বৃষ্টিস্নাত ‘জাগরেব’ দিন

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
লিখেছেন জীবনযুদ্ধ [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৪/০৪/২০১৬ - ১১:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


দুটি হাত বুকের কাছটায় ভাঁজ করে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে গৃহত্যাগী এক সন্ন্যাসী প্রায় শত বছর আগে আউড়েছিলেন এক শ্লোক, “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত”, অর্থাৎ ওঠো, জাগো, জ্ঞান লাভ করো। এই শ্লোকটির কথা আমার খুব করে মনে থাকলেও মিহি ঠাণ্ডার প্রত্যুষে আমি ওসব ভুলে থাকার ভান করে মাথার ওপরে কম্বল মুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকি। তবে সব দিন তো আর একই ভাবে সকালের বার্তা নিয়ে আসে না! এই যেমন সেদিনের সেই প্রত্যুষে আমি যতই না লুকবার চেষ্টা করি, খুব কাছেই কোন এক গির্জার একটানা ঘণ্টা ধ্বনি আমার কানের কাছে এসে বার বার বলতে থাকে, “ওঠো, জাগো, মুঠো ভরে জগতালোকের কর্ণধার সূর্যদেবতার কিরণ গায়ে মাখো, চোখ ভরে দেখ নতুন সব অজানা সৌন্দর্য, জীবন-পেয়ালাকে পূর্ণ করো নতুন পরিবেশ আর নতুন মানুষের সঞ্জাত অমৃত রসে। এমন সুতীব্র আহ্বান উপেক্ষা করবার সাধ্য আমার নেই, তাই চোখ কচলে উঠে হাতে ক্যামেরার রশি ঝুলিয়ে সেই সাত সকালেই ঘণ্টা ধ্বনিকে অনুসরন করতে বেরিয়ে পড়ি।

আগের রাতে বেশ খানিকটা হুজ্জত করেই জাগরেবের এই হোস্টেলে এসে পৌঁছেছিলাম। ইউরোপে আজকাল ভিসামুক্ত অঞ্চলের বদৌলতে সেই উত্তরের ফিনল্যান্ড থেকে দক্ষিণের স্লোভেনিয়া অব্ধি সিমান্তের ঝামেলা ছাড়াই একটানা চলে যাওয়া যায়। স্লোভেনিয়ার পাশের দেশ ক্রোয়াশিয়া এখনও সেই ভিসামুক্ত অঞ্চলের আওতাভুক্ত নয়। তা হলে কি হবে, এদের কানে অন্তত এটুকু জল গেছে যে এভাবে পর্যটকদের আগমন থামিয়ে রাখলে আখেরে ক্ষতি নিজেদেরই। তাই তারা এক নিয়ম করেছে, যদি ইউরোপের ভিসামুক্ত অঞ্চলে প্রবেশের সেঞ্জেন ভিসা কারও থাকে, তবে সেই এক ভিসা দেখিয়ে এই বলকানের দেশ ক্রোয়াশিয়াতেও প্রবেশ করা যাবে। আলাদা করে ক্রোয়াশিয়ার কোন ভিসা নিতে হবে না। তবে সেতো কাগুজে কথা, বাস্তবেও সেই হয় কি না সে নিয়ে কিছুটা সংশয় তো ছিলই। তাই স্লোভেনিয়া থেকে ক্রোয়াশিয়ায় প্রবেশ করবার পর ট্রেনটি এক গ্রামীণ স্টেশনে থামবার পর যখন ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার পাসপোর্ট চাইলো তখন কিছুটা ঘর্মাক্ত হাতেই আমার পাসপোর্টখানা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। অবশিষ্ট আশঙ্কার অবসান ঘটিয়ে মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই তারা আমার পাসপোর্ট এনে ফেরত দিয়ে গেলো। আমার কূপে আমি ছাড়া আর উঠেছে এক ব্রিটিশ তরুণী আর ইউক্রেনের কিছু যুবক-যুবতি। এরা সবাই যাচ্ছে জাগরেবে সেই সময়ে অনুষ্ঠিতব্য এক সঙ্গীত উৎসবে। সে নিয়ে তাঁদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। ব্রিটিশ মেয়েটি চলেছে একাই। তাঁর সাথে দু চারটা বাক্য বিনিময়ের মাঝেই দেখলাম মেয়েটি উঠে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো, যদিও ফিরে এলো খানিক বাদেই। এবার তাঁর মিলিয়ে যাবার কারণটি বুঝতে পারলাম। এর মাঝে সে তার জ্যাকেট আর জিনসটি বদলে ফেলে পড়ে এসেছে বেশ আবেদনময়ি এক ফ্রক। তাকে নাকি বরণ করতে স্টেশনে আসবার কথা এক ক্রোয়াশিয়ান ছেলে-বন্ধুর। তবে কি সেই ছেলে-বন্ধুটির জন্যেই এই সাজ বদল? কি হবে আমার সেসব চিন্তা করে? আমি তাই অনর্থক চিন্তার জাল না ছড়িয়ে জানালার পাশ দিয়ে হুস হুস করে বেরিয়ে যাওয়া সূর্যমুখীর ক্ষেতের দিকে চেয়ে থেকে তন্দ্রালুতায় ডুবে যাই।

জাগরেবের লাভনি কোলোদভর স্টেশনে এসে আমাদের ট্রেনটি যখন জিরনোর জন্যে একটু দম দেয় তখন বিকেল গড়িয়ে রাত নামবার পালা। গ্রীষ্মের এমন দিনগুলোতে আসলে সন্ধ্যে বলে কিছু নেই। বিকেলের কটকটে রোদের পরই হটাৎ এক সময় ঝুপ করে নেমে পড়ে রাতের আঁধার। আমি সেই ফাঁকে আমার বোঁচকাটি এক হাতে নিয়ে নেমে হোটেলের পথে হাঁটা ধরি, অন্য হাতে সম্বল সেই স্টেশন থেকে হোটেলের পথের নিশানা সম্বলিত একখানা ম্যাপ। তবে টিমটিমে সড়কবাতির আলোয় সেই ম্যাপের রেখাগুলো পড়বার সময়ে আমার রাতকানা হবার জোগাড় হয়। অসহায়ভাবে আমি পথের এ মাথা থেকে ও মাথায় ঘুরে বেড়াতে থাকি। আমার এই দিকভ্রান্ত পথ চলার মাঝেই একসময় বুঝতে পারি পথ-ঘাটও ফাঁকা হয়ে এসেছে, কমতে শুরু করেছে পথচলতি জনতার সংখ্যা। দু একজন যাকেই হোটেলের নাম ধরে ঠিকানা জিজ্ঞেস করি, তারা ওই হোটেল শব্দটি শুনবার সাথে সাথেই বলে, ‘ও আচ্ছা হোটেল? তা এই পথের ও মাথাতেই তো আছে একখানা হোটেল। সেখানেই যাও না, পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই কোন ঘর’। তখন তাঁদের বুঝিয়ে বলতে হয় আমার আগেভাগেই আরেকটি হোটেলে ঘর বুকিং দেয়া আছে, তাই সেই কাঙ্ক্ষিত হোটেলের হদিসই আমি চাইছি। “ও তাই বল, না বাপু ও হোটেলের নাম তো শুনিনি”। পড়লাম ভালো বিপদে। সুদীর্ঘ এক সময় এভাবে চক্কর খাবার পর যখন ভাবছিলাম এবার হয়তো সেই বুকিং এর আশা ছেড়ে আশেপাশের যে কোন হোটেলের উঠে যেতে হবে, তখন এক পানশালার সামনে বিয়ার নিয়ে বসা এক যুবক আমাকে সমাধান বাতলে দিলো। যুবকের নির্দেশিত পথে গিয়ে নিজেকে কিন্তু স্রেফ বেকুব মনে হল, কারণ এই পথের পাশ দিয়েই হেঁটে গেছি বার দুয়েক, কিন্তু হোটেলটি এক প্রধান গলির উপগলির ভেতরে হওয়ায় ঠিক চোখে পড়েনি।

