দুব্রভনিকে মুগ্ধতায় দ্রবীভূত

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১১/১২/২০১৫ - ১:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


সাধারণত এতটা ভোরে আমার ঘুম ভাঙেনা, কিন্তু সেদিন ভাঙল। চোখ মেলে দেখি শিয়রের দিকের দরজার পাল্লাদুটো ঠেলে এক শিরশিরে হাওয়া ঘরে এসে ক্রমাগত দুলিয়ে যাচ্ছে তাদের। কাল রাতে কি তবে দরজার খিল আটকাতে ভুলে গিয়েছিলাম? আড়মোড়া ভেঙে ধবধবে সাদা চাঁদরে ঢাকা বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার পাল্লার অর্গল বদ্ধ করবো, কিন্তু সে আর শেষ পর্যন্ত হলনা। কারণ তার আগেই অদৃশ্য এক মায়াজাল আমাকে টেনে নিয়ে গেছে কাঁচের সেই দরজার ওপাশের বারান্দায় অপেক্ষারত অপার্থিব এক জগতে। আমার সামনে প্রশান্ত মহিমাময় এক সমুদ্র, বহু দূর দিগন্ত অবধি পালিশ করা মার্বেল পাথরের মতো তার বিস্তার। হয়তোবা দিগন্ত ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে যেখানে আকাশের সাথে মিলন হয়েছে এই সমুদ্রের, ঠিক সেখানেই ভাসছে মেঘের দলের মতো মিহি নীলাভ কুয়াশার পাল। আর সেই কুয়াশার মাঝে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রত্যুষের প্রথম সূর্যের গলিত রক্তিম দীপ্তি। চোখ কিছুটা সয়ে এলে সেই প্রভাতি কুয়াশার মাঝ দিয়েই অস্পষ্ট ভাবে দেখা যায় সাগরের বুকে হটাৎ ডুবোচরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট কটি দ্বীপের রেখাকৃতি। এমন নির্ব্যাঘাত প্রশান্তির আশীর্বাদপুষ্ট দৃশ্য জীবনে প্রতিদিন দেখা যায়না, প্রাণ ভরে প্রতিদিন নেয়া যায়না এমন নির্মল সমুদ্রবায়ু। তাই আমি ধরে নিলাম আজকের এই দিনটি আমার জন্যে ঈশ্বর প্রদত্ত অভিনবত্বে ভরা ব্যতিক্রমী এক দিন।

জাগরেব থেকে বিমানে দুব্রভনিকে এসে পৌঁছেছি আগের দিন রাতে। ক্রোয়েশিয়ার মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় কেশবতী নারীর চুলের বেণীর মতো এক চিলতে ভূমি মূল ভূমি থেকে বেরিয়ে বসনিয়ার পশ্চিম ভাগকে আলিঙ্গন করে বসনিয়া আর মন্টিনিগ্রোকে বঞ্চিত করেছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের নীলাভ ফেনিল ঢেওয়ের ছোঁয়া হতে। এই বেণীসুলভ ভূমির একেবারে নিম্নপ্রান্তেই হল দুব্রভনিক, যে শহরটির গোড়াপত্তন যে ঠিক কবে হয়েছিলো তা নিয়ে আজও ইতিহাসবেত্তাদের মাঝে বাহাস লেগেই আছে। কেও বলেন রোমানদের সময়ে পত্তন হয়েছিলো এই পোতাশ্রয়ি নগরীর আবার কেওবা বলেন এ শহরের পত্তন হয়েছিলো তারও কয়েক শতাব্দী পূর্বে। তো সেসব রজ্জু টানাটানির অধ্যায় বাদ দিয়ে আমরা যদি কেবল সুনীল অ্যাড্রিয়াটিকের পাড় ঘেঁষে স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার চাঙ্গর বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শহর সুরক্ষার প্রাকারের দিকে তাকাই তবেই আন্দাজ করে নেয়া যায় যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা এ শহরের ইতিহাসকে।

পাথুরে ঢাল বেয়ে নামার সময় পাহাড়ি জলপ্রপাত যেভাবে প্রতি পদে বাধা পেয়ে শেষমেশ গিয়ে মিশে নদীর বুকে, ঠিক তেমনই করে বহুদূর থেকে প্রবাহিত আসা বলকানের পাহাড় শ্রেণী এই অ্যাড্রিয়াটিকের তীরে এসে তার খাঁজে খাঁজে গড়ে ওঠা লালচে টালি আর সাদা চুনকামের বাড়িগুলোতে বাধা পেয়ে পেয়ে এক সময় গিয়ে মিলিত হয়েছে সেই মহা সমুদ্রে। এমনই এক পাহাড়ের খাঁজে সেসিপের বাড়ি, যেখানে এসে আমি উঠেছি আগের রাতে। বিমানবন্দর থেকে প্রথম বাসে সেসিপের বাড়ির খুব নিকটেই যেখানে পৌঁছেছিলাম সে জায়গাটি থেকে ওর বাড়ির উঠোনের থেকে তাকালে মনে হয় এইতো পাঁচ মিনিটের পথ কেবল। কিন্তু মাঝের যে দুর্লঙ্ঘ খাড়া পাহাড়ের ঢাল তাকে পেরোই কিভাবে? অবশেষে আরও একটি বাসে চড়ে পাহাড়ের গাঁ বেয়ে এঁকে বেঁকে চলা সঙ্কীর্ণ এক রাস্তা মাড়িয়ে সেই আপাত পাঁচ মিনিটের পথ প্রায় ত্রিশ মিনিতে পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছুলাম সেই পাড়ায়। তখনও আরও চমক অপেক্ষা করছিলো আমার জন্যে। ঠিকানামতো পৌঁছে দেখলাম সেসিপের বাড়িটি আসলে সেই পাহাড়ের চুড়োয়, আর সেখানে পৌছুতে হলে আমাকে এখনও বাইতে হবে প্রায় সত্তর ধাপের সিঁড়ি। সেসব ডিঙিয়ে যখন অবশেষে সেসিপের বাড়ির কড়া নাড়লাম ততোক্ষণে আমার প্রাণ বায়ু বেরুবার উপক্রম। দরজা খুলে দিল সেসিপ নিজেই। অন্যদিন সন্ধ্যে রাতের মধ্যে ঘুমিয়ে পরলেও আজ বেচারা জেগে রয়েছে শুধু আমার আসার অপেক্ষায়। বলিষ্ঠ, সুঠাম আর প্রভুত্বব্যাঞ্জক চেহারার অধিকারী সেসিপ। কে বলবে ওর বয়স ৭৪? এক সময় নাকি যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী জাহাজে নাবিকের চাকরী করতো। বউ গত হয়েছে কয়েক বছর আগে, দু ছেলেও আর বাপের সাথে না থেকে থাকে দূরের শহরে। সেসিপের বাড়িতে মোট তিনটে ঘর। সামনের দিকের দুটো ঘর সাগরের দিকে মুখ করে আর পেছনের এক চিলতে ঘরটি কিছুটা গুমোট। নিজের সেরা ঘরগুলো আগন্তুকদের কাছে ছেড়ে দিয়ে সেসিপ আজকাল সেই পেছনের ঘুপচি ঘরেই রাত কাটায়। এতে হয়তো বা বুড়ো সেসিপের দুটো পয়সা রোজগার হয় এই হিসেবে ভরা অবসর জীবনকে আরও কিছুটা স্বাচ্ছন্দে চালাবার জন্যে। আমি বাংলাদেশের ছেলে জেনে আমাকে সেসিপ বলল, “একবার দূর প্রাচ্যে যাবার সময় তোমাদের ওই চিটাগাং বন্দরে নেমেছিলাম আমরা। বেশ ছোটোখাটো ছিমছাম বন্দর, আমাদের বেশ ভালোই লেগেছিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝির সময় ছিল সেটা।“

আগের রাতে পেটে কিছু পড়েনি, তাই ভোর হতেই খিদেটা কেমন যেন চনমনিয়ে উঠছিল। সেসিপের কাছ থেকে পুরনো শহরের একটা ভালো ম্যাপ চেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আপাতত কিছু খাবারের সন্ধানে। খুব বেশি দূরে যেতে হল না, সেই সত্তরটি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমেই দেখি পাশের এক দোকান থেকে ধুম্রপক্ক মাছের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কালবিলম্ব না করে সেই মাছের এক পদ দিয়ে সকালের খিদেটুকু মিটিয়ে ফেললাম।

