আমার আরও একটি লেখা 'প্রথম আলো' পত্রিকার চিঠিপত্র কলামেও ঠাঁই হল না । এ নিয়ে তিনটি লেখা, এবং তিনটিই শিক্ষা-বিষয়ক ( ঢাকা বোর্ডে পরীক্ষার খাতা উত্তোলন করতে গিয়ে শিক্ষকরা কতটা হেয় প্রতিপন্ন হন এবং আত্মসম্মানবোধ কতটা নিচে নামিয়ে ফেলেন সে সম্পর্কে একটি লেখা এবং পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা বহুকাল ধরে চলছে সে সম্পর্কে একটি ) , প্রথম আলোর বিজ্ঞ সাবএডিটর তাঁর টেবিলের নিচের ডাস্টবিনে স্থান দিয়ে আমাকে কৃতার্থ করেছেন। অথচ প্রায় একই বিষয় নিয়ে গতকালও একটি চিঠি তারা ছেপেছে দেখলাম। আফজাল রহমান নামের একজন বিজ্ঞ গবেষক, যিনি একটি সরকারি কলেজের শিক্ষকও, একপ্রস্থ লিখেছিলেন 'প্রথম আলো'র উপসম্পাদকীয় পাতায়। তার মতামতের সাথে কিছু বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়ে আমি নাতিদীর্ঘ একখানা লেখা 'প্রথম আলো' তে মেইল করে পাঠাই ঈদের আগে। মেইল করে এর আগেও আমি সেখানে লেখা পাঠিয়েছিলাম যা যথারীতি আলোর মুখ দেখে নি। তাই কিঞ্চিৎ সন্দেহ থেকে ঈদের পর 'প্রথম আলো' পত্রিকাতে ফোন করে 'চিঠি-পত্র' কলামের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাধর সাবএডিটরকে বিষয়টি জিগ্যেস করতেই এক নারী কণ্ঠ ওপার থেকে জানালো, মেইলে পাঠানো সবলেখাই তারা সংগ্রহ করেন তবে লেখা পাঠালেই ছাপা হবে এমন ধারণা করা আমার উচিত নয়। আমি অবশ্য সে ধারণা করি নি কারণ এ উত্তরটা আমার অজানা নয়। ধরে নিলাম, আরও একটি লেখার অপমৃত্যু হল। মজার ব্যাপার হল এই 'প্রথম আলো'ই আমার একই চিঠি এক সপ্তাহের ব্যবধানে দু'বার ছেপেছিল। যাকগে, মনের ভেতর অনেকদিনের পুঞ্জীভূত কিছু ক্ষোভ-হতাশা-আশঙ্কার সংযত বহিঃপ্রকাশ ছিল লেখাটি তাই ভার্চুয়াল পাঠক-কমিউনিটির জন্য আপলোড করে দিলাম। কী জানি, হয়ত লেখার বানান ঠিক নেই, ভাষাও হয়ত দুর্বল, বিষয়টিও হয়ত সময়ের সাথে তাল মেলানো নয়-আপনারাই বিচার করুন।
আমি 'তালেব মাস্টার' এর পরিণতি চাই না
গত ৯ অক্টোবর তারিখে প্রথম আলোতে আফজাল রহমানের লেখা “আরও একজন 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক' এর জবানবন্দি”- লেখাটি পড়ে বুকের ওপর চেপে বসা অনেক দিনের পুরোনো ভারটি কিছুটা হালকা হল বলে মনে হচ্ছিল। লেখককে ধন্যবাদ জানাই। তার পর্যবেক্ষণ যেমন সত্য তেমন সত্য তার উপলব্ধি। তবে শিক্ষকদের আদর্শচ্যুতি, মনোনিবেশের সঙ্কট, ব্যবসায়িক মনোভঙ্গি সম্পর্কে তার বক্তব্য সর্বাংশে মেনে নিতে পারছি না বলেই এ লেখার অবতারণা। হতে পারে তীব্র হতাশবোধ থেকেই তিনি এ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতই একই ভাবনায় উজ্জীবিত আমিও প্রায় একদশক আগে এই মহান পেশায় যোগ দেই। তখনকার সময়ের লোভনীয় বেতনের চাকুরি ছেড়ে, আজন্ম লালিত নাগরিক মানসিকতাকে বাক্সবন্দী করে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেয়ার বছর খানেকের মধ্যে জনাব আফজালের মত একই হতাশায় আমিও ডুবেছি। তখনও আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মিদের কেউ কেউ এ পেশার অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে আমাকে সতর্ক করেছিল। তাদের সতর্কবাণী এখন আমার সতর্কবাণী। জানি না এখন যারা যোগ দিচ্ছে এ পেশায় তারাও কি এভাবে ভাবছে কি না ?