সাত সকালে যেহেতু গির্জার ঘণ্টা ধ্বনিতে ঘুম ভাঙল তাই অবধারিতভাবে সেখানটাতেই ঠিক করলাম প্রাথমিক গন্তব্য। এটি আবার জাগরেবের প্রধান ক্যাথেড্রাল কি না! তবে হোটেল থেকে বেরিয়েই ডানে তাকিয়ে দু বার চোখে ডলা মেরে নিলাম। কারণ দিব্যি দেখতে পাচ্ছি পাশের বাড়ির হলদে দেয়ালে রাস্তামুখি বেশ কয়েকটি দরজা হাট করে খোলা। এ কেমন ব্যাপার রে বাবা? এমন কাকডাকা ভোরে বলা নেই কওয়া নেই, এমনভাবে দরজা খুলে রেখে কে কথায় গেলো? একটু ধাতস্থ হবার পর বুঝলাম নিখুঁতভাবে সেই দেয়ালে আসলে আঁকা হয়েছে সেই দরজার ছবিগুলো। ভাগ্যিস ঢুঁ মারিনি, নয়তো নিশ্চিত নিরেট দেয়ালে গোত্তা খেতে হতো। সেই বাহারি দেয়াল পেরোলেই গির্জার চত্বর শুরু। এতো সকালে বেশ কিছু বুড়োবুড়ি হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটছেন সকালের প্রার্থনাটি ধরবার জন্যে। আর সকালের ঘুম ভাঙা কয়েকটি কাক সামনের প্রসবন থেকে আলসে ভঙ্গিতে জলের কয়েক ফোঁটা চঞ্চুতে তুলে নিচ্ছে। কাকের দলের দলছুট একজন দিব্যি আলসে ভঙ্গিতে সেই চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা চার পরীর একজনের মাথায় চড়ে পুচ্ছ নাচিয়ে চলেছে। সেই সোনালি আবরণে মোড়া পরীদের তো আর সাধ্য নেই তাকে নামাবার, তাই হয়তো বাধ্য হয়েই এই অত্যাচার মেনে নেয়া। আর মেনে নেবেনই বা না কেন? বিশ্বাস, আশা, নিষ্কলুষতা আর বিনয় আর চারের উপস্থাপনের জন্যেই তো অস্ট্রিয়ান ভাস্কর আন্তন দমিনিক তাঁদের গড়ে এখানে স্থাপন করেছিলেন।

সাধন-ভজনরত ভক্তদের কোনরূপ ব্যাঘাত না করেই আমি আমার মতো করে ক্যাথেড্রালের ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। পনের শতকের কোন এক সময়ে গথিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই ক্যাথেড্রালের অভ্যন্তরভাগ চোখ ধাধিয়ে দেবার মতো। বিশেষ করে নানা ধর্মীয় ঘটনা চিত্রায়িত করে ফুটিয়ে তোলা বাহারি দীর্ঘ কাঁচের জানালাগুলো সহজেই দৃষ্টি আটকে ধরে। সেকালে এ ধরণের কাঁচের জানালাগুলো সাধারণত স্পেন বা ফরাসি দেশ থেকে তৈরি করিয়ে আনা হতো। এ ধরণের স্থাপত্য নকশা মণ্ডিত ক্যাথলিক গির্জায় এই যে প্রথম প্রবেশ করলাম তা নয়, তবে মূল বেদির বাঁ ধারে একজনের শায়িত মূর্তিটি ঘিরে যেমনতর আরাধনা চলছে তেমনটি কিন্তু আগে কোথাও দেখিনি। যাকে ঘিরে এই প্রার্থনা, তিনি কিন্তু মোটেও অবিতর্কিত কেও নন। বরং এমন একজন মানুষ যে মৃত্যুর পরও দেবতাতুল্য আরাধনা পাচ্ছেন সেটি ভেবেই বিষম খেতে হয়। যার কথা বলছি তিনি জাগরেবের একদার আর্চ বিশপ ভিক্টর স্তেফিনাক। তাকে ঘিরে কেন এই বিতর্ক সেই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ফিরে যেতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে। ৪১ এ জার্মানি যুগোস্লাভিয়া দখলে নিলে ক্রোয়াশিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদের দাবি করে বসে আর সেই দেশে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেন উগ্র জাতীয়তাবাদী দল উস্তাশার প্রধান পাভেলিচ। অর্থোডক্স সার্বদের পাইকারি হারে নিকেশ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, ইহুদিদের জার্মানদের হাতে তুলে দেয়া এমন নানা কাজে অল্প কদিনেই উস্তাশা দল এক মূর্তিমান আতঙ্কে রূপ নেয়। আর এই তালমাতাল সময়ে উস্তাশা দলের সাথে বেশ ধহরম মহরম সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন আর্চ বিশপ স্তেফিনাক। নিন্দুকেরা বলেন পাভেলিচ তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া বড় কোন কাজে হাত দিতেন না। তাই পাভেলিচ তথা উস্তাশাদের অপকর্মের দায় তো কিছুটা হলেও তাঁর ঘাড়েও বর্তায়। যদিও অপর এক পক্ষ যারা সেই যুক্তি মানতে নারাজ, তাঁদের কথা হল স্তেফিনাক বেশ কয়েকবার পাভেলিচকে এসব নৃশংসতা সম্পর্কে সাবধান এবং সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি, পাভেলিচ তখন দড়ি ছাড়া পাগলা কুকুর। এই যুক্তি যদি মেনেও নেই, তবুও আমার মনে হয় না তিনি পুরোপুরি দায়মুক্ত। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ ধরণের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নিজ ধর্মমতের মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে অন্য মতের বিরুদ্ধে সুকৌশলে এমন সব বিদ্বেষ ছড়ান যাতে করে শেষ পর্যন্ত পাভেলিচের মতোই কিছু উন্মাদ শেষ অব্ধি জন্ম নেয়। নিজ ধর্মমত বা জাতীয়তার ঝাণ্ডা ওড়ানোর পদ্ধতিটা পাভেলিচরা তাদের গুরুর শিখিয়ে দেয়া পন্থার চেয়েও কঠোরতম পন্থায় প্রয়োগ করে। আর তখনই বাধে গোল। যুদ্ধের পর অবশ্য কম্যুনিস্ট সরকার এই উস্তাশা সংশ্রবের কারণে স্তেফিনাকের বিচার করে, বিচারে তাঁর ষোল বছরের জেল হয়। কিন্তু কয়েক বছর পরেই নানামুখী চাপে তাকে জেলখানা থেকে সরিয়ে নিজ গ্রামে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। সেখানেই বছর কয়েক বাদে তাঁর মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পর ভ্যাটিকান থেকে তিনি পান শহিদের অভিধা। আর যিনি ‘শহিদ’ তাকে আর এই ক্যাথেড্রালে অধিষ্ঠান দিতে বাঁধা কোথায়?

