গেলো, সূর্য ঢলে পড়েছে অনেকখানি। কিন্তু কারো হাতেই ঘড়ি নেই। আরেকটু এগিয়ে সড়ক ছেড়ে সোমেশ্বরীর তীরে নেমে পড়লেন অভিযাত্রীরা। হাইকিঙের নেশা তাঁদের সবার মাঝে, নদী ধরে হেঁটে যাওয়াই ঠিক করলেন সবাই।

শেষ বিকেলের মরে আসা আলোয় সোমেশ্বরীর রূপ অতটা বোঝা যাবে না। তবুও সেই আলোয় নদীর ধূ ধূ চর, তাতে দুলতে থাকা কাশের বন, দূরে মেঘালয়ের নীল পাহাড়, আর তার চূড়োর কাছে জমে থাকা মেঘ, নদীর চরে বসে থাকা বকের সারি, আর জলে জ্বলতে থাকা ক্লান্ত সূর্য সবাইকে মুগ্ধ করলো।

নদীর কাছে এসে তার জলে পা না ভেজালে কি চলে? কাজেই কখনো নদী কখনো বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, তিল ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যে হবার মুখে দুর্গাপুরের মুখোমুখি হলেন সবাই। সামনে শান্ত সোমেশ্বরী, হাঁটুপানি মাত্র, সবাই হেঁটে হেঁটে পার হচ্ছে। চমৎকার ঠান্ডা জল, দুর্গাপুরের সড়কে উঠে সবাই আবার হাঁটা শুরু করলেন। স্থানীয় রিকশাচালকেরা যদিও খুব আপত্তি জানালেন, তাঁরা থাকতে মেহমানরা কেন হেঁটে যাবেন, কিন্তু হাইকারদের রিকশায় চড়া বারণ।

হাঁটতে হাঁটতে দুর্গাপুর বাজারে হাজির হলেন অভিযাত্রীরা। পূজোমন্ডপে ছেয়ে গেছে দুগর্াপুর, সবশুদ্ধ বাইশটা মন্ডপ তৈরি হয়েছে। পুতুল আপা বাজার দেখতে ভালোবাসেন, তিনি এ দোকানে সে দোকানে ঘুরঘুর করতে লাগলেন। একটা মিষ্টির দোকানে হালকা পেটপূজা সেরে বাজারে ইতনষ্ট স্ততভ্রষ্ট হয়ে বেড়াতে লাগলেন সবাই। কোন মন্ডপে ব্যান্ড পার্টি বিভিন্ন সুরে কাঁপিয়ে তুলছে চারদিক, আবার কোনটায় ঢাকের লড়াই চলছে দুই ঢাকীর মাঝে। ঘুরতে ঘুরতে দুর্গাপুর মন্দিরের সামনে জড়ো হলেন ছ'জন, সেখানে পাশাপাশি দুর্গা আর কালীর মূর্তির সামনে প্রণত অনেক ভক্ত। পুতুল আপা ছবি তুলতে লাগলেন, বাকি সবাই আশেপাশের মানুষের কৌতূহল নিবৃত্তির দায়িত্ব নিলেন। এক ভদ্রলোক, তাঁর ঢুলঢুলু চোখ সন্ধ্যের আঁধারেও সানগ্লাসে ঢাকা, ইংরেজিতে আলাপ চালিয়ে গেলেন কিছুক্ষণ, কিন্তু অভিযাত্রীরা ঢাকা থেকে এসেছেন শুনে তাঁর কৌতূহল অনাহারে মারা পড়লো।

এর পর বাজারের চারপাশটা আরেকটু দেখে নিয়ে, এক রাউন্ড চা খেয়ে বিরিশিরিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন দলের সদস্যরা। পূজোর আসর জমবে মাঝরাতে, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না কেউ। পরদিন অনেক হাঁটাহাঁটি আছে ভাগ্যে।

হাঁটতে হাঁটতে দুর্গাপুর বাজার থেকে হাইকারদের নাম ডুবিয়ে এবার রিকশা নিলেন সবাই, পাকা রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগছে না কারো। নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখা গেলো, কুচকুচে কালো জলে অষ্টমীর চাঁদ মলিন একটা ছায়া ফেলেছে, এই আবছায়ায় হেঁটে নদী পার হওয়া একটা ঝকমারি। তাছাড়া পানির গভীরতা একটু বেড়েছে, সবাই নৌকো করে পার হচ্ছেন। তাই একটা খেয়া নৌকোয় চড়ে আকাশে তারা দেখতে দেখতে নদী পেরিয়ে বিরিশিরিতে ফিরে এলেন তাঁরা।

