আমার নিজের গল্প

ইমরুল কায়েস এর ছবি
লিখেছেন ইমরুল কায়েস (তারিখ: বুধ, ১৭/০৬/২০০৯ - ১২:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এটা আমার নিজের গল্প
ইমরুল কায়েস

[ বুয়েট সিএসই ব্যাচ০৪ এর র‌্যাগ উপলক্ষ্যে প্রকাশিতব্য সুভেন্যির ' দ্বিমিক' এর জন্য লেখাটা লেখা। অনেকদিন হল সচলে লেখা হয় না, ভাবলাম লেখাটা এখানেও থাকুক। লেখার বিষয়বস্তু পুরোটাই ব্যক্তিগত কথন, অনেকের কাছে ভাল নাও লাগতে পারে।]

এক দুপুরে রাজশাহীতে মোন্নাফের মোড়ের পাঁচতলা এমআর ছাত্রাবাসের দ্বিতীয়তলায় বেলকনির পাশে বসে বায়োলজি মুখস্ত করছিলাম। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে, সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এটাও সিরিয়াসলি দিতে হবে। এমন সময় নিচে টিএন্ডটিতে আমার নামে ফোন আসে
' ইমরুল কায়েস বলছ। '
' জ্বী,বলছি ।'
' বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়েছ? '
' না। '
' রেজাল্ট হয়ে গেছে। তুমি তিরানব্বইতম হয়েছে।'
ফোনটা এসেছিল রাজশাহী একটা ভর্তি কোচিং থেকে। আমি ওদের ছাত্র ছিলাম না, তারপরেও হয়ত ওরা নিজেদের খাতিরেই আমার খবরটা রেখেছিল। যাই হোক, এই ফোনের পর থেকেই মানসিকভাবে বুয়েটের ছাত্র হয়ে যাই এবং এই ছাত্রত্বটা আর কয়েকটা দিন পরে থাকবে না বলে আপাতত কিছুটা নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছি।

দুই হাজার চার সালের মাঝামাঝি বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের একজন গর্বিত ছাত্র হয়ে সোহরাওয়ার্দি হলের এক হাজার বারো নম্বর রুমে মফস্বল থেকে আনা বাক্স-পেঁটরা নিয়ে উঠে পড়ি। রুমের ছাত্রসংখ্যা ছয়জন,যদিও সাধারণত চারজনের থাকার কথা। রুমে খাট চারটা,টেবিলও চারটা। প্রথমদিন ছয়জনের মধ্যে এগুলো নিয়ে ভাগাভাগি শুরু হল। নাক খিটখিটে টাইপের একজন ছিল, এক বিছানায় অন্যের সাথে ডাবলিং করলে নাকি তার ঘুম হয় না। অগত্যা সে একটা বিছানা এককভাবে নিয়ে টেবিলের অধিকার ত্যাগ করল। আমরা বাকি পাঁচজন তিনটা খাট আর চারটা টেবিল ভাগ করে নিলাম। শুরু হল হলের জীবন।

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ইন্টারমেডিয়েট পড়েছিলাম। সেখানে বুয়েট বলতে খুব বেশী আইডিয়া পাইনি। স্বাভাবিকভাবেই বুয়েট সম্পর্কিত অনেক উচ্চ ধারনা নিয়ে মফস্বল থেকে এসেছিলাম,ভেবেছিলাম পড়াশুনা যথেষ্ট ইন্টারেকটিভ হবে। এসে দেখি ঐ ঘটনা একই, যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপান্ন আর কি। ক্লাস শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মাথায় সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। শুধুই জীবনযাপন সম্পর্কিত কিছু নিম্মতর প্রক্রিয়ার অনুকরন করার জন্যও যে পড়ালেখার দরকার আছে এই বোধটা নিজের ভিতরে ঐ বয়সে অতটা প্রবলভাবে আসে নি। দুই-তিন সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত নিলাম, অনেক হয়েছে, এখানে আর নয়। ' আর নয় ' চিন্তার যথেষ্ট দ্বান্দ্বিকতা ছিল, ঘাত-প্রতিঘাতের সংশয় ছিল, কিন্তু আঠারো বছর বয়সের কাছে এইসব বাস্তবতাবোধ অস্থিমজ্জা নিয়ে সামনে আসতে পারে নি।