পুরনো শহরটির চারধার সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সুউচ্চ প্রাকার দিয়ে ঘেরা। তা হবেই বা না কেন? কালে কালে তো আর কম ঝাঁপটা যায়নি এ শহরের উপর দিয়ে। জলদস্যু, তস্কর আর লুটেরা হয়ে কখনা এ শহরে হানা দিয়েছে ভেনিসিয়রা, কখনও ফরাসিরা, আবার কখনও পর্তুগিজরা। তবে শুধু এরাই নয়, জীবিকার সন্ধানে, ভাগ্যের টানে কিংবা শরণার্থী হয়েও আরও বহু জাতির আগমন ঘটেছিল এই ছোট্ট শহরে। হয়তোবা সে কারণেই ঠাস বুনটের সেই পুরনো শহরের স্বল্প পরিসরেই আমার চোখে পড়েছিল বহু ধর্মমতের উপাসনালয়। মাত্র আধ মাইলেও কম দূরত্বে এ শহরে খুঁজে পাওয়া যায় সিনাগগ, মসজিদ, ক্যাথলিক চার্চ, অর্থোডক্স চার্চ কিংবা ফ্রান্সিস্কান চার্চ।

আগেকার আমলের দুর্গবেষ্টিত শহরের মতো এ শহরের মূল প্রবেশপথ একটি, সেটি শহরের পশ্চিম প্রান্তে। তবে উত্তর প্রান্তেও কয়েকটি ছোটোখাটো প্রবেশদ্বার আছে। কিন্তু সেগুলো দিয়ে কেবল মানুষই ঢুকতে পারে, কোনও যানবাহন নয়। একে পূর্ব আর দক্ষিণ প্রান্তে উত্তাল সমুদ্র থেকে আড়াল করেছে পাথরের বাঁধের এলোমেলো কিছু বৃত্তাংশ। আমি সেই উত্তর দিকের সরু পথ ধরেই এ শহরে ঢুকলাম। ঢুকলাম বলতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামা শুরু করলাম আরকি। কারণ ওই উত্তর প্রান্তের দ্বার আর তার সংলগ্ন বাড়িগুলো পাহাড়ের একেবারে মাথায়। তাই সেখান থেকে এ শহরের প্রধান সড়ক স্তারদুনে নামতে হলে এই পাহাড়ের মাঝে গা লাগালাগি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে সন্তর্পণে জায়গা করে বেরিয়ে যাওয়া পাথরের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। সে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় কখনও নাকে আসতে পারে পাশের বাড়ির রসুইঘর থেকে ভেসে আসা সামুদ্রিক কোনও তাজা মাছ ভাজার গন্ধ, কিংবা মাথায় এসে ঠেকতে পারে কিছুটা উপরে জানলার পাল্লার মাঝে শুঁকোতে দেয়া গৃহিণীর কাপড়ের অংশবিশেষ। আবার জমজমাট দিনের গমগমে সময় হলে এই সিঁড়ির দুপাশের বাড়ির নীচের তলাটিতে দিব্যি দোকান খুলে বসা দোকানির হাতছানিতে মোহিত হয়ে ভেতরে ঢুকলে খসে যেতে পারে পকেটের কিছু কুনা। পাশের অ্যাড্রিয়াটিক থেকে তুলে আনা স্পঞ্জ মুক্তায় গড়া মালা নাকি আর কোথাও মেলেনা, পছন্দের মানুষের জন্যে এমন মালা না কিনে ফিরে যাওয়াটা নাকি বড় ধরণের নির্বুদ্ধিতা। আর জেনে শুনে নির্বুদ্ধিতার দায়ভায় কেইবা আপন ঘাড়ে নিতে চায়?

পাথরে বাঁধাই করা স্তারদুন সড়কের শত মানুষের ভিড়ে পা দেবা মাত্রই আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিল সাধু ব্লাইসে চার্চের চুড়োয় লাগানো ঘণ্টা ধ্বনি। বারোক স্থাপত্যে নির্মিত এই চার্চের সম্মুখভাগে বাঁ হাতে এই শহরের একটি ছোটোখাটো অনুকৃতি নিয়ে অভ্যর্থনা জানান সাধু ব্লাইসে স্বয়ং। শোনা যায় তার হাত ধরেই নাকি হয়েছিলো এ শহরের পত্তন। চার্চের ভেতরের মূল বেদীর অঙ্গসজ্জাটি আহামরি কিছু না হলেও দু ধারের শ্বেত পাথরের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা দেবশিশুদের ভাস্কর্যগুলো দৃষ্টি কেড়ে নেবার মতো।

এই চার্চ দর্শন শেষে কিছু সময়ের জন্যে আমি হারিয়ে গেলাম এই ক্ষুদ্র শহরের গলি উপগলির গোলক ধাঁধায়। এ শহরে পরিচিত হওয়া একজন আমাকে বলছিল “আমাদের এই শহরটিকে বেশ ছোট মনে হলেও তুমি যদি উদ্দেশ্যহীনভাবে সারাদিন এ শহরে হাঁটো তবে হয়তো প্রতি বাঁকেই সন্ধান পাবে নতুন নতুন উপগলির”। সত্যিই তাই, এ যেন এক লুকোচুরি খেলবার উৎকৃষ্ট জায়গা। গলিগুলোও বেশ সঙ্কীর্ণ, কেবল কয়েক জন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে। মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা এমন অনেক গলির মাঝে চক্কর খেতে খেতে এসে উপস্থিত হলাম একটা ছোট্ট বাজার মতো জায়গায়। পুরো শহরটাই পাথরের আস্তরে ঢাকা হলেও আগেই চোখে পড়েছিল এখানে সেখানে স্বল্প মাটিতে বেড়ে ওঠা বেশ কিছু কমলালেবুর গাছ। এই বাজারে এসে বুঝলাম সেটি খুব সম্ভবত এখানকার অন্যতম প্রধান একটি ফল। অস্থায়ীভাবে বসানো বেশ কিছু দোকানের দোকানি হাঁক ছেড়ে সবাইকে আহ্বান করছে তার দোকানের এক মিষ্টি দ্রব্য চেখে দেখতে। ব্যাপারটা কি দেখতে গিয়ে এক খাসা জিনিশের সন্ধান পেলাম। এ অঞ্চলের এই কমলালেবুর খোসা খুব সম্ভবত বেশ পুরু। আর এই কমলালেবু, আলমণ্ড আর ফিগ ফলের খোসা ছাড়িরে তাকে শুকিয়ে উপরে এক মিহি চিনির আবরণ দিয়ে বানানো হয় এই মিষ্টি দ্রব্যটি। দোকানের সামনে রাখা পাত্রের বিনামূল্যের নমুনা থেকে কিছুটা খেয়ে বুঝলাম বেশ খেতে এ জিনিশ। আশপাশের বাকি দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে টসটসে চেরি, বিশালাকারের ফিগ, বেশ কয়েক ধরণের উজ্জ্বল রঙা বেরি, আরও কতো কি। ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি দোকানে দেখলাম দেদারে বিক্রি হচ্ছে স্থানীয়ভাবে বানানো ‘সুইট এন্ড কিওর’ ব্র্যান্ডি। এই ব্রাণ্ডিতেও নাকি কিছুটা মিষ্টি মিশিয়ে দেয়া হয় স্বাদ কিছুটা পরিবর্তন করার জন্যে। এইসব খাবার আর পানিয়ের দোকানের পাশেই আরেক ছোকরা বিক্রি করছে এক অদ্ভুত ধরণের কাঠের ছোট খাটো কিছু ব্যাঙ, যার উপরিভাগে আরেকটি কাঠের দণ্ড দিয়ে ঘর্ষণ করলে সেটা থেকে অবিকল আওয়াজ বেরোয় কোলা ব্যাঙের ডাকের মতোই। ছোট্ট ওইটুকু ব্যাঙের জন্যে ছোকরা দাম হাঁকছে দশ ইউরো, কিছুটা আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও তাই ও আর কেনা হলনা।