ওয়াইএমসিএ-এর বাবুর্চির নাম এভারেস্ট, দুপুরেই তার সাথে বন্দোবস্ত করা হয়েছে রাতের খাবারের ব্যাপারে। খাবার পরিবেশনে একটু দেরী হচ্ছে দেখে পুরুষ সদস্যরা বিরিশিরি বাজারে একটু ঘোরাঘুরির জন্যে বেরোলেন। সেখানে দুর্গামূর্তির সামনে ধূপ হাতে ঢাকের বাজনার তালে নেচে চলেছে এক কিশোর, আর মাইকে কানফাটানো বিজ্ঞাপন চলছে পূজার লটারির। আস্তে আস্তে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছেন মন্ডপে। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার পেটের তাগিদে ওয়াইএমসিএতে ফিরলেন সকলে।

রাতের খাবার সেরে বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ আড্ডা মারলেন সবাই। ওয়াইএমসিএ-র দোতলা দালানের সামনে প্রশস্ত ঘাসে ছাওয়া চত্বর, তাতে হাজার জোনাকির রাজত্ব। আকাশে হালকা মেঘ, তাই চাঁদের আলো ঘোলা হয়ে আছে। হালকা বাতাস ঘুমপরীদের বার্তা এনে দিলো সবার চোখে।

২.

ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে সবার ওঠার কথা। কিন্তু বাদ সাধলো বৃষ্টি। গোঁয়ারের মতো ঝরেই চললো ব্যাটা। ঘুমবিশারদ হিমু বাদে সবারই মেজাজ কিঞ্চিৎ খিঁচড়ে গেলো, কিন্তু বেলা ন'টার আগে বৃষ্টি থামলো না, আর এ সময়টা ঘুম আর তন্দ্রার মাঝেই কাটিয়ে দিলেন সকলে। বৃষ্টি থামার পর ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সবাই। আজকের লক্ষ্য মেঘালয় সীমান্ত, রাণীক্ষং চার্চ আর বিজয়পুরের সাদামাটির পাহাড়।

বিরিশিরি বাজারে নাস্তা সেরে জোর হাঁটা দিলেন সকলে। সোমেশ্বরীর বাঁধ পেরিয়ে বালির চড়ায় নেমে নৌকো ধরে নদী পেরিয়ে শিবগঞ্জে পৌঁছুলেন যখন, তখন দশটা বেজে গেছে। আকাশে হালকা মেঘ, কিন্তু রোদের তেজ নেই মোটেও। হাঁটার আদর্শ আবহাওয়া, যদিও বাতাস কিছুটা আর্দ্র। ঘাট থেকে সোজা উত্তরে চলে গেছে পাকা সড়ক। পথভর্তি গরু আর গরুর দয়া, দেখেশুনে না চললে যে কোন মূহুর্তে তাতে পা পড়তে পারে। এদিকে শিলা আপা গরু ভয় পান, আর এটা বুঝেই হয়তো গদাইলস্করি চালে চলতে চলতে মাঝে মাঝে গরুগুলো তাঁকে ঢুঁশিয়ে দেয়ার ভান করে ভয় দেখাচ্ছে। পর পর কয়েকবার এমন হতে শিলা আপা এক ছুটে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেন, যাতে এসব গরু টাইপ জানোয়ার তাঁকে ঘাঁটানোর সুযোগ না পায়।

হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পরপর পথচারীদের কাছে বিজয়পুরের দিক জানতে চাইলেন তারা, কারণ কখন যে কোন সড়ক কোথায় বেঁকেচুরে যায়, তা বোঝা ভার। এই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হলো, যখন জনৈক ভদ্রলোক জানালেন, সামনে ডানে নেমে গিয়ে ঘুরে যেতে হবে, মূল সড়ক দু'জায়গায় ভাঙা। আর ভাঙা অংশে দুই মানুষ পানি। খানাখন্দের পরোয়া করেন না সদস্যরা, কিন্তু দুই মানুষ কাদাপানির সাথে গাজোয়ারি না দেখানোই ভালো। কাজেই ক্ষেতের মধ্যে নেমে গিয়ে গ্রামের ভেতরে ইঁট বিছানো সড়ক বরাবর হাঁটতে লাগলেন তাঁরা। এখন ডান পাশে সোমেশ্বরী নদীর অপূর্ব তীর, বামে ছিমছাম ঘরবাড়ির নিকোনো উঠোন। মেঘ হারিয়ে গেছে কখন, চারদিকে ঝাঁ ঝাঁ রোদ এখন। এভাবে চলতে চলতে তাঁরা পেরিয়ে গেলেন ডাকুমারা-ইসলামপুর, বড়ইকান্দি আর কামারখালি। মাঝখানে রামকৃষ্ণ মিশনে থেমেছেন সকলে, পেটপুরে পরিষ্কার টিউবওয়েলের জল পান করেছেন। রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজা উপলক্ষে খিচুড়ি রান্না হচ্ছিলো, অভিযাত্রীদের উষ্ণ নিমন্ত্রণ জানালেন সেখানকার বড়কর্তা। কিন্তু পূজোর প্রস্তুতি খানিকটা দেখেই আবার পথে নেমে এলেন সকলে, খিচুড়ির মনমাতানো সৌরভের প্রলোভনকে টুঁটি চেপে খুন করে। হাইকারদের অমন ছোঁচা হলে চলে না।

