কাসা পোপোরলুই

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২২/০২/২০১৬ - ১:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগেকার কথা। আমি তখন ডালাসে ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের ছাত্র। আমার প্রফেসরের গবেষণা প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় আমার বৃত্তির টাকা বন্ধ। ওদিকে আমার ব্যাঙ্কের হিসেবে তখন আছে মাত্র দুশো নব্বই ডলারের মতো। এ টাকায় বাড়ি ভাড়া দেয়া তো দূরের কথা, এক মাসের বেশি খাবার খরচও চলবার কথা নয়। চরম দুঃসময় আমার তখন। ঠিক এ মুহূর্তে আমার পাশে মহীরুহের মতো এসে দাঁড়ালেন আমার ছোট মামা এবং মামি। তাঁরা থাকেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ দূরে দু রুমের এক ভাড়া বাড়িতে। পুত্রবৎ স্নেহে তাঁরা আমাকে নিয়ে তুললেন তাদের সে বাড়িতে। আমার ছোট ছোট দুটি মামাতো বোন হাসিমুখে তাদের ঘরটি আমাকে ছেড়ে দিলো। মামার এই বাড়িটি থেকে প্রতিদিন আমাকে দুটো বাস দাবড়িয়ে ক্লাসে পৌছাতে হয়। এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে সময় লাগে প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো। এই সময়ে আমেরিকায় এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে যাওয়া যায়। এতটা সময় হয়তো লাগতো না যদিনা আমাকে মাঝে আরেক যাত্রী ছাউনিতে নেমে পরের বাসের জন্যে আরও আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অপেক্ষার এই সময়গুলো ছিল চরম বিষাদময়। কোন কোন সময় কাঁচের দেয়াল দিয়ে ঘেরা সেই ছাউনিতে আমিসহ অপেক্ষমাণ থাকতাম গুটিকয় মানুষ। তবে এই গতানুগতিক অপেক্ষার দিনগুলোর মাঝেই একটি দিন হয়ে ওঠে ব্যতিক্রমী, যে দিনটিতে আমার সাথে পরিচয় ঘটে আলেক্সান্দ্রিয়ার। আলেক্সান্দ্রিয়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়েই অর্থনীতি বিভাগে পড়ে, আর থাকে সেই ছাউনির আশেপাশের এক আবাসন কমপ্লেক্সে। আলেক্সান্দ্রিয়াকে দেখে প্রথমে আমি আমেরিকান ভাবলেও দু চারটে শব্দ উচ্চারণের পরেই বুঝে যাই ও আমার মতই বিদেশী। সেদিন খুব বেশি কথা হয় না আমাদের মাঝে। আমার অবচেতন মন পরদিন সেই ছাউনিতে আবারও আলেক্সান্দ্রিয়াকে খুঁজে ফেরে। কিন্তু সেক্ষণে তাঁর দেখা আর পাই না। ইচ্ছে করেই ওর অপেক্ষায় আমি ঠিক সময়ে হাজির হওয়া বাসটির প্রস্থান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। আমাকে অপেক্ষা ঠিক বিফলে পর্যবাসিত হয় না, অল্পক্ষণ পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে আলেক্সান্দ্রিয়া। আমি ওকে সান্ত্বনা দেবার ভাষায় বলি, “চিন্তা করো না, তোমার মতো আমিও একই পথযাত্রী। পরের বাস আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়বে”। সেই আধ-ঘণ্টার অবসর আমাদের মাঝে কথামালা রচনা করবার এক সুপ্ত কাঙ্ক্ষিত সুযোগ এনে দেয়। সেদিন আমি জানতে পারি ও সেই সুদূর রুমানিয়ার তিমিশোয়ারা শহরের মেয়ে আর পড়াশোনা করেছে বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্নাতক পড়বার পর স্বামীর সাথে পাড়ি জমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ঠিক এ জায়গাটিতে ‘স্বামী’ শব্দটি শোনবার পর আমি থমকে যাই। আমার পঁচিশ বছর বয়সের যৌবন কিছুতেই মেনে নিতে চায় না কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা দীঘল কালো চুল আর গোলাপি আভা ছড়ানো ওষ্ঠাধরের এই মেয়েটি অন্য কারও সহধর্মিণী। বিদ্রোহী সেই মন চিড়ে ফেলতে চায় বাস্তবতার শেকল, আর কালবোশেখি ঝড়ের মুখে থাকা খোলা জানালার মতো হুটোপুটি করে আমার মনের অসংখ্য কপাট। কিন্তু লাভা ছড়িয়ে শান্ত হয়ে যাওয়া মৃত আগ্নেয়গিরির মতোই আমার সেই মন আবার সম্বিত ফিরে পেয়ে অতীত-ভবিষ্যৎ এই কালগুলো দূরে ঠেলে মেনে নেয় বর্তমানকে। আলেক্সান্দ্রিয়াকে আমি তাই আমার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি, যদিও এক ধরণের সুপ্ত ভালোলাগা আমার রয়েই যায়। আমি অবশ্য সেটি কখনো ওর সামনে প্রকাশ করি না। শুধু শুনে যাই ওর গল্প, বাস থেকে নেমে ওকে পৌঁছে দেই ওর ক্লাসের দরজা অব্ধি। এতদিনের পরিচয়ের পরও আমি কিন্তু ওর দূরালাপনির নম্বর নেইনি। কিছুটা সেটা ইচ্ছে করেই। আমি চেয়েছিলাম আমার সেই বন্ধুত্বটি থাকুক হটাৎ বিকল হওয়া ট্রেনের যাত্রা বিরতিতে জংশনের বিশ্রাম কক্ষে যেমন করে দুজন অপরিচিত মানুষের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, ঠিক তেমন। আমাদের ক্ষেত্রে হয়েওছিল তাই। একদিন আমি বাহিত করলাম আমার স্নাতকোত্তরের শেষ দিন, পাড়ি জমালাম ভিন্ন শহরে। আর আলেক্সান্দ্রিয়া? কে জানে? হয়তো সেও ছিটকে গেছে এই বিশাল আমেরিকার কোন শহরে তাঁর স্বামীর হাত ধরে। বেশ ভুলে বসেছিলাম তাঁর কথা এই বিগত বছরগুলোতে। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে যা একবার জায়গা নেয়, তা হয়তো কখনই উবে যায় না। কোন এক কুঠুরিতে চাদর মুড়ি দিয়ে সে ঘুমিয়ে থাকে দিনের পর দিন। জেগে ওঠে হয়তো বিশেষ কোন ক্ষণে, বিশেষ কোন ঘটনার আকস্মিকতায়। এই যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার স্মৃতি হটাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো ব্রাসভ থেকে বুখারেস্টে পৌঁছে ‘গারা দা নর্দ’ স্টেশনে পা দেবা মাত্র, কোন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। এই সেই শহর না, যে শহরে আসবার আমন্ত্রণ দিয়েছিল আমার সেই গোপন বান্ধবী? এমন কি হতে পারে সে ফিরে এসেছে তাঁর নিজের দেশে, নিজের শহরে? এতকাল বাদে সে কি আমার কথা মনে রেখেছে? আলেক্সান্দ্রিয়ার মুখচ্ছবিটি আমার চোখের সামনে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। আমার চশমাখানি বুক পকেটে ভাজ করে রেখে আমি বুখারেস্টের ধূলি-ধুসরিত রাজপথে তাকে খোঁজার চেষ্টা করি, কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাইনা। সম্পূর্ণ অর্থহীন এমন সব দৃষ্টিভ্রমের মাঝেই বেশ কয়েকবার পথ ভুল করে অবশেষে এসে থামি স্টেশনের সংলগ্ন ‘হেলো’ হোটেলের সদর দরজার সম্মুখে।

