ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়

শামীম এর ছবি
লিখেছেন শামীম (তারিখ: শুক্র, ১৬/০৫/২০০৮ - ৫:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারসংক্ষেপ: ক্রমবর্ধিষ্ণু চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পানিসরবরাহের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর থেকে যে পরিমান পানি সংগ্রহ করা হয়, স্বাভাবিক উপায়ে সেটা পূরণ বা পূণঃসঞ্চিত হয় না। ফলশ্রুতিতে পানির স্তর নিচে নেমে বিভিন্নরকম অসুবিধার সৃষ্টি করছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় হল ভূ-গর্ভে কৃত্রিম উপায়ে পানি সঞ্চিত করা যেন তা পানি সংগ্রহে হারানো পানির অভাব পূরণ করে। এই প্রবন্ধে কৃত্রিম উপায়ে ভূ-গর্ভে পানি সংগহ করার উপায়ের উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শব্দ তালিকা: পানিস্তর, পূণঃসঞ্চয়ী কূপ, পানি সঞ্চয়
পরিভাষার তালিকা: Aquifer – পানিস্তর; Underground – ভূ-গর্ভ; Groundwater recharge – ভূ-গর্ভে পানিসঞ্চয়; Reservoir – জলাধার; Recharge well – পূণঃসঞ্চয়ী কূপ

ভূমিকা

ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় নিত্যব্যবহার্য পানির মূল উৎস ভূ-গর্ভস্থ জলাধার বা আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার। কিন্ত অতিব্যবহারে এই প্রাকৃতিক জলাধার শূন্য হতে চলেছে এবং পানির স্তর আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পানিস্বল্পতার কারণে এবং পানিস্তরের গভীরতা বৃদ্ধিজনিত ব্যয়বৃদ্ধির কারণে এই উৎস হতে পানি সংগ্রহ হুমকীর সম্মুখীন হয়ে পড়বে।

মনে হতে পারে যে কোন জলাধার থেকে পানি নিলে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভূ-গর্ভের প্রাকৃতিক জলাধারের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণ হল যে পরিমান পানি এখান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সেই পরিমান পানি স্বাভাবিকভাবে এতে সঞ্চিত/সংগৃহীত হতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

এ ধরণের প্রাকৃতিক সম্পদের (Resource) ক্ষয় (Depletion) কারো কাম্য নয়। এই ক্ষয় রোধকল্পে এই পানিস্তর থেকে পানি সংগ্রহের পরিমান এতে পানি সঞ্চিত হওয়ার হারের সমান অথবা এর চেয়ে কম হওয়া বাঞ্ছনীয়। দৈনন্দিন জীবনে পানির ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প ব্যবস্থা না করে পানি সংগ্রহের পরিমান কমানোও প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া পানি সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দিলেও একাজে ব্যবহৃত স্থাপনাগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকবে যা সম্পদের অপচয় হিসেবেই গণ্য হবে। তাই, বর্তমান পানি সংগ্রহের পরিমান না কমিয়ে বরং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে পানি সঞ্চয়/সংগ্রহের পরিমান বাড়ানোর উপায় বিবেচনা করা প্রয়োজন।
এই প্রবন্ধে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পানির সঞ্চয়ের উপায় হিসেবে কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানিসঞ্চয় (Artificial groundwater recharge) বিষয়ে আলোচনা করা হবে।

ভূ-গর্ভস্থ প্রাকৃতিক জলাধারের বৈশিষ্ট

ভূপৃষ্ঠের গভীরে বালু বা এর চেয়ে বড় আকারের মাটির কণার স্তর রয়েছে। এই কণাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক ফাঁকা জায়গা (Pore space) থাকে। এই জায়গাগুলোতেই পানি সঞ্চিত থাকে যা নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা যায়। সাধারণত বালুর স্তরগুলোতে আয়তনের শতকরা ৩৫-৪০ ভাগ জায়গা ফাঁকা থাকে যা পানি দিয়ে পরিপূর্ণ ভর্তি থাকে। এই জলাধারে প্রাকৃতিক ভাবে বিভিন্ন উপায়ে পানি সংগৃহীত হয়। এই ভূ-গর্ভস্থ পানিবাহী স্তরের সঞ্চিত পানির একটি মূল উৎস হল ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত জলাশয় (নদী, খাল, পুকুর ইত্যাদি) থেকে চুঁইয়ে আসা পানি। যে অঞ্চলে পানি সংগৃহীত হয় সেখানকার আশে পাশের অঞ্চলের পানিধারী স্তর থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে আসে। এছাড়া, বৃষ্টিপাতের পানি, সেচের পানি ভূ-পৃষ্ঠে আসার পর উপরের মাটির স্তরগুলো ভেদ করে ধীরে ধীরে চুঁইয়ে নিচের স্তরে জমা হয়।

ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্য

বিভিন্ন কারণে ভূ-গর্ভস্থ স্তরে কৃত্রিমভাবে পানি সঞ্চিত করা হয়। যেমন -

  • প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসকে একটি লাভজনক অর্থনৈতীক সম্পদ হিসেবে বজায় রাখার জন্য।
  • পানি সংগ্রহে ভূ-পৃষ্ঠের এবং ভূ-গর্ভস্থ জলাধারের সমন্বিত ব্যবহারের জন্য।
  • ধীরে ধীরে পানির স্তর নেমে যাওয়া, ভূ-গর্ভস্থ পানির অসুবিধাজনক লবনাক্ততা, কিংবা, লবনাক্ত পানি প্রবেশের ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিভিন্নরকম খারাপ অবস্থা প্রতিহত করার জন্য।
  • স্থানীয় বা আমদানীকৃত ভূপৃষ্ঠের পানি ভূ-গর্ভে সঞ্চিত করে রাখার উদ্দেশ্যে।
  • ভূমি দেবে যাওয়া কমানোর জন্য বা থামানোর জন্য।
  • স্থানীয় কূপগুলোতে যথেষ্ট পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য।
  • পয়ঃবর্জ্য বা ওয়েস্টওয়াটার পরিশোধন এবং সঞ্চয় করার জন্য, যেন এটা পরবর্তীতে পূণরায় ব্যবহার করা যায়।
  • গরম বা ঠান্ডা পানি সঞ্চয় বা এ থেকে শক্তি আহরনের জন্য।
  • জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য নিচু অঞ্চলে পানি নিষ্কাশনের সুবিধা না থাকলে অতিরিক্ত পানিকে ভূ-গর্ভে পাঠিয়ে সঞ্চিত করা হয়।

কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় করার উপায়

মূলনীতি
ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চিত করতে হলে প্রথমত ভূমির উপরে জমানো পানি থাকতে হবে এবং জমানো পানিকে ভূ-গর্ভে পৌছাতে হবে। জমানো পানির উৎস হিসেবে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম জলাশয় ব্যবহৃত হতে পারে। এছাড়াও বন্যার পানি কৃত্রিম জলাশয়ে জমিয়ে রেখে কিংবা প্রবাহিত নদী/খালের নাব্যতা বাড়িয়ে ওখানে পানি জমিয়ে এ কাজ করা যায়। তাছাড়া জলীয় পয়ঃবর্জ্য বা সুয়ারেজের পানি পরিশোধন করেও এ কাজে ব্যবহার করা যায়। বৃষ্টিপাত বা অন্য কোন উপায়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে সেই পানিকেও ভূগর্ভে পাঠানো যেতে পারে।

এ কাজে প্রাথমিক বাঁধা হিসেবে আছে আমাদের ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি এলাকায় মাটির স্তর বিন্যাস। ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে অবস্থিত পানিধারক স্তর এবং ভূ-পৃষ্ঠের মাঝে পানি কুপরিবাহী এক বা একাধিক স্তর থাকতে পারে। পানি কুপরিবাহী স্তরগুলো সাধারণত খুব ক্ষুদ্র মাটিকণা দিয়ে তৈরী, সাধারণ ভাবে ওগুলোকে কাদা বা এঁটেল মাটি বলা হয়। সাধারণ অবস্থায় এই স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে পানি সঞ্চালনের হার অত্যন্ত কম। কাজেই ভূ-পৃষ্ঠে থাকা অতিরিক্ত পানিকে ভূ-গর্ভের পানিধারক স্তরে পৌছানোর জন্য এই সকল বাঁধা অতিক্রম করানোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।