ক্যাথেড্রাল দর্শন শেষে আমি যখন বেরিয়ে আসি, তখন সকালের মিষ্টি শীতল ভাবটা কেটে গিয়ে অল্প অল্প করে সূর্য কিরণ গলে পড়তে শুরু করেছে। আর সামনের ট্রাম স্ট্যান্ডে অফিসগামি জনতার ভিড়টিও বেশ জমে উঠেছে। তাঁদের কেও কেও ট্রামে ওঠার আগে পাশের টং দোকান থেকে টুক করে খবরের কাগজ আর সকালের ক্রশয়া কিনে জোরেশোরে পা চালিয়ে ট্রামের হাতল ধরে উঠে পড়ছেন। পূর্ব ইউরোপের যেসব শহরে এখনও ট্রাম চলে সেসব অনেক শহরেই এখনও সেই পুরনো আমলের ঝনঝনে কিছু ট্রাম চললেও এই জাগরেব শহরের ট্রামগুলো কিন্তু বেজায় আধুনিক। এমন ঝকঝকে ট্রাম দেখলে নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য না থাকলেও মনে হয় চেপে বসি, চলে যাই শহরের অন্য কোন প্রান্তে। আর সবের দেখাদেখি আমিও সেই সেই ট্রাম স্টেশনের পাশের টং দোকান থেকে সকালের কিছু খাবার কিনে আয়েশ করে খেতে খেতে সকালের জনস্রোত পর্যবেক্ষণ করি।

এ তল্লাটেই শুনেছি দোলাচ মার্কেট নামে এক বাহারি বাজার বসে, কিন্তু এই সাত সকালে বোধ করি এখনও সেটি তেমন জমেনি। তাই আমি সেদিকে না চলে বরং শহরের অন্য দিকে পা চালাই। তেমন যে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে আমার, তা নয়। এই এমনই হাঁটা-হাটির মধ্যে এ শহরের গলি-উপগলির সন্ধান লাভ, সেই আমার উদ্দেশ্য। এভাবে চলতে চলতে আমি এক সময় পৌঁছে যাই মার্শাল টিটা স্কয়ারের কাছে। কোন এক নিরামিষাশী রসিক সেই স্কয়ারের কোণের চার মাথায় এক ‘স্টপ’ সাইনের স্টপ কথাটির নিচে লিখে রেখেছে ‘ইটিং অ্যানিম্যাল’। এই চার মাথায় উল্টো দিকে মধ্য গ্রীষ্মের ফুলের ডালি চারদিকে সাজিয়ে বারক স্তাপত্য রীতিতে তৈরি এক অপূর্ব হলদে ভবন এই স্কয়ারের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে। এটি জাগরেবের মূল থিয়েটার ভবন। ভিয়েনার দু স্থপতি ফেলনার এবং হেলমার যারা সারা ইউরোপে আরও চল্লিশটি থিয়েটার ভবনের নকশা প্রণয়নের গৌরবের ভাগীদার, তাঁরাই এই ভবনটির নকশা করেছিলেন সেই প্রায় একশ বছরেরও বেশি আগে। মূল দরজার কাঁচের মধ্য দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বুঝলাম ভেতরে যাবার উপায় নেই, সে সময়ে থিয়েটারটি বন্ধ।

ইলিকা স্ট্রিট ধরে হাঁটছি। এটিই নাকি জাগরেবের সবচেয়ে পুরনো আর দীর্ঘতম সড়ক। গত কয়েকশ বছরে আর সব সড়কের নাম-ধাম পাল্টে গেলেও কোন এক কারণে ইলিকা ঠিকই তার নামটি ধরে রেখেছে। পুরনো হলেও তেমন প্রশস্ত নয় এই সড়কটি, বড়জোর দু তিনটে গাড়ি হয়তো পাশাপাশি চলতে পারে এমন। তবে এর মাঝে দিয়েই আবার চলে গেছে ট্রামের লাইন। এই ইলিকা আর ইয়েলিকিকা সড়কের কোণের হলদে এক পুরনো ভবনের দোতলার কার্নিশের ঠিক নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো ‘সিঙ্গার’ কথাটি দেখে একটু কৌতূহলী হই। আমার মা প্রায় ত্রিশ বছর আগে যে সিঙ্গার সেলাই মেশিনটি কিনেছিলেন সেটি দিয়ে এখনও খুট-খুট করে সেলাইয়ের চাকা ঘোরান। আমি মজা করে মেশিনটির নাম দিয়েছিলাম অক্ষয় কোম্পানি। সেই সিঙ্গারের কোন দোকান আজ অব্ধি বাংলাদেশের বাইরে চোখে পড়েনি। তাই এখানে হটাৎ এই সিঙ্গারের নাম দেখে একটু তো অবাক হবারই কথা। এর আগে একবার স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভায় ‘বাটা’ কোম্পানির একটি দোকান আবিষ্কার করেও এমনই অবাক হয়েছিলাম। সেই সিঙ্গার নাম ঝোলানো ভবনটির নিচতলার বিশাল কাঁচে ঘেরা দোকানগুলোর কাছে এসে বুঝতে পারলাম বহুকাল আগেই হয়তো সিঙ্গার কোম্পানিকে এই দোকানটিকে কোন এক বই-খাতা বিক্রির দোকানের কাছে দিয়ে পাতিতাড়ি গোটাতে হয়েছে।

বুদাপেস্টে যেমন দেখেছিলাম, এ শহরেও অনেকটা তেমনই দেখলাম। দৈন্যের কাছে হার মেনেছে অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত আবাসিক বাড়িগুলো। কোন বাড়ির সামনের ভাগে হয়তো পলেস্তারা কিয়দংশ খসে পড়েছে, কোনটির জানালার পাল্লাগুলো বহুকাল আগেই মরচে ধরে ক্ষয়ে পড়বার অপেক্ষায়। তবুও আর্ট নুভহ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই বাড়িগুলোর বহির্ভাগ এখনও দেখবার মতো। প্রায় কালচে হয়ে আসা একটি বাড়ির এমনই এক কারুকাজের সামনে তো আমাকে রীতিমতো থমকে যেতে হল। কারণ এখানে দেয়ালের গাত্রে কোন মুখমণ্ডল বা নকশা নয়, বরং ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি পুরো দৃশ্য, স্নানের দৃশ্য। এক নগ্ন মা তার কয়েকটি সন্তানকে নিয়ে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ওদিকে স্নানের ভয়ে আরেকটি শিশু মায়ের হাতকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে অন্য দিকে, কি জীবন্ত সে দৃশ্য।

আমার পরের গন্তব্য এই ইলেকা স্ট্রিটের শেষ প্রান্তের এক পাহাড়ে। এটিকে বলা চলে এ শহরের পুরোনতম প্রান্ত, যেটি গড়ে উঠেছিল প্রায় সাতশো বছর পূর্বে। সে পাহাড়ের মাথায় আছে দুর্গের মতো এক ছোটখাটো ভবন। সেই দুর্গের সন্নিবেশে উঁচু রেইন ট্রি ছাওয়া উদ্যানটি থেকে নাকি এই পুরো জাগরেব শহরটিকে এক নজরে দেখে নেয়া যায়। তো সেখানে যাবার জন্যে যখন কিছুটা খাড়া পথের ঢালে হাঁটছি, সে সময়ে পাশের এক হাই স্কুলের এক দঙ্গল ছেলে-মেয়ে স্কুল ছুটির ফাঁকে চুটিয়ে আড্ডা মারছে। শুধু আড্ডাই নয়, মাটির চুলোর উপর পাক খেয়ে উঠে যাওয়া সাদা ধোঁয়ার মতোই সেই ছেলে-মেয়ের জটলাটি থেকে ঊর্ধ্বপানে উঠে যাচ্ছে তামাকের কড়া ধোঁয়া। বলকানে এই একটি বিষয় খেয়াল করেছি, বাস-স্টপ, দোকান, বিমান-বন্দর, স্কুল সবের সামনেই প্রায় সকল বয়সের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ধূমপায়ীদের অস্তিত্ব। বিশেষ করে এমনভাবে একটি স্কুলের সামনে ছেলে-মেয়েদের প্রকাশ্যে ধুমপান করতে দেখে আমার বিষম খাবার অবস্থা হয়। খুব সম্ভবত এই দেশগুলোতে এমন জনসমাগমের স্থানে প্রকাশ্য ধূমপানে কোন বিধি-নিষেধ নেই।