' আর নয় ' চিন্তাটা যত সহজে করতে পরেছিলাম এর প্রতিফল সংক্রান্ত কার্যকরণে হাত দিতে আমার ততই দেরী হয়েছিল। বিশেষত বিষন্নতা ভর করেছিল কিছুদিন। আনপ্রেডেক্টেবিলিটি আমার চরিত্রে খুব একটা না থাকলেও এ সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তার কিছু কিছু লক্ষণ আমার মধ্যে চলে আসে। হুটহাট বিকেলে এক কাপড়েই ঢাকা থেকে দুইশত সত্তর মাইল দূরের বাসায় রওয়ানা দেই। বাসায় বুঝতে পারে কোন সমস্যা আছে। খাওয়ার টেবিলে জানতে চাইলে আমি কিছু বলি না, এদিক-ওদিক মাথা নেড়ে মনোযোগ দিয়ে ভাত খেতে থাকি। পরদিন আবার ঢাকায় ফিরে আসি, ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষে হলে আসলে আবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি, রাজ্যের অনাগ্রহ আর নেতিবাচকতা সিন্দাবাদের ভূতের মত আমার কাঁধে ভর করে।

অতঃপর একদিন, যেদিন শহরজুড়ে প্রচন্ড গরম পড়ে সেদিন আমি আমার ঢাকাবাসের পাট চুকিয়ে ফেলতে চাই, সবকিছু গুছিয়ে রওয়ানা দিই বাড়ির দিকে। না, এই বাড়ি যাওয়াই যে আমার বুয়েট সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার পরিমিত আর পূর্ণতাবোধের পরিচায়ক নয় সেটা তো এই লেখার মাধ্যমেই বোঝা যাচ্ছে। বাড়ি থেকে সাত-পাঁচ নানা কথার মধ্যে যে কথাটা শুনে আবার ঢাকা ফিরে আসি সেটা হল,এবার পড়ালেখা না করলেও চলবে। বাড়ি থেকে প্রতিমাসে টাকা দেয়া হবে, আমার যা ইচ্ছা মনে হবে আমি যেন তাই। ঢাকা ফিরেই প্রথমে মনস্ত করলাম, না , এবার আর না, এখানে সেখানে ঘুরি ফিরি, সামনে জিরো ফোর ব্যাচ আসলে তাদের সাথে পড়লেই হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ । এর পরের কয়েকমাস হল আমার শেখার মাস,তারুণ্য থেকে যৌবনে পদার্পণের মাস, চিন্তা-চেতনার কাঠামোতে ক্যানভাস লাগানোর মাস।