এছাড়াও ভূপৃষ্ঠের পানি ভূ-গর্ভে পৌছে সঞ্চিত হওয়ার পেছনে অপর বাঁধা হল ভূ-স্তরগুলোর মধ্য দিয়ে পানি সঞ্চালনের ধীর গতি। ফলে যে সময়ে সামান্য পরিমান পানি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ভূ-গর্ভে সঞ্চালিত হয়, সেই সময়ের মধ্যেই বৃষ্টিপাত বা অন্য উপায়ে আসা পানি গড়িয়ে কোন নালা/খাল/নদী দিয়ে চলে যায়। ফলে উদ্দিষ্ট জায়গায় ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চিত হতে পারে না।

পদ্ধতিসমূহ
নিম্নলিখিত বিভিন্ন উপায়ে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় বৃদ্ধি করা যায়।

  • বেসিন পদ্ধতি
  • সেচ পদ্ধতি
  • খাল পদ্ধতি
  • গর্ত পদ্ধতি
  • ডিচ-ফারো পদ্ধতি
  • পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতি
  • ফ্লাডিং পদ্ধতি
  • অপরিকল্পিত পূণঃসঞ্চয়
উপরোক্ত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পূণঃসঞ্চয়ী কূপ (recharge well) পদ্ধতিটি বাংলাদেশের সমস্যাসঙ্কুল এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হওয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বিবেচ্য বিষয়সমূহ