সেই দুর্গের সামনের উদ্যানের এক কোণে নিবিষ্ট মনে এক বৃদ্ধা ছোট ছোট কিছু ফ্রিজ চুম্বকের উপর জাগরেবের কিছু ছবি এঁকে চলেছেন, প্রতিটির দাম ছ ইউরো। পেছনে দাঁড়িয়ে যখন আমি তার আঁকা দেখছি, এমন সময়ে হটাৎ দুম করে এক কান ফাটা বেমক্কা আওয়াজে পিলে চমকে গেল। ভোঁ দৌড় দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে অবশ্য বোমা বা সেই জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলাম না। আমার এই বিহ্বল অবস্থা দেখে সেই বৃদ্ধা হেসে আমাকে সেই দুর্গের সবচেয়ে উঁচু তলার এক জানালার দিকে তাকাতে বললেন, সেখান থেকে তখনও সাদা ধোঁয়া উড়ছে। এমনটি নাকি হয়ে আসছে সেই আঠারো শতকের মাঝামাঝি থেকেই। শুরুতে ওই জানালা থেকে ছোট এক কামান দেগে শহরের বাইরে থাকা অধিবাসীদের দিন শেষে শহরে ঢোকার কথা মনে করিয়ে দেয়া হতো। সেই তিন চারশো বছর আগে তাতার আর তুর্কীদের অনাকাঙ্ঘিত আক্রমণে যখন শহরবাসী পর্যুদস্ত তখন এমনভাবে কামান দেগে সবাইকে শহরে দিনের আলো থাকতেই ফিরিয়ে এনে রাতের জন্যে শহরে ঢোকার মূল ফটকটি বন্ধ রাখা হতো। সে আতঙ্কের যুগ কেটে গেছে বহুকাল আগেই, তবুও শুধুমাত্র সেই রীতিটি রক্ষা করবার জন্যেই প্রতিদিন ঠিক বেলা বারোটায় এই কামান দাগা হয়। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশত আমি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম সেই বেলা বারোটাতেই।

সকালে যখন দোলাচ মার্কেটের পাশ দিয়ে গিয়েছিলাম, তখনও এই বাজারটি পুরোপুরি জেঁকে বসেনি। এই ভর দুপুরে নিশ্চয়ই সেটি তার পুরো পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাই ভাবলাম এ বেলায় দোলাচ মার্কেটে গিয়ে কিছু ফলমূল কিনে নিই বিকেলের জন্যে। খোলা এক চত্বরে আশেপাশের গ্রামের চাষিরা নিয়ে এসেছেন নানা পদের ফল, সবজি, ফুল, হাতে তৈরি নানা পদের ছোটদের খেলার সামগ্রী। সেই যে ছোটবেলায় বৈশাখী মেলায় গিয়ে টমটম গাড়ির সাথে দেখতে পেতাম মেয়েদের খেলার নানা পদের হাড়ি-পাতিল, ঠিক তেমনই এ বাজারেও আছে কাঠের তৈরি মেয়েদের খেলার পুতুলের পালঙ্ক, ঝাড়ু, খন্তা। শুধু কেবল পুতুল খেলার সামগ্রীই নয়, সাথে আছে ক্রোয়েশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধানকারী নর-নারী পুতুল। কিন্তু একটা মজার বিষয় হল এই পুতুলগুলোর, তা সেটি ছেলে পুতুল হোক আর মেয়ে পুতুল হোক, পরনের পোশাক কিন্তু এক নয়। কেন নয় সেটা জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম এই জাগরেব অঞ্চলের মানুষের যে আবহমান পোশাক তার সাথে পূর্ব ক্রোয়েশিয়া আর দক্ষিণ পশ্চিমের অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলের বাসিন্দাদের পোশাকের মাঝে রয়েছে বেশ কিছু পার্থক্য। বিংশ শতাব্দীতে এসে এইসব অঞ্চলেই একই ধরণের আধুনিক পোশাকের চল হলেও, কয়েকশ বছর আগেও নাকি এই পোশাকের ধরণ দেখেই কে কোন অঞ্চলের মানুষ সেটি নির্ণয় করা যেত। এই পুতুলের দোকানগুলোর উল্টোদিকে এক কিষাণি বারো কুনা এক পাউন্ড দরে বিক্রি করছেন মালিনা অর্থাৎ রাস্পবেরি। তবে সবচেয়ে লোভনীয় স্থানটি বোধ করি চেরির দোকানের সামনের স্থানটি। এমন পাকা টসটসে চেরি ফেলে আলগোছে চলে যাবো ততটা দুর্জন আমি নই। তাই ঝটপট প্রায় দেড় পাউন্ড খানেক চেরি তুলে হাতের বোঝা খানিক বাড়িয়ে নিলাম। আশেপাশের এতসব উজ্জ্বল রঙ্গা সবজি আর ফলফলান্তির মাঝেই এক সময় দেখি ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। শুধু মেঘ জমেছে তাই নয়, মিনিট দশেকের ভেতরেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে বাজারের সব দোকানিদের সেদিনের মতো সামিয়ানা গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরতে বাধ্য করলো। বেচারাদের সেদিনের বিক্রি বাটা বুঝি খুব একটা ভালো হল না। ওরা না হয় বাড়ির পথ ধরল, কিন্তু আমি? এই নিঃসঙ্গ শহরে হোটেলের অস্থায়ী ঠিকানাটি বাদে আমার তো ছুটে যাবার মতো আর কোন স্থান নেই, ওদিকে পরের গন্তব্য দুব্রভনিক শহরে যাবার প্লেন ধরবার কথা সেই বিকেলে। হাতে তাই এখনও বেশ কিছুটা সময়। আমি হাত দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট থেকে মাথাটাকে কোনমতে বাঁচিয়ে এই বাজারের পাশের এক কফি শপে ঢুকে বৃষ্টির এই অঝোর ধারাপাত দেখতে থাকি। সাথে সেই দোকানের এক কড়া কফির পেয়ালায় ধীর লয়ে চুমুক চলতে থাকে। ঝুম বৃষ্টি বলে দোকানে খদ্দের তেমন নেই, আমার অল্প দূরে ফোকলা দাঁতের দু বুড়ো এসে বসলেন। তাঁদের অবশ্য কফিতে চলবে না। তারা চেয়ে নিলেন দু বোতল বিয়ার আর কেশো গলায় টানতে থাকলেন সাথে আনা সস্তা সিগারেট। কিছুটা গুমোট সেই কফি শপে সিগারেটের গন্ধে কিছুটা অস্বস্তি বোধ হলেও, কিই বা করার আছে আমার? আমি তো ওদিকে বৃষ্টির হাতে বন্দি।