আমি নিতান্ত ভবঘুরে জীবনযাপন করলাম কয়েকমাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়াটা হয়ে পড়ল নিয়মিত থাকা খাওয়ার জায়গা। সবকিছুর মধ্যে আলাদাভাবে শাহবাগস্থ পাবলিক লাইব্রেরীর কথা মনে থাকবে। তখন পাবলিক লাইব্রেরীতে না ছিল এখনকার দিনের মত এসি অথবা ফোমওয়ালা চেয়ার। স্রেফ কাঠের চেয়ারে কিভাবে টানা ঘন্টার পর ঘন্টা বই পড়েছি সেটা এখন ভাবলে অবাক লাগে। আসলে দিনের অধিকাংশ সময়ই কাটত পাবলিক লাইব্রেরীতেই,বই পড়ে। হলে ফিরতাম শুধু ঘুমানোর জন্য, সেটাও আবার রাত চারটা-পাঁচটার দিকে,কোন কোন দিন তো লাইব্রেরীতেই থাকতাম সারারাত। রাত গভীর হয়ে গেলে লাইব্রেরীটার অবস্থা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। লোকজন অনেকগুলো চেয়ার একত্র করে মাথার নিচে বই দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। কিছুক্ষণ পর হয়ত লাইব্রেরীয়ান এসে গায়ে টোকা দিত, এনারা জেগে উঠতেন, হাতের তালুতে চোখ কঁচলে বসে পড়েতেন, এ বই ও বই ধরে ঝিম মেরে বসে থেকে লাইব্রেরীয়ান চলে গেলে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন। আমি এদের দেখতাম আর এদের জেনেরিক ক্লাস অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। লাইব্রেরীতে ঝিমিয়ে,পড়ে, লাইব্রীরই ক্যান্টিনে খেয়ে,মহিলা সমিতিতে প্রচুর নাটক দেখে আর সর্বোপরি নানান ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বারোন্মোচন করে সেসব অদ্ভুদ সব দিন গেছে। আজও হঠাৎ হঠাৎ সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। জীবনে খাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলে আমি তাই ঐ কয়েকমাসকে আলাদা চোখে দেখি, ঐ সব দিনের একেকটা মুহূর্ত আমার কাছে জোহান্সবার্গের স্বর্ণখন্ডের মতই দামী মনে হয়।

একসময় জিরো ফোর ব্যাচ এসে পড়ে। আবার নতুন করে ক্লাস শুরু করতে হয়। অনেকদিন একাডেমিক শিক্ষার বাহিরে ছিলাম, তাই সত্যি বলতে এসময় এবার বেশ ভালই লাগছিল। যদিও বায়ান্ন তিপান্নর সেই মিনিয়্যাচারাল হাইপোথিসিস মাথার মধ্যে ছিলই তারপরেও নতুন নতুন ছাত্ররা আসছে, তাদের সাথে পরিচয় হবে, নতুন করে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হবে এই বিষয়গুলো ভেবে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিলাম। প্রথম দিন ক্লাসে সম্ভবত বসেছিলাম মোমিনুল আর মেসবাহর পাশে আর প্রথম ঘনিষ্টতা হয়েছিল মাহমুদের সাথে। মাহমুদ তখন বেশ বয়সের তুলনায় মোটাসোটা আর গাবদাটাইপ ছিল। বয়সের সাথে যদিও এখন উচ্ছ্বাসভাবটা অনেকটা কমে গেছে, তখন সেটা বেশ প্রকট আকারেই ছিল, সামান্য কিছুতেই বেশ খুশিতে গদগদ হয়ে উঠত। এই বুয়েট লাইফে মাহমুদ আমাদের বন্ধুদের হাসিয়েছে বেশ। এটা তার সহজাত প্রতিভাই এবং বোধকরি এজন্যই বন্ধুদের মধ্যে সে এত জনপ্রিয়। নাসিফের সাথে পরিচয় হয় সি প্রোগ্রামিং এর ল্যাবে বসে, সেখানে তাকে বেশ বিধ্বস্থ অবস্থায় প্রথমদিন আবিস্কার করি। কম্পুউটারে নলেজ খুব কম বলে সে আমার কাছে সেদিন সামান্য আক্ষেপও প্রকাশ করেছিল। নাসিফের সাথে আস্তে আস্তে ঘনিষ্টতা বাড়ে। ঘনিষ্টতা বাড়ে আমিন,শুভ(এ),শুভ(বি),হাসিব,সজীব এদের সাথেও। দেখতে দেখতে একটা গ্রুপের মত দাঁড়িয়ে যায়। দল বেঁধে ঢাকার আশেপাশে দিনে গিয়ে দিনেই ঘুরে আসা, সবার জন্মদিন উদযাপন, টার্ম শেষে বা মিডটার্মে নানান জায়গায় ট্যুর দেয়া এসব কি কখনও ভোলা যাবে?
সবকিছুর মধ্যে ট্যুরের ব্যাপারটা একটু আলাদা করে বলতেই হয়।

