অপাংক্তেয় প্রাণ

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: রবি, ২৭/০৩/২০১১ - ৩:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চাঁদের আলো নিয়ে জন্মেছিল সে। হতদরিদ্র পরিবারেও উজ্জ্বলতা আর আনন্দের হাওয়াই মিঠাই উড়িয়েছিল। কচুঘেচু খেয়েও ফর্সা সুন্দর স্বাস্থ্যবান শরীরের শিশু। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সমস্যার উৎপত্তি। চার পাঁচ বছরে এসেও বুদ্ধি শুদ্ধির লক্ষণ নেই। দশ বছর পেরিয়ে গেলেও অবুঝ শিশু রয়ে যায়। মায়ের কোলে কোলে ঘুরতে চায়। ডাক্তার বৈদ্য দেখানোর পর বিষন্ন পিতামাতা জেনে যায় ছেলে জন্ম প্রতিবন্ধী, চিকিৎসায় ফল নেই।

এতবড় ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটতে আমেনার কষ্ট হতো। তবু ফুটফুটে মুখটা দেখলে কষ্ট উবে যেত। বিছানায় পেশাব পায়খানাও করে দিত সময় সময়। মা আছে, চিন্তা নেই। পরিষ্কার করে দেবে হাসিমুখে। পাড়াপ্রতিবেশী দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ছেলেটার তখন চোদ্দ বছর। একদিন আমেনাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হলো উপজেলা সদরে। টেম্পুতে যেতে দশ মিনিট। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে যেতে কষ্ট হলেও উপায় নেই। ঘরে কেউ নেই দেখার। যদি অবুঝ ছেলে পুকুরে নেমে ডুবে যায়, সেই ভয়ে এগারোটার দিকে দুই মুঠ সাদা ভাত লবন দিয়ে কচলে খাইয়ে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

দুপুরের পর গ্রামে একটা খবর এলে হৈ চৈ পড়ে যায়। কাছের মহাসড়কে একটা টেম্পুকে গুড়িয়ে দিয়ে পালিয়েছে বেপরোয়া বাস। স্থানেই মারা গেছে কয়েকজন। সেই টেম্পুর যাত্রী ছিল আমেনা আর তার ছেলে। দুজনেই মারা গেছে। লাশ নিয়ে গেছে পুলিশে।

হায় হায় করে ওঠে পাড়ার লোক। খবর পেয়ে শহর থেকে আমেনার স্বামী ছুটে এসে লাশের খোঁজ করতে যায় সদরে। গিয়ে কেবল বউয়ের লাশটাই পায়। ছেলের লাশ নেই। অনেক খোঁজার পর মারাত্মক আহত একটা ছেলেকে হাড়ভাঙা ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়েছে বলে জানা গেল। ওখানে গিয়ে আপাদমস্তক ব্যান্ডেজ বাধা অজ্ঞান ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ওঠে ফজলু।

ডাক্তাররা বহুকষ্টে অপারেশান করে জোড়াতালি লাগায় শরীরে। যতটুকু জোড়া লাগার ততটুকু লাগে। হাসপাতালের মেয়াদ শেষে নিয়ে আসতে হয় ছেলেকে। এই রোগীর আর কোন চিকিৎসা নেই। যা হয়েছে আর বেশী জোড়া লাগবে না। অনির্দিষ্টকাল হাসপাতালে থাকা যায় না।

ফজলু মিয়া পড়লো বিপদে। এই ছেলেকে এখন দেখবে কে? কথা বলতে পারে না, মাথায়ও গন্ডগোল আছে, এখন শরীরের সমস্ত হাড়ে ভাঙন। যখন হাত পা সবল ছিল তখনো হাঁটতো না, এখন এই পঙ্গু অবস্থায় কি করবে? আগে বিছানা নোংরা করতো, বউ সাফ করতো। এখন কে সামলাবে এসব। সন্তানের স্নেহ ছাপিয়ে বিরক্তিটাই প্রবলতর হতে থাকে চেহারায়। নানান জায়গায় ধর্না দেয় ছেলেটাকে গছানোর জন্য। এত মানবাধিকার সংস্থা এনজিও আছে দেশে। কিন্তু এই ছেলের দায়িত্ব নেবার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না।