নামে হেলো হোটেল হলেও হোটেলের বয় বেয়ারা বাবুর্চি কারও মুখে সহাস্যে হেলো শব্দটি শুনতে পেলাম না। অভ্যর্থনা কক্ষের ছোকরাটি এতটাই তাড়াহুড়োর মধ্যে আমাকে রুমের চাবি বুঝিয়ে দিলো যে আমি তাকে পরবর্তী কোন প্রশ্ন করবার আগেই সে হাঁক ছাড়ল ,”নেক্সট পারসন”? পুরো ভিড়মি খেয়ে গেলাম। সে অবস্থাতেই নিজের রমে ঢুকে খেলাম পরবর্তী ধাক্কা। বিদ্যুৎ নেই। এ কেমন ব্যাপার? তবে কি এখানেও লোড শেডিং চলছে? ঘরের জানালা খুলে দিয়ে পাশের ভবনের দিকে খেয়াল করে দেখলাম সেখানে দিব্যি বিদ্যুৎ আছে। খুব বুঝলাম কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আবারও ছুটলাম নিচতলায় সেই ছোকরার কাছে। সেখানটা কিন্তু দেখলাম আলোয় ঝলমল করছে। তাহলে কেবল আমার ঘরেই বিদ্যুৎ নেই এ কেমন কারবার? ছোকরাকে জিজ্ঞেস করাতে এবার সে একটু কাঁচুমাচু করে বলল, “ইয়ে মানে তোমাকে আমি একটা কার্ড দিতে ভুলে গেছি। রুমে ঢুকেই ডানের এক মেশিনে এই কার্ড পাঞ্চ করলে তবেই তোমার ঘরে বিদ্যুৎ চালু হবে”। রেল স্টেশনের টিকেট বিক্রেতার মতো সে তড়িঘড়ি করে যেভাবে আমাকে চাবি বুঝিয়ে দিয়েছে তাতে এই ভুলে যাওয়াটা ছিল খুবই স্বাভাবিক। এই কার্ডের ব্যাপারটি হল কেও কক্ষে ঢুকে সেই কার্ডটি যতক্ষণ পাঞ্চ করে রাখবে ততক্ষণই ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে। অর্থাৎ কেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও যেন আলো পাখা না চলে, সে জন্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের এই ব্যবস্থা। বেশ বিরক্ত হয়ে সেই ছোকরাকে বললাম, “ কাল তোমাদের এখানে আশেপাশের কয়েকটি জায়গায় যেতে চাই। তা ট্রাম বাসের হদিসটুকু কি একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে? নাকি তুমি এখনও ব্যস্ত”? এবার একটু লজ্জিত হয়ে ছেলেটি একটা ম্যাপ নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলো কাল আমি কোন কোন পাতাল রেল ধরে কোথায় কোথায় যেতে পারি।

সেদিন রাতে খাবার খুঁজতে গিয়ে পড়লাম এক বিপত্তিতে। ভেবেছিলাম স্টেশনের কাছেই যেহেতু তাই এলাকাটি বেশ গমগমে হবে। হ্যাঁ সেটি গমগমে এলাকা বটে, তবে শুধু দিনের বেলায়। আঁধার নামার সাথে সাথে এলাকাটি যেন পরিণত হয় ভুতের আস্তানায়। আশেপাশে রেস্তোরাঁ-বেকারি যা ছিল সবই সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই ঝাঁপি ফেলে তখনকার মতো বিদেয় নিয়েছে। একটি কি দুটি বেকারি দেখলাম মূল দরজা বন্ধ করে কেবল একটি জানালা দিয়ে পথ চলতি খদ্দেরদেরকে শুকনো কিছু খাবার বিক্রি করছে। ব্যাপার বেশি সুবিধের ঠেকল না। এটা কি এরা করছে নিরাপত্তার খাতিরে নাকি দোকানের লোকবল সেসময়ে কিছুটা কম হওয়ায়? এ সময়ে মনে হল আর সব খাবারের দোকান বন্ধ হলেও সেই স্টেশনের খাবারের দোকানগুলো নিশ্চয়ই এখনই বন্ধ হবার কথা নয়। কারণ সেখানে নিশ্চয়ই এই রাত-বিরেতেও অনেক ট্রেন আসে দূর-দূরান্ত থেকে, তাই যাত্রীদের কথা ভেবেই কিছু দোকান হয়তো খোলা থাকবে। সে রাতে সেই স্টেশনের খাবারের দোকানেই অবশেষে শেষ রক্ষে হয়েছিলো, নতুবা হয়তো শুকনো খাবারের উপর ভরসা করেই সারা রাত আধপেটা হয়ে থাকতে হতো। স্টেশন থেকে বেরুবার মুখে আরেকটি বেকারি খোলা দেখে ভাবলাম সকালের প্রাতরাশের জন্যে বরং কিছু-মিছু এখনই কিনে রাখি। এই বেকারিতে বেশ কিছু নতুন নতুন পদের রুমানিয়ান খাবারের সাথে আমার পরিচিতি ঘটলো। এই যেমন একটি খাবার হল মামালিগা। এটি দেখতে পিঠা আর কেকের মাঝামাঝি, কিছুটা হলদেটে। খাবারটি নাকি তৈরি করা হয় ভুট্টার আটা আর ভেড়ার দুধের মিশ্রণকে মণ্ড বানিয়ে তারপর জল, মাখন আর খনিজ লবণ মিশিয়ে। তবে এই মালমসলা হিসেবে ভুট্টার নামটি সেই দোকানির মুখ থেকে বের করতে আমার বেশখানি কায়দা কসরত করতে হয়েছিলো। আমি যতবারই তাকে জিজ্ঞাসা করি উপাদানের কথা সে স্মিত হেসে জবাব দেয় ‘চুচুরুস’। আরে বাপু চুচুরুস তো বুঝলাম, কিন্তু সেই চুচুরুস বস্তুটিই বা কি? এমন নামের কোন খাদ্য দ্রব্যের কথা কস্মিনকালেও শুনিনি। স্পেনে গিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একদিন খাবারের দোকানে গিয়ে এমনই ভাষাগত বিপাকে পড়েছিলেন, অবশেষে ছবি এঁকে তবেই পরিবেশনকারীকে বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি আসলে কি চাইছেন। হটাৎ করে আমার মাথায় খেলে যায় সেই বুদ্ধিটি। আমি নাছোড়বান্দার মতো সেই দোকানিকে বলি চুচুরুসের কোন ছবি দেখাতে পারবে? আমার ভাগ্য ভালো এই কারণে যে তখন দোকানে খদ্দের তেমন নেই, দোকানটি প্রায় বন্ধ হবার সময়। তাই দোকানির অন্য কোন তাড়া নেই, বেচারি আমার পাল্লায় পড়ে অবশেষে ব্যাপক খুঁজেপেতে একখানা ছবি জোগাড় করে তাঁর মুঠোফোন থেকে। আর তাই থেকে বুঝতে পারি ও আসলে বলতে চেয়েছে ভুট্টার কথা। তো সেই ভুট্টার আটা দিয়ে বানানো এই মামালিগারই আরেকটি কাছকাছি খাবার হল বুলয। সেটি আসলে এই মামালিগাকে একটু আগুনে পুড়িয়ে তাকে শুষ্ক করার পরের রূপ। সেই দোকানেই আরেকটি যে জনপ্রিয় রুমানিয়ান খাবারের দেখা পেলাম সেটি হল সারমালে। এটি দেখতে অনেকটা চাইনিজ দোকানের এগ রোলের মতো, যদিও এটির পুরটি তৈরি করা হয় বাধাকপির পাতা দিয়ে। আর ভেতরে তাকে শুকরের মাংস, পেঁয়াজ, জলপাই তেল, সেলেরি পাতা, গোল মরিচ আর পাপ্রিকার একটি মিশ্রণ। রুমানিয়ার আর সব খাবার-দাবারের ব্যাপারে একটা সাধারণ পর্যবেক্ষণ এখানে উল্লেখ করি, আর তা হল আমার কাছে মনে হয়েছে এখানার অনেক খাবারেই তুর্কী এবং পশ্চিম-বলকান এই দু অঞ্চলেরই একটা প্রভাব আছে। তুর্কী ধাঁচের খাবারের মধ্যে কাপ্সিকাম আর কড়া ঝাল দিয়ে রাধা মাংসের পদগুলো দেখলাম এ দেশে বেশ চলে।