বেশ মেঘলা দিন সেদিন, তাই শহরের একেবারে মধ্য এলাকায় অবস্থিত অর্থোডক্স চার্চের ঝাড়বাতিটি অবেলাতেই জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সে আলোয় ঝলমল করছে পেছনের আলটার পিসে থাকা মেরীর কোলে যীশু আর এক হাতে বাইবেল নিয়ে বাণীরত যীশুর ছবিগুলো। সেই চার্চের বাঁ ধারে এক সামিয়ানার নিচে আধপোড়া চুরুটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে এক শিল্পী তখন জলরঙে এঁকে চলেছেন দুব্রভনিকের সৈকতের নানা ছবি। যেন এই ছবি আঁকাটাই তার একমাত্র কাজ, তার ছবি কে কিনল আর কিনলনা তাতে তার কিচ্ছু যায় আসে না।

শহরের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে ফ্রান্সিস্কান মঠ দেখতে গিয়ে সন্ধান পেলাম প্রায় সাতশো বছরের পুরনো এক ফার্মেসির। এই ফার্মেসিটি ঠিক চলার পথ থেকে দৃষ্টিগোচর হয়না, কিছুটা ভেতর বাড়িতে গিয়ে তবেই খুঁজে পেতে হয়। এই ফার্মেসিটি যেমন একাধারে জাদুঘর, তেমন স্থানীয়দের ওষুধের চাহিদা মেটানোর জন্যে পূর্ণ সচল একটি ঔষধালয়ও বটে। ফার্মেসির কাউন্টারে রাখা ফ্রেমে বাঁধাই করা বায়ার কোম্পানির বহুকালের পুরনো এক অ্যাসপিরিনের বিজ্ঞাপন চিত্র বলছে, “ইয়েদিনি না সভিয়েতু”, অর্থাৎ পৃথিবীর অদ্বিতীয়। ফার্মেসিটি কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম এখানে যতনা মানুষ আসে রোগের ওষুধ নিতে, তার চেয়ে বেশি আসে রমণীরা গোলাপের পাপড়ি থেকে বানানো কিছু প্রসাধন সামগ্রী কিনতে। কারণ এ ফার্মেসীতে নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি কিছু আয়ুর্বেদিক প্রসাধন সামগ্রীও রাখা হয়।

চীনের মহা প্রাচীরটি দেখা হয়নি অদ্যাবধি, শুনেছি সে প্রাচীরের উপর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া যায়। এই দুব্রভনিকের পুরনো শহরটিকে ঘিরে থাকা প্রাচীরটি তেমন বিশাল না হলেও এর ওপর দিয়েও দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায়, যদিও সেটি ঠিক বিনামূল্যে নয়। তা হোক, তার বদলে যে দমবন্ধকরা দৃশ্য দেখা সম্ভব হয় তার মূল্য কোনও অর্থকড়িতে মাপা সম্ভব নয়।

পাথরের দেয়ালের গা আঁকড়ে থাকা এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ের প্রস্তর মৃত্তিকা খাড়াভাবে নেমে একসময় গিয়ে মিলিত হয়েছে প্রবল রোষে আছড়ে পড়া অ্যাড্রিয়াটিকের সবুজাভ নীল জলের সাথে। চারধারে বয়ে যাচ্ছে এক মিষ্টি নোনা বাতাস, যে বাতাস অনবরত ঘুরিয়ে যাচ্ছে এই ছোট্ট দিক নির্দেশক যন্ত্রের ধাতব তীরকে। মাথার ওপর দিয়ে হটাৎ হটাৎ কর্কশ শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে গাঙচিল। জলচর পাখির পায়ের পাতার মতো কচি সবুজ পাতা মেলে লতিয়ে ওঠা কিছু আঙ্গুর গাছ প্রবল গতিতে দুলে যাচ্ছে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। আগে বুঝিনি, এখন এই প্রাকারের মাথায় চড়ে বুঝলাম যে ঘণ্টাধ্বনি শুনেছিলাম এ শহরে পা দেবা মাত্র, সেই বিশালাকারের ঘণ্টাটি আসলে বাজায় এক কলের ধাতব সৈনিক। সময় যেন এইখানটায় এসে থমকে গেছে মহাকালের স্রোতের কাছে। প্রাচীরের এক প্রান্তে ফুটোয় লাগানো লোহার কামানগুলো যেন বলছে এইতো এখনি হয়তো দূর দিগন্তে দেখা দিতে পারে কোনও বোম্বেটে জাহাজ, যার জন্যে তারা সদা প্রস্তুত। তেমন কিছু ঘটনার জন্যে কিন্তু আমাদের অনন্ত অতীতে ফিরে যেতে হবেনা, কেবল একটু মানসপটের দৃষ্টি ঘুরিয়ে বছর বিশেক পেছনে ফিরে গেলেই হবে। ৯১’এ ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই এই দুব্রভনিক শহরটি প্রবল আক্রমণের মুখে পরে। সে সময়ে যুগোস্লাভ ফেডারেশনে টিকে ছিল সার্বিয়া আর মন্টিনিগ্রো। দুব্রভনিক নিয়ে সার্বিয়ানদের তেমন মাথা ব্যথা না থাকলেও, এ শহরের প্রতি লোভ ছিল মন্টিনিগ্রোয়ানদের। খুব কাছেই মন্টিনিগ্রোর আরেকটি পোতাশ্রয়ী শহর কোটর, তাই দুব্রভনিকে সাথে পেলে মন্টিনিগ্রোর ভু-রাজনৈতিক অবস্থানটা আরও পোক্ত হয়। মূলত মন্টিনিগ্রোই সার্বিয়ার উপর চাপ দেয় দুব্রভনিককে যুগোস্লাভ ফেডারেশনের সাথে যুক্ত করার জন্যে। সেদিনটি ছিল সাধু নিকলাস ডে, ৯১ এর ডিসেম্বরের ছ’ তারিখ। খুব সকালে দুব্রভনিকের অধিবাসীরা আবিষ্কার করলো এ শহরের পোতাশ্রয়ের কয়েক মাইল দূরেই কামান তাক করে বসে আছে যুগোস্লাভ নৌবাহিনীর সমরপোতগুলো। টানা প্রায় পাঁচ মাস এভাবেই অবরোধ চলে এ শহরের উপর। কোনও এক কারণে অবশ্য তখনকার যুগোস্লাভ বাহিনী এ শহরে স্থল সৈন্য পাঠায়নি, তারা চেয়েছিল এবং ভেবেছিলো নৌ শক্তির বল প্রয়োগের মাধ্যমেই এ শহরকে ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার ছিল এই পুরনো শহরের শতাব্দী প্রাচীন বাড়িগুলোর উপর নিরবচ্ছিন্ন মর্টারের গোলা নিক্ষেপ। তাতে বহু সাধারণ মানুষ হতাহত তো হয়ই, তার সাথে অপূরণীয় কিছু ক্ষতি হয়ে যায় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের। আজ তাই এই প্রাকার থেকে পুরনো শহরের বাড়ির ছাদগুলোর টিলার দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় স্পষ্টতই পুরো শহরের ছাঁদে ছড়িয়ে আছে দু বর্ণের টালি। একটি উজ্জ্বল লালচে হলুদ বর্ণের, আরেকটি কিছুটা বিবর্ণ হলুদ বর্ণের। এই উজ্জ্বল রঙের টালির ছাঁদগুলি হল সে বাড়িগুলোর, যেগুলোর ছাঁদ ভেদ করে সেই মাসগুলোতে পড়েছিল অগুনতি মর্টারের শেল। যুদ্ধের পর তাই সে ছাঁদগুলোতে বসানো আনকোরা নতুন টালি। সেই পুরনো শহরের কিছু বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময়েও আমি দেখেছিলাম বাড়ির মালিকেরা সামনের দিকের দেয়ালে টানিয়ে রেখেছেন যুদ্ধের ঠিক পর পরের তাদের ভগ্নপ্রায় বাড়ির ছবি, আর সেদিনের ঘটনার কিছু ছোটোখাটো বিবরণ। এই যেমন একজন লিখেছেন, “সেদিন সকাল ঠিক সাতটে দশে প্রথম মর্টারের শেলটি এসে পরে আমাদের বাড়ির ছাঁদে। আমি প্রথমেই আমার ৮৮ বছরের মাকে পাঁজকোলা করে নিয়ে যাই আমাদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে। বোনটিকে বলি একটা কম্বল মাথায় দিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিতে। প্রথমেই আমি চেষ্টা করি দোতলায় থাকা মূল্যবান কিছু কাগজ আর যৎসামান্য দ্রব্যাদি সরিয়ে নিতে। ভয় হচ্ছিলো কখন না আবার দ্বিতীয় গোলাটি এসে পরে। হাতের কাছে যতগুলো জলের বোতল পেয়েছিলাম তাই দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম আগুন নেভাতে। সেদিন সন্ধ্যে অবধি মোট সাতটি মর্টারর গোলা এসে পড়েছিল আমাদের বাড়ির ছাঁদে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ আমরা এখনও বেঁচে আছি”। আরেকজন বাড়ির মালিক তার বাড়ির সামনে ডিসেম্বরের ছ’ তারিখে তার ভগ্নপ্রায় বাড়ির সামনে তোলা একটি ছবি টানিয়ে রেখেছেন, যেখানে তিনি হাস্যজ্বল মুখে কম্বল মুড়ি দিয়ে ডান হাতটি বিজয়ের ভঙ্গীতে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছেন, যেন বলতে চাচ্ছেন যতই বোমা ফেল জয় একদিন আমাদের হবেই।

