হরতালের দিনলিপি এবং একটি আড়িপাতা বিদেশী সংলাপ

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: মঙ্গল, ২৯/১০/২০১৩ - ৩:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হরতালের তৃতীয় দিন আজ। চুড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম কিস্তির হরতাল আজ শেষ হবে। এত বয়সেও হরতালে সরকারের কি ক্ষতি আজো বুঝতে পারিনি। তবে দেশের ক্ষতি, মানুষের ক্ষতি এটা কিছুটা বুঝি। সেই হিসেবে আমার নিজের ক্ষতি খুব কম, আমার সামর্থ্যের মধ্যে আছে এখনো। সংক্ষেপে বলতে গেলে দৈনিক আর্থিক ক্ষতি যাতায়াতের নানা বাহন বাবদ নগদ সাড়ে তিনশো টাকা + কয়েক মাইল হাঁটার পরিশ্রম + ঘন্টা দুয়েক সময় + আর কিছু পথের ভোগান্তি = সফল হরতাল। অফিস যাতায়াতে কিছুদূর হাঁটি, কিছুদূর রিকশায় চড়ি, কিছুদূর টেক্সি টেম্পুতে ঝুলি, অথবা যখন যা পাওয়া যায় তাতে ঝুলে পড়ি প্রাণটা পকেটে নিয়ে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, একটা খাসা গণতন্ত্রের জন্য এইটুকু ভোগান্তি এমন কি বেশী ক্ষতি। জীবনের চেয়ে গণতন্ত্রের মূল্য অবশ্যই বেশী।

এটাই বাংলাদেশ, এখানকার এই নিয়ম। সারাবছর নানা ইস্যুতে হরতাল মারামারি থাকে। শতে শতে মানুষ মরলেও আমাদের গায়ে লাগে না। অঢেল জনসংখ্যা আমাদের। কোটি খরচ হয়ে গেলেও বেশী লাগবে না। একাত্তরে সামান্য ত্রিশ লাখ গেছে যা তিন বছরে ভুরে গেছিলাম। আমরা গণতান্ত্রিক দেশ। পাঁচ বছরে একবার চুড়ান্ত পর্বের গণতান্ত্রিক খেলা হয় যার নাম নির্বাচন। এই খেলা দেখে আসছি ১৯৯১ সাল থেকে। নির্বাচনের আগে প্রতিবার কিছু ভোগান্তি হয় মানুষের, যার নাম গণতান্ত্রিক ভোগান্তি। এদেশে বাস করতে হলে এটা মানতেই হবে। উপায় নাই। প্রধান দুই দলের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের এটাই সাধু নিয়ম। সবাই মেনে নিয়েছে। আমিও। কোন প্রতিবাদ করি না।

নিয়ম হয়েছে প্রতিবার সরকার বদলের সময় কয়েক লাখ লোক আন্দোলন সহিংসতা মারামারি করবে, আর কয়েক কোটি মানুষ মাথানীচু করে তা মেনে নেবে। কালকে আমি যখন অফিস থেকে ফেরার পথে প্রথম কিস্তি হেঁটে আগ্রাবাদ পৌঁছে ফুটপাতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম, সামনের রাস্তা দিয়ে শত শত মানুষ কর্মস্থল থেকে হেঁটে ফিরছিল মাথা নীচু করে। ভাগ্যবান কেউ কেউ রিকসা টেক্সিও পেয়ে গেছে। তবে রিস্ক আছে কোন যানবাহনে থাকলে। আন্দোলনকারীরা হুট করে উদয় হয়ে আপনাকে আর আপনার যানবাহন দুটোকে পুড়িয়ে স্বর্গে পার করে দিতে পারে। আপনি তাও প্রতিবাদ করবেন না। মাথানীচু করে কবরে চলে যাবেন, অথবা পোড়া শরীর নিয়ে বাকী জীবন পঙ্গু হয়ে কাটাবেন। এসবের কোন প্রতিবাদ করার কিংবা অসন্তুষ্ট হবার নিয়ম নেই। গণতন্ত্রের নিয়ম সহনশীলতা।