আমার হোটেলটি ‘গারা দা নর্দ’ স্টেশনের খুব কাছে হওয়ায় পাতাল রেল স্টেশনটিও বেশ কাছে, আর সেখান থেকে দুবার ট্রেন বদলে মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় ইজভর স্টেশনে, মানে যে স্টেশনে নেমে রুমানিয়ার সংসদ ভবনে হেঁটে যেতে হয়। এটি যদি শুধুই এ দেশের সংসদ ভবন হতো তাহলে হয়তো এই বিশাল অট্টালিকাটি দেখবার জন্যে আমার আগ্রহ তেমনতর হতোনা। কিন্তু এটির পেছনে চসেস্কু সংক্রান্ত যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে সেটিই মূলত আমাকে পরদিন সকালে আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেখানে। তবে এই সংসদ ভবনের বিস্তারিত আলোচনার যাবার আগে সেই ইযভর স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হওয়া কিছু কথা পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চাই।

বেশ কয়েক বছর আগে রুমানিয়ার বেশ কয়েকটি অনবদ্য চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছিলো, যার একটি ছিল- “চার মাস, তিন সপ্তাহ, দু’ দিন”। গল্পটি ছিল এমন- বুখারেস্টের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একটি মেয়ে পরিণয়ে জড়িয়ে পড়ে এক সহপাঠীর সাথে, একটা সময় পরে মেয়েটি জানতে পারে সে অন্তঃসত্ত্বা। পাহাড়সম আতঙ্ক আর লজ্জা ভর করে তাকে। যেহেতু দু জনেই তখন ছাত্রাবস্থায়, তাই সে মুহূর্তে বিয়ের কথা চিন্তা করাটাও বাস্তবসম্মত নয়। এ অবস্থায় ছেলেটিও তাকে তেমন সহযোগিতা করে না। নিরুপায় হয়ে এক সময়ে সে সব কথা খুলে বলে তাঁর এক প্রিয় বান্ধবীর কাছে। এই বান্ধবীটি তাকে বাতলে দেয় এক উপায়। যে কারণে এই তরুণীটি আরও বেশি শঙ্কায় পড়েছিল, তাঁর কারণ হল সে সময়ে রুমানিয়ায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। চসেস্কুর কথা ছিল বেশি মানুষ মানে বেশি কর্মশক্তি, বেশি বেশি সমাজতন্ত্রের জয়গান। অর্থাৎ গর্ভপাত করতে হলে কোন হাসপাতালে গিয়ে সেটি করা সম্ভব নয় তরুণীটির পক্ষে। তাঁর সেই বান্ধবীটি তাকে সন্ধান দেয় এক গর্ভপাত জানা হাতুড়ে ডাক্তারের, যে একটি হোটেলে গিয়ে মেয়েটিকে গর্ভপাতে সাহায্য করবে। বিনিময়ে তাকে দিতে হবে বেশ কিছু টাকা। উপায়ন্তর না দেখে মেয়েটি রাজি হয় এই প্রস্তাবে। সিনেমার পরবর্তী কাহিনি এই গর্ভপাতকে ঘিরেই। কিন্তু যে বিশেষ কারণে এই চলচ্চিত্রটির কথা উল্লেখ করলাম তা হল চসেস্কুর এই হটকারি সিদ্ধান্তের ফলে সেসময়ে এই তরুণীর মতো অনেক মাই গর্ভপাতে বিফল হয়ে তাঁদের কোলের সদ্যোজাত সন্তানটিকে বুখারেস্টের বিভিন্ন পথের কোণে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হতো। রুমানিয়ার অনাথালয়গুলোর তখন উপচে পড়ার দশা। পরিণামে অসংখ্য এমন পিতৃ–মাতৃ পরিচয়বিহীন ছিন্নমূল শিশুর ঠিকানা হয়ে দাঁড়াল বুখারেস্টের পাতাল স্টেশনগুলো। এখানেই তারা থাকে দল বেঁধে, লোকের কুলি মজদুর হয়, কোনভাবে পেটে দু’মুঠো অন্ন দিয়ে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকে। সেই ইযভর স্টেশনটিতে ঢোকার মুখে আমার সেই চলচ্চিত্রটির কথা মনে হয়, মনে হয় সেই হতভাগ্য প্রজন্মটির কথা। এখন অবশ্য তাঁদের আর এসব স্টেশনে দেখা যায়না। বোধ করি গত বিশ বছরে তারা পরিণত হয়ে মিশে গেছে অথবা হারিয়ে গেছে সমাজের অন্য কোথাও।

‘কাসা পোপোরলুই’ বা ‘জনতার ভবন’ নামে খ্যাত রুমানিয়ার এখনকার যে সংসদ ভবনটিতে যাবো বলে মনস্থির করেছি সেটি কিন্তু রুমানিয়ার স্বাধীনতার পর পর তৈরি করা হয়নি, এটি তৈরি হয়েছে মাত্র দু’ দশক আগে। তায় আবার যখন তৈরি হয়েছিলো তখন ঠিক সংসদ ভবনের কথা ভেবে এটি তৈরি হয়নি। খেয়ালি চসেস্কুর পাগলামোর জের ধরে বিপুল অর্থ, সময় আর লোকবল লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো এই শ্বেতহস্তী। কেও কেও বলেন চসেস্কু এটি তৈরি করেছিলেন নিজের বাসভবন হিসেবে ব্যবহারের জন্যে, আবার অনেকে তাতে বাদ সাধেন। তারা যুক্তি দেন, চসেস্কুর উচ্চতাভীতি ছিল, তাই সুউচ্চ এই ভবনটিকে তিনি কিছুতেই নিজের ভবন হিসেবে ব্যবহারের কথা চিন্তা করতে পারেন না। তবে কারণ যেটিই হোক, অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবেই যে এই বিশাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিলো সে নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। এই ভবনটি যে কতটা বিশাল সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিই। এতে কক্ষ আছে প্রায় এগার শর মতো আর ঝাড়বাতি আছে কয়েক হাজার। ভবনটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে প্রতিবছর শুধু বিদ্যুৎ বিলই গুনতে হয় প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকার মতো। আমেরিকার পেন্টাগন ভবনটির পর এটিই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত ভবন।

যেহেতু এটি এখন সংসদ ভবন তাই চাইলেই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায় না, ঢোকার সময়ে পাসপোর্ট জমা দিয়ে কয়েকটি ছোট দলে ভাগ হয়ে গাইডের সাথে ঢুকতে হয়। এখানে এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখালাম ঢোকার টিকেট কিনতে যেখানে প্রায় পঁয়ত্রিশ লেই দিতে হয়, ছবি তোলার জন্যে সেখানে আরও প্রায় ত্রিশ লেই দিতে হয়। অর্থাৎ ঢোকার টাকা আর ছবি তোলবার টাকা প্রায় সমান। তবে শুধু ছবি তোলবার জন্যে ত্রিশ লেই একটু বেশিই ঠেকল, তাই ও টিকেট আর কাটলাম না।