প্রায় ঘণ্টা খানেক বাদে বৃষ্টির তেজ কিছুটা দমে এলে আমি এবার কফির দাম চুকিয়ে উঠবার তোরজোড় করি। তখনও টিপটিপ করে কিছুটা বারিপাত হয়েই যাচ্ছে। এর মাঝে আর পদব্রজে শহর পরিভ্রমণ সম্ভব নয়। অগত্যা তাই ভাবি হোটেলে ফিরে গিয়ে বরং জানালার কপাট খুলে বৃষ্টির শব্দ শুনি। রাখালের তাড়া খাওয়া ভেড়ার পালের মতো আমি এখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির জল মাড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে আমার হোটেল পাড়ায় পৌঁছুবার চেষ্টা করি। সেই হোটেল পাড়া অর্থাৎ ভ্লাস্কা স্ট্রিটের মাথায় এক খবরের কাগজের স্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছে আবারও বৃষ্টি তেড়ে নামবার ভয়কে উপেক্ষা করেই কয়েক মুহূর্ত একটু দম নেবার জন্যে থামলাম। সেটি একটি বিশেষ কারণে। আমাদের দেশে যেমন পত্রিকা স্ট্যান্ড বলতে বোঝায় খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকা সাঁটা বিবর্ণ কোন দেয়াল আর শুকিয়ে যাওয়া হলদে মলিন আঠার রেখা, এটি মোটেও তেমন কোন পত্রিকা স্ট্যান্ড নয়। এখানে কালো সিমেন্টের আস্তরে ঢাকা গোলাকার এক মোটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই ভ্লাস্কা স্ট্রিটেই জন্মগ্রহণকারী কবি অগাস্ট সেনয়া। আর সেই থামের এক ধারে উৎকীর্ণ আছে সেই কবির একটি কবিতা, অন্য ধারটি বরাদ্দ পত্রিকা বা ওই জাতীয় কিছু সাঁটার জন্যে। কাল রাতে সেই হোটেল খুঁজবার হুজ্জতির পর বেশ তেতে ছিলাম এই পাড়াটির উপর, কিন্তু এ পাড়াতেই কিনা জন্মগ্রহণ করেছেন এমন একজন বিখ্যাত কবি- এ তথ্যটি জানবার পর তেমন কোন বিরাগ আর রইল না।

হোটেলে ফিরে রুমে ঢোকার আগে ম্যানেজারের ঘর থেকে ইনেস আমাকে দেখে বলে উঠলো, ‘কি হে ঘোরাঘুরি ঠিক মতো হল না বুঝি? তোমার কপাল আজ হয়তো একটু খারাপ। ঝকমকে দিনে আমাদের এই জাগরেব শহরটি দেখতে কিন্তু মন্দ নয়’। আমি ইনেসকে আশ্বস্ত করি, ‘যতটুকু ঘুরতে পেরেছি, তাতেই আমি ঢের খুশি। তোমার কি সময় আছে? হাতে কাজ না থাকলে বরং তোমার সাথে কিছু গল্প করা যায়’। ইনেসের বয়স হয়তো হবে মধ্য ত্রিশের কাছাকাছি, আগের স্বামীর সাথে ঘর টেকেনি। গত রাতে যখন হোটেলে এসেছিলাম তখনও হোটেলে ওকে দেখেছিলাম। আমি আসবার পরেও রাত একটা নাগাদ হোটেলে আরেক বোর্ডার আসা অব্ধি নাকি ওকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। সব কিছু সমাধা করে বাড়ি ফিরতে পেরেছে রাত দুটোয়। আবার সেই সকাল দশটা নাগাদ হোটেলে ফিরতে হয়েছে। অর্থাৎ সারাটি দিনই তাকে বরাদ্দ করতে হয় এই চাকরিটি বাঁচাবার জন্যে, একমাত্র যে সন্তানটিকে অবলম্বন করে ও আছে তাকে তো মানুষ করতে হবে। তাই এ ছাড়া আর উপায় কি? সমাজ বিজ্ঞান থেকে স্নাতক পাশ করবার পর ইনেস ব্যাংক থেকে কিছু ঋণ নিয়ে বছর দশেক আগে তৈজসপত্রের এক দোকান খুলে বসেছিল। কিন্তু সে সময়ে নাকি ক্রোয়েশিয়ায় শুরু হয় এক বড়সড় অর্থনৈতিক মন্দা। বাধ্য হয়ে ইনেসকে দোকানের ব্যবসা গুটিয়ে দেউলিয়া হতে হয়। বর্তমানের এই চাকরিতে কষ্ট থাকলেও, মাস শেষে অন্তত কিছু নিশ্চিত বেতন পাওয়া যায়। সেটাই ওর কাছে এখন বড় প্রাপ্তি। ইনেস আমাকে বলে ওদের সরকারের মধ্যে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতিবাজদের কথা, সমাজের বিত্তশালী ভণ্ডদের কথা। মূলত এই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের জন্যেই ক্রোয়েশিয়া খুব দ্রুত অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারছে না। ইনেসের কাছে আমি আরও জানতে চাই সমাজতান্ত্রিক সময়ে রাষ্ট্র প্রবর্তিত যেই সামাজিক সুযোগ সুবিধেগুলো ছিল, সেগুলো আজও বলবত আছে কি? আছে, তবে সামাজিক সুবিধেগুলোর মূল দাবিদার সমাজের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষেরা হলেও উচ্চ শ্রেণির ভণ্ডরাও সে রুটির ভাগ বসাতে পিছপা হন না। আর সেখানেই ইনেসের আপত্তি। উদাহরণ দেবার জন্যে ও বলে, জাগরেব শহরে দরিদ্রদের জন্যে লঙ্গরখানার মতো কিছু বিনামূল্যে খাবার বিতরণের স্থান আছে, সেখানে রাতের আঁধারে অনেক সামর্থ্যবানও গিয়ে লাইন ধরে বিনামূল্যের খাবারের লোভে। এভাবে চললে সরকারের পক্ষেই বা আর কতকাল এই কর্মসূচীকে চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে? আর তখন তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রকৃত অভাবী মানুষ! ওদেশে ইনেসের মতো খেটে খাওয়া মানুষদের এখনও একটা মোটামুটি সুবিধে হল এখনও ওখানে সেই সমাজতান্ত্রিক সময়ের মতো প্রায় বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা পরিসেবাটি পাওয়া যায়। আর এর বাইরে আরেকটি বেসরকারি চিকিৎসা বিমা কিনলে ওষুধপত্র কিনতে নামমাত্র মূল্য লাগে। ইনেস যেমন প্রতি মাসে বিশ ইউরো খরচ করে সেই বেসরকারি চিকিৎসা বিমাটি কিনতে। সেটা ওর জন্যে তেমন কোন বাড়তি চাপ নয়। ভেবে দেখলাম, এরূপ চিকিৎসা ব্যবস্থা আমেরিকাতে রীতিমতো অকল্পনীয়।

ইনেসের সাথে কথা বার্তার মাঝেই ওই ম্যানেজারের পাশের ঘরের টালির ছাদে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার শব্দ শুনতে পাই। কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি আমি। ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল কাঁচের এধারে জমেছে বাষ্প আর ওধারটি বৃষ্টির জলে ঝাপসা প্রায়। ইনেস আমার জন্যে এক কাপ কফি বানিয়ে আনে। মেঘে ঢাকা সেই বাদল দিনের আঁধারে সেই ক্ষুদ্র ঘরটিতে ইনেসের এনে রাখা সাদা কাপটিকে আরও বেশি সাদা মনে হয়। আমি ভুতগ্রস্থের মতো সেই ঘরে একা কফির পেয়ালা নিয়ে বসে থাকি আর পরের গন্তব্যের জন্যে ছক কষতে থাকি।


মন্তব্য

মন মাঝি এর ছবি

চলুক দারুন!