গ্রামের লোকজন আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আল্লাহ গরীব মানুষকে এত বিপদ কেন যে দেয়। মড়ার উপর খাড়ার ঘা। মায়ের সাথে সাথে ছেলেটাও মরে গেলে ভালো হতো। ফজলু মিয়ারও সেই মত। কিন্তু ছেলেটা না খেয়ে না খেয়ে হাড় চামড়ায় জং ধরিয়ে ফেললেও মরার দিকে যাচ্ছে না। পাছা ঘষে ঘষে বাঁকাচোরা চার হাতপায়ে বিচিত্র উপায়ে ছেলেটা যখন স্থান পরিবর্তন করে, সেই দৃশ্যটা বর্ণনা করার ভাষা নেই। কারণ সেটা হাঁটাও না হামাগুড়িও নয়। কেমন একটা পাশবিক চলন। মানুষ থেকে একটা প্রাণী যেন পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভয়াবহ একটা দৃশ্য। না দেখলে বিশ্বাস করবে না কেউ।

খাদ্য গ্রহনের ব্যাপারটাও অদ্ভুত। প্রতিবেশীরা কুকুর বেড়ালকে যেভাবে খাবার দেয় সেরকম করে এই ছেলেটাকেও কিছু উচ্ছিষ্ট ছুড়ে দেয়। ছেলেটা সেই খাবার দুহাতের খামচাখামচিতে যে ভঙ্গিতে মুখে তুলে নেয় সেই দৃশ্যটা দেখলে কুকুর বিড়ালকেও অনেক ধনী মনে হবে। তাকানো যায় না এমন।

ফজলু মিয়া শহরে দারোয়ানির চাকরী করে, ছেলেকে দেখাশোনা করতে হলে চাকরী ছাড়তে হবে। সেটা সম্ভব না। তাই ছেলেটাকে গ্রামের মানুষের দয়ার উপর ছেড়ে দিয়ে শহরে চলে যায় সে। আর মনে মনে বিধাতার কাছে চায় ছেলেকে যেন ভালোয় ভালোয় তুলে নেয়। কিন্তু বিধাতা তার প্রতি কর্ণপাত করে না। মাস কেটে বছর গড়িয়ে গেলেও টিকে থাকে ছেলেটা।

গ্রামে যাইনি ইতিমধ্যে। ছেলেটার খোঁজ নেয়া হয় নি দীর্ঘদিন। অনেকদিন পর সেদিন ফজলু মিয়ার সাথে দেখা হলো পথে। খবর কি, জিজ্ঞেস করলাম। ফজলু মিয়া খুব স্বাভাবিক সুরে বললো-
"খবর খুব ভালো, ছেলেটা মরে গেছে।"

ফজলু মিয়ার চোখে বিষাদের চিহ্ন খুঁজে লাভ হলো না। পরম স্বস্তির চিহ্ন ঝলমল করছে সেখানে।
ভাবছিলাম ছেলেটার মূল্যহীন জীবনটার কথা। কোন কোন প্রাণ শরীরে এমন অপাংক্তেয় হয়ে ঝুলে থাকে!


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

"খবর খুব ভালো, ছেলেটা মরে গেছে।" - ধাক্কা খেলাম।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ধাক্কা থেকেই লিখতে হলো

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

-অতীত

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ধন্যবাদ অতীত

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

কী আর বলি! এটাই বাস্তবতা। এমনকি অসুস্থ অতিআপনজনদের বেলায়ও এই-ই হয়।

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অতি আপনজনের ক্ষেত্রেও

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। শুধু গ্রাম্য জীবনেই নয় শহরের অভিজাত পাড়ায় শিক্ষিত মহলে আরো বেশি...তাদের সাথে ফজলু মিয়ার পার্থক্যটা এখানেই ফজলু মিয়ারা স্বাভাবিক কন্ঠে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু শহুরে বাসিন্দারা তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাছে মান খোয়ানোর ভয়ে শুধু যে চুপ থাকে তা নয় তাদের বিরক্তির স্বীকার হয় তাদের-ই প্রতিবন্ধি শিশুটি...... হায়রে বাঙ্গালী সমাজ! এর নাম যদি জীবন হয় তাহলে কি প্রয়োজন এমন জীবনের...

সাবরিনা সুলতানা

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার মনে আছে হয়তো, এটা সেই ছেলেটার গল্প। শেষ পর্যন্ত পারিনি আমি। লিখেই অপরাধবোধের দায় সারলাম।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

খুব সত্যি। খুউব!! মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

নির্মম বাস্তবতা!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নিরুপায় নির্মম

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

অসুস্থ বাবা মায়ের মৃত্যুতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখেছি। কুলখানি, চল্লিশার নামে পার্টি দিতে দেখেছি। -রু

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

লেখাটা গল্প হলেই ভাল হত। খুব খারাপ লাগছে।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ভাবি গল্পই হতো

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব শকিং গল্প। তার চেয়েও শকিং হচ্ছে, এটা গল্প না।

----------------
সাত্যকি

----------------

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।