কামারখালিতে পৌঁছে রিকশা নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন দলপতি। বড় সড়ক ধরে বাস্তবিক হেঁটে মজা নেই। তাই তিনটা রিকশায় চড়ে মিনিট দশেকের মধ্যে বিজয়পুর আর মধুবাড়ি ফাঁড়ির তেরাস্তায় এসে থামলেন তাঁরা। সেখানে জনৈক বিডিআর সদস্য বাজারে ডিম কিনতে এসেছিলেন, তিনি আমাদের সীমান্ত এলাকায় হাঁটাহাঁটির ইচ্ছের কথা শুনে খুব দৃঢ়ভাবে জানালেন, এ বছর এ সুযোগ পাচ্ছে না কেউ। সীমান্ত এখন গরম, গত কয়েকদিনে হাজার হাজার বাংলাদেশী সীমানা লঙ্ঘনার্থীকে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে ভাগানো হয়েছে। এই ভ্রমণে বেরোবার আগে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো, পূজার দিনগুলোয় বিজয়পুর সীমান্ত খুলে দেয়া হয়, কিন্তু গত বছরের কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার জের হিসেবে এবার এ সুযোগ লুপ্ত।

চোখের সামনে পাকা ফলের মতো ঝুলে আছে নীলরঙা গারো রেঞ্জ, কিন্তু সেটা ভারতে পড়েছে। দেশবিভাগের সময় কেন এই স্বপ্নের মতো পাহাড়গুলো বাংলাদেশের ভাগে পড়েনি, এ নিয়ে আফসোস করতে করতে খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজ ঠান্ডা করতে একটা মুদি দোকানে হালকা পানীয় নিয়ে বসলেন অভিযাত্রীরা। দোকান সামলাচ্ছে এক বালক, রেজাউল তার নাম। আসিফের গানের মহাভক্ত সে, চোখ বুঁজে প্রেমিকা কেন চলে গেলো, এ নিয়ে আফসোস সংক্রান্ত একটা গান আউড়ে যাচ্ছে সে। তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন পুতুল আর শিলা আপা। ছোকরা মহা এঁচড়ে পাকা, বাইসেপে উল্কি আঁকা, এই বয়সেই খৈনি না হলে তার চলে না, সেই মেঘালয়ের বাজার থেকে খৈনি কিনে এনে খায় সে। বয়স জিজ্ঞেস করতে সে জানালো, পনেরো-ষোলো তো হবেই, যদিও তাকে দেখে দশ বছরের বেশি মনে হয় না। না, পড়াশোনা সে করে না, বাবার দোকান সামলায়। আশেপাশের দোকান থেকে এই এলাকার কয়েকজন মুরুব্বি জানালেন, এই ছোকরাকে শাসন করা শক্ত, কিছু বললেই সে টাকাপয়সা মেরে উধাও হয়ে যেতে পারে। পুতুল আপা মৃদু ভঙ্গিতে শাসন করলেন তাকে, খৈনি না খেয়ে চকলেট-মিষ্টি খাওয়ার সদুপদেশ দিলেন। আরেক মুরুব্বি জানালেন, খৈনি আর এমন কি, ওর চেয়ে গুরুতর জিনিস রপ্ত করে বসেছে রেজাউল। এ কথা শুনে দাঁত খিঁচিয়ে সে বললো, 'ধ্যত্তেরি, জীবনে আছেই বা কী?' হিমু হাসি হাসি মুখে জানালো, জীবনে অনেক চমৎকার সব জিনিস আছে, তবে ছোটবেলা থেকে খৈনি খেয়ে ভবিষ্যৎটাকে পঁচিয়ে ফেললে সেসব জিনিসের নাগাল পাওয়া মুশকিল, তখন হায় আফসোস ছাড়া করার কিছুই থাকবে না। এতো সদুপদেশ হয়তো রেজাউলের পছন্দ হলো না, সে গা মোচড়াতে লাগলো। শিলা আপা তবুও তাকে রেহাই দিলেন না, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে একসময় বিদায় নিলেন তার কাছ থেকে।