ভেতরে ঢোকার পর প্রথমেই এক চওড়া মর্মর পাথরের সিঁড়ির সম্মুখে গাইড আমাদের নিয়ে গেলো। সিঁড়িটি এতটাই প্রশস্ত যে প্রায় জনা বিশেক লোক দিব্যি হাত ধরাধরি করে সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে পারবে। অভিজাত রমণীর পরিধেয় গাউনের নিম্নাংশের মতো সিঁড়ির গোঁড়ার দিকটি নেমে এসে দুপাশে কিছুটা প্রসারিত হয়েছে। সিঁড়িটি নির্দেশ করে ভদ্রমহিলা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি অনুমান করতে পার ঠিক কি পরিমাণ পাথর ব্যবহৃত হয়েছে শুধুমাত্র এই সিঁড়িটি বানাতে? সঠিক উত্তরটি জানার পর রীতিমতো হা হয়ে গেলাম। পুরো এক আস্ত পাহাড়ের পাথর নাকি লেগেছে এটি বানাতে। কিন্তু এই একটি সিঁড়ি বানাতেই লেগে গেলো পুরো এক পাহাড়ের পাথর? হিসেবটা কি একটু গোলমেলে নয়? সেটি গাইডকে জিজ্ঞেস করাতে সে হেসে বলল, তোমার মনে প্রশ্ন জাগাটা অমূলক নয়। পেছনের ব্যাপারটি কি জানো? এই সিঁড়িটি বানাবার সময়ে এটিকে মোট সতের বার ভেঙ্গে গড়া হয়েছে। প্রতিবারই চসেস্কু এসে কোন না কোন খুঁত ধরতেন আর পুণরায় তৈরি করতে বলতেন। যেন তাঁর ব্যক্তিগত বাড়ি তৈরি হচ্ছে আর তিনি দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ফরমায়েশ। আর তাই ৬০০ সদস্যের বিশাল স্থপতিদলের রীতিমতো ঘাম ছুটে গিয়েছিলো এই ভবনটির নকশা প্রণয়নে। এখানে আরেকটি মজার ব্যাপার হল সেই ৬০০ সদস্যের দলের প্রধান কিন্তু ছিলেন আঙ্কা পেত্রেস্কু নামের এক তরুণী স্থপতি, সেই নির্মাণ কালের সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। পৃথিবীর আর কোন এমন বিখ্যাত ভবনের নকশায় এতটা নবীন স্থপতি দলনেতা বা নেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন বলে মনে হয় না।

এই ভবনে আলোচনা কক্ষের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না, এমনই এক কক্ষে গিয়ে শুনলাম কক্ষের ঠিক মাঝে ছাদ থেকে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতিটির ওজনই নাকি প্রায় পাঁচ টন। আর এটি এমনই বিদ্যুৎ টানে যে, অধিকাংশ সময়েই এটি নিবিয়ে রাখা হয়। এই ঝাড়বাতির মতই পাশের বিশাল ‘ইউনিয়ন’ হলরুমের মেঝেতে পাতা গালিচার ওজন নাকি পাক্কা দেড় টন। তাই সেটি কোন কারণে তুলতে গেলে প্রায় জনা বিশেক মানুষের মেহনতের প্রয়োজন হয়। আচ্ছা, এই যে বিশাল গোলক ধাঁধার মতো এই ভবন, এখানে এসে কেও যদি হারিয়ে যায়? এ প্রশ্নে গাইড স্মিত হেসে আমাদের নির্দেশ করলেন মেঝের বিভিন্ন কোণের টাইলসে আঁকা একটি নকশার প্রতি। সেই নকশাটি নাকি এই পুরো ভবনের একটি ছোটখাটো মানচিত্র। তাই কেও হারিয়ে গেলে তাকে প্রথমে বুঝে নিতে হবে সে আসলে সেই নকশার ঠিক কোন প্রান্তে আছে সেই মুহূর্তে, তারপর সেই বুঝে ঠিক করে নিতে হবে বহির্গমনের পথ। এ ফাঁকে গাইড আমাদের জানালেন আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য। আর তা হল, এই ভবনটি বানাবার সময়ে চসেস্কু নাকি কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যে এই ভবন তৈরিতে যা যা কিছু লাগবে তাঁর সবই হতে হবে খাঁটি রুমানিয়ান। তিনি এমন একটি দেশীয় দ্রব্যে তৈরি প্রাসাদপ্রম অট্টালিকা বানিয়ে বাইরের পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের বেশ চমকে দিতে চেয়েছিলেন। রুমানিয়ার কার্পেথিয়ান পর্বতমালায় যেহেতু বেশ প্রচুর পরিমাণে নানা প্রকারের পাথর পাওয়া যায়, আর তাঁর সংলগ্ন বনানীতে যেহেতু আছে অফুরন্ত লার্চ, ওক, লিন্ডেন গাছের সমাহার-তাই পাথর আর কাঠ এ দুটো নিয়েই রুমানিয়ান স্থপতিদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। শুধু গোল বাধে জানালার রেশমি পর্দা নিয়ে, ও জিনিশ তো আর খাঁটি রুমানিয়ান নয়। স্থপতিরা শেষতক গেলেন চসেস্কুর কাছে কর্তার মতামত জানতে। তিনি রায় দিলেন এক কাজ করা যেতে পারে। চীন দেশ থেকে না হয় রেশমের পোকা আমদানি করে তারপর তাঁদের খাইয়ে বড় করে সেই রেশম থেকে রেশমি সুতা রুমানিয়াতেই তৈরি করা হোক, তাতে করে সেই রেশমি সুতো কিছুটা হলেও তো রুমানিয়ান হল। সিলভার আর সোনার কাজ করা সেই রেশমি কাপড়ের বিশাল বিশাল পর্দাগুলোর প্রতিটিই তৈরি করা হয়েছিলো সম্পূর্ণ যন্ত্রের সাহায্য ব্যতিরেকে।

বিশাল এই ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিবছর যে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, তা নির্বাহ করা রুমানিয়ান সরকারের পক্ষে সম্ভব হয় না, তাই এখন এই ভবনের বিভিন্ন কক্ষ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সভা সেমিনারের জন্যে ভাড়া দেয়া হয়। সে থেকে এই ভবনের রক্ষণাবেক্ষণের কিছুটা খরচ উঠে আসে। চসেস্কুর পতনের পর পরই এই বিশাল ব্যয়ের কথা চিন্তা করেই তখনকার নীতিনির্ধারকেরা কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন এই ভবনটি নিয়ে। এটি কি তারা বেঁচে দেবেন? নাকি সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্যে রেখে দেবেন? ভবনটির নির্মাণ কাজ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি, নকশা মতে পুরো শেষ করতে আরও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সে মুহূর্তে তারা ঠিক করলেন আর বেশি অর্থ ব্যয় না করে নকশায় কিছুটা কাটছাঁট করে নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। এটি নির্মাণ শেষ হবার পরে নাকি বিখ্যাত ক্যাসিনো ব্যবসায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এবারের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প এই ভবনটি এক বিলিয়ন ডলার মূল্যে কিনে নেবার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর নাকি পরিকল্পনা ছিল এটিকে পূর্ব ইউরোপের অন্যতম বিখ্যাত কাসিনো হাউসে পরিণত করার। ভাগ্যিস সেটি হয়নি। কারণ ক্যাসিনো বানান হলে চূড়ান্ত বাণিজ্জিকরণেরর ফলে এই ভবনটির স্থাপত্য কৌশলের ব্যাপারগুলো হয়তো চাপা পড়ে যেত।