প্রথম ট্যুরে গেলাম সেন্টমার্টিনে,লেভেল টু টার্ম টু এর মিডটার্মে। গ্রুপে ছিলাম সর্বসাকুল্যে আটজন।আমি,নাসিফ,হাসিব,মাহমুদ,আমিন,শুভ,সজীব আর রাকিব। এই ট্যুরটার ইমোশনাল এনক্রচমেন্ট অনেক অনেক বেশী কারন এটা বুয়েটে ছিল অল্পবয়সে প্রথম ট্যুর। সেন্টমার্টিনে হোটেল অবকাশে পূর্নিমা রাতে বালির ঢিঁপির উপরে শোয়ানো চেয়ারগুলোতে সবাই মিলে বসে সমুদ্রের গর্জন,ঝির ঝির বাতাস আর পূর্নিমার যে সামগ্রিকতা প্রত্যক্ষ করেছি , আমার বিশ্বাস এক জীবনে মানুষ এরকম অনুভূতি খুব বেশী পরিবেশ থেকে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। সেটা বুঝেছিও পরে, আরেকবার সেন্টমার্টিনে গিয়ে ঐ আগের বোধের মত কিছু বুঝতে পারি নি। এরপর বন্ধুদের সাথে আরো ঘুরেছি নানান জায়গায়। বান্দরবন, বগালেকের নৈর্সগিক দৃশ্য,পাহাড়ী জীবনযাপনের নৈঃশব্দ, এই যান্ত্রিক শহরে আজো মনে পড়ে। কেওক্রাডং এর চূ্ড়ায় ওঠাটা যেমন রোমাঞ্চকর ছিল তার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফেরেষ্টে পায়ে লেবু মেখে চীনে জোঁকের সাথে সারা রাস্তায় যুদ্ধ করতে করতে , মেছোবাঘের ভয় পেয়ে এবং অবশেষে দুধরাজ সাপ দেখে স্তম্ভিত হয়ে বনের অপর পাশে পৌছানো। পঞ্চগড়ের সমতল চা বাগান, শ্রীমঙ্গলের টিলায় চা বাগান,মাধবকু্ন্ডের ঝর্ণা দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছি তেমনি ভাল লেগেছে কুয়াকাটায় বা ট্টলারে চেপে ফাতরা বনে যেতে। কুষ্টিয়ায়ও গিয়েছিলাম একবার, প্রমত্তা পদ্মা,রবীন্দ্র কুঠীবাড়ি আর লালনমেলা দেখে এসেছি।

আমাদের জীবনযাপনের সব কাজকর্মে এক ধরনের ছন্দোবদ্ধতা থাকে, থাকে প্যাটার্ন। বুয়েটে সেটা ভালভাবেই বুঝেছি। এই কয়েক বছরে সকালে ক্লাস,দুপুরে ঘুম, বিকেলে টিউশনি,রাতে ক্লাসটেষ্টের পড়া বা আড্ডা এগুলো মিলে যে গোছানো প্রকার তৈরী হয়েছে তা থেকে হুট করে বেড়িয়ে যাওয়া একটু মুশকিলই হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ লাগছে সোহরাওয়ার্দী হলের রুম নম্বর চার হাজার দুই ছাড়তে। বুয়েটে পড়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ এই হলে থাকা। যারা হলে থাকেনি আসলে এই বিষয়টা তাদের কিছুতেই বোঝানো যাবে না। হলে থাকার অনির্বচনীয় আনন্দ এই কয় বছর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছি। প্রথম একটা টার্ম বাদে বাকীটা সময় রুমে সিনিয়রই ছিলাম, স্বাভাবিকভাবেই রুমমেটদের উপর ডোমিনেশন সবসময়ই ছিল। উইংয়ে সিনিয়ররা ছায়ার মতন ছিলেন,আমরা যখন সিনিয়র হয়েছি তখন চেষ্টা করেছি আমরা সিনিয়রদের কাছে যে রকম আন্তরিকতা পেয়েছি জুনিয়রদের ঠিক ততটাই দিতে।