ওদিকে শাহেদ ভাই আর মিলন ভাই নিখোঁজ। খানিকক্ষণ তাদের খুঁজে না পেয়ে এক গারো দিদির দোকানে মেসেজ রেখে বাকি চারজন পা বাড়ালেন রাণীক্ষং চার্চের দিকে। পথে একদল বালক নির্বিকারচিত্তে ভুল রাস্তা দেখিয়ে দিলো, সে পথ ধরে ঘন জঙ্গলের দোরগোড়ায় গিয়ে আবার ফিরে এলেন অভিযাত্রীরা, সেই বালকেরা তখন নক্ষত্রবেগে দৌড়ুচ্ছে উত্তর দিকে। কী আর করা, আরেকটু এগিয়ে বয়স্ক এক ভদ্রলোককে জেরা করে চার্চের অবস্থানটা জেনে নেয়া হলো।

রাণীক্ষং চার্চের গোড়ায় পোস্ট অফিস, আর পাশ দিয়ে বয়ে চলছে সোমেশ্বরী, আর তার পাশেই ভারত। টিলার ওপরে চার্চ, বিরিশিরি থেকে আগত একদল কিশোরের সাথে চার্চে ঢুকলেন সবাই। চার্চের ক্যাম্পাস অসাধারণ শান্ত, সমাহিত ভাব চারদিকে, ছায়ায় বসলেন সকলে। খানিকক্ষণ পর শাহেদ ভাই আর মিলন ভাই এসে হাজির। এবার ফাদার ক্লিনসন মানকিনের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন তাঁরা। টিলার একদম ওপরে ফাদারের বাসভবন, সেখান থেকে চারপাশটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। গারোদের ধর্মান্তর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো তাঁর সাথে। গারোরা কখনও কারো বশ্যতা স্বীকার করেনি, কাউকে খাজনা দিতে চায়নি, তাদের কিছুটা শিথিল করা হয়েছে খ্রিষ্টের ধর্মের সংস্পর্শে, ভালোবাসা আর মমতার কথা দিয়ে, জানালেন ফাদার। গারো শব্দটাই নাকি গোঁয়ার থেকে এসেছে, এমনই একটা ধারণা চালু আছে, কারণ গারোরা নিজেদের মান্দি বলে ডাকে, যার অর্থ মানুষ। বেশ বিস্ময়কর মিল এস্কিমোদের সাথে, যারা নিজেদের নানুক --- অর্থাৎ মানুষ --- নামে ডাকে, আর যেখানে এস্কিমো শব্দের অর্থ কাঁচা মাংসখোর। আদিবাসীদের বিকৃত নামে ডাকার রীতি বোধহয় ঔপনিবেশিকতার একটা ধারা।

ফাদার মানকিন আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন চার্চের চারপাশটা। টিলার ওপর থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, ভবানীপুর ক্যাম্প চোখে পড়ে। মাইল দুয়েক সামনেই মেঘালয়, সেই বিশাল নীল পাহাড়গুলো।

ফাদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার সোমেশ্বরীর দিকে এগিয়ে গেলেন অভিযাত্রীরা। মেঘ সরে গিয়েছে বহুক্ষণ হলো। দুপুরের রোদ মাতালের মতো টলছে চারদিকে, সোমেশ্বরী তার রূপের ভান্ডার উজাড় করে দিচ্ছে সামনে। পারদ আর রূপোর মতো জলের ওপর সোনালী-হলুদ বালির চড়া, তার ওপাশে পান্নাসবুজ পাহাড়, তার ওপরে গম্ভীরনীল আকাশ, আর তার ওপর নীলচে কালিমাখা ধবধবে তুলোর মতন মেঘ, আর সেই মেঘেরও ওপাশে উঁকি দিচ্ছে ওপাশের নীল পাহাড়সারি। ব্যাগ আর জুতো খুলে রেখে হুড়োহুড়ি করে সোমেশ্বরীর মিষ্টি-শীতল জলে নেমে পড়লেন সকলে। উঁহু, গোসলের জন্যে নয়, হেঁটে হেঁটে নদীর মাঝের চরটায় উঠবেন সবাই। সেখানে হলুদ বালির ফাঁকে ফাঁকে জমে আছে নীল জল।

সোমেশ্বরীর বুকে সাধ মিটিয়ে ছুটোছুটি ঝাঁপাঝাঁপি করে একসময় আবার ফিরে এলেন সবাই। চার্চের স্কুলের বারান্দায় খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার এগোলেন সবাই, সাথে পকেটভর্তি কাঁচা তেঁতুল, নদীর পাড়ে বিশাল তেঁতুল গাছটায় এক পিচ্চির সৌজন্যে পাওয়া। মেহমানদের অনুরোধে একেবারে গাছ ফাঁকা করে তেঁতুল পেড়ে দিয়েছে সে। এরপর বড় সড়কে উঠে শুরু হলো হাঁটা। ওপরে শরতের উদাস আকাশের নীল, দুপাশে ক্ষেতের সবুজ, উষ্ণ রোদকে হটিয়ে দিচ্ছে বাতাসের ঝলক, আর কী চাই? এবার গন্তব্য সাদামাটির পাহাড়।

কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। মিনিট ত্রিশেক হেঁটে বহেরছড়িতে থেমে চিঁড়ের চানাচুর, দেওদানার খই, কলা আর কুঁড়িবেলের চা খেয়ে লাঞ্চের স্বাদ মেটাতে হলো। অবশ্য পথে টানাকলের পানিও খানিকটা পেটে ঢুকলো। কুঁড়িবেলের চা জিনিসটা অসাধারণ, কচি বেলকে শুকিয়ে ঢেঁকিতে কুটে বানানো হয় এই পানীয়। চমৎকার ঝাঁঝালো ফ্লেভার, চায়ের কাজ চালিয়ে নেয়া যায় অনায়াসে।

এরপর মূল সড়ক থেকে নেমে কাঁচা পথে নেমে যেতে হলো। পথের পাশে বেঁধে রাখা গরুদের মাথায় হাত বুলিয়ে, ক্ষুদে ছাগলশিশুকে পথ ভুলিয়ে দিয়ে, পাতিহাঁসের দলকে তাড়া করে খানিকটা এগোনোর পর একটা কালভার্টের ওপর বসলেন সবাই। স্থানীয় হাজং ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ জুড়ে দিলেন পুতুল আপা, বাকিরা সতৃষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন মেঘালয়ের এক উঁচু চূড়ার দিকে। অনেক দূরে সেই পীক, উচ্চতা তিন থেকে চার হাজার ফিটের মতো হবে, অন্যান্য পাহাড়কে হার মানিয়ে তার নীল শীর্ষ সগর্বে স্পর্শ করেছে সাদা মেঘের ভেলাকে। হয়তো একদিন ঊঈই সদস্যরা সেখানে ট্রেক করতে যাবেন, কে জানে।

পথে আরো একবার থেমে আরো ঘন্টাখানেক হেঁটে একসময় ছনগড়া পার হয়ে আরাপাড়ার সাদামাটির পাহাড়ের দেখা মিললো। পাহাড় নয়, টিলা। সেখানে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে অফিশিয়াল চিত্রগ্রহণের পর মনমরা হয়ে নেমে এলেন সকলে। সাদামাটির পাহাড় দেখতে এতোদূরে এসে এই পিচকিনি টিলা দেখে কারো মন ভরে নি। কী আর করা। ওদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে, হেঁটে শিবগঞ্জে ফেরাটা আর নিরাপদ নয়। তাই রিকশার খোঁজে সামনে বিপিনগঞ্জের বাজারে এগিয়ে গেলেন পুরুষ সদস্যেরা। পুতুল আপা আর শিলা আপাকে স্থানীয় এক হাজং পরিবারের সাথে গল্প করার দায়িত্ব দিয়ে বসিয়ে রাখা হলো।

বিপিনগঞ্জের বাজার মোটামুটি বড়, সেখানে চা আর কলা খেয়ে তিনটা রিকশা জুটিয়ে ফেললেন অভিযাত্রীরা। বাজারে এক জায়গায় বড় বান মাছ আর কচ্ছপ বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর বেগতিক হাল দেখে খানিকটা মন খারাপ করে আবার ফিরে এলেন মিলন ভাই আর হিমু। ওদিকে শাহেদ ভাই কোলার বোতল ভর্তি করে টাটকা দুধ কিনে নিয়েছেন, রাতে ডিনারে জমবে ভালো। ইকবাল ভাই তিন টাকায় তিনটা বাতাবি লেবু কিনে এনে হাজির।

রিকশায় চড়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে নেমে এলো। রাণীক্ষঙের মাঠে ফুটবল ম্যাচ দেখে সাইকেলে চড়ে ঘরে ফিরছেন ছনগড়া-আরাপাড়া-মাইজপাড়া-বিপিনগঞ্জের মানুষেরা, তাদের কাছ থেকে খবর নিলেন রিকশাচালকেরা, জানা গেলো ভবানীপুর কাকে যেন চারখানা গোল দিয়ে হারিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরপরই নামতে হলো রিকশা থেকে, পথ এখানে ওখানে ভাঙা। আস্তে আস্তে গোধূলি ছেয়ে ফেলছে পৃথিবীকে। আকাশে জ্বলে উঠলো চাঁদ আর মঙ্গল। অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই মাঠে নামলো জোনাকির দল, পথের দুপাশে তাদের রাজত্ব। কাওসার আহমেদ চৌধুরির লেখা গান কন্ঠে জেগে উঠতে চায় এমন দৃশ্য দেখলে, এখানে রাত এমনই নির্জন, কবিতা পড়ার প্রহর শুরু হয়ে যায় সন্ধ্যের পরপরই।