ঘুরতে ঘুরতে এবার আমরা চলে আসি চারতলার এক ব্যাল্কনিতে। এখান থেকে এই ভবনের মূল অগ্রভাগের সম্মুখ দৃশ্যমান। উনিরি বুলোভার্ডের বিশালাকার অট্টালিকাগুলো এক নিমিষেই এখান থেকে দেখা যায়, আর দেখা যায় রেইনট্রি গাছে ছাওয়া বেশ প্রশস্ত একখানি সড়ক। সে দেখতে অনেকটা আমাদের মানিক মিয়া অ্যাভেন্যুয়ের মতো। তবে এই সড়ক আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকার অট্টালিকাগুলোরও একটি ইতিহাস আছে। সেটি বলতে গেলে আবারও সেই চসেস্কুর পাগলামির কথাই টেনে আনতে হয়। আশির দশকের প্রথমভাগে যখন এই ভবন নির্মাণ শুরু হয়, তখনই চসেস্কু নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন শুধু এই ভবনটি নির্মাণ করলেই হবে না, আশেপাশের ভবনগুলোকেও হতে হবে এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধু তাই নয়, উনিরি বুলোভার্ডটিকে হতে হবে ঠিক প্যারিসের বিখ্যাত শ্যাম্প এলিসে সড়কের অনুরূপ।

চিন্তায় পড়ে গেলেন স্থপতিরা। কারণ সেসময়ে এ এলাকাটি বিরাণ ছিল না, বেশ ভালোরকমের বসতি ছিল এখানে। কিন্তু চসেস্কুর কথার বাইরে এক চুলও যে যাবেন তেমন সাধ্য তাঁদের ছিলো না। বাধ্য হয়েই প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে হয় তাঁদের। যারা উচ্ছেদ হলেন তারা কিন্তু তেমন একটা ক্ষতিপূরণ পেলেন না, বলা নেই কওয়া নেই হটাৎ তাঁদের গিয়ে উঠতে হল বুখারেস্টের অন্য কোন প্রান্তে অন্য কোন পরিবারের বাড়িতে। তাজমহল সৃষ্টির পেছনে যেমন লুকিয়ে আছে এর নির্মাণ শ্রমিকদের বেদনার এক ইতিহাস, তেমনি এই ভবনটি তৈরির পেছনেও আছে এই হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর করুণার্তি। সেই ব্যাল্কনিতে দাঁড়াবার সময়েই গাইড আমাদের জিজ্ঞেস করলো বলতো তোমরা এখন ঠিক ক তালায় দাঁড়িয়ে আছ? ভূমি থেকে উচ্চতা হিসেব করে আমরাও সরল বিশ্বাসে জবাব দিলাম, কেন চার তলায়। হাততালি দিয়ে উঠে সেই মেয়েটি জানাল, উত্তর ধারে কাছেও হয়নি, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ এখন ষোলতলায়। সে কি করে সম্ভব? দিব্যি দেখছি আমাদের নিচে কেবল তিনটি তল! এর উত্তরে জানলাম ভূগর্ভে এই ভবনটির রয়েছে আরও বারোটি তল। আর সেই বারোতলের সর্বশেষ তলটিতে আছে চসেস্কুর জন্যে নির্মিত পারমাণবিক বোমা থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম এমন একটি বাঙ্কার। চসেস্কুর নাকি পারমাণবিক হামলা নিয়ে বেশ একধরণের শঙ্কা কাজ করতো, তাই তিনি স্থপতিতদের আগেভাগেই নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন এমন একটি বাঙ্কার তৈরি করে দেবার জন্যে।

বিশাল এই সংসদ ভবনের মাত্র দশ শতাংশ জায়গায় পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া হয়, আর তাতেই লেগে যায় বেশ কয়েক ঘণ্টা। আমাদের সাথের এক শিশু অস্থির হয়ে ওর বাবাকে বলছিল, “বাবা আর কত দূর? পা যে ব্যথা হয়ে এলো”। এ কথায় বাবাটি হেসে ছেলেটি তুলে নেন নিজের কাঁধে। এরপর আমরা আসি ভূগর্ভে সদ্যনির্মিত এক চিত্রশালায়, সেখানে তখন এক চিত্র প্রদর্শনী চলছে। নিচের আর সব ভূগর্ভের তলগুলোতে পর্যটকদের যাওয়া বারণ। আর সেখানেই হয় আমাদের এই ভবন পরিক্রমার পরিসমাপ্তি।

বাইরে যখন বেরিয়ে এলাম তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় আড়াইটে। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, কিন্তু এবার বুঝলাম বেশ ভালই খিদে পেয়েছে। বিশাল এক পার্ক পেড়িয়ে রেগিনা বুলোভার্ডে উঠতেই চোখে পড়লো এক তুর্কী দোকান। দোকানটির ভেতরে বসবার ব্যবস্থা নেই, খেতে হলে বাইরেই দাঁড়িয়ে খেতে হবে। সেটি কোন ব্যস্ত সময় নয়, দোকানের একমাত্র পরিবেশনকারি ছেলেটি তাঁর তুর্কী লাল টুপি মাথায় দিয়ে বাইরের রকে বসে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বিড়ি ফুঁকছে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি বিড়ির আগুন নিভিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে জানতে চাইলো কি নেব আমি? আমি বেছে নিলাম ভাপে সেদ্ধ করা একটি আস্ত ট্রাউট মাছ। খেতে মন্দ নয়, তবে খাবার ব্যবস্থাটি খুব একটা সুবিধের নয় এই আরকি। অবশ্য সব খানেই যে সুবিধেমত সব মিলবে তারও তো কোন মানে নেই, তাই না?

উদরপূর্তির পর আমার এবারকার গন্তব্য রুমানিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবন। পাঠক চমকে উঠবেন না, কোন উমেদারি বা বিপদে পড়ে সেখানে যাচ্ছি না। সেখানে যাচ্ছি সেই মন্ত্রণালয় চত্বরটি এক ঝলক দেখবার জন্যে। কেন সেটি পরে বিশদে বলছি। তার আগে সেখানে যাবার পথে আর কি কি দেখে নিলাম সে নিয়ে কিছু বয়ান দেই।

হাঁটছি উনিরি বুলোভার্ডটি ধরে। এখান থেকে আমার গন্তব্যে স্বল্প সময়ে যাবার জন্যে মূল রাস্তা থেকে নেমে আরেকটি ছোট রাস্তা ধরলাম, ভাগ্যিস ধরেছিলাম। নতুবা হয়তো বুখারেস্টের অনবদ্য আর ঐতিহাসিক কিছু চার্চ অদেখা থেকে যেত। ব্যাপারটা হল বুখারেস্টের এই প্রাচীন চার্চগুলোর অধিকাংশই ওই একই এলাকায় অবস্থিত। কিন্তু মুশকিল হয়েছিলো সেগুলো ছিল একেবারে চসেক্সুর যাতায়াতের পথে। ফলে একদিন সে ঘোষণা দেয় এই সব চার্চগুলো অবিলম্বে ভেঙ্গে ফেলতে, যেন এগুলো কিছুতেই চলার পথে তাঁর দৃষ্টিগোচর না হয়। প্রমাদ গুনলেন এবার নগর স্থপতিরা। এই স্বেচ্ছাচারী শাসকের খেয়ালে শেষ পর্যন্ত এই পুরাকীর্তিসম চার্চগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে? এক বুদ্ধি বার করলেন তারা। চার্চগুলো না ভেঙ্গে বরং সেগুলোর চার ধারে ঘেরাটোপের মতো যদি আবাসন কমপ্লেক্স নির্মাণ করা যায় তবে কেমন হয়? তাহলেই তো আর চসেস্কুর চলার পথে এই চার্চগুলো আর নজরে পড়বে না। সেই বুদ্ধি করে অবশেষে তারা এই চার্চগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন।