****************************************

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

ধন্যবাদ মন মাঝি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভাবলাম সেই জিন্স জ্যাকেট বদলে আবেদনময়ী ফ্রক পরা বালিকার ছবিটবি দেবেন, তা না খালি ইঁট কাঠের ছবি মন খারাপ
যাহোক, লেখায় একটু প্যারা কেটে দিলে পড়তে বেশি সুবিধা হবে।
যাওয়ার কপাল তো হবে না, পড়ে আর দেখেই মন জুড়াই মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হে হে, পরের বার ইট কাঠের বদলে বাস্তবের মানুষদের ছবি বেশি দেবার চেষ্টা করবো

অতিথি লেখক এর ছবি

এইটা কি হলো !! অ্যাঁ আমি জন্মকূপমণ্ডুক আর সেই আমি কিনা আপনার রচনাশৈলীর রূপে মুগ্ধ হয়ে টো টো করে আপনার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলাম। অদ্ভুত সুন্দর লেখেন আপনি। লেখার সাথে ছবি গুলো মিলিয়ে বুঁদ হয়ে পড়ছিলাম। আমি ভাবতাম ভ্রমনবৃত্তান্ত আমার চরম অপছন্দের বিষয়, কিন্তু কি হতচ্ছাড়া নেশা ধরিয়ে দিলেন আপনি।

সোহেল ইমাম

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

একজনকে হলেও যে নেশা ধরাতে পেরেছি সেটা আমার পরম সার্থকতা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

অতিথি লেখক এর ছবি

উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত = ওঠো, জাগো, তোমার প্রাপ্য তুমি বুঝে নাও।

অ্যালোসিয়াস ভিক্তর স্তেপিনাক ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৬০ সালে মরার সময় পর্যন্ত জাগ্‌রেবের ক্রোয়াট ক্যাথলিকদের আর্চবিশপ ছিল। এই বাক্যটা থেকে বোঝা যায় স্তেপিনাক জীবনে যা কিছুই করে থাকুক ক্রোয়াট ক্যাথলিকরা কখনো স্তেপিনাকের ওপর থেকে ঈমান হারায়নি, এবং তারা স্তেপিনাককে ধোয়া তুলসীপাতা মনে করে। সুতরাং এই ক্রোয়াটদের মধ্য থেকে উস্তাশাদের মতো চরম জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ছাগুগোষ্ঠী বের হওয়াটা স্বাভাবিক। নাস্তেক জোসিপ ব্রোজ তিতো’র সরকার স্তেপিনাককে লঘু দণ্ডই দিয়েছিল (১৬ বছরের আরামদণ্ড), কিন্তু সেটাও যে ক্রোয়াটদের সহ্য হয়নি তা থেকে বোঝা যায় কমিউনিস্ট আমলেও উস্তাশাদের প্রভাব খুব একটা কম ছিলনা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্তেপিনাক কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে ইতালী ইসোনজো ফ্রন্টে লড়ে সেখানকার রোমান ক্যাথলিকদের কচুকাটা করেছিল। ভগবানের কী লীলা! তার ১৫ বছরের মধ্যে স্তেপিনাক জাগ্‌রেবের ক্রোয়াট ক্যাথলিকদের আর্চবিশপের সহযোগীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে যায়, আর তারও ৭ বছর পরে সে খোদ আর্চবিশপই বনে যায়।

১৯৪১-এর ১০ই এপ্রিল উস্তাশারা স্বাধীন ক্রোয়াট রাষ্ট্রের (এনডিএইচ) ঘোষনা করে। সেদিনই জাগ্‌রেবে জার্মান ট্যাঙ্ক ঢোকে আর উস্তাশারা তাদের স্বাগত জানায়। যুদ্ধের পরবর্তী দিনগুলোতে উস্তাশারা বসনিয়াক মুসলিমদের সাথে জুটি বেঁধে সার্ব অর্থোডক্স, যাযাবর রোমা আর জাতি নির্বিশেষে ইহুদীদের কচুকাটা করেছে। স্তেপিনাক শুরু থেকেই উস্তাশা আর এনডিএইচের পক্ষে ছিল। উস্তাশাদের জনসভায় তাদের পক্ষে বক্তৃতাও দিত। স্তেপিনাকের এমন অবস্থানের পেছনের শক্তিটা হচ্ছে খোদ ভ্যাটিকান। গোটা যুদ্ধের সময়কালে ক্রোয়াট ক্যাথলিক আর বসনিয়াক মুসলিমদের দ্বারা সার্ব অর্থোডক্স, যাযাবর রোমা আর জাতি নির্বিশেষে ইহুদী গণহত্যার ব্যাপারে ভ্যাটিকান আশ্চর্য নীরব ছিল। নিজের বিবেক বিক্রি করে দিয়ে উস্তাশাদের সমর্থনের পুরস্কার স্তেপিনাক ভ্যাটিকানের কাছ থেকে ঠিকই পেয়েছিল। তিতো সরকার স্তেপিনাকের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে কারাদণ্ড দিলে ভ্যাটিকান নিজে আর তার মুরিদরা স্তেপিনাককে ছেড়ে দেয়ার জন্য যুগোশ্লাভিয়ার ওপর চাপ দিতে থাকে। এমন অবস্থাতেই ১৯৫২ সালে পোপ দ্বাদশ পিউস স্তেপিনাককে কার্ডিনাল পদে অধিষ্ঠিত করে। ১৯৯৮ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল জাগ্‌রেবে গেলে ৫ লাখ ক্রোয়াটের সমাবেশে স্তেপিনাককে শহীদ ঘোষনা করে। ভ্যাটিকানের ‘অবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট’ এভাবে তার প্রাপ্য মরার পরেও বুঝে পায়।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দুটো বিষয় এখানে বলবো।

এক, একথা সত্য যে ভ্যাটিকান কখনো এনডিএইচকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি কিন্তু ১৯৪১-এর অগাস্টেই পোপ দ্বাদশ পিউস প্যাপাল নুনচিও জিউসেপ্পে রামিরো মার্কোনীকে ভ্যাটিকানের প্রতিনিধির মর্যাদায় জাগ্‌রেবে পাঠায়। এতে সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না। মার্কোনী তার কার্যকালে উস্তাশাদের প্রধান পাভেলিচের সাথে বেশ খাতির রেখে চলেছে। এনডিএইচ-এর প্রতিনিধিরাও ভ্যাটিকানে নিয়মিত আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ রেখে চলেছে। ১৯৪২ সালে জার্মানরা যুদ্ধে জিততে থাকলে ভ্যাটিকান এনডিএইচ-এর সাথে আরও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কে জড়াতে থাকে। ভ্যাটিকান খুব ভালোভাবেই এনডিএইচ-এ চলমান গণহত্যার খবর জানতো, কিন্তু কখনো এই ব্যাপারে এনডিএইচ-কে নিষেধ বা তিরস্কার করেনি বা এনডিএইচ-এর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেনি। উস্তাশাদের আধ্যাত্মিক গুরু, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ক্রনোশ্লাভ দ্রাগানোভিচ্‌কেও ভ্যাটিকান কখনো তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়নি। ’দশ বছরের মধ্যে সার্বমুক্ত ক্রোয়েশিয়া (+বসনিয়া)’ অথবা ‘সার্বদের এক তৃতীয়াংশকে মারো, এক তৃতীয়াংশকে তাড়াও আর এক তৃতীয়াংশকে ক্যাথলিক বানাও’ অথবা ‘একজন ভালো উস্তাশা হচ্ছে সে, যে ছুরি দিয়ে কেটে সার্ব নারীর গর্ভ থেকে বাচ্চা বের করে আনতে পারে’ – এনডিএইচ কর্তৃক এমনসব প্রকাশ্য ঘোষনা ভ্যাটিকানের না জানার কোন কারণ ছিল না। এনডিএইচ এই ব্যাপারে কোন রাখঢাকও করেনি। ভ্যাটিকান হয়তো অর্থোডক্সদের বিলুপ্তি আর ক্যাথলিকদের বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ৫ লাখ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করাটাকে বিবেচ্য বিষয় বলে মনে করেনি। শুধু এখানেই শেষ না, যুদ্ধশেষের প্রাক্কালে উস্তাশার নাটের গুরুদের পালিয়ে যাবার ব্যাপারে ক্যাথলিক চার্চ ও ভ্যাটিকানের প্রত্যক্ষ সহযোগীতা ছিল। কাউকে কাউকে (যেমন পাভেলিচ) তারা আশ্রয় দিয়ে লুকিয়েও রেখেছিল। যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয় তখনও ভ্যাটিকান মিত্রশক্তির ওপর চাপ দিয়ে গেছে যেন উস্তাশা নেতাদের কোন বিচারের সম্মুখীন করা না হয়। বিচারে যাদের শাস্তি হয়েছিল তাদের শাস্তি হ্রাসের ব্যাপারে যুগোশ্লাভিয়াকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেছে। জানি না সভ্য পৃথিবী কখনো ভ্যাটিকানের এই অবস্থান ও আচরণের প্রশ্নে ভ্রূকুটি তুলে দাঁড়াবে কিনা।