শিবগঞ্জের ঘাটে এসে ট্রলারে চাপলেন সবাই, ভর সন্ধ্যে তখন। সোমেশ্বরীর হালকা ছলাৎ ছলাৎকে ছাপিয়ে ফুঁসে উঠলো শ্যালো ইঞ্জিন, আবার বিরিশিরিতে ফিরলেন অভিযাত্রীরা। জোনাকি আর জ্যোছনার হাতে সঁপে দিয়ে এলেন তারা রূপবতী সোমেশ্বরীকে।

ওয়াইএমসিএতে ফিরে গোসল সেরে রাতের খাবার সেরে নিলেন সকলে। পরদিন কলমাকান্দার দিকে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা ছিলো, কিন্তু বাবুর্চি এভারেস্টকে জেরা করে জানা গেলো সেখানে আপাতত দেখার কিছু নেই। তাছাড়া রাস্তার অবস্থা এখন খুবই খারাপ। পরে কোন একসময় হাওড়াঞ্চলে সময় কাটানোর সংকল্প নিয়ে ঘুমুতে গেলেন সবাই। তবে ঘুমের আগে একটা জমাট আড্ডা ECB সদস্যরা কখনো মিস করেন না।

৩.

পরদিন ভোরে তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি। আধোঘুমে ভোরটা কাটিয়ে সকালে উঠে পড়লেন সকলে। ব্যাগ গুছিয়ে ওয়াইএমসিএ ছেড়ে বেরোলেন তাঁরা, বিল চুকিয়ে দেয়া হয়েছে গত রাতেই। পূজা মন্ডপের পাশে একটা খাবার দোকানে নাশতা সেরে বিরিশিরি বাস স্ট্যান্ডের দিকে রিকশায় চেপে যাত্রা করলেন সকলে। আজ আকাশ মেঘ নিয়ে খেলছে।

ঢাকার বাস ছাড়বে বারোটায়, আর জারিয়াতে অভিযাত্রীরা পৌঁছুলেন সাড়ে দশটায়। মোখলেস নামে এক বালক এই ভিনদেশী বোঁচকাওয়ালা প্যাসেঞ্জারদের হাতছাড়া করতে রাজি নয়, কোত্থেকে ছুটে এসে ঝুলোঝুলি করতে লাগলো সে, তার নৌকোতে করেই এই বৈতরণী পার হতে হবে। এতটুকু পিচ্চির এই উপার্জনস্পৃহা দেখে হিমু আর ইকবাল বেশ স্পৃষ্ট হলেন, মোখলেসের ডিঙিতে চড়ে বসলেন সকলে। কিন্তু তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই সবাই টেরটি পেলেন, সিদ্ধান্তটা অতটা ভালো হয়নি। কারণ মোখলেসের রন্ধ্রেরক্তে রয়েছে একক নৌকাবাইচে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ের নেশা, সে তুফানের মতো বৈঠা মেরে চলছে, তার উৎসাহের চোটে নৌকো এই ডোবে তো সেই ডোবে অবস্থা। ভয়ে ভয়ে হিমু জানতে চাইলো, এখানে পানি কতটা গভীর। মোখলেস তার সবক'টি দাঁত বিকশিত করে জানালো, তিরিশ চল্লিশ হাত তো হবেই। হাতটা কি ওর না হিমুর হাত, জানতে চাওয়ায় সে একটা অট্টহাসি দিয়ে আরো টালমাটাল ভঙ্গিতে নৌকো বেয়ে চললো। টেরাফির্মাতে পা রাখার পর অনেকের বুকের ধুকধুক কমে এলো।

ওদিকে টিকেট কাটতে গিয়েও আরেক আপদ। রাস্তার পাশের ঢালে একটা ঝুপড়ি ঘরে টেবিল আর বেঞ্চ পেতে কাউন্টার তৈরি করা, আর তার পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে একখানা বিশাল বাস। হঠাৎ কী হলো, বলা নেই কওয়া নেই সেই মহারাজ কাত হয়ে পড়লেন। উপস্থিত কয়েকজন ততক্ষণাৎ সেই জগদ্দলকে ঠেলে কোনমতে আটকে রাখলেন, নইলে ঝুপড়ি ঘরকে ধ্বসিয়ে দিয়ে নিচের জমিতে গিয়ে আছড়ে পড়তো বাসটা, আর তার নিচে যে কতজন পড়তেন তার হিসেব নেই। তবে হিমু সেই ঝুপড়ি ঘরের জানালার বারোটা বাজিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়েছে, তার ধারণা বাসটাকে আটকে রাখার সাধ্য ঐ জনা দশেক লোকের নেই। কিন্তু শেষ পর্যণ্ত বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, বাসটা দুলকি চালে কাত হয়েই খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলো।