  • পরিমান: অর্থাৎ সঞ্চয়ের জন্য যেন যথেষ্ট পরিমান পানি পাওয়া যায় সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
  • বিশুদ্ধতা: ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চালনের ক্ষেত্রে সঞ্চিত পানির বিশুদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণ ভাবে পানি জমার সুযোগ করে দিয়ে স্বাভাবিক উপায়ে পানি ভূ-পৃষ্ঠে প্রবেশের সুযোগ করে দিলে মাটির বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় প্রায় সমস্ত দূষণই দুর হয়ে যায়। কিন্তু পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতিতে সরাসরি নিচের স্তরে পানি চলে যায় বলে ঐ উপায়ে পানির দূষণ দুর হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই পানি পরিশোধণ করেই রিচার্জ বা পূণঃসঞ্চয়ী কূপ দিয়ে চালনা করতে হবে।
  • রসায়ন: সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে যেই পানি ভূ-গর্ভে প্রবেশ করানো হবে, স্বাভাবিকভাবেই সেই পানি এবং ভূ-গর্ভে আগে থেকে সঞ্চিত পানির রাসায়নিক গুণাবলী আলাদা হবে। এই দুই প্রকার বৈশিষ্টের পানি মিশ্রনের ফলে পানির যে নতুন বৈশিষ্ট হবে সেটার রাসায়নিক নিরাপত্তা সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও মাটির স্তরে থাকা বিভিন্ন খনিজ পদার্থের সাথে ঐ নতুন বৈশিষ্টের পানির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফলের নিরাপত্তা সম্পর্কেও নিশ্চিত হতে হবে। পানিধারণ ক্ষমতা: ভূ-গর্ভে কী পরিমান পানি সঞ্চয় করা যাবে সেটিও নির্ণয় করতে হবে। কারণ ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি সঞ্চয়ের চেষ্টা করলে সেটা অর্থনৈতীকভাবে লাভজনক হবে না।
  • পরিবাহিতা হ্রাস বা clogging: অপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল পানিধারণকারী ভূ-স্তরের পরিবাহিতা হ্রাস। পানিতে ভাসমান অতিক্ষুদ্র ধুলিকণা বা অন্যান্য কণাগুলো পরিবাহী স্তর দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে আটকে গিয়ে সেই স্থানের পরিবাহীতা কমিয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে মাটি ছাকনি বা ফিল্টারের মত কাজ করে এবং ময়লা আটকে এর ভেতর দিয়ে পানির প্রবাহ ব্যহত হতে পারে। সুতরাং সঞ্চয়ের জন্য যে পানি মাটিস্তরে প্রবেশ করানো হবে সেটাকে অবশ্যই পলি বা অন্য কোন ক্ষুদ্রকণা মুক্ত হতে হবে।
  • সঞ্চয়ের হার: মাটির প্রতিটি স্তরেই এর গঠনকারী মাটিকণাগুলোর আকারগত বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে এর ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহের সর্বোচ্চ গতি বা পরিবাহিতা নির্ণয় করা যায়। ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের সময় পানি ধারণকারী স্তরের পরিবাহীতার চেয়ে বেশি হারে পানি প্রবেশ করানো যাবে না।
  • অধক্ষেপের সম্ভাবনা: এর পাশাপাশি, ভূস্তরে আগে থেকে সঞ্চিত পানি ও খনিজ পদার্থের সাথে প্রবেশ করানো পানি বিক্রিয়া করে কোন দানাদার অধক্ষেপ সৃষ্টি করে কি না কিংবা সৃষ্টি হওয়ার মত পরিস্থিতি উৎপন্ন হয় কি না এবং সেটা পানিস্তরের পরিবাহিতা কমিয়ে দিতে পারে কি না সেটাও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আইনগত বাধ্যবাধকতা: অর্থাৎ স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পানি নীতি অনুযায়ী ভূ-গর্ভে প্রবেশ করানো পানির গুণাগুণ কীরূপ হবে সেটা এবং সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন কী পরিমান পানি এভাবে সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে ভূ-গর্ভে প্রবেশ করানো যাবে।
  • খরচ: সাধারণভাবে পানি পরিশোধন কিংবা আমদানী করে ব্যবহারের খরচ যদি কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় এবং এ থেকে পানি তুলে ব্যবহারের চেয়ে কম খরচে করা যায় তাহলে সেটাই করা উচিৎ। এতে ভূ-গর্ভে স্বাভাবিক উপায়ে পানি সঞ্চিত হওয়ার জন্য যেমন সময় পাবে, তেমনি খরচও বাঁচবে।
  • স্থানীয় রীতিনীতি বা সংস্কৃতি: অর্থাৎ কোন এলাকার স্থানীয় বা সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয় বা সংস্কৃতিকে ব্যহত করে এমন উপায়ে কাজ করা ঠিক হবে না। কোন এলাকায় যদি জলাশয়কে ঘিরে কোন সংস্কৃতি থাকে বা কোন এলাকা থাকে যেখানে অনুপ্রবেশকে ভাল চোখে দেখা হয় না তবে সেসকল এলাকায় এ সকল কর্মকান্ড জনসাধারণের অসন্তোষের মুখে পড়তে পারে। তাছাড়া কোন জলাশয়কে ঘিরে কোন কুসংস্কার থাকলেও সেটার পানি ভূ-গর্ভে সঞ্চিত করলে সেই পানি ব্যবহারে অনীহা থাকতে পারে।
  • পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র: ভূ-পৃষ্ঠের জলাশয় শুকিয়ে ফেলে সেখানকার জীববৈচিত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করে ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় করা ঠিক হবে না।

পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতি

যে সকল এলাকায় ভূ-গর্ভের পানিস্তর এবং ভূ-পৃষ্ঠের মাঝে একটি পুরু অপ্রবেশ্য স্তর থাকে সেসকল এলাকার জন্য এবং যে সকল এলাকায় জলাশয় তৈরীর মত যথেষ্ট জায়গা নেই সেসকল এলাকায় ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের জন্য পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতিটি সবচেয়ে লাগসই উপায়। এই পদ্ধতিটি নলকূপ দিয়ে পানি তোলার পদ্ধতির মতই। শুধুমাত্র নলকূপ দিয়ে পানি তোলার পরিবর্তে পানি ভূ-গর্ভে প্রবেশ করানো হবে।