দুই, এনডিএইচ-কে যারা যারা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল তারা হচ্ছে – হাঙ্গেরী, জার্মানী, ইতালী, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, জাপান, স্পেন, মাঞ্চুকো (জাপান অধিকৃত মাঞ্চুরিয়ার পুতুল সরকার), ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, থাইল্যান্ড, জাপান অধিকৃত চীন, জাপান অধিকৃত বার্মা, জাপান অধিকৃত ফিলিপাইন। এর বাইরে আরও একজন এনডিএইচ-কে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন – তিনি হচ্ছেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস! ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত জার্মানীতে হিটলার সরকারের রাষ্ট্রীয় সহায়তায় থাকা নেতাজী যেমন নাৎসীদের চালানো গণহত্যা দেখতে পাননি বা সে ব্যাপারে কিছু শুনতে পাননি, তেমন তিনি আন্তে পাভেলিচ, মিলে বুদাকদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রকাশ্য হুমকিগুলো খবরের কাগজে পড়তে পাননি, রেডিওতে শুনতে পাননি। কাছাকাছি থেকেও ক্রোয়েশিয়ায় লাখ লাখ মানুষকে খুন করা হচ্ছিল সে সম্পর্কেও কিচ্ছুটি জানতে পারেননি। জানি না ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ কখনো নেতাজীর এই অবস্থান ও আচরণের প্রশ্নে ভ্রূকুটি তুলে দাঁড়াবে কিনা।

দূর থেকে তোলা ছবি দিলে বারোক স্থাপত্যের মাহাত্ম্য আর কতটুকু বোঝা যাবে। বারোকের বৈশিষ্ট্যই তো তার সূক্ষ্ম, জটিল কারুকাজে। একটু আফসোস থেকে গেলো।

ইফতিখার আহমেদের শাসনামলে ব্রাদার্স, জুকিদের মতো নবাগতদের কাছে ‘সিঙ্গার’-এর ব্যবসায় যে ধ্বস নামে তাতে অনেক দেশেই সিঙ্গার ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে মাহবুব জামিলের সিঙ্গার এখন আরও দশটা ব্রান্ডের পণ্যভরা বাজারের আর যে কোন দোকানের মতো হয়ে গেছে।

ন্যুভ স্থাপত্যরীতির ভবনের প্রাচীরের গায়ে আঁকা স্নানের দৃশ্যের ফ্রেসকো দেখতে না পাওয়া আরেকটা আফসোস তৈরি করলো।

ধূমপানের ব্যাপারে একটা অসমর্থিত পর্যবেক্ষণের কথা জানি। সকল বর্তমান ও সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে ধূমপানের হার নাকি অনেক বেশি হয়। অবশ্য সারা দুনিয়ার বিড়িখোরদের হিসাব করলে দক্ষিণ ইউরোপের ধারেকাছে কেউ নাই। আর সাবেক যুগোশ্লাভ দেশগুলো একেবারে পয়লা কাতারে আছে। সুতরাং জাগ্‌রেবের লোকজনের মাথার উপর দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া দেখতে পাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

ওসমানীয়রা জাগ্‌রেবে কবে আক্রমণ করেছিল? ১৪৯৩ থেকে ১৫৯৩ পর্যন্ত ক্রোয়াটদের সাথে ওসমানীয় সালতানাতের চলা যুদ্ধ মূলত মধ্য-পূর্বাঞ্চলে হয়েছিল। জাগ্‌রেব তো সেখান থেকে অনেক দূর! ১৫৯৩ সালে সিসাকের যুদ্ধে ওসমানীয়দের পরাজয়ের পর ১৬৯৯ সাল পর্যন্ত আরও কিছু টুকটাক যুদ্ধ চলেছে, কিন্তু তার সবই বসনিয়া সীমান্তে। জাগ্‌রেব মোটামুটি পুরোটা সময়েই ওসমানীয় আক্রমণ থেকে নিরাপদ ছিল।

অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা করে, বহু শতাব্দী ধরে ক্রোয়েশিয়াতে আশেপাশের সব জাতির মানুষজন জড়ো হয়েছে। স্থানীয় ক্রোয়াটদের বাইরে স্থানীয় সার্ব, স্থানীয় বসনিয়াক, গোরানী, পোমাক, ইতালীয়, দালমেশিয়, আলবেনিয়, রোমা, ম্যাগিয়ার, স্লোভেনিয়, চেক, মন্টেনিগ্রান, মাকেদোনিয়, অস্ট্রিয়, জার্মান জাতির মানুষের দেশ এটা। সুতরাং এদের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, আচারে ব্যাপক বৈচিত্র্য থাকাটা স্বাভাবিক। পুতুলের আকার-চেহারা-পোশাকে সেই বৈচিত্র্য ধরে রাখার ব্যাপারটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক। মানতেই হবে লেখকের দৃষ্টি বেশ প্রখর।

আশেপাশের দেশগুলোতে ক্রোয়েশিয়ার তাজা ফলের বেশ চাহিদা আছে। বিশেষত এর বেরি গোত্রের ফলগুলো আর আঙুর। আপনি তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হননি জেনে ভালো লাগলো। ইয়ে, মানে শুনেছিলাম ক্রোয়েশিয়ার আঙুরের রস থেকে বানানো সাদা পানীয়ের নাকি বেশ সুনাম আছে। বিশেষ করে Vrhunsko Bijelo Vino‘র। আপনি কি অমন কোন সাদা পানীয় চাখার সুযোগ পেয়েছিলেন?

অগাস্ট শোনোয়াকে কবি বলাটা কি ঠিক? অবশ্য এটা ঠিক যে সবচে’ জনপ্রিয় ক্রোয়াট দেশাত্মবোধক গানটা তাঁরই রচনা। কিন্তু শোনোয়া মূলত ঔপন্যাসিক। মাত্র ৪৩ বছর বাঁচা শোনোয়া আধুনিক ক্রোয়াট কথাসাহিত্যের জনক। শোনোয়ার ভাস্কর্যটার কি ছবি তোলেননি?