টিকেট কাটার পর দেড়টি ঘন্টা চায়ের দোকানে আড্ডা মেরে আর পথের পাশে পুকুরপাড়ে বসে কাটিয়ে দিলেন ছ'জন। আগামী বছর একটা শক্ত ট্রেকিঙের প্রোগ্রাম হাতে নেবেন ঊঈই সদস্যরা, সেটা কি তিব্বতের কৈলাস পর্বত প্রদক্ষিণ, নাকি অন্নপূর্ণা ট্রেইলে চক্কর মারা --- এই নিয়ে ক্লাবের গত মিটিঙে অমীমাংসিত থেকে যাওয়া নানা ইসু্য হিসেবনিকেশ করতে করতে দেড়ঘন্টা একসময় পার হলো। বিরিশিরি ছেড়ে বাস ছুটলো ঢাকার দিকে।

পাঠক, ঘুরে আসুন বিরিশিরি-দুর্গাপুর-বিজয়পুর থেকে, ছুঁয়ে আসুন উদ্ভিন্নযৌবনা সোমেশ্বরীকে। যাবার আগে একটু যোগাযোগ আর পরিকল্পনা করে যাবেন, নইলে হয়তো মিছেই সময় নষ্ট হতে পারে। আর হ্যাঁ, সেই নির্জনতা আর সৌন্দর্যকে দয়া করে নষ্ট করবেন না। গোটা পৃথিবীর সৌন্দর্য আমাদের জন্যে, ভবিষ্যতেও আমাদের জন্যেই থাকবে, যদি না আমরা তাকে আমাদের বুটের নিচে পিষে মারি। শহরের প্লাস্টিক-কাগজের আবর্জনায় কলঙ্কিত করবেন না মাতৃভূমির সোনালী আঁচলকে।

(অক্টোবর ০৫, ২০০৩)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

একবার সব বন্ধুবান্ধব মিলে ঘুরতে যাওয়ার প্লান করছিলাম । সবাই নানান জায়গার কথা বলছিল । আমি সোমেশ্বরীর কথা তুলেছিলাম । ধোপে টেকেনি । সবাই বলেছিল আরে একটা নদী দেখার কি আছে । আমাদের সোমেশ্বরী দেখা হয়নি সেবার । কিন্তু মনের মধ্যে ইচ্ছেটা আমার ছিল । আপনার লেখা পড়ে ইচ্ছেটা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। পরীক্ষা শেষের এই বন্ধে যাব নাকি একবার !
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

হিমু এর ছবি

গেলে শরতে যাওয়াই ভালো। আমি পরে শীতের শেষ আর গরমের শুরুতে গিয়েছি, তখন তেমন একটা ভালো লাগেনি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অতিথি লেখক এর ছবি

পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ ।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আপনার লেখা এই ভ্রমণকাহিণীটাই প্রথমে পড়েছিলাম। পিডিএফ থেকে। কত্তকাল আগের কথা মনে হয় এখন!

আলমগীর এর ছবি

জীবনে তো কিছুই দেখলাম না। দুর্গাপুরে আমার এক খালাগোত্রীয় কে থাকতেন। কখনই যাওয়া হয়নি। সুন্দর বর্ণনা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সোমেশ্বরীতে আমি বেশ কয়েকবার গেছি... কয়েকবারের চেয়ে অনেকবার বলাটাই ভালো। ঐটা ছিলো আমার ডুব দেওয়ার জায়গা। ঢাকা শহরে ক্লান্ত হইতে হইতে এক সকালে হুট কইরাই রওনা দিতাম বিরিশিরিতে। তারপর পৃথবীবির সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কয়েকটা দিন। তখন সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিলো না।
সোমেশ্বরী এখন দেশের প্রায় হারিয়ে যেতে বসা নদীগুলোর একটা। আমি তারে প্রথম দেখি আজ থেকে বুঝিবা এক যুগ আগে... সেই রূপ এখন নাই। তবু মনে হয় বর্ষার উন্মত্ত সোমেশ্বরীর রূপটাই বেশি খোলতাই।

আর বিরিশিরিতে আমার সবচেয়ে উপভোগ্য ছিলো দিনের ঘোরাঘুরির বাদে সারারাত কবি রফিক আজাদের সাথে আড্ডা... মেঘালয় থেকে আসতো ডিপ্লোমেট... পাশের ঘরে বাজতো হাসন রাজা... আহ্...