আমার বিষয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হওয়া সত্বেও বছরের পর বছর এমনসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণের চেষ্টা করেছি যাদের প্রাথমিক শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়াটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। অথচ আমারই অনেক সহকর্মী যাদের অনেকে হয়ত দেশের শীর্ষস্থানীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখারও সুযোগ পায়নি তারা অবলীলায় ঢাকার বড় বড় কলেজের শিক্ষক হয়ে বসে আছেন। আমিও দেখেছি, সন্তানকে নামকরা স্কুলের একজন শিক্ষকের বাসায় ব্যাচে পড়াতে কেবল নাম লিখানোর জন্য অভিভাবক দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু জনাব আফজালের সাথে আমি ভিন্নমত পোষণ করি অন্যএক বিবেচনায়। যখন শিক্ষকতাকে বেকারত্ব দূর করার এক মোক্ষম পেশা হিসেবে বিবেচনা করার রাষ্ট্রীয় ছেলেখেলায় পড়ে সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের করুণা আর তাচ্ছিল্যের শিকার হন শিক্ষক তখন আমার সেবাদানের মানসিকতা ধূলায় মিশে যায়। যখন সহস্রাধিক পদ খালি থাকা সত্বেও শিক্ষকদের পদোন্নতি হয় না অথচ কল্পিত পদ সৃষ্টি করে কোনো কোনো পেশায় উপর্যুপরি পদোন্নতি চলতে থাকে তখন নিজকে স্বান্তনা নয় ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হয়। এমনকি সরকারি চাকুরির ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকে বছরের পর বছর ধরে যখন শিক্ষকগণ বঞ্চিত থাকেন তখন ভাবি আগামীতে যারা আলো মনে করে এ আগুনে ঝাঁপ দেবে তাদের জন্য আমরা কি রেখে যাচ্ছি ? তাই আশরাফ সিদ্দিকীর সেই 'তালেব মাস্টার' কবিতার কথা মনে পড়লে প্রায়ই অজানা আশঙ্কায় শিহরিত হই ,ত্যাগের পরাকাষ্ঠা এক শিক্ষকের মর্মান্তিক উচ্চারণ- 'আমি যেন সেই হতভাগ্য বাতিওয়ালা/ আলো দিয়ে বেড়াই পথে পথে কিন্তু নিজের জীবনই অন্ধকারমালা।' নিজকে আমি তালেব মাস্টারের পরিণতির সাথে মেলাতে চাই না বলেই জনাব আফজালের সাথে একমত নই।
নকল প্রতিরোধ করতে গিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ লাঞ্ছিত-আহত হলে তাঁকে হাসপাতালে গিয়ে উত্সাহ দেয়া দূরে থাক, স্বান্তনা দিতেও কাউকে যেতে দেখি না। অন্যদিকে হরতালে ঢিলের আঘাতে আহত পুলিশ কনস্টেবলকে দেখতে মন্ত্রী-এমপি-কর্তাব্যক্তিদের মিছিল শুরু হয়ে যায়। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় বটে কিন্তু শিক্ষকের সমস্যা নিয়ে কোনো গোল টেবিল বৈঠক হয় না, অথচ সর্বস্তরে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কোন কোন পেশায় বেতন-ভাতা বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার টেবিলে ঝড় উঠে যায় এমনকি তাকে দেশি-বিদেশি অর্থে বারবার ঢেলে সাজাতেও উৎসাহের ঘাটতি দেখি না। ঢাকা শহরের অনেক ভিক্ষুক বা রিকশাচালকের মাসিক আয় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বেতনের