সতের শতকের শেষ দিকে দক্ষিণ রুমানিয়ায়া ‘ভালাসিয়ান রেনেসাঁ’ নামক এক স্থাপত্য রীতির উদ্ভব ঘটে। এই রীতিটিকে বলা চলে গথিক, বাইজান্টাইন আর অটোমান স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে উদ্ভব নতুন এক ধারা। এমন ধারার যে চার্চটির সামনে প্রথমে এসে পৌছুলাম সেটির নাম ‘ওল্ড কোর্ট চার্চ’। চার্চের ভেতরে তখন ঝাড়-পোঁছের কাজ চলছে, তাই সে জন্যে আপাতত কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু তাই জন্যে থেমে নেই ভক্তদের আনাগোনা কিংবা ভক্তি প্রদর্শন। পটুয়ারা যেসব স্ট্যান্ডে ক্যানভাস রেখে ছবি আঁকেন, তেমনই কিছু স্ট্যান্ডে চার্চের বাইরের আঙিনায় রাখা রয়েছে মেরি কিংবা যিশুর কিছুর আইকন। পথ চলতি অনেকেই দেখলাম পুণ্যের আশায় হাঁটার পথে থেমে ছুঁয়ে দিচ্ছেন মেরীর আইকন, অনেকে আবার পাশেই জ্বলতে থাকা আগুনের ভাণ্ড থেকে মোম জ্বালিয়ে রেখে যাচ্ছেন আইকনের পাদদেশে।

আগেই বলেছি এই সব চার্চগুলোই একেবারে বিভিন্ন পাড়ার মাঝখানে, এক গোলক ধাধাময় জায়গায়। তা তেমন স্থানে বেশ কয়েকবার চক্কর খেয়ে, দু দুবার পুরনো জায়গায় ফিরে এসে শেষ অব্ধি আরেকটি বেশ মলিন যে ক্ষুদ্রাকার চার্চের সন্ধান পেলাম সেটির নাম ‘স্তাভ্রপলেওস চার্চ’। সতের শতকে এক গ্রীক যাজকের হাত দিয়ে এই চার্চটির পত্তন হয়েছিলো, আর এটিই নাকি এ শহরের সবচেয়ে সুন্দর চার্চ। ভেতরের গম্বুজের ছাদ থেকে মেঝে অব্ধি যে অপূর্ব কারুকাজ করা অসংখ্য চিত্র আঁকা রয়েছে এই চার্চের অভ্যন্তরভাগে, তাতে এটিকে ‘সবচেয়ে সুন্দর’ অভিধায় ভূষিত না করার কোন কারণ দেখি না। তবে আমার দেখা অন্য অনেক অর্থোডক্স চার্চের সাথে এটির কোন এক জায়গায় কোন এক পার্থক্য আছে। চার্চের ভেতরটা দেখা শেষ করে বহির্ভাগের ছবি তোলার সময়ে তাই ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ থম মেরে চিন্তা করার পর বুঝতে পেলাম পার্থক্যটি। এই চার্চটির শুধু অভ্যন্তরভাগ নয়, বহির্ভাগের দেয়ালেও আঁকা আছে নানা সাধু সন্তদের ছবি। কালের বিবর্তন আর রোদ হাওয়ায় তাঁর অধিকাংশই আজ মলিন প্রায়। বহির্ভাগে এমন অসাধারণ চিত্রায়ন আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক শীতের রাতের কথা। মার রাঁধা শীতের ফুলকপি আর ছোট আলুর ঝোলের ভাত খাচ্ছি আর রাতের খবর শুনছি। সে রাতের আর সব খবরের মাঝে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর সংবাদটি ছিল বুখারেস্টের রাস্তায় গণ-অভ্যুত্থান এবং চসেস্কুর পলায়ন। খাপছাড়াভাবে নির্মিত বিভিন্ন ভবনের আচ্ছাদনে চার্চগুলোকে লুকিয়ে রাখা সেই পাড়াগুলোকে পেছনে ফেলে যখন রেভলুশন স্কয়ারের কাছেই এক বিশালাকায় ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালাম, আমার স্মৃতি যেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো সেদিনের সেই রাতে আমাদের বাড়ির সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় দেখা দৃশ্যগুলোর মাঝে। আজও ঝাপসা-ভাবে মনে পড়ে বুখারেস্টের রাস্তায় নেমে আসা ট্যাঙ্ক, হাজার হাজার জনতার ক্রোধন্মত্ত চিৎকার, চসেস্কুর সেই শেষ ভাষণ- এমন কিছু টুকরো ছবি। যে ভবনটির সামনের চত্বরে আমি এখন দাঁড়িয়ে সেটি একসময়ে ছিল রুমানিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর, আর এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবন। এ ভবনের ব্যাল্কনি থেকেই শেষ ভাষণটি দেবার পর অবস্থা বেগতিক দেখে ছাদে থাকা হেলিকপ্টার নিয়ে তড়িঘড়ি করে চসেস্কুকে পালাতে হয়। কিন্তু কি হয়েছিলো সেদিন আসলে?

পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট শাসকদের মাঝে সবচেয়ে অজনপ্রিয় শাসকটি ছিলেন এই চসেস্কু। যার অন্যতম কারণ ছিল তাঁর স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি, পার্টি পদে অথবা শাসনকাজে নিজ পরিবারের লোকেদের অন্তর্ভুক্তি, ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে চসেস্কু অবশ্য ততটা সোভিয়েত অনুগত ছিলেন না, যে কারণে কম্যুনিস্ট দেশ হওয়া সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তাঁর বেশ কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সত্তরের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার বেশ চাঙ্গা, চসেস্কু ঠিক করলেন নিজের দেশে বেশ কিছু তেল শোধনাগার তৈরি করবেন। উদ্দেশ্য পুবের অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে পশ্চিমে রফতানি করা। একারণে বেশ চড়া সুদে বেশ বড় আকারের বিদেশী ঋণও নিয়ে এলেন। শুরু হল সেসব শোধনাগার তৈরির কাজ। কিন্তু রুমানিয়ার নির্মাণ শ্রমিকরা তো আর তেমন দক্ষ নয়। তাই দেখা গেলো নির্মাণ কাজ শেষ হল প্রকল্পের সময়সীমার বেশ কিছুটা সময় পার করে। ততদিনে আবার বিশ্ববাজারে তেলের দর পড়ে গেছে। এভাবেই চসেস্কুর পরিকল্পনা পুরো মাঠে মারা গেলো। কিন্তু ঋণ যা নিয়েছেন, তাতো শোধাতে হবে ঠিকই। অতঃপর নিজের দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে চসেস্কু রুমানিয়ার কৃষিপণ্য রফতানি করে দিতে লাগলেন বাইরের দেশে, যাতে সেই অর্থ দিয়ে ঋণের কিস্তির টাকা কিছুটা হলেও শোধ করা যায়। চসেস্কুর অনেক পাগলামি, আর নিপীড়ন সহ্য করলেও দেশের মানুষ এবার আঘাত পাওয়া শুরু করলো নিত্যদিনের আহারে, যেটিই মূলত তাঁদের মাঝে ক্ষোভের দানা বাধিয়ে তুলল। চসেস্কু-বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতটি হয়েছিলো পশ্চিমের শহর তিমিশোয়ারায়। এ শহরের বাস করে বেশকিছু জাতিগত সংখ্যালঘু হাঙ্গেরিয়ানরা, ধর্মমতে যারা ক্যাথলিক। তো তাঁদের এক যাজক সর্বপ্রথম চসেস্কু-বিরোধী বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে খেপিয়ে তুললেন। চসেকুর গুপ্ত পুলিশ ‘সিকুরিতাতে’ ভেবেছিলো এই যাজক যেহেতু ক্যাথলিক হাঙ্গেরিয়ান তাই হয়তো সাধারণ অর্থোডক্স খ্রিস্টান রমানিয়ানরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে না। কিন্তু হিসেবে ভুল করেছিলো তারা। অচিরেই দেখা গেলো সেই বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে ধর্ম-মত নির্বিশেষে এক জনসমুদ্রে। সেদিনের সেই বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়ে খুন করে কয়েকশ বিক্ষোভকারিকে। আর এতেই বারুদের স্তূপে আগুন লাগে, বিক্ষোভ ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। পুরো ব্যাপারটা যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন চসেস্কু ঠিক করলেন পার্টি অফিসের সামনে এক সমাবেশ আয়োজন করে নিজের কর্মী-সমর্থকদের সেই সমাবেশে ডেকে নিজের শক্তি প্রদর্শন করবেন। সেদিনের সে সমাবেশের অগ্রভাগে থাকা সমর্থকেরা কিন্তু ঠিকই প্রথমদিকে চসেস্কুর স্তুতি গাইছিলেন। কিন্তু কিছু সময় পরেই হটাৎ কে যেন ‘চসেস্কু নিপাত যাক’ স্লোগান শুরু করে সেই সমাবেশের পেছন দিকে, আর উত্তাল জনতা সেটাই তুলে নেয় তাঁদের ঠোঁটের অগ্রভাগে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চসেস্কু দেখলেন নিজের কর্মী-সমর্থকদের সমাবেশই পাল্টা রূপ নিয়েছে চসেস্কু-বিরোধী সমাবেশে। এ যাত্রায় আর নিস্তার নেই বুঝতে পেরে ছাদে মজুদ হেলিকপ্টারে করে তিনি আর তাঁর স্ত্রী এলেনা তখনই পালিয়ে যান। তবে কপাল মন্দ ছিল তাঁদের। পথে তিরগোভিস্তে নামক এক শহরের এক সামরিক ব্যারাকে হেলিকপ্টারটি থামে যাত্রা-বিরতির জন্যে, আর সেখানেই বিদ্রোহী সেনারা তাকে এবং তাঁর স্ত্রীকে আটক করে খুবই সংক্ষিপ্ত এক বিচারের মাধ্যমে গুলি করে মারে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে।