এই যুদ্ধ নিয়ে কথা হয়েছিলো সেসিপের সাথেও। আমি ওকে জিজ্ঞেস করাতে ও প্রথমে কোনও উত্তর না দিয়ে ইশারায় আমাকে ডেকে নিয়ে গেলে ওর রান্নাঘরে। তারপর দেরাজের ভেতরে থাকা এক বাক্স বের করে আমাকে বলল, “এই দেখো আমার যুদ্ধের স্মৃতি”। সেই বাক্সে সেসিপ জমা করে রেখেছিল ওর বাড়ির ছাঁদে পড়া মর্টার আর গোলার অংশবিশেষ। যুদ্ধ শুরু হবার পর পরই সেসিপ ওর বউ আর ছেলেদের পাঠিয়ে দেয় প্রায় বিশ মাইল দূরের ওর শ্বশুরবাড়িতে। সেসিপ রয়ে যায় শহরের আর সব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে শহর রক্ষা করতে। কিন্তু ওদের অস্ত্রবল তেমন ছিলনা। ওই পুরনো আমলের গাদা বন্দুক যা ছিল তাই নিয়ে ওরা পালা করে নাকি উপকূলে পাহারা দিতো যাতে কোনও ভাবে শত্রুসৈন্য নৌ বহর থেকে এ শহরে পদার্পণ করতে না পারে। যুদ্ধের কথা বলতে বলতে সেসিপের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, বিরক্তি আর ক্রোধের সাথে আমাকে ও বলল, “ওরা জানতো আমরা উস্তাশা। তাই আমাদের ওরা ঠিকই ভয় করতো। সে জন্যেই হয়তো ওরা প্রায় পাঁচ মাস আমাদের উপকূল অবরোধ করে রাখলেও আমাদের তীরে নামার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি। আমরা ক্রোয়াটরা হলাম এমন যে যদি তুমি আমাদের টাকাকড়ি নিয়ে যাও, আমরা হয়তো তোমাকে কিছুই বলবনা। এইতো আমাদের গতবারের প্রধানমন্ত্রী কয়েক লক্ষ ইউরো আত্মসাৎ করে ভেগেছে। সে নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু যদি আমাদের পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত এ দুটোর দিকে যদি কেও হাত বাড়ায় তবে আমরা হিংস্র নেকড়ের মতো তেড়ে আসবো”। সেসিপ ওর কথার মাঝে উস্তাশা শব্দটি উচ্চারণ করায় এবং নিজেকে একজন উস্তাশা হিসেবে উপস্থাপন করায় একটু যেন হোঁচট খেলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রোয়াটদের মধ্যে যে চরম ডানপন্থী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশটি ছিল তাদেরকেই বলা হতো উস্তাশা। এই উস্তাশারা আবার ছিল নাৎসিপন্থী এবং চরম নৃশংস। যুদ্ধের সময় এরা নাৎসিদের ডান হাত হয়ে কাজ করে। ধারণা করা হয় এই উস্তাশাদের হাতে খুন হয় প্রায় নয় লক্ষ সার্ব, ইহুদী, রুমানিয়ান এবং ফ্রান্সিস্কান ধর্মের অনুসারীরা। কুখ্যাত ইয়াসনভাচ কনসেনট্রেসন ক্যাম্পের পত্তন হয় এই উস্তাশাদের হাত ধরেই। ক্রোয়াট সমাজে এই উস্তাশাদের ছিল এক বিশাল প্রভাব এবং হয়তোবা এখনও আছে। সেসিপকে তাই এ ব্যাপারে আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি না করে পারলাম না, “আচ্ছা সেসিপ তুমি এই যে উস্তাশাদের কথা বললে, তারা কি ফ্যাসিস্ট নয়”? এ কথায় সেসিপ কিছুটা যেন তেতে ওঠে, “ফ্যাসিস্ট? কে ফ্যাসিস্ট? এই যে আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমাকে কি তোমার ফ্যাসিস্ট মনে হয়? দেশকে ভালোবাসা আর দেশের জন্যে কাজ করা কি ফ্যাসিসম? এই ফ্যাসিস্ট ধুয়ো তুলেই তো টিটো ক্ষমতায় এলো। তারপর আমাদের এই শহরের প্রায় দুশো জনকে বিনা বিচারে ফাঁসিতে চড়াল। তাদের অপরাধ তারা নাকি উস্তাশা দলে ছিল। উস্তাশাদের অপরাধের তেমন কোনও প্রমাণ কি কেও দিতে পারবে”? যতটুকু বুঝলাম সেসিপের সাথে উস্তাশা বিষয়ক কোনও আলোচনা করে ফল পাওয়া যাবেনা। কারণ ওর মনে বদ্ধমূল ধারণা উস্তাশারা ছিল কেবলই এক জাতীয়তাবাদী দল, কিন্তু তাদের অন্যান্য কুকর্ম সম্বন্ধে ও হয়তো অজ্ঞ অথবা জানলেও প্রকাশ করতে চায়না ইচ্ছাকৃতভাবে। শুধু তাই না, সেসিপের সাথে এই আলোচনাকে আমি তখন মেলাতে পারছিলাম কিছু দিন আগের এক সংবাদের সাথে। বেশ কয়েক বছর আগে দিনকো যাকিক নামক এক উস্তাশা যুদ্ধাপরাধীকে প্রায় পাঁচ দশক পর আর্জেন্টিনা থেকে বিচারের জন্যে ফিরিয়ে আনা হয় ক্রোয়েশিয়ায়। এই যাকিক ছিল সেই ইয়াসনভাচ ক্যাম্পের প্রধান যেখানে তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে নিকেশ করা হয়। কিন্তু এই যাকিককে যেদিন বিমানে আনা হল সেদিন দেখা গেল তার সমর্থনে বিমানবন্দরে বেশ বড়সড় লোকের জমায়েত, যা ছিল ক্রোয়েশিয়ার জন্যে বেশ বিব্রতকর। শুধু তাই নয় জাগরেবের প্রধান ক্যাথিড্রালে গত কয়েক বছর ধরে উস্তাশা পার্টির প্রধান পাভেলিচের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়, যেটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বেশ সমালোচনা কুড়িয়েছিল। মার্শাল টিটো নিজে যদিও এসেছিলেন পার্টিজান দল থেকে যারা আবার চরম শত্রু ছিল উস্তাশাদের, তদাপি তিনি উস্তাশাদের অতীতের দুষ্কর্ম নিয়ে খুব একটা ঘাঁটাননি। খুব সম্ভবত রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যে টিটো ইচ্ছে করেই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি স্বাধীন ক্রোয়েশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি তুজমান যিনি নিজেও একসময় ছিলেন পার্টিজান যোদ্ধা, একসময় বলে বসেছিলেন উস্তাশার হাতে নিহতদের সংখ্যাটি নাকি একটু বেশ বাড়িয়েই বলা হয়। সচেতনভাবে তিনিও চেষ্টা করেছিলেন উস্তাশাদের অতীতের অপরাধকে লঘু করতে। আর এভাবেই রাজনীতির কাছে এসে এককালের মুক্তিযোদ্ধাও হয়ে যায় প্রতিক্রিয়াশীলদের দোসর।