আপনি কবে ক্রোয়েশিয়া গিয়েছিলেন? ২০০৯-এর পর থেকে ওদের অবস্থার তো ভালোই উন্নতি হয়েছে। অবশ্য বলকানরা খুব বেশিদিন ঠোকাঠুকি না লাগিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর জাতি না। এরা আফগানদের মতো পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়।

আচ্ছা, আমরা দেশটাকে ক্রোয়েশিয়া বলি কেন? দেশটার নাম তো Hrvatska (বাংলায় উচ্চারণটা লিখলে ‘খহ্রবাৎস্কা’ ধরনের কিছু একটা হবে)!

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

বলকান নিয়ে কিছু লিখতে হলে আমাকে একজনের কথা মাথায় রেখে লিখতে হয়, যিনি আমার চেয়েও বলকান নিয়ে ঢের বেশি জ্ঞান রাখেন। ফেলুদা যেমন কিছু জানতে হলে যেতেন সিধু জেঠার কাছে, তেমনি আমিও এই বলকান বিষয়ক কিছু লেখার আগে সুযোগ থাকলে আপনার কিছু পরামর্শ চেয়ে নিতাম হাসি

এখানে প্রাপ্য বলতে কি জ্ঞান কেই বোঝানো হয়নি?

এন ডি এইচ কে স্বীকৃতি দান নিয়ে ভ্যাটিকানের অবস্থান সম্পর্কে আমার জানা ছিল না, আমি আমাকে এ ব্যাপারে সমৃদ্ধ করলেন। আর স্টেফিনাক এবং পাভেলিচ কে নিয়ে বলা আপনার প্রতিটি কথায় ঠিক, আমি ইচ্ছে করেই ও ব্যাপারে মূল লেখায় বেশি কিছু লিখতে চাই নি.. ইতিহাসের ভারটা বেশি চলে আসে বলে.

সুভাষ বোস সম্পর্কে আপনার এই পর্যবেক্ষণ টিও আমাকে নতুন করে ভাবলো, এ নিয়ে আরো তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবো।

ইফতিখার আহমেদ কে?

জাগরেব ওসমানীয় আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকলেও, আক্রমণের আশংকাটি পুরো মাত্রায় ছিল. এর আরেকটি প্রমাণ দেখেছি সেই জাগরেবের ক্যাথেড্রাল দেখতে গিয়ে। সেই ক্যাথেড্রালের তিন দিকে বেষ্টনী করে এক বিশাল দুর্গসম প্রাকার আছে, যেটি ১৫১২ সাল থেকে ১৫২১ সালের মধ্যে তৈরী করা হয়েছিল। সেটি তৈরী করা হয়েছিল অটোমান আক্রমনের ভয় থেকেই।

নারে ভাই, এবারের যাত্রায় ওই সাদা পানীয় চাখার সুযোগ পাই নি. আমি গিয়েছিলাম গত বছর. বিগত বছর গুলোতে এরা কিছুটা উন্নতি করেছে বটে, তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের দুর্নীতি পুরোপুরি হটাতে পারে নি.

অগাস্ট সেনোযার ছবিটি তোলা হয়নি। তখন একটু বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই ব্যাগের ভেতর থেকে আর ক্যামেরা বের করবার সাহস পাইনি। সেখানে সেনওয়ার একটি কবিতা উত্কীর্ণ থাকায় আমি ভেবেছিলাম তিনি শুধুই কবি.

শেষ প্রশ্নটির উত্তর আমার জানা নেই. ভবিষ্যতে কোনো ক্রয়েশিয়ানের সাথে দেখা হলে এর উত্তর টি জানবার চেষ্টা করবো।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি আমার সাথে পরামর্শ করে লিখতে যাবেন কেন? আপনি লিখবেন — যা আপনি দেখেছেন, শুনেছেন, জেনেছেন। তাতে পাঠক একটা জেনুইন বা অথেনটিক লেখা পড়তে পায়। পাঠক লেখা পড়ে তার নিজের মতামত জানাবে — এইটুকুই।

আমি আক্ষরিক অনুবাদ দিয়েছি। ‘প্রাপ্য’কে ‘জ্ঞান’ মনে করার স্বাধীনতা আপনার আছে।

ভ্রমণের গল্পকে ইতিহাস দিয়ে ভারাক্রান্ত করার দরকার নেই। লেখাটা পড়ে ইতিহাসের কথা মনে পড়ায় আমি ওসব বলেছি। শুধু ভ্যাটিকান আর নেতাজী নয়, পূর্বজ্ঞানের চশমাটিকে খুলে, বিদ্যমান ভালোলাগা-মন্দলাগাকে সরিয়ে রেখে যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস পড়েন তাহলে দেখবেন আপনার কাছে অনেকের কাছা খুলে গেছে।

ইফতিখার আহমেদ কে সেটা জানতে এই লিঙ্কটা দেখুন আর এই খবরটা পড়ুন

ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো। ওসমানীয় আক্রমণের সরাসরি শিকার না হলেও জাগ্‌রেবে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হতেই পারে। সীমান্তে যুদ্ধে হারলে আলটিমেটলি জাগ্‌রেব তো আক্রান্ত হতোই।

ক্রোয়াট সাদা পানীয় মনে হয় আপনি যেখানে বাস করেন সেখানেও একটু খাটাখাটুনি করলে পেয়ে যেতে পারেন। তবে জায়গায় বসে টাটকা স্বাদ নেয়া আর মহাসমূদ্র পাড়ি দেয়া জিনিসের স্বাদ নেয়া তো আর এক নয়! যাকগে, কপালে না থাকলে কী আর করা!

কোন দেশের রাজনীতির অঙ্গন থেকে দুর্নীতি তো দূর হবে না, তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাবেক যুগোশ্লাভ রিপাবলিকগুলোর মধ্যে ক্রোয়াটদের সবচে’ ভালো করার কথা। সেটা এখনো হয়ে উঠছে না সেটা দুঃখজনক।

শোনোয়ার ঐ ভাস্কর্যের ছবি দেখলাম নেটে পাওয়া যায়। কাস্টিং করা ভাস্কর্যটার উপস্থাপনায় বেশ মুন্সিয়ানা আছে — দৃষ্টিনন্দন! ছবিটা দেখে মনে হলো এই আঙিনাটাতে আপনি হেঁটেছেন! ঈর্ষান্বিত হবার হয়তো কথা ছিল, কিন্তু তা হলাম না। ভ্রমণের জন্য আপনার যে প্রচেষ্টা, ত্যাগ আর আকাঙ্খা সেটা আমি কখনো অর্জন করতে পারবো না। সুতরাং খামাখা ঈর্ষান্বিত হবো কেন!

ক্রোয়েশিয়ার নাম নিয়ে এখানে উইকি কিছু বলেছে। কিন্তু সেটা পড়েও বিশেষ কিছু বুঝলাম না।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

হুমম ইফতিখার আহমেদের ব্যাপারটা বুঝলাম, ধন্যবাদ সমৃদ্ধ করার জন্যে

অর্ণব এর ছবি

আপনি দুদিনের জন্য ঘুরতে গিয়ে স্থানীয়দের থেকে বেশি ইতিহাস জেনে আসেন। কিভাবে পারেন? গুরু গুরু

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আমার স্বল্প প্রচেষ্টাতে যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করি. পড়বার এবং মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

লতিফুল কবির এর ছবি

ভ্রমনের কাঁধে ভর করে যে গল্প এলো, তাঁর দাম ভ্রমনের চেয়ে কোন অংশে কম না। ধন্যবাদ আপনাকে।

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ লেখাটি পড়বার এবং মন্তব্যের জন্যে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।