সকালে অফিসে আসার আগে একাত্তর টিভিতে যিনি ক্ষমতা দেবেন আর নেবেন তাদের দুদিন আগের টেলিফোনের রেকর্ডকৃত কথা শুনছিলাম। কয়েক মিনিট শোনার পর স্ত্রী ফস করে বলে উঠলো, দুটোই দেখি কলতলার বুয়ার মতো ঝগড়া করছে। আমি শশশশশশ করে চুপ করতে বললাম। কথা বোলো না। ওরা জাতির মাতা অথবা মাথা। আর এখানে এটাই নিয়ম। চুপ করে মনযোগ দিয়ে শোনো। ওরা যদি বলে এটা আইন, তাহলে এটাই আইন। যদি বলে এটা সংবিধান, তাহলে এটাই সংবিধান। যদি বলে আমি হরতাল ছাড়তে পারবো না, তাহলে বুঝতে হবে পারবে না। এখানে কোন ঝামেলা নেই। সব পরিষ্কার। দুজনই গণতান্ত্রিক চেয়ারে বসা কিন্তু খুব খেয়াল কৈরা।

স্ত্রী তবু তেড়ে উঠে বললো, তাহলে কালকে যে মোড়ে এক প্রেগনেন্ট মহিলাকে হাসপাতাল যাবার পথে টেক্সি থেকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে টেক্সিতে আগুন ধরিয়ে দিল সেটা? অথবা ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের সেই শিক্ষিকা যাকে টেক্সিসহ আগুনে পুড়িয়ে দিল শিবিরের ছেলেরা, ওটা?

বললাম, এসব হলো নির্বাচনের প্রসব যন্ত্রণা। তোমার তো ভালো বোঝা উচিত। জাতি পাঁচ বছরে একবার গর্ভধারণ করে। সেই সময় কিছু ব্যথা বেদনা সৃষ্টি হয়। যদি নরমাল ডেলিভারি না হয় তখন সিজার করতে হয় জাতিকেও। এখন সময় বলবে আগামী পাঁচ বছরের ডেলিভারী নরমাল না সিজার হবে। সিজার হলে আলগা রক্ত লাগে সে তো স্বাভাবিক। সুতরাং এসব নিয়ে চিন্তিত হবার কোন দরকার নাই।

যুক্তিতে কাবু হয়ে চুপ মেরে গেল স্ত্রী ।

বিদেশী কোম্পানীতে চাকরী করি। এখানে বেকুব নাদান লোকজনে ভর্তি। কালকে দুই বিদেশী বসে বসে আলাপ করছিল আমি কান পেতে শুনছিলাম।

-আচ্ছা তুই জানস এরা কদিন পরপর এরাম করে ক্যান?
-কিরাম করে?
-এই যে হরতাল হরতাল করে গাড়িতে আগুন দেয়, সামনে যা পায় তা ভেঙ্গে ফেলে, এদের পবলেমটা ঠিক কুতায়?
-তুই কতদিন এদেশে কামলা খাটস?
-এই তো বছরখানেক।
-তাইলে তুই বুঝবি না, আমি এখানে দশ বছর ধরে আছি, আমি বুঝি
-ক্যান?
-ব্যাটা আমাগো দেশে যে গনতন্ত্রই নাই সেটা এইখানে আসার আগে বুঝবারই পারি নাই
-কস্কি মমিন? মানে কি?
-মানে আমাদের দেশে আওয়াজ ছাড়া ইলেকশান হয়, অমনি যখন তখন পেসিডেন্ট বদলায় যায়, তোরে ভাইবা পরীক্ষায় একবার পেসিডেনের নাম জিগাইছিল পারস নাই মনে আছে?
-হ মনে আছে, আমি নতুন বেডার নাম তখনো মুখস্ত করি নাই বইলা
-কেমনে করবি, ভুল তো কইরা যাইতেছে আমাদের রাজনীতিকগুলা। নিয়ম হইল যে বেডা আগামীবার ইলেকশান করবো, তার নামে ইলেকশানের দুই বছর আগ থেকে শ্লোগান দেয়া শুরু কইত্তে হয়। তারপর ফাইনাল খেলার আগে ইলেকশানের কমসে ছমাস আগ থেকে জ্বালাও পোড়াও মারাও পিটাও করে দেশ ছারখার করে দিতে হবে। যাতে গদিতে থাকা ওই বেটা বুঝতে পারে টাইম শ্যাষ আর জনগন বুঝতে পারে নেক্সট কে আইতেছে
-বুঝলাম। কিন্তু জ্বালাও পোড়াও করে লাভ ক্ষতি কার।
-লাভ ক্ষতির কথা পরে কইতেছি। পথম কথা হইল আন্দোলন জিনিসডা এদের একটা ঐতিহ্য। শত শত বছর ধরে এরা পালন কইরা আসতেছে। এটা ছাড়া গদি ছাড়ার নিয়ম নাকি নাই।
-সেইটা বুঝলাম, কিন্তুক জ্বালানি পোড়ানিতে তো লাভের কিছু দেখি না।
-আরে বেডা জ্বালা পোড়া করে কি লাভ তুই মুর্খ কি বুঝবি। তুই তো ইকোনোমিক্সে গোল্লা পাইছিলি। আমি একজাগায় পড়ছি অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হইলে টেকার ছুটাছুটি দরকার, টেকা ছুটাছুটি করতে কিছু ভাঙতে হবে তাপর গড়তে হবে। তাইলে না টেকাটুকা ছুটাছুটি করবে। ঘরে বসে আণ্ডা মারলে তোরে টেকা দিবে কে।
-হ এইবার বুঝছি, এরা বহুত চালাকের জাত। আমরা কত বুকা রে। অথচ আমরা এই দেশে আইস্যা বেবসা করতেছি।
-ঐ চুপপপ আস্তে ক, এরা শুনলে বুঝে ফেলবে আমাদের দেশে গণতন্ত্র নাই।