উস্তাশা প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম সার্ব এবং ক্রোয়াটদের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দ্বেষের পটভূমিকাটি জানানোর জন্যে। বলকান যুদ্ধ প্রায় দু দশক আগে শেষ হয়ে গেলেও এই তীব্র দ্বেষ কিন্তু এখনও শেষ হয়ে যায়নি। জাগরেব ভ্রমণের সময় তার কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম।

জাগরেবের এক পুতুলের দোকানে পরিচয় হয়েছিলো নাতালিয়ার সাথে। নাতালিয়া স্থানীয় এক কলেজে পড়ে, অবসরের সময়ে এই দোকানে কাজ করে বাড়তি কিছু রোজগারের আশায়। নাতালিয়াকে আমি ভেবেছিলাম ক্রোয়াট, কিন্তু ওর সাথে কথা বলে জানলাম নাতালিয়া ক্রোয়াট ঠিকই, তবে ক্রোয়েশিয়ার ক্রোয়াট নয়। বরং ও হল বসনিয়ান ক্রোয়াট। যুদ্ধের শুরুতে, নাতালিয়া যখন একেবারেই শিশু, ওদের পুরো পরিবারটি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আশে ক্রোয়েশিয়ায়। ওদের পুরো গ্রামটিই নাকি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারপর থেকে ওরা শরণার্থী হয়ে ক্রোয়েশিয়াতেই আছে। যদিও ওর বাবা আর বড় ভাই কাজের সন্ধানে চলে গেছে নেদারল্যান্ডে। আর নাতালিয়া ওর মাকে নিয়ে পরে আছে জাগরেবে। যুদ্ধ ওদেরকে স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করলেও, আজও বসনিয়ার প্রতি এক গভীর আত্মিক টান অনুভব করে ও। আমাকে বলছিল, “চেভাপি খেয়েছ কখনও? চেভাপি খাবার জন্যে হলেও একটিবার বসনিয়ায় যেও। অমন খাসা জিনিস পুরো বলকানের আর কোথাও পাবেনা। এখানেও চেভাপি বানায়, তবে বসনিয়ার চেভাপির সাথে তা কোনও ভাবেই তুলনীয় নয়”। ওর কথা থেকে বুঝতে পারছিলাম নাতালিয়া এখনও ওর মনন থেকে বসনিয়ান সত্ত্বাটিকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। হটাৎ মনে হল ঠিক এ কারণেই হয়তো ওকে জিজ্ঞাসা করা যায় এখনকার সার্ব আর ক্রোয়াটদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। আমার প্রশ্নের উত্তরে ও নিজের মতো করেই, নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আর দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে জানালো। এই যেমন, বলকান যুদ্ধের পর এতোগুলো বছর পার হলেও এখনও কোনও নামী সার্ব সঙ্গীত শিল্পী জাগরেবে প্রকাশ্যে কোনও কনসার্ট করতে পারেনা হামলার আশঙ্কায়, যারা আসেন তারা কেবল ঘরোয়া আয়োজনেই অংশ নেন। দু দেশের মাঝে ভিসা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোও এখনও তেমন সহজ নয়। নাতালিয়ার এক বান্ধবী ভালোবেসে ফেলেছে এক সার্ব যুবককে, কিন্তু এই ভিসা আর নাগরিকত্ব সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোই নাকি এই যুগলের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। ক্রোয়াটদের মাঝে সার্ব বিদ্বেষ এখনও এতটাই নাকি প্রবল যে, ঝগড়ার সময় অন্য কোনও গালি দেবার বদলে লোকে বলে, “তুই একটা আস্ত সার্ব”।

ছিলাম সেই দুর্গ প্রাকারে, সেখান থেকে চলে এলাম যুদ্ধ আর রাজনীতির ময়দানে। যাকগে, আবার ফিরে যাওয়া যাক সেখানেই। আমার ঘোরাঘুরির শেষ পর্যায়েই বুঝতে পারি বাতাস যেন বড্ড জোরে বইছে, ঈশান কোণে জমে উঠেছে থাক থাক কালো মেঘ। তীরে বেঁধে রাখা কিছু নৌকো অস্থির ভাবে দোলা শুরু করেছে ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে। কালচে নীল কুয়াশা আর মেঘ দূর দিগন্তকে গ্রাস করতে করতে যেন এগিয়ে আসছে এই তীরের পানে। মাথার উপরে জ্বলতে থাকা সূর্যটা ততোক্ষণে এই মেঘের দলের কাছে পরাভূত হয়ে মুখ লুকিয়েছে অন্য কোথাও, যেন আজকের মতো তার ছুটি। আগের দিন জাগরেব বিমানবন্দরের কোনও এক কোণে ফেলে এসেছিলাম আমার ছাতাটি। তাই এক্ষণে ঝড় নামলে কাকভেজা না হয়ে উপায় নেই। আমি ভিজলে ক্ষতি নেই, কিন্তু সাথের ক্যামেরাটিকে তো বাঁচাতে হবে। তাই প্রাকারের শেষ পথটুকু একটু পা চালিয়েই শেষ করলাম। শেষ ধাপের সিঁড়ি বেয়ে সবে সেই পুরনো শহরের এক গলিতে পা দিয়েছি, তক্ষুনি ঝমঝমিয়ে বড় বড় ফোঁটায় নামলো অঝোর বাদল ধারা। উপায়ন্তর না দেখে আমি এক দোকানের বাইরের দিকে এক চিলতে ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম। শুধু আমি নই, আমার সাথে এসে দাঁড়ালেন এক সুইডিশ বৃদ্ধাও। ছাউনিটি তেমন বিশাল নয়, তাই এই ঝুম বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের পা। ভেতরের দোকানের কয়েকজন আমাদের লক্ষ্য করছিলেন, কিন্তু কেওই আর বলছিল না যে তোমরা ভেতরে আসতে পারো। কিছুটা ইতস্তত করে আমি আর সেই বৃদ্ধাও আর সেই দোকানের ভেতরে ঢুকলাম না। কে জানে? আমাদের এই চুপচুপে জলে ভেজা জুতো নিয়ে ভেতরে ঢোকাটিকে যদি ওরা ভালভাবে না নেয়? প্রতিক্ষণেই ভাবি এই বুঝি কমে এলো বৃষ্টির ধারা, কিন্তু তৎক্ষণাৎ যেন দ্বিগুণ শক্তিতে বর্ষিত হতে থাকে জলধারা। এভাবে প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে অবিরাম বর্ষণের পর যখন বৃষ্টির তেজ কিছুটা কমে এলো, তখন সেই দোকানের সম্মুখ থেকে বেরুতে গিয়ে দেখি আরেক বিপত্তি। পুরো শহরটাই ডুবে গেছে প্রায় হাঁটু জলে। কারণ শুধু এই পুরনো শহরে পতিত হওয়া বৃষ্টির জলই তো নয়, পাশের পাহাড়গুলো নিঙরে আসা জলও নিম্নমুখী প্রবাহের সূত্রানুযায়ী এসে হাজির হয় এই শহরের বুকে। ঢাকার জলাবদ্ধতার স্মৃতি মাথায় নিয়ে ভাবছিলাম এ জল আদৌও আজ সারাদিনে নামবে তো?