এই পদ্ধতিতে যথেষ্ট দ্রুত ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয় করা যায়। তবে ফিল্টার পাইপ কোন কারণে বন্ধ হয়ে গেলে সঞ্চয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। চিত্র-১ এ পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতির সরল/সাধারণ রেখাচিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে একটি নলকূপ ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর (aquifer) পর্যন্ত স্থাপন করা হয়। সাধারণ নলকূপের মতই সেই স্তরে ছাঁকন বা ফিল্টার পাইপ দেয়া হয়। শুধুমাত্র নলকূপের উপরের প্রান্তে পানি প্রবেশের জন্য হ্যান্ডপাম্পের বদলে আরেকটি ফিল্টার পাইপ লাগাতে হবে। প্রচলিত ধারণায় নলকূপের উপরের অংশে পানি তোলার জন্য স্থাপিত হ্যান্ডপাম্পটিকেই নলকূপ/টিউবওয়েল হিসেবে অভিহিত করা হয় – যেটা আদৌ সঠিক নয়। আসলে হ্যান্ডপাম্পের নিচের অংশে মাটির ভেতরে স্থাপন করা সম্পুর্ন পাইপ ও ফিল্টার পাইপগুলো একত্রে নলকূপ বা টিউবওয়েল গঠন করে।

পূণঃসঞ্চয়ী কূপের প্রবেশ অংশে পানি আসার আগে বিশুদ্ধতার স্বার্থে কয়েকটি পরিশোধন ধাপ পার হয়ে আসবে। সঞ্চয়ের জন্য সংগৃহীত পানির উৎস অনুযায়ী পরিশোধনের প্রয়োজনীয়তাও ভিন্ন হবে।

এছাড়া ফিল্টার বন্ধ হওয়া রোধ করার জন্য

  • পানি বাহিত মাটির কণা এতে প্রবেশ করা আটকাতে হবে।
  • কোনরকম বুদবুদের কণা প্রবেশ করা আটকাতে হবে।
  • কূপের ভেতরে কোনরূপ জীবানু বা অন্য পদার্থ জন্মানো রোধ করতে হবে।
  • এছাড়া যথারীতি পানির রাসায়নিক গুণাগুণের কারণে অধক্ষেপ পরে যেন ফিল্টার কিংবা পানিস্তর প্রবেশ্যতা না হারায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
  • এছাড়া ভূ-গর্ভের পানি আর সঞ্চয়ের পানির তাপমাত্রার পার্থক্য অধিক হলে সান্দ্রতার পার্থক্যের জন্যও পানি সঞ্চয়ের হার ব্যহত হতে পারে।
  • পূণঃসঞ্চয়ী কূপের উপরের প্রবেশ অংশে একটা বড় ব্যাসার্ধের পাইপ পরিয়ে যে কোন সময়ে এই পথ দিয়ে ভূস্তরে পানি সঞ্চয় বন্ধ রাখা যাবে। কোন কারণে ভূ-স্তরে পাঠানোর জন্য আসা পানির গুণগত মান আশানুরূপ না হলে এভাবে ভূ-স্তরকে ঐ পানি প্রবেশের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
  • এই সকল গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য চিত্র-১ এর মত করে সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠের পানি ভূ-গর্ভে প্রবেশ না করিয়ে প্রবেশপথের চারপাশে (জায়গার অভাব হলে এক/দুই/তিন পাশেও হতে পারে) বৃত্তাকারে কয়েকটি ফিল্টার রাখা যেতে পারে। চিত্র-২এ এমন একটি পূণঃসঞ্চয়ী কূপ এবং পরিশোধনের লক্ষ্যে ফিল্টারের লম্বচ্ছেদ আনুমানিক সরল/সাধারণ উপস্থাপনা করা হয়েছে। পানিতে ভাসমান ময়লার পরিমান অত্যধিক বেশি থাকলে চিত্রের সবচেয়ে বাইরের বালু ফিল্টারে বাইরেও অতিরিক্ত আরেকটি পাথরের ফিল্টার যোগ করা যেতে পারে।

কোথায় স্থাপন করা যেতে পারে
কোন জলাশয়ের পানি সঞ্চয়ের উপযুক্ত গুণাগুণ সম্পন্ন হলে পূণঃসঞ্চয়ী কূপগুলোকে জলাশয়ের মাঝেও দেয়া যায়। সরাসরি জলধারার মাঝে না দিয়েও ইনটেক অবকাঠামো বানিয়ে পাইপযোগে সঞ্চয়কূপের কাছে পানিকে নিয়ে আসা যায়।