গাধার বাচ্চারা কয় কি? এদ্দিন আমি ভাবতাম ওই দেশে গণতন্ত্র বেশী, আমাদের কম। এখন দেখি আমরাই........।

এমন তৃপ্তি জীবনে আর কোন সংলাপ শুনে পাইনি।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

দেঁতো হাসি , আমিও এত তৃপ্তিদায়ক সংলাপ এর আগে শুনি নাই।
ইসরাত

অতিথি লেখক এর ছবি

সংলাপ কি সত্যি এরকম ছিল? অ্যাঁ কস্কি মমিন!
সংলাপ পড়ার আগে যে একটা রাগ তৈরি হয়েছিল, সংলাপ পড়ে দেখি সেটা উধাও।

-ছায়াবৃত্ত

গান্ধর্বী এর ছবি

সংলাপখান শুনে মনটা ভালু হয়ে গেলু হো হো হো

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

সংলাপটা বেশি রকম ফাটাফাটি লাগলো।
কোন ভুল নেই যা বলেছে এরা।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

এটাই বাংলাদেশ, এখানকার এই নিয়ম। সারাবছর নানা ইস্যুতে হরতাল মারামারি থাকে। শতে শতে মানুষ মরলেও আমাদের গায়ে লাগে না। অঢেল জনসংখ্যা আমাদের। কোটি খরচ হয়ে গেলেও বেশী লাগবে না। একাত্তরে সামান্য ত্রিশ লাখ গেছে যা তিন বছরে ভুরে গেছিলাম। আমরা গণতান্ত্রিক দেশ। পাঁচ বছরে একবার চুড়ান্ত পর্বের গণতান্ত্রিক খেলা হয় যার নাম নির্বাচন। এই খেলা দেখে আসছি ১৯৯১ সাল থেকে। নির্বাচনের আগে প্রতিবার কিছু ভোগান্তি হয় মানুষের, যার নাম গণতান্ত্রিক ভোগান্তি। এদেশে বাস করতে হলে এটা মানতেই হবে। উপায় নাই। প্রধান দুই দলের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের এটাই সাধু নিয়ম। সবাই মেনে নিয়েছে। আমিও। কোন প্রতিবাদ করি না।

চলুক

জাতি পাঁচ বছরে একবার গর্ভধারণ করে। সেই সময় কিছু ব্যথা বেদনা সৃষ্টি হয়। যদি নরমাল ডেলিভারি না হয় তখন সিজার করতে হয় জাতিকেও। এখন সময় বলবে আগামী পাঁচ বছরের ডেলিভারী নরমাল না সিজার হবে। সিজার হলে আলগা রক্ত লাগে সে তো স্বাভাবিক

গুল্লি

লেখা দুর্দান্ত হয়েছে, যুক্তি দিয়ে বউকে তো একেবারে কুপোকাত করে দিলেন গড়াগড়ি দিয়া হাসি

মাসুদ সজীব

নির্ঝরা শ্রাবণ  এর ছবি

নীড় ভাই,

সংলাপ খানা খাসা ছিল। বিয়াপক বিনুদন হো হো হো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।