সিনিয়রদের কথা বলতে গেলে জিরো ওয়ান ব্যাচের মেকানিক্যালের মোস্তফা ভাইয়ের কথা একটু আলাদা করে বলতেই হয়। মোস্তফা ভাই বয়সে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র হলেও আমরা একেবার বন্ধুর মত ছিলাম। তার সাথে মেশার অবশ্য আরেকটা কারন ছিল। যে কোন কারনেই হোক তিনি জুনিয়র হলেও আমাকে বয়সের তুলনায় অনেক ম্যাচিউর মনে করতেন, বিভিন্ন দিক থেকে আমার মধ্যে অনেক পটেনশিয়াল দেখতে পেতেন। আমরা আমাদের কমপ্লেক্স অনুভূতি শেয়ার করেছি, ইন্টেলেকচুয়াল বিষয় নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছি যেগুলো বুয়েটে অনেক কাছের বন্ধুর সাথেও কখনও সেভাবে হয়ত হয়ে ওঠে নি। মোস্তফা ভাইয়ের মুখে যেরকম কথা ফুঁটত, পেটেও সেরকম খাবার ধরত। আমরা মধ্যরাতের দিকে ঢাবির একুশে হলের সামনের হোটেলে গরুর বট দিয়ে পরোটা খেয়ে হেঁটে গল্প করতে করতে হলে ফিরতাম, খেতাম নাজিরাবাজারের গরুর চাপ। হলের ছাদে ,উইংয়ের বেলকনীতে অথবা শহীদুল্লাহ হলের পুকুরে দুইজনের ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা কখনও ভুলে যাবার নয়। পাশ করে সাউথ কোরিয়াতে পড়তে গেছেন মোস্তফা ভাই। তিনি চলে যাবার পর হলে আমার বাকী দিনগুলোতে তাকে আসলেই খুব মিস করেছি। তিনি যেখানেই থাকেন যেন ভাল থাকেন।

সিএসই ডিপার্টমেন্টের পড়াশুনার চাপে এই কয়েক বছর নিজের উপর একটা স্টীম রোলার গেছে এটা যেমন সত্য , তেমনি এই রোলারের জন্য এনজয়মেন্ট বিন্দুমাত্র কম হয় নি এটাও সত্য। একাডেমিক ইয়ারের প্রথম তিনটা বছর ইএমই বিল্ডিংয়ে ক্লাসের সময় কর্মচারী ক্যান্টিনে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দলবেঁধে সকালের নাস্তা, বিকেলে ল্যাবের পর ক্যাফেটেরিয়ায় পুরি,জিলাপি,চপ,বেগুনী,ছোলা,নুডলস গ্রোগাসে গেলা, শহীদ মিনারে দলবেঁধে আড্ডা দেয়া, রাতের বেলা মেডিকেলের সামনে পেনাংয়ে খেতে যাওয়া, এসব কি আর সহজে ভোলা যাবে? আবার সবার জন্য কিছু কিছু জিনিস অর্গানাইজ করতে পেরেও ভাল লেগেছে। লেভেল থ্রী,টার্ম-টু তে ময়নামতিতে পিকনিক করতে যাওয়া, লেভেল ফোর টার্ম ওয়ানের শেষে বত্রিশ জনের সেন্টমার্টিন-কক্সবাজার ট্যুর, শেষ টার্মে সুভেন্যির আর সিএসই র্যা গের কাজ করতে অনেক কষ্ট হলেও সেগুলো আনন্দচিত্তে করে গেছি সহপাঠীদের জন্য কিছু করা হবে বলে।