রীতিমতো ভোজবাজির মতো পুরো শহরের সেই হাঁটু জল কিন্তু নেমে গেল আধ ঘণ্টার মধ্যেই। সাথে সাথে চলে এলো নগর কর্তৃপক্ষের গাড়ি, শহরের পাথুরে সেই সড়কগুলোতে জমে থাকা জলকাদা ধুয়ে মুছে ফেলতে। মোটামুটি এক ঘণ্টা পরেই শহরটি ফিরে গেল ঠিক আগের রূপে। সূর্যটিও যেন কোন ফাঁকে তার দিনের ছুটি বাতিল করে মেঘের দলকে হটিয়ে দিয়ে এসে বসে গেল নিজের আগের স্থানে। কে বলবে এই শহরটিই দু ঘণ্টা আগে ঢুঁকে পড়েছিল প্রকৃতির তীব্র বাদল-মুঠোর মধ্যে?

কোনও আধুনিক নগর-প্রকৌশল বিদ্যা খাটিয়ে বানানো জল-নিষ্কাশন ব্যাবস্থা নয়, বরং এই পুরো শহরের নিষ্কাশন ব্যাবস্থাটি নাকি তৈরি করা হয়েছিলো কয়েক শতাব্দী পূর্বে। এমনকি শহরের পশ্চিম প্রান্তে যে বিশালাকৃতির ষষ্ঠভুজা এক ফোয়ারা এখন দেখা যায় সেটিতেও নাকি দূরের কোন এক পাহাড় থেকে মিষ্টি জলের ধারা বইয়ে আনার ব্যাবস্থা করা হয়েছিলো আজ থেকে ছয়শ বছর আগেই। সেসিপের কাছ থেকে শুনেছিলাম সেই পাঁচ মাসের নৌ-অবরোধের সময় যখন গোটা দুব্রভনিকের জল-সঞ্চালন ব্যাবস্থা ভেঙে পড়েছিল তখন পুরো শহরের বাসিন্দাদের মিষ্টি জলের অন্যতম ভরসা স্থল ছিল এই পুরনো শহরের ফোয়ারাগুলোই।

পরদিন বেশ কাক ডাকা ভোরেই আমার বসনিয়াগামী বাস ধরবার কথা। যাবার আগে সেসিপ বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল ঠিক কোথা থেকে কতো নম্বর বাস ধরতে হবে। বিদায় বেলায় করমর্দন করে বলল, “এর পর যদি আবার কখনও আসো আমাদের এই দুব্রভনিকে, তবে আমার এখানেই উঠো”। কিন্তু আবার কি কখনও আসা হবে এই প্রিয়তমা শহরে? ভবিষ্যতকে আমার সব সময়ই অনন্ত মহাকালের ওপারে থাকা রহস্যময়তায় মোড়া এক বস্তু বলে মনে হয়। একমাত্র প্রবাহমান সময়ই হয়তো একসময় পৌঁছে দিতে পারে সুদূরের সেই পথে, দিতে পারে আজকের প্রশ্নের উত্তর।


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

আপনার ভ্রমণ বিষয়ক লেখা অন্য যে কারো চেয়ে ভিন্ন। প্রথমত আপনি শুধু দৃশ্য ভ্রমণে যান না, খুঁজে আনেন দৃশ্যের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। লেখার কাব্যময়তা আর গতিশীলতা সত্যি মুগ্ধকর। আপনি ভ্রমণ স্থানগুলোও অদ্ভুত, সাধারণ বাঙালিরা এমন স্থানে যায় না। আপনার এ ভ্রমণ চলতে থাকুক, আপনার চোখে, আপনার লেখায় অদেখা পৃথিবী দেখি। শুভকামনা হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সজীব ভাই আপনার এই দীর্ঘ এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্যে।

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

পুরোপুরি সহমত।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার সব ছবি, সেই সাথে ছবির থেকেও প্রাঞ্জল বর্ণনা। আপনার ভ্রমণ বিষয়ক লেখাগুলো মুগ্ধ হয়ে পড়ছি। এমন লেখা আরও আসুক।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ রূপক, আপনিও কিন্তু বেশ লেখেন

নজমুল আলবাব এর ছবি

আপনার ইয়ার দুস্তদের ঠিকানা ঠুকানা রাইখেনতো। বড় হয়ে যখন বেড়াতে যাবো তখন চেয়ে নেবনে। দেঁতো হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

নো প্রব্লেম, সময়মতো চেয়ে নেবেন। হাসি

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

নাম না জানা পাঠক এবং অনুসন্ধিতৎসু, আপনাদের মন্তব্য পড়ে মনে হলো এমন সুপাঠকের জন্যেই তো লেখালেখি। আর ব্লগে লেখার মজাই এটা, গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনার পাশাপাশি ভাগাভাগি করে নেয়া যায় পাঠকের প্রজ্ঞার কিছুটা অংশও।

ফ্রান্সিস্কানরা মাধুকরীর জীবন পালন করতেন কিনা ঠিক জানিনা। আমি তো এদের সম্পর্কে জানতে পারি এই সেদিন। বছর খানেক আগে পোলান্ডের এক কনসেনট্রেসন ক্যাম্প ঘুরতে গিয়ে দেখলাম নাৎসীরা আর অনেকের সাথে ধরে এনেছিল এই ফ্রান্সিস্কানদের, পুরে দিয়েছিল চুল্লীতে। ক্যাথলিকরা মনে হয় এদের সম্পর্কে ঠিক সুমনোভাব পোষণ করতো না.

স্পঞ্জ মুক্তা নাম স্পঞ্জ হলেও কাজে নয়. এটি আর সব মুক্তার মতোই নিরেট। তবে রংটা হলো লালচে খয়েরী। আর আকারে সাদা বা গোলাপী মুক্তার চেয়ে কিছুটা বড়. এ জিনিশ নাকি পাওয়া যায় ওই পাশের আড্রিয়াটিক সাগরে।

ওখানে গিয়ে চেরি/বেরি খেয়ে দেখা হলেও ফিগ খেয়ে দেখা হয়নি, তবে একটা কথা বলতেই হয় এমন বিশাল আকারের ফিগ আমার আগে কখনো চোখে পড়েনি।

ফল শুকিয়ে চিনি দিয়ে বিক্রীর ব্যাপারটা এই আমেরিকাতেও দেখেছি, তবে বাংলাদেশে কেন নেই জানিনা। দুব্রভনিকে যেটি খেয়েছিলাম সেটি অবস্য ফলের খোসায় চিনি মাখিয়ে শুকিয়ে তৈরি, যেটা এর আগে কোথাও দেখিনি। আচ্ছা অমন ব্যাঙ ঢাকার কোথায় পাব বলতে পারেন ?

উস্তাসা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই ক্রোয়াট এবং বসনিয়ানদের যে জুটির কথা আপনারা দুজনেই উল্লেখ করেছেন তার সবই সত্যি। একবার ভেবেছিলাম লেখায় উস্তাশাদের কথা আরো লিখি, কিন্তু অনেক পাঠকই আবার ইতিহাসের কচকচানি বেশি পছন্দ করেননা। তাই এ নিয়ে আর কথা বাড়াই নি. আমার শুধু অবাক লাগে পারস্পরিক এই হানাহানির ইতিহাসে ভরা এই জাতিগুলোকে এক পতাকাতলে টিটো কিভাবে নিয়ে এসেছিলেন।

আপনাদের সন্ধান জানলে বলতাম চলুন একটা চা- চক্রে বসা যাক, আড্ডা দেয়া যাক কিছুক্ষণ।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমে ধন্যবাদ এই চমৎকার লেখাটির জন্য। গল্প, ভ্রমণকাহিনী, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ছবি – সব কিছুর এক পরিমিত সমন্বয়। অবশ্য আপনার বেশিরভাগ ভ্রমণকাহিনীই এমন।

দুব্রভনিক এক্সক্লেভের আসল মালিক হচ্ছে হার্জ্জেগোভিনা। যেমন ইস্ত্রিয়া পেনিনসুলার আসল মালিক হচ্ছে স্লোভেনিয়া। অথবা উনা/সাভা নদীর দক্ষিণ তীরের আড্রিয়াটিক উপকূলের আসল মালিক বসনিয়া। কিন্তু এই জায়গাগুলো ইউগোশ্লাভ ফেডারেশন গঠনের সময় ক্রোয়াটরা নিজেদের ম্যাপে ঢুকিয়ে নেয়। সার্ব-ক্রোয়াট শ্রেষ্ঠত্বের ফেডারেশনে এমন অনেক অন্যায়ই হয়েছে। আর বলকান এলাকার জাতিগত যুদ্ধ, একে অন্যের ভূমি দখলের সুদীর্ঘ, কুৎসিত ঐতিহ্যের কথা সবাই জানেন। দুব্রভনিকের ওপর মন্টেনেগ্রো বা সার্বিয়ার দাবি একেবারে ভুয়া।