চসেস্কুর তো পতন হল, কমুনিসমেরও পতন হল। কিন্তু তাতেই কি রুমানিয়ার মানুষ পেল কাঙ্ক্ষিত সব কিছু? এখানেই আছে এক শুভঙ্করের ফাঁকি। চসেস্কু-বিরোধী বিপ্লবে সেদিন যারা অংশ নিয়েছিল তাঁদের মধ্যে আসলে ছিল দুটি দল, একটি দল ছিল শুধুই চসেস্কু-বিরোধী আর আরেকটি দল ছিল চসেস্কু-সহ কম্যুনিস্ট সিস্টেমের বিরোধী। সেদিনের সেই গণ-অভ্যুথান কিন্তু এমনি এমনি সফল হয়নি, ভেতরে ভেতরে চসেস্কুর কিছু কাছের আমলা, পার্টির ওপরের দিকের নেতা আর সামরিক বাহিনীর জেনারেল বেঁকে বসেছিলেন চসেস্কুর বিরুদ্ধে। অনেকটা তাঁদের সবুজ সংকেতেই বিপ্লব এগিয়ে যেতে পেরেছিল এবং চসেস্কুর আর শেষ রক্ষা হয়নি। কিন্তু চসেস্কুর ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থাকা এই লোকগুলো, যারা শেষ সময়ে চসেস্কুকে পরিত্যাগ করেছিলেন, তারাও কিন্তু ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। চসেস্কুর ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছারিতার সারদ বাজিয়ে গেছেন এরাও একসময়। কিন্তু শেষ সময়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আর চসেস্কুকে তড়িঘড়ি বিচারের কাঠগড়ায় তুলে তারা জনতার কাছে এই বার্তা পৌছাতে সক্ষম হন যে সকল অপকর্মের হোতাই ছিল চসেস্কু আর তাকেই যখন মেরে ফেলা হয়েছে তখন আর বিপ্লবের আর প্রয়োজনীয়তা কি? এবার তবে সবাই বাড়ি চল। আন্দোলনরত জনতা বাড়ি ফিরেছিল এবং মস্ত বড় ধোঁকাও খেয়েছিল। পরবর্তী দু’দশকে দেখা যায় চসেস্কুর সেই পুরনো আমলের সাঙ্গপাঙ্গরাই ভোল পাল্টে ভিন্ন পার্টির ব্যানারে থেকে গেছে ক্ষমতার মধু-হাড়ির আশেপাশে। আর দীর্ঘ এই দু দশকে চসেস্কুর অপকর্মের সাথীদের একজনকেও কিন্তু বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এমনকি গুপ্ত পুলিশ সিকুরিতাতের যেসব অফিসার সেই ডিসেম্বর বিপ্লবে কয়েকশ মানুষকে হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন, তাঁদের কাউকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো সম্ভব হয়নি অদ্যাবধি। কে জানে হয়তো বুখারেস্টের ‘ঘেন্সিয়া’ গোরস্থানে নিজের কফিনে শুয়ে শুয়ে চসেস্কু মুচকি হেসে বলছেন, “খুব তো আমাকে এক সকালের বিচারেই গুলি করে মারলে তোমরা, কিন্তু তাতে কি লবডঙ্কাটি হয়েছে বলত তোমরা? পেরেছ কি আমার গড়া পুরো সিস্টেমটিকে ভেঙ্গে ফেলতে”?

পরদিন ভোর ছটায় আমার রুমানিয়া ছাড়বার ফ্লাইট। এ দেশে এলাম বটে, কিন্তু বেশ অনেক কিছুই অদেখা থেকে গেলো। এই যেমন ইচ্ছে ছিল ঐতিহ্য-মণ্ডিত তিমিশোয়ারা শহরটি দেখবার। আরও ইচ্ছে ছিল কার্পেথিয়ানের বুক চিরে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া বিস্ময়কর ট্রান্সিলভানিয়া মহাসড়কে নেমে ভাসমান মেঘের দলকে তাড়া করা। কিন্তু এ যাত্রায় তো আর এতসব কিছু হবার নয়। নিজের খেরোখাতায় না হয় টুকে রাখি সেসব অদেখা স্থানের নাম। যদি বা ভবিতব্য একদিন পথ দেখায় সে পথের পানে, সে আশায়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এই পর্বটা যে আসবে সেটা তো আগেই বলেছিলেন, তাই এই পর্বের ইতিহাস আলোচনায় কী থাকবে সেটা ধারণায় ছিল। আপনি বেশ গুছিয়ে সেটা তুলে ধরেছেন। ভ্রমণকাহিনী বা মেমোয়ার্সে এর বেশি ইতিহাস আলোচনা থাকার দরকার নেই। এই পর্বে ছবি বোধকরি একটু কম হয়ে গেলো।

আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যুগল যে কোন কোন দেশের ইতিহাস পালটে দিতে পারে সেটার বড় প্রমাণ রুমানিয়া। চসেস্কু যখন বিদেশী ঋণ শোধ করে গুছিয়ে আনছিল তখনই সেটা কারো কারো স্বার্থে লেগে যায়। ফলাফল চসেস্কুকে উৎখাত। কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছিল? ১৯৮৮ সালে রুমানিয়ার অর্থনীতি যেখানে ছিল সেখানে আবার পৌঁছাতে তাদের ২০০৫ সাল লেগে যায়। জানি না রুমানিয়ার জনগণ আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যুগলের কৃতিত্বে আনন্দিত কিনা।

দুর্নীতি, অন্যায় ইত্যাদি ধামাচাপা দেবার একটা সহজ উপায় হচ্ছে দলের একজনকে মুরগী বানিয়ে জবাই করে দেয়া। আর সেই একজন যদি সাবেক চীফ হয় তাহলে তো কথাই নেই! তখন সবাই বিশ্বাস করবে - এই ব্যাটাই সব নষ্টের গোড়া। তিমিসোয়ারার তথাকথিত বিপ্লবের সেই মুরগীটা হচ্ছে নিকোলাই আর এলেনা চসেস্কু।