একসময় বুয়েটে কয়েকবছর পড়তে হবে ভেবে খারাপ লাগত আর এখন বুয়েটে পড়া শেষে চলে যাচ্ছি বলে খারাপ লাগছে। আসলেই হিউম্যান লাইফ ইজ এ কমপ্লেক্স মেজ,জীবনের গতিপ্রকৃতি আর তার অনিশ্চয়তার আপেক্ষিকতা অনুমান করা সত্যি বড় কঠিন। সান্ত্বনা একটাই অনেকের ভাষায় ' গোল্ডেন পিরিয়ড অব লাইফটা ' এমনি এমনি গেল না। অনেক কিছুই শিখলাম, সমৃদ্ধ হল অভিজ্ঞতার ভান্ডার। বুয়েট থেকে আরেকটা জিনিস পেলাম, সেটা হল প্রচুর বন্ধু। বন্ধুদের মধ্যে আমি নাসিফ আর মাহমুদের কথা আলাদা করে বলতে চাই। এদের দুইজনের সাথে আমার অধিকাংশ সময় কেটেছে। কি পড়াশুনা , কি আড্ডা, কি ঘুরে বেড়ানো সবকিছুতেই এই দুইজন ছাড়া আমি ছিলাম অচল।সহপাঠী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে , একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে এই দুইজনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

বুয়েট নিয়ে অনেকের অনেক অনুযোগ-অভিযোগ আছে। আমার কোন অনুযোগ-অভিযোগ নেই কারন আমি জানি এই দরিদ্র দেশে একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এর চেয়ে ভালভাবে চলতে পারা সম্ভব নয়। আজ এই বিদায়বেলায় দেনা-পাওনার হিসাব মেটানোর জন্য যখন বসেছি তখন দেখতে পাচ্ছি বুয়েট থেকে পেয়েছি অনেক বেশী, অন্তত যতটুকু আশা করে দুই হাজার চার সালের ডিসেম্বরে ক্লাস শুরু করেছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। এই কয় বছরে নানাদিক থেকে আরোপিত যন্ত্রনার জন্য ঘনীভূত ক্ষোভের খাতিরে আমার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমি যদি কখনো বিষেদেগার করে থাকি , অভিযোগ করে থাকি , আজ এই বিদায় বেলায় সেগুলো আমি সানন্দে প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।


মন্তব্য

অমিত এর ছবি

চলুক

 তারানা  এর ছবি

সুন্দর লেখা!!!

সাইফ এর ছবি

আহা ! ইমরুল ভাই, কি সুন্দর একটা লেখা। নিজের ছাত্র জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। আপনার সাফল্য কামনা করি।

রানা মেহের এর ছবি

আজ সবাই এতো নস্টালজিক কেন?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ফারুক হাসান এর ছবি

চলুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বুয়েটের সবগুলা দেখি বিদায় ঘণ্টা বাজাইতেছে, বুয়েট তো খালি হয়ে যাবে
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

এনকিদু এর ছবি

আজ এই বিদায় বেলায় সেগুলো আমি সানন্দে প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

বিশাল কলিজা তোর ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

ইমরুল কায়েস এর ছবি

হ ,সেইরকম বড় কলিজা।
......................................................
পতিত হাওয়া

রেনেট এর ছবি

বুয়েটে পড়ার মত ঘিলু নাই চিন্তা করে মাঝে মাঝেই আফসোস হয়।
---------------------------------------------------------------------------
No one can save me
The damage is done

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আহা এই ছেলে আমার ঠিক মাথার উপরে ছিল! আমি ৩০০২-তে থেকে বুয়েট জীবনটা কাটিয়ে এসেছি। লেখাটা পড়ার সময় একটা কথা মনে হল। সময়ের সাথে সাথে বুয়েটে আমার ধরণের ছাত্রদের-মানুষদের লাইফস্টাইলে কি বিশেষ পরিবর্তন আসে না? নয়তো আমার হাঁটুর বয়সীর অভিজ্ঞতা আর আমার অভিজ্ঞতাতে এত মিল হয় কী করে? সময় কাটানো, রুচি ফেরানো, দ্বায়িত্ব পালন এত সব বিষয়ের পদ্ধতি একই থাকে কী করে?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইমরুল কায়েস এর ছবি

সময় কাটানো, রুচি ফেরানো, দ্বায়িত্ব পালন এত সব বিষয়ের পদ্ধতি একই থাকে কী করে?