আপনি ফ্রান্সিসকান চার্চের কথা বলায় মনে পড়লো কোথায় যেন পড়েছিলাম ফ্রান্সিসকান সন্তরা এক কালে নাকি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো ভিক্ষান্ন দিয়ে জীবনযাপন করতেন। এই তথ্যের সত্যতা জানি না। খ্রীস্টধর্মে এমন মাধুকরীর কথা আর শুনিনি।

স্পঞ্জ মুক্তা কী জিনিস? বুঝতে পারিনি।

বারোক রীতির স্থাপত্য বা অন্য কোন শিল্পের কথা শুনলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এই জীবনে অমন অমানুষিক শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হবে না ভেবে আফসোস হয়।

অনেক দেশেই ফল শুকিয়ে চিনির প্রলেপ দিয়ে বিক্রি করা হয়। এই কালচারটা আমাদের দেশে নেই কেন জানি না। অবশ্য আমাদের দেশে শুকনো ফল, প্রক্রিয়াজাতকৃত মাছ-মাংস-সবজী কোনটারই প্রচলন বা আদর নেই। আপনি কি দুব্রভনিকের ডুমুর (ফিগ) খেয়েছিলেন? আড্রিয়াটিকের সব তীরের ডুমুরের স্বাদ নাকি অসাধারণ? ডাকতে পারে অমন কাঠের কোলাব্যাঙ ঢাকাতেও পাওয়া যায়। দাম বোধ করি সাত/আট ইউরো হবে।

উস্তাশারা হচ্ছে বলকানের চরম জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ক্যাথলিক ছাগুগোষ্ঠী। যারা বসনিয়াক, সার্ব আর স্লোভেনিয়ানদেরকেও ক্রোয়াট মনে করে - যথাক্রমে মুসলিম ক্রোয়াট, অর্থোডক্স ক্রোয়াট এবং পাহাড়ী ক্রোয়াট(!)। এদের আলটিমেট উদ্দেশ্য হচ্ছে বৃহত্তর ক্রোয়েশিয়া গঠন করা যার ভেতরে বর্তমান ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, বসনিয়া, হার্জ্জেগোভিনা, সার্বিয়া – সবই থাকবে। এদের দার্শনিক গুরু হচ্ছে মিলান সুফ্‌লে। ইতিহাস না পড়া অতিবিজ্ঞানবাদীরা তাকে শহীদের মর্যাদা দিতে চাইলেও তার ডালে বহুত কুছ্‌ কালা। এদের আধ্যাত্মিক গুরু ফ্রান্সিসকান তরিকার ক্রুনোশ্লাভ দ্রাগানোভিচ্‌। আর এদের নেতা আন্তে পাভেলিচ্‌ যে নিজে ‘পগ্লাভনিক’ উপাধী নিয়েছিল (যেমন, হিটলারের ফ্যুয়েরার বা মুসলিনির ডিউস)। এদের দুষ্কর্মের ইতিহাস লিখতে নিলে আকারে ইলিয়াড-অডেসি ছাড়িয়ে যাবে। কোন বিবেচনায়, কোন দুর্বলতায় এই দানবগোষ্ঠী কোন ছাড় পেতে পারে না। উস্তাশাদের নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় আছে। এরা মূলত ক্যাথলিক হলেও সার্ব অর্থোডক্স খ্রীস্টানদের চেয়ে বসনিয়াক মুসলিমদের এরা বেশি পছন্দ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ক্যাথলিক-মুসলিম জুটি যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার কথা জানলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

বসনিয়াক চেভাপি/চেভাপ কি খেয়েছিলেন? চেভাপ < কেবাপ < কেবাব < কাবাব।

আপনার ভ্রমণ চলুক, সাথে ভ্রমণকাহিনীও।

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

জীবনযুদ্ধ তার ভ্রমনবৃত্তান্তে আবারো পাঠকদের চমৎকৃত করলেন। তবে এই পোস্টে ছবির পরিমান একটু কম লাগলো।

অতিথি লেখকের (নামবিহীন) মন্তব্যঃ
"দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ক্যাথলিক-মুসলিম জুটি যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার কথা জানলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।"
সাথে এতোটুকুই যোগ করতে চাই, বিশ্বযুদ্ধকালীন এই ক্যাথলিক-মুসলিম জুটির অমানবিক যুদ্ধপরাধ নব্বই এর দশকে সার্বদের পাল্টা যুদ্ধাপরাধের (ক্রোয়াট ও বসনিয়াকদের প্রতি) পিছনে একটা অন্যতম প্রভাবকের কাজ করেছিলো। (যদিও তা সার্বদের পক্ষে কোনভাবেই সাফাই হতে পারে না)।

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

খ্রীস্টধর্মে মাধুকরীর ধারনাটা আগে ছিলো বর্তমানে তা আর নেই বললেই চলে। বর্তমানে ধনে-দৌলতে তারা যথেষ্ঠ সমৃদ্ধ, দারিদ্রতা প্রতিস্থাপিত হয়েছে আরাম আয়েশ দিয়ে। শুধু ফ্রান্সিসকান নয়, এ ধারনাতে ছিলো ডোমিনিকান, বেনেডিক্টান ইত্যাদি। এরা আসলে ক্যাথলিক চার্চের অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়, যারা বিভিন্ন মিশন বা নীতি নিয়ে কাজ করে। যেমনটা আমাদের দেশের মিশনারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালায় মূলতঃ হলিক্রশ সম্প্রদায়ের প্রিস্ট, নান, ব্রাদারেরা।

ক্যাথলিক চার্চের সাথে আসলে সবারই ভালো সম্পর্ক এবং খারাপও ("মুখে মধু, অন্তরে বিষ" আর কি)! এরা আসলে অনেকটা দুধের মাছির মতো।

নাৎসীদের গণহত্যা নব সাম্রাজ্যবাদের তাড়না হতে উদ্ভূত। তারা ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট, অর্থোডক্স কাউকেই ছাড়েনি যদিও মূল লক্ষ্য ছিলো ইহুদীরা।

যোসেফ ব্রজ টিটোর লৌহকঠিন ব্যাক্তিত্ব, দক্ষ নেতৃত্বের কারনেই যুগোশ্লাভ ফেডারেশনকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিলো। কম্যুনিস্ট হলেও তিনি ছিলেন স্বৈর-মনোভাবাপন্ন যদিও সাবেক যুগোশ্লাভ ফেডারেশনে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পরই তাসের ঘর ভাঙতে শুরু করে। বিভিন্ন জাতীগোষ্ঠির মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, যার অগ্রভাগে ছিলো সার্বিয়ানরা।

চা-চক্র? দেশে আসবেন কবে? আওয়াজ দিয়েন। তার আগে নাম না জানা অতিথি লেখকের সন্ধান দরকার।

অতিথি লেখক এর ছবি

জীবনযুদ্ধ ও অনুসন্ধিৎসু - আপনাদের দু’জনকেই মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

মাধুকরীর ব্যাপারটা আমি আসলে ঠিকমতো বোঝাতে পারিনি। দার্শনিক অবস্থান থেকে মাধুকরী আর ট্যাঁক খালি থাকায় মাধুকরীতে পার্থক্য আছে। সেমেটিক কোন ধর্মই দার্শনিক অবস্থান থেকে মাধুকরী সমর্থন করার কথা না। তারা ধর্মীয় কাজে ক্রাউডসোর্সিং সমর্থন করে, কিন্তু পুরোহিত-মোহন্ত-সন্তদের জীবনধারণের জন্য মাধুকরী সমর্থন করে না। তাদের জীবনধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট ধর্মানুসারীদের নিয়মিত চাঁদা প্রদানের ব্যাপারটি যতদিন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি ততদিন পর্যন্ত তাদের কাউকে হয়তো মাধুকরী করতে হয়েছে। তবে সেটা দার্শনিক অবস্থান থেকে নয়। ভারতেসহ প্রাচ্যদেশীয় ধর্মগুলোর কোন কোনটাতে দার্শনিক অবস্থান থেকে মাধুকরী সমর্থন করা হয়। আমি শুনেছিলাম ফ্রান্সিসকানরা দার্শনিক অবস্থান থেকেই মাধুকরীতে লিপ্ত ছিল – এর সত্যতা জানি না।