চসেস্কুকে মারার প্রক্রিয়াটিকে 'বিচার' বলাটা একটা তামাশা মাত্র। যারা বেশি ঘাঁটতে চান না, তারা উইকির এই ভূক্তিটা পড়ে নিতে পারেন। টেলিভিশনে সেটা দেখার দুর্ভাগ্য এই অধমেরও হয়েছিল। আজ পর্যন্ত মনে দাগ কেটে থাকা ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোর একটা সেই ঘটনা।

চসেস্কু সব সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসণ ও মাতব্বরীর বাইরে থাকতে চেয়েছিল। জোসিপ ব্রোজ তিতো বা এনভার হোক্সা'র (আনোয়ার হোজ্জা) মতো আঞ্চলিক নেতাদের সাথে মিলে সহযোগিতা গ্রুপ গড়ে তুললে হয়তো কিছু করা যেতো। কিন্তু তার বদলে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়ে আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখানোর ফলে তাকে করুণ পরিনতি বহন করতে হয়েছে।

চসেস্কু পরবর্তী রুমানিয়ার ইতিহাস বিশাল ফাঁকি আর বঞ্চনার ইতিহাস। আজকের রুমানিয়ার যে আপাত শাঁসালো চেহারা দেখা যায় সেটা ১৭০ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই, ইইউ'র খয়রাত, আইএমএফ-এর ১২.৯৫ বিলিয়ন ইউরো ঋণ, ইইউ'র ৫ বিলিয়ন ইউরো ঋণ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ১.৫ বিলিয়ন ইউরো ঋণ আর অন্যান্যদের কাছ থেকে আরও ১ বিলিয়ন ইউরো ঋণ নেবার ফল। এইসব ঋণ তো আর গাছে ধরে না, এর জন্য দণ্ড দিতে হয়। বছরে ৩.৫% সুদ দিতে হয়, বেতন ২৫% কমানো হয়েছে, ১৯% থেকে ২৪% ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। খরুচে, ফূর্তিবাজ মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ'সবের পরিণতি বোঝার জন্য রুমানিয়ার ধারে কাছের অনেক দেশের সাম্প্রতিক ঘটনকাবলী খেয়াল করলেই চলে। রুমানিয়ানদের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনার মন্তব্য একটা অন্য ধরণের প্রাপ্তি। কারণ বহু কিছু জানা যায় এই আপনার মন্তব্যের সূত্র ধরেই। অনেক ধন্যবাদ এতটা বিশদ আলোচনা করবার জন্যে।

অতিথি লেখক এর ছবি

রুমানিয়া নিয়ে কি আর কোন পর্ব আসবে? রুমানিয়ার প্রকৃতি, ওয়াইন আর বালিকাদের কথা না থাকলে যে রুমানিয়ার গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়! রুমানিয়ার আপস্টার্ট ক্লাস আর সাধারণ মানুষের গল্প শুনতে পেলে সেটা বোনাস হতো।

আর একটা কথা, যেটা আগে বলা হয়নি। আপনার নিজের গল্পটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। যদি কোনদিন মনে হয় তাহলে আপনার গ্র্যাড স্কুলের জীবনের গল্পটা আমাদের শোনাবেন।

অনেক অনেক ভালো থাকুন, নিয়মিত লিখুন।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

খুব শীঘ্রই হয়ত আসবেনা, তবে ভবিষ্যতে আরো লিখে পারি সে নিয়ে। রুমানিয়ার সাধারণ জন-সমাজ নিয়ে দু একটি কথা বলেছিলেম আগের পর্বে, সেটি হয়তো পড়ে থাকতে পারেন।
আমার গ্রাড স্কুলের জীবন কাহিনি নিয়েও লেখার ইচ্ছে আছে, আপনার অনুপ্রেরণা ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, লেখাটি পড়বার এবং মন্তব্য করবার জন্যে।

অনুসন্ধিৎসু এর ছবি

এই পর্বে ছবির সংখ্যা একটু কম হয়ে গেলো । কারণ টা কি ক্যামেরার জন্য অতিরিক্ত ত্রিশ লেই এর টিকেটের জন্য?
এই বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর । কিছুদিন আগে, দিল্লীর জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে আমার অনুরূপ অভিজ্ঞতা হলো । প্রবেশ ফিঃ নেই, কিন্তু ক্যামেরা/মুঠোফোনের জন্য ৩০০ রুপী লাগবে! ধান্ধাবাজী আর কাকে বলে!
আমিও আর ভিতরে যাইনি, বাইরে থেকে ঘুরে চলে এসেছি!

এই লেখায়, আপনার ইতিহাসের বর্ণনাগুলো দুর্দান্ত হয়েছে ।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনুসন্ধিৎসু,
ঠিক ধরেছেন। ভ্রমণের শেষ দিকে তখন আমি, পকেটের অবস্থা ততটা সবল নয়. তাই ও টিকেট আর কাটিনি। যার ফলে ভেতরের ছবি আর তোলা হয়ে ওঠেনি। যদিও ভেতরে ঢুকে কিছুটা আফসোস হয়েছে সে নিয়ে। কিন্তু তখন আর ফিরে গিয়ে ছবির জন্যে টিকেট কাটবার মতো অবস্থা ছিলো না।

ধন্যবাদ আপনাকে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখার ভক্ত হয়েছি আরও আগেই। মুগ্ধতা আরেকটু বাড়ল বৈকি। হাততালি

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ রূপক ভাই

মাসুদ সজীব এর ছবি

মন্ত্রমুগ্ধের মতো দুইবার টানা পড়েছি। আপনার ভ্রমণ বিষয়ক লেখার অনেক বড় ভক্ত আমি। ভ্রমণ সবাই করে কিন্তু কজন মানুষ সেই স্থানের ইতিহাস, ঐতিহ্য কে জানে এবং অন্যকে জানাতে পারে? আপনি সেই গুটি কয়েকজনের মাঝে অন্যতম।

এমন শক্তিশালী বর্ণনার পরে ছবির প্রয়োজন বোধ করিনি আমি। আপনি আমার খুব কাছেই ছিলেন একসময় (ডালাস-টেক্সাস) একসময় সেটি ভেবে আরেকটু বেশি ভালো লাগলো হাসি । আপনার নিজের জীবনের অংশটুকুর বর্ণনা বোধহয় সবচেয়ে বেশি নষ্টালজিক আর মুগ্ধ করেছে। নিজের জীবনের গপ্পো ও কিছু লেইখেন। ভালোথাকুন, সব সময়, আরো বেশি করে লিখুন।

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মাসুদ ভাই. এই উইকেন্ডে ডালাসে আসছি, আপনি সে শহরে থাকলে হয়তো দেখা হতো.

নিজের অনেক কথাই তো লিখতে চাই, কিন্তু পাছে লোকে কিছু বলে ভেবে আর লেখা হয় না. তবে এবার ভাবছি সত্যি সত্যি ই লিখবো।

আমার ভ্রমণ কাহিনিগুলো নিয়ে একটা বই বের হয়েছে এবারের বইমেলায়, "রিগা থেকে সারায়েভো".

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন লিখেছেন।আপনার লেখার বর্নণা এবং তথ্য উপস্থাপনা অতুলনীয়।আপনার ভ্রমন কাহিনী গুলো অনেক ভাল লাগে আশা করি আরো লিখবেন।আপনার লেখা বইটা কি অনলাইনে কেনা যাবে?
_মোঃ মেহেদি হাসান তানিম

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি যদি দেশের বাইরে থাকেন তবে এখান থেকে বইটি অর্ডার করতে পারবেন--

http://boi-wala.com/riga-theke-sarajevo.html

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।