শুধু বন্যার সময় জলমগ্ন হয় এমন এলাকায়ও এ ধরণের পূণঃসঞ্চয়ী কূপ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে সুবিধা হল যে, অসুবিধা সৃষ্টিকারী অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হবে এবং পাশাপাশি সেটা ভবিষ্যতের প্রয়োজনে সম্পদ হিসেবেও সংরক্ষিত করা হবে।

ঢাকা শহরের যে সকল এলাকায় বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় সে সকল এলাকায় এরকম পূণঃসঞ্চয়ী কূপ স্থাপন করলে এতে পানি আসার পথে কয়েকটি বালু/পাথরের ফিল্টার এবং সবশেষে সামান্য জীবানুনাশক দিলেই কাজ হবে বলে মনে হয়। এতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য অতিরিক্ত স্টর্ম সূয়্যারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে।

ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের সুবিধাসমূহ

  • ভূ-স্তরে সঞ্চিত পানি বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এটা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে থাকে।
  • এই পদ্ধতিটি কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন এবং সাধারণ উভয় শ্রেণীর জনগণ সহজে বুঝতে পারে।
  • পানি নিষ্কাশনের জন্য তেমন কোন জটিল যন্ত্রপাতির দরকার হয় না। খোড়াখুড়ি করে স্টর্ম সূয়্যার নির্মানের প্রয়োজন হয় না।
  • বর্ষাকালের অতিরিক্ত পানি সঞ্চয় করে সেটা শুষ্ক শীতকালে ব্যবহার করা যায়। উন্নত গুণাগুণ সম্পন্ন পানি প্রবেশ এবং মিশ্রণের ফলে ভূ-স্তরের পানির গুণাগুণ ভালো হয়। ইতিপূর্বে একটি আর্সেনিক গবেষণা পাইলট প্রকল্পে এরকম পানি প্রবেশ করানোতে সেখান থেকে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা অর্ধেকে নেমে এসেছিল (Sarkar and Rahman, ২০০১)
  • ভূ-স্তরের পানি সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
  • বিশেষত শুষ্ক/মরু অঞ্চলে পরিবেশ উন্নয়নের জন্য এ পদ্ধতিটি খুবই আকর্ষনীয়। এ ধরণের প্রকল্প চালাতে খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হয় না।
  • ভূ-গর্ভে পানি প্রবেশ করানোর ফলে ভূ-পৃষ্ঠে বৃষ্টির অতিরিক্ত পানির প্রবাহ হ্রাস পায় যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নদী বা জলাশয়ে ভূমিক্ষয়ের ফলে আসা পলির পরিমান কমিয়ে দেয়।
  • ভূ-পৃষ্ঠের লবণমুক্ত পানি প্রবেশের ফলে ভূ-গর্ভের পানির লবণাক্ততা হ্রাস পায় এবং কৃষি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের উপযুক্ততা বেড়ে যায়।

ভূ-গর্ভে পানি সঞ্চয়ের অসুবিধাসমূহ

  • যথেষ্ট পরিমান উপযুক্ত আইনকানুন এবং এর কঠোর প্রয়োগ না থাকলে যে কেউ যথেচ্ছ ভাবে ভূ-গর্ভে পানি প্রবেশ করাবে। এ ধরণের অশোধিত পয়ঃনালার পানি প্রবেশ করালে এটা বরং ভূ-গর্ভের পানি দূষণের কারণ হবে।
  • রাস্তা থেকে গড়িয়ে আসা অশোধিত পানি, কিংবা বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক যুক্ত কৃষিজমির পানি এ ধরণের কূপ দিয়ে অবাধে ভূ-গর্ভে প্রবেশ করে দূষণ ছড়িয়ে দিতে পারে।
  • সঠিকভাবে গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণ না করলে এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তরের অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে।
  • সঞ্চয়ের জন্য যথেষ্ট পানি না পাওয়া গেলে এ ধরণের প্রকল্প অর্থনৈতীকভাবে লাভজনক না ও হতে পারে।
  • এ ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে ভূ-স্তরের প্রকৃতি এবং এর মধ্য দিয়ে পানির গতি প্রকৃতি খুব ভালভাবে নীরিক্ষা করতে হবে।