আর দিনে তারই সহকারী আর্নিশ মান্দা আমার সঙ্গি। আর্নিশের নিজের হাতে বানানো হাড়িয়া খাওয়ার স্বাদ কি ভোলা যায়? তার সাথে ঘুরে ঘুরে একেবারে গারোদের নিজস্ব ভেতরে যাওয়া। আমি বুঝি আর বাইরের কেউ না তবে।

২০০৩ এ আমিও গেছিলাম সোমেশ্বরীতে... শীতে... তখন সোমেশ্বরী পায়ে হেঁটে পার হয়েছি। সঙ্গে আমার দুই কলিগ বন্ধু... তারা যেতেই চাইছিলো না... কিন্তু আমার মুখে এত প্রশংসা শুনতে শুনতে একদিনের জন্য গিয়ে তারপর আর আসেন না... তিনদিন থাকলেন।

গত কয়েক বছর ব্যস্ততায় যাওয়া হয় নাই... এইবছর যাবো ভাবতেছি। প্রথমবারের মতো বউ পোলাপান নিয়া।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

হিমু এর ছবি

আকারের কারণেই কি না কে জানে, ভ্রমন্থনগুলি পাঠক পায়নি।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মেহজাবীন আহমেদ এর ছবি

দুর্গাপুর ও বিরিশিরি নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ
http://www.facebook.com/group.php?gid=9355095478#/group.php?gid=9355095478

হিমু এর ছবি

গ্রুপটা খুব গোছানো। দেখে ভালো লাগলো। মেহজাবীন ও তাঁর সহকর্মীরা, যাঁরা এই গ্রুপের পেছনে সময় দিয়েছেন, তাঁদের অভিনন্দন। আমার এই লেখাটির লিঙ্কও দেখতে পেলাম, সেজন্যে ধন্যবাদ।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

স্বপ্নহারা এর ছবি

লেখা যথারীতি জটিল। এই ভ্রমণের আগে আমায় বলেছিলেন বিরিশিরি যাচ্ছেন।

ময়মনসিং থেকে মনে হয় ৩৭ কিলোমিটার বাস জার্নি। তার শেষ ১৫/২০ কিমি যেতে ৩ ঘন্টা লাগছিল...।আসলেই জানের উপর দিয়ে চলা।প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা!

আমি কোথাও কোথাও সোমেশ্বরী নদীর বদলে সোমেশ্বর নদ বলে উল্লেখ পেয়েছি আর কেউ কি এমন শুনেছেন?

-------------------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভাল লাগল পড়ে হাসি
আমার লেখাটারও বিজ্ঞাপন রেখে যাই... রিসেন্ট ছবি দেখতে পাবে সবাই। চোখ টিপি

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার
___________________
নীলগিরি ডাকছে আমায়
ভাসতে হবে মেঘের ভেলায় ...

অতিথি লেখক এর ছবি

ঈশ। এমন কত জায়গাই দেখা হয়নি জীবনে, কবে যে যেতে পারব...

লিঙ্ক পেয়ে পড়ে গেলাম; আপনার চমৎকার লেখা ওখানের সুন্দর ছবিগুলোকে পূর্ণতা দিল যেন...

কৌস্তুভ

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

যাব যাব করে বুড়ো হয়ে গেলাম, যাওয়া হলনা। লেখাটি পড়ে আবারও ইচ্ছাটি জেগে উঠলো। এখন ভাবনা, রাস্তাকি ভাল হয়েছে ? এই শরীর যাত্রার ধকল সইতে পারেতো ?
লেখাটি পড়ে তবু খানিকটা সাধ মিটল।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

তানিম এহসান এর ছবি

আহ সোমেশ্বরী! প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৯৪ সালে, কত কষ্ট করে যে যেতে হয়েছিল! কিন্তু সোমেশ্বরীর কাছে যেয়ে সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম। এরপর আবার যাই ১৯৯৬ সালে, সেবার দূর্গাপুর থেকে কলমাকান্দা পর্যন্ত রিকশা-নৌকা দিয়ে গিয়েছি, কি যে সুন্দর! তারপর কলমাকান্দা থেকে গভীর রাতে যেয়ে নেত্রকোনা পৌঁছানো।

বাংলাদেশে’র অসংখ্য নদী দেখেছি, সময় কাটিয়েছি নদী’র সাথে কিন্তু সোমেশ্বরী নিজ গুণেই সবচাইতে পছন্দের নদী, তারপর চিত্রা, বিলকুমারী, সন্ধ্যা...... নস্টালজিক হয়ে গেলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।