রুশ অর্থোডক্সদের সাথে প্রটোস্ট্যান্টদের বিরোধটা কেমন রক্তক্ষয়ী ছিল সেটা নিকোলাই গোগলের ‘তারাস বুলবা’তে আমরা দেখেছি। এই প্রকার সাংঘর্ষিক সম্পর্ক খ্রীস্টধর্মের অনেক ডিনমিনেশনের মধ্যে এক সময় বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় চার্চের প্রভাব কমার পর থেকে এই সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছে। রোমান ক্যাথলিকরা জনবল, অর্থবল সব দিক দিয়েই শক্তিশালী। তাই তারা এখন একটা বড়ভাইসুলভ ইমেজ নিয়ে চলে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক কারণগুলো পাঠ করলে বোঝা যায় সেখানে গণহত্যা চালানোর ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর যে দোহাই দেয়া হয় সেটা নিতান্তই ভুয়া। হত্যা, ধ্বংস, জবরদখল আর লুটপাটের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ বাঁধানো হয়েছিল। যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন হারতে নিলে ইহুদীদের পাশাপাশি রুশ অর্থোডক্স আর মুসলিমদেরকেও গ্যাস চেম্বারে পাঠানো শুরু হয়ে যেত।

খোসাসুদ্ধ ফলে চিনি মাখিয়ে শুকানোর রেওয়াজ আরও অনেক দেশে আছে। এই পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাতকৃত বরই সাইজের আম খাবার সুযোগ হয়েছিল। আমাদের দেশে ঝড়ে পড়ে গিয়ে অমন সাইজের আম টন টন নষ্ট হয়। একটু উদ্যোগ নিলে এই অপচয়টা রোধ করা যায়।

অমন কাঠের ব্যাঙ ঢাকার মীরপুর রোডের ‘আইডিয়াজ’-এ দেখেছিলাম।

উস্তাশাদের নিয়ে পারলে আলাদা পোস্ট দিন। অজ্ঞতাবশত এরা আমাদের দেশে আলোচিত নয়। দেশের ইতিহাসে বিদ্যমান অনেক কিছুর বিশ্লেষণের সময় উস্তাশাদের ব্যাপারে জ্ঞান থাকাটা সহায়ক হবার কথা।

জোসিপ ব্রোজ তিতো’র বাবা ক্রোয়াট, মা স্লোভেনিয়ান। জন্মেছেন ক্রোয়াট শহর কুম্রোভেৎচে আর মারা গেছেন স্লোভেনিয়ান শহর লিউব্লিয়ানাতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত হয়ে জারের রুশ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে উরাল পর্বতে নির্বাসিত হয়ে রাশিয়ার কমিউনিস্টদের সংস্পর্শে না আসলেও তিনি কমিউনিস্ট হতেন। কারণ, তার আগেই তিনি শ্রমিক আন্দোলন আর সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। বাবা-মা, জন্ম-মৃত্যুর মতো এটাও তাঁর নির্বন্ধে ছিল তাই তিনি অক্টোবর বিপ্লবেও অংশ নিয়েছেন আর স্লাভদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিতো যে সময়কার মানুষ তখন দুনিয়াটা চলতো সুপারলিডারদের দ্বারা। সুতরাং তিতোও যে একজন সুপারলিডার হবেন এটাই স্বাভাবিক। পরস্পরের সাথে অনিঃশেষ হানাহানি করা স্লাভরা কী করে একটা ইউনিয়ন গড়তে সম্মত হলো অথবা তারা আধা ক্রোয়াট আধা স্লোভেনিয়ান তিতোকে কেন মেনে নিল সেটা এক বিশাল, জটিল, ইন্টারেস্টিং ইতিহাস। সেটা নিয়ে আলোচনা করার সামর্থ্য আমার নেই। যাদের আগ্রহ আছে তারা নিজ গরজে পড়ে নেবেন।

স্বার্থপরের মতো গুটিকয়েকজন চায়ের টেবিলে বসে আড্ডা দেবার চেয়ে ব্লগে আড্ডা দেয়াটাই তো বেশি মজার। যার খুশি সে-ই এতে অংশ নিতে পারেন। সব আলোচনা সবার জন্য উন্মুক্ত!

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

কিছুদিন আগে একটা মুভি দেখলাম, "ব্যাটেল অফ নেরেত্ভা", ষাটের দশকের মুভি, যুগোস্লাভিয়ায় তৈরী। মজার ব্যাপার কি জানেন এই মুভিতে দেখলাম নাৎসীদের পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে চেটনিকদের। অথচ চেটনিকদের গ্রুপ গুলোর অধিকাংশই ছিল নাৎসী বিরোধী। এই মুভিতেও দেখলাম উস্তাশাদের তেমন ভাবে তুলে ধরা হয়নি, কিছুটা যেন এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। সেবা থেকে প্রকাশিত "মৃত্যুঞ্জয়" বইটি পড়তে পারেন, উস্তাশা আর চেটনিকদের নিয়ে জমজমাট এক বই.

"তারাশ বুলবা " পড়া হয়নি এখনও, পড়তে হবে.

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখিত, আমি আপনার মতো করে চেটনিকদেরকে কোন ছাড় দিতে পারছিনা। এই জলি রজারগুলোকে (ওদের পতাকা দেখুন) সার্ব খাটাশ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। এদেরকে সার্ব নাৎসীও বলা যায়।

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

সহমত আপনার সাথে ।

"অতিথি লেখক", আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমার স্বল্পজ্ঞানের কিছু ক্ষেত্রকে পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য ।

আপনার মন্তব্যগুলোতে বুঝতে পারলাম যে সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ও তার জাতিগত হানাহানি, বিভাজন বিষয়ে আপনি যথেষ্ঠ ধারনা রাখেন| আপনি যতোই বলুন না কেন, এ বিষয়ক আলোচনা আপনার সামর্থ্যের বাইরে । এ আপনার অনাবশ্যক বিনয়তা । লিখে ফেলুন না; তিতো, যুগোশ্লাভ ফেডারেশন, উস্তাশা, চেটনিকদের নিয়ে| আমার স্বল্পজ্ঞানের সবই ঝেড়ে দিয়েছি কয়েকটি মন্তব্যে, কিন্তু স্পষ্টতই বুঝতে পারছি আপনার ধারনার গভীরতা|
লিখে ফেলুন, আমাদের মতো অগভীত জলের পাঠকদের জন্য ।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনুসন্ধিতৎসুর সাথে পুরোপুরিই একমত। আমিও ঠিক একই কথা ভাবছিলাম। "অতিথি লেখক", লিখে ফেলুন না একটা পুরো লেখা, আমরা আরও একটু আলোকিত হই

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দুব্রভনিকের সাথে সম্পর্কিত একটা তথ্য এখানে তুলে রাখছি। ব্যাপারটা বেশ ইনটারেস্টিং।

"The first written mention of the Albanian language was on 14 July 1285 in Dubrovnik (modern-day Croatia), when a certain Matthew, witness of a crime, stated "I heard a voice shouting on the mountainside in the Albanian tongue" (Latin: Audivi unam vocem, clamantem in monte in lingua albanesca)." (https://en.wikipedia.org/wiki/Albanian_language#History)

দুনিয়াতে আর কোন ন্যাচারাল ভাষার শুরুটা মনে হয় এমন দিন তারিখ দিয়ে হয়নি।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ব্যাপারটা জানা ছিলোনা, অশেষ ধন্যবাদ আপনার মন্তব্ব্যের জন্যে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।