উপসংহার

টেকসই উন্নয়নের জন্য অতিব্যবহারে ভূ-গর্ভের প্রাকৃতিক জলাধার শূন্য হওয়া এবং পানির স্তর আরও গভীরে চলে যাওয়া রোধ করা দরকার। এজন্য ভূ-গর্ভের পানির বদলে ভূ-পৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা অনেকক্ষেত্রেই অসম্ভব কারণ যেমন সবসময় ভূ-পৃষ্ঠের পানি পাওয়া যায় না তেমনি ভূ-গর্ভের পানি সংগ্রহের জন্য ইতিপূর্বে স্থাপিত স্থাপনা গুলো অকেজো হয়ে পড়ে সম্পদের অপচয় ঘটাবে। তাই কৃত্রিমভাবে ভূ-গর্ভে পানির সঞ্চয় বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

দেশে শুষ্ক এবং বৃষ্টির সময় প্রাপ্ত পানির পরিমাণের বিরাট পার্থক্য রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে বিপুল পরিমান পানি বন্যা আকারে চলে যায়। এই পানিকে সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করার জন্য বড় বড় জলাশয়ের স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয়, তাই এজন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে পানি সঞ্চয়/সংগ্রহের পরিমান বাড়ানোর উপায় বিবেচনা করা প্রয়োজন।

কৃত্রিমভাবে পানি সঞ্চয়ের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে পূণঃসঞ্চয়ী কূপ পদ্ধতিটি সহজবোধ্য এবং কম জায়গাতে করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে খুব দ্রুত পানি সঞ্চয় করা যায়, ফলে অতিবর্ষা বা বন্যার পানি সরে যাওয়ার আগেই সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমান সঞ্চয় করা সম্ভব। তাই এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।

পূণঃসঞ্চয়ী প্রকল্পের উদাহরণ

ভারত
[url=http://www.vatten.goteborg.se/prod/va/dalis2.nsf/vyFilArkiv/Artificial%2...$file/Artificial%20groundwater%20recharge.pdf]সুইডেন[/url]
অ্যারিজোনা

তথ্যসূত্র

    ১. Todd, D. K., “Groundwater Hydrology”, 2nd Ed., John Wiley & Sons, Singapore. ২. Kumar, N. N., and Aiyagari, N. 1997. Artificial recharge of groundwater. URL(pdf)
    ৩. O'Hare, M.P., Fairchild, D.M., Hajali, P.A., and Canter, L.W. 1986. Artificial Recharge and Groundwater: Status and Potential in the Contiguous United States, Lewis Publishers, Chelsea, MI.
    ৪. Sarkar, A. R., and Rahman, O. T. 2001. In-situ removal of arsenic - Experiences of DPHE-Danida Pilot Project. In Proc: Technologies for arsenic removal from drinking water, Ed: Ahmed, F., Ali, A. and Adeel, Z.
    URL(pdf)


মন্তব্য

শামীম এর ছবি

পূর্বপ্রকাশিত পোস্ট জন্য ফ্রন্ট পেজে না দিয়ে শুধু নিজের ব্লগে রাখলাম। কেউ যদি কখনো ঘুরতে আসে .... চোখে পড়লেও পড়তে পারে।

ছাপার উপযোগি সংস্করণ পি.ডি.এফ. ফরম্যাটে ডাউনলোড করতে পারেন দৃষ্টিপাত ব্লগের এই লিংক থেকে।

ধন্যবাদ।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

এভাবে লুকায়ে পাবলিশ করলেন! এগুলাতো মানুষের চোখে আসতে হবে। ভাল হয়েছে।

শামীম এর ছবি

ধন্যবাদ।

এখানে কপি রাখলাম। প্রথমে দৃষ্টিপাত ব্লগে দিয়েছি। তারপর, আমাদের প্রযুক্তি ফোরামে আর এখানে।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

হিমু এর ছবি

দেশের বিভিন্ন অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে কমছে বলে শুনছি।

আচ্ছা, বাড়ির ছাদ থেকে রেইনপাইপ দিয়ে ভূগর্ভে পানি পাঠানোর কৌশলটিকে কি প্রতিটি বাড়ির নকশায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব?



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।