সোনার পাথর বাটি

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: শনি, ১২/০১/২০১৩ - ১:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭৫
-মারি আইসসোছ না? মারি ন আইউছ? মাইর হাইয়েরে মাইয়া ফোয়ার ডইল্লা ইক্কাই ইক্কাই হাঁদদদে না ব্যাডা? যা দুরো ইঁউত্তুন। মাইর হাইয়েরে আঁর হাঁছে নোয়াবি। চো**নীর ফোয়ার মাথা ফুডাই আঁর হাছে আবি। (মেরে আসছস, মেরে আসিস নাই? মাইর খেয়ে মেয়েমানুষের মতো কাদতেছিস? যা দুর হ এখান থেকে। মাইর খেয়ে আসবি না আমার কাছে, .....তার মাথা ফুডাই তারপর আসবি আমার কাছে)

তীব্র ঝাড়িতে ইউনুস মিয়া তার একমাত্র পুত্র পাড়ার হাড় জ্বালানো সাত বছরের ইসহাক মিয়াকে দুর করে দেয়। ইউনুস মিয়ার বিচার আচারের কায়দা ছিল এরকম। কর্কশ। কুৎসিত। ছেলেটা বাপের আশকারা পাবার পর কদিন বাদে সত্যি সত্যি ইট মেরে একজনের মাথা ফাটিয়ে ঘরে এল হাসতে হাসতে।
-আজিয়া এক চো**নীর ফোয়ার মাথা ফুডাই আসসি। (আজকে এক.......ছেলের মাথা ফুটিয়ে আসছি)

বাপ তাকে গোল্ড মেডেল দেবার মতো আনন্দে দুহাতে কোলে তুলে নেয়।
-এই তো বাফর ব্যাডা। এন্ডইল্লা গরিলি গম লাগে। নইলে তুই বাঁশখাইল্লা ইনুইচ্চার ফোয়া ন। (এই তো বাপের ব্যাটা, এরকম করলে ভালো লাগে, নইলে তুমি বাশখালীর ইউনুসের ছেলেই নস)

১৯৮০

বুমেরাং! একদিন ইউনুস মিয়ার কাছে আইসক্রীম খাওয়ার টাকা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে ইসহাক মিয়া। ঘর থেকে তাড়া খেয়ে রাস্তায় নেমে এবার নিজের বাপের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করা শুরু করলো। বাপবেটা দুজনেই যুদ্ধংদেহী। বাপ ঘরের মধ্যে লাটি হাতে বসে আছে। ইসহাক মিয়া ঘরে ঢুকতে পারছে না মারের ভয়ে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে খিস্তি করেই যাচ্ছে। আমাদের কানে তালা লেগে যাবার যোগাড় তার বাক্যবাণে। তার একটা চরম বাক্য হলো -"চো**নীর ফোয়া বাফর গুষ্টি মারি। তুই কি ন মরিবি? তুই মইরলে তোর হবরত যাইয়েরে ফত্তিন উগ্গা গরি লাথি মাইরগুম। (.........তুই কি মরবি না? তুই মরলে তোর কবরে প্রত্যেকদিন একটা করে লাথি দিয়ে আসবো)

১৯৮৫
ততদিনে আমি অন্য এলাকায়। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে পুরোনো এলাকা পার হবার সময় মুখোমুখি হলাম ইউনুস মিয়ার বউয়ের। আলুথালু বেশ। সে ছুটে এসে বললো, "অবা তুই ইসহাকরে ইক্কিনি গরি ডাহ না। ইতে গরত ন আইয়ের। উন্দি গোস্বা অইয়েরে হারাই হারাই গালিগালাজ গরের।" (তুমি ইসহাককে একটু ডেকে আনো, সে ঘরে আসছে না, রাগ করে ওদিকে দাড়িয়ে গালাগালি করছে)। স্কুলে যদিও ইসহাক আমাদের সাথে পড়তো কিন্ত ক্লাস এইটের পর তাকে আর স্কুলে দেখা যায়নি। বখে গিয়েছিল। পকেটে ছুরি নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। স্কুল সেখানেই ইস্তফা। তার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নাই অনেক বছর। এখন শুনছি ছিনতাইও করে। তবু এক সময়কার প্রতিবেশী বলে ডেকে আনার সাহস করলাম। নালাপাড়া বাজারের মসজিদের কাছে গিয়ে দেখলাম এই ভর দুপুরে মদ খেয়ে দুলছে আর খিস্তি করছে অবিরাম। তার সাঙ্গপাঙ্গরা অশ্লীল ভঙ্গীতে হাসতেছে। ইসহাকের চোখ লাল। আমাকে দেখে চিনতেও পারলো না বোধহয়। অচেনা এমন দৃষ্টিতে তাকালো, তাতে আমি শিউরে উঠলাম। তবু কাছে গিয়ে সাহস করে বললাম,"ইসহাক, তোরে তোর মা ডাকের।" কথা শুনে ইসহাক এমন একটা খিস্তি করলো, আমি কানে দুহাত দিয়ে একটা রিকশায় উঠে পালালাম জায়গা ছেড়ে।