কিছু কিছু বিষয় মিল যে থাকতেই হয় পান্ডবদা।
......................................................
পতিত হাওয়া

বিপ্লব রহমান এর ছবি

দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়
রইলো না...

চলুক


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নাসিফ এর ছবি

সেন্টমার্টিনে হোটেল অবকাশে পূর্নিমা রাতে বালির ঢিঁপির উপরে শোয়ানো চেয়ারগুলোতে সবাই মিলে বসে সমুদ্রের গর্জন,ঝির ঝির বাতাস আর পূর্নিমার যে সামগ্রিকতা প্রত্যক্ষ করেছি , আমার বিশ্বাস এক জীবনে মানুষ এরকম অনুভূতি খুব বেশী পরিবেশ থেকে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না।

আহ ! কী অপূর্ব একটা রাত ছিল ।

রাতের বেলা মেডিকেলের সামনে পেনাংয়ে খেতে যাওয়া, এসব কি আর সহজে ভোলা যাবে?

জীবনে ভুলব না । বিশেষ করে খাওয়ার পর বিড়ি টানতে টানতে হলে ফেরার মুহূর্তগুলো...

সহপাঠী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে , একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে এই দুইজনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আমাদের পক্ষ থেকেও কথাটা তোমার প্রতি একই রকম সত্য ।

ইমরুল কায়েস এর ছবি

ধন্যবাদ।
......................................................
পতিত হাওয়া

ফারুক হাসান এর ছবি

জুবায়ের ভাই ঝুম্পা লাহিড়ির বই পড়ে যেমনটা বলেছিলেন, বুয়েট নিয়ে লেখা পড়লেই আমারও তেমনি বলতে ইচ্ছে করে, এই লেখাটা আমার লেখার কথা ছিল।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

শেষ লাইনটাই মন ভরিয়ে দিলো... চলুক

তানবীরা এর ছবি

লাইব্রেরীতে ঝিমিয়ে,পড়ে, লাইব্রীরই ক্যান্টিনে খেয়ে,মহিলা সমিতিতে প্রচুর নাটক দেখে আর সর্বোপরি নানান ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বারোন্মোচন করে সেসব অদ্ভুদ সব দিন গেছে।

আমরা মেয়েরা এগুলো জীবনভর কি মিস করেই যাবো?
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

ইমরুল কায়েস এর ছবি

হু, সবার সবকিছু পেলে চলবে। হাসি
......................................................
পতিত হাওয়া

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পৃথিবীতে মেয়েদের এখনো অনেক বেশি খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় একথা সত্যি জেনেও বলতে পারি, মেয়েরাও অনেক অভিজ্ঞতার (সদর্থে) মধ্য দিয়ে যায় যা ছেলেদের চিন্তাও কখনো আসবেনা। মেয়েরা অপেক্ষাকৃত বেশি সংবেদনশীল বলে তাদের অ্যান্টেনায় ধরা পড়ে এমন অনেক অভিজ্ঞতা ছেলেদের মাথার উপর দিয়ে যায়।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রীতম সাহা [অতিথি] এর ছবি

ভাল লেগেছে ভাইয়া।।।
গুরুর ইতিহাস জেনে গেলাম।।।। চোখ টিপি

-প্রীতম সাহা

অতিথি লেখক এর ছবি

চমত্--- কার লেখা..........

নিবিড় এর ছবি

এই লেখাটা আগে মিস করলাম কেমনে আগে


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।