চেয়ে বেশি তাতে কি কেউ বিস্মিত হয় ? শিক্ষকের বেতন বাড়ানো বা তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কি কি করা দরকার সে গবেষণা ক'জন করে? নিবেদিতপ্রাণ, যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো শিক্ষককে মূল্যায়নের কী ব্যবস্থা আমাদের দেশে আছে, প্রশ্নগুলো আমি জনাব আফজালকে করতে চাই। জনাব আফজাল সৌভাগ্যক্রমে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন অথচ হাজার হাজার শিক্ষক যোগ্যতা থাকা সত্বেও এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এসব দেখে আর যাই হোক আত্মসচেতন, উচ্চাকাক্সক্ষী কোন মানুষ এ পেশা বাছাই করবে না। কিন্তু আশার কথা হলো এখনো মেধাবীরা এ পেশায় আসছে, আসছে কারণ কিছু শিক্ষক এখনো অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন আগুনের শিখার মধ্যে ফুল ফোটাতে, শিক্ষকতা পেশার দৈন্য ঘুচাতে।
তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকবেলা করতে হলে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে হবে; যেভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তরুণ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করছে। সরকারী অন্যান্য চাকুরির সাথে পেশাগত বিবেচনায় শিক্ষকতা পেশাটি অনেক পিছিয়ে আছে; বলা যেতে পারে চরম অবহেলার শিকার। এসব বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে উপরন্তু শিক্ষকদের জন্য ভিন্ন বেতন কাঠামো করতে হবে। কতজন শিক্ষক বা শিক্ষিত বাবা-মা তাদের সন্তানকে শিক্ষকতা পেশায় দেখতে চান, এমন একটি গবেষণা যদি করা যায় তাহলেই জাতির ভবিষ্যত দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যাবে। গবেষণাটি হওয়া খুব জরুরি।
মন্তব্য
আপনি নকল ধরা অধ্যক্ষের লাঞ্ছিত হ্ওয়ার সাথে জনগনের খেদমতকারদের আঘাতের তুলনা করেছেন, তাও আবার এই বিশেষ মুহূর্তে! ধন্য আপনার লেখা প্রকাশের আশা।
প্রথম আলো একটা সংবাদপত্রের চেয়ে বেশী ব্র্যান্ড নাম।এদেশের নব উত্থিত বাজার অর্থনীতির অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক হস্ত (হস্তের রং হতে পারে কালো কিংবা লাল)।এদের সবকিছুই নিজস্ব।হতে পারে পত্র লেখকদেরও একটা অনুমোদিত প্যানেল আছে।হয়তো আপনার নাম সেখানে এনলিস্টেড নাই।অতএব ভবিষ্যতে ওইখানে পত্র ছাপানোর দূরাশা না করাই ভাল।
আর একটা কথা।যে কথাটার জন্য এত প্যাচাল।সংবাদপত্র হিসাবে প্রথম আলোর চরিত্র ও ভুমিকা কি-এ নিয়ে কখনো ভেবেছেন কি?দেখুন,তালিকায় যখনি লতিফ সাহেবের নাম এলো-সাথে সাথে ফর্মুলা ট্রুথ কমিশন আবিস্কৃত হলো।
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
এ মিলটার কথা ভাবি নি। তবে সেই যে জয় গোস্বামীর কাব্য...
'আমরা তো অল্পে খুশি / কি হবে দুঃখ করে
আমাদের দিন চলে যায় /সাধারণ ভাত-কাপড়ে'
- এটাই মোদ্দা কথা।
--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।
নতুন মন্তব্য করুন