১৯৯০
একদিন খবর পেলাম খুন ধর্ষন ডাকাতি ছিনতাই ইত্যাদি অভিযোগে ইসহাকের যাবজ্জীবন সাজা হয়ে গেছে। এলাকাবাসী স্বস্তি পেল। আমরাও খুশী হলাম উপযুক্ত সাজা হয়েছে বলে।

২০০৫
মানুষ তো মানুষ, খোদ সময়ই চমকে গেল সেদিন। কয়েক বছর আগে ছাড়াপ্রাপ্ত জেল ফেরত ইসহাক হাজি ইসহাক মজুমদার হয়ে ইলেকশানে দাঁড়িয়েছে। সেই ইসহাক!! শুধু দাঁড়ালো না, হাজিসাব ইলেকশানে জিতে এলাকার কমিশনারের মসনদে আসীন হলো। জাতীয়তা সনদের জন্য আমাকে একদিন তার দরবারে হাজির হতে হলো বিব্রতবোধ চেপে। দুই দশক পর দেখা হলেও দাড়িগোফের জঙ্গল ভেদ করে সেই সুফি শয়তান পুরোনো ইসহাককেই খুঁজে পাওয়া গেল। তবু বাল্য পরিচিত হিসেবে জাতীয়তা সার্টিফিকেটের সাথে এক কাপ চাও জুটে যায় বোনাস!

কমিশনার অফিস থেকে বেরিয়ে চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটটা খুলে দেখলাম। মনে হলো সিটি কর্পোরেশানের লাল সবুজ লোগোটা আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি দিচ্ছে। মনে পড়লো ছেলেবেলা থাকে আজ পর্যন্ত 'সোনার পাথর বাটি' নামের একটা বিদঘুটে বাগধারার অর্থ কোনদিনই ধরতে পারি নাই। আমার বর্তমান অনুভুতিটাকে সেরকম কিছু মনে হলো।


মন্তব্য

অমি_বন্যা এর ছবি

এ রকম অজস্র লোগো আছে চারপাশে সেই সাথে এইসব হাজি সাব । লোগোরা বিদ্রুপ করে আর লজ্জায় মাথা কাটা যায় বিবেকের।

লেখায় হাততালি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বিবেকও আজকাল সব সহনীয় হয়ে গেছে। পড়ার জন্য অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

ছোটবেলা থেকে সেইরকম শিক্ষা পেয়ে আসল হাজি সাব হয়ে গেসে,,, আমাদের আশেপাশে বেশিরভাগ তো এরাই।

বহুদ্দিন পর আপনার লেখা পড়লাম নীড়দা।
ভালো থাকবেন হাসি

- নৃ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। বহুদিন পর আপনাকে দেখেও ভালো লাগলো। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

কৌস্তুভ এর ছবি

দেশে দেশে একই অবস্থা। মন খারাপ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

উপমহাদেশে এগুলি অতি সুলভ দৃশ্য মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি এর ছবি

এটা কি গল্প? ভালো বুঝলাম না। তবে সেটা আমাদের বুদ্ধি কম বলে বোধহয়।

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি
---------------------------------
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরি তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।
--------------------------------------------

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এটা গল্পই। তবে জীবন থেকে নেয়া গল্প। কাছ থেকে দেখা গল্প।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

এত ছোট একটা ক্যানভাসে এত বিশাল সময়ের ছবি, এত সংক্ষেপে- সত্যিই অসাধারণ। ডায়ালেক্ট কি কক্সবাজারের নাকি?

এই চিত্র কি কোনদিন বদলাবে না? কি করে বদলাবে? কেউ সাহস করে মাঠে নামবে না। আর রাজনীতি এতটাই কলুষিত বলে প্রচারিত হয়েছে যে, ভালো মানুষ রাজনীতি করলেও তাকে অবশ্বাসের চোখেই দেখা হবে। কিন্তু এটাও সত্যি যে রাজনীতিতে ভালো মানুষ না আসলে পরিণতি নির্মম ধ্বংস!

নির্ঝর অলয়

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এই ধারা, এই রাজনীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। চলুক

স্যাম এর ছবি

দারুন নীড় সন্ধানী চলুক

মেঘনাদ এর ছবি

দুনিয়া আন এন্ডিল্লা গরি বরবাদ হই জাইবগদি এরি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।