পৃথিবীর পথে পথে, সেই পথ যেন না শেষ হয় (পর্ব ৬: গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন)

মইনুল রাজু এর ছবি
লিখেছেন মইনুল রাজু [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/১১/২০১৪ - ৫:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এই গিরিখাত পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতমও নয়, দীর্ঘতমও নয়। তবু, তার নামের আগে 'গ্র্যান্ড' কথাটা ঠিকই মানিয়ে গেছে। শুধু মানিয়ে গেছে বললে ভুল হবে, বলতে হবে, যথার্থই মানিয়ে গেছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মাহাত্ম্য তার দৈর্ঘ্য কিংবা গভীরতায় নয়, তার মাহাত্ম্য বুকের মধ্যে আগলে রাখা বুড়ো পৃথিবীর ইতিহাসে। স্তরে স্তরে সাজানো সে ইতিহাস। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সে-ইতিহাস মুখে বলে না, বরং মাটির ফাঁদে বন্দী করে প্রদর্শন করে দর্শকের চোখে; প্রদর্শন করে কাল, সময়, বেলা, কালবেলা।

আজ থেকে দশ হাজার বছর আগের কোনো এক বস্তু ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হলে, অনুসন্ধিৎসু মন মাত্রই রোমাঞ্চিত হবে। কল্পনার পালে হাওয়া লাগিয়ে ভাবতে চেষ্টা করবে- কি ছিলো এই পৃথিবীতে, কারা ছিলো এই পৃথিবীতে; দশ হাজার বছর আগের সে-দিন, কোন সে মরুর উষ্ণ বায়ে তপ্ত হতো বালি, কোনো সে জলের শীতল ছোঁয়ায় সিক্ত হতো ভুমি। আর, সেখানে যদি বলা হয় হাজার নয়, লাখ নয়, মিলিয়ন নয়, বরং বিলিয়ন বছর আগের নিদর্শন উন্মুক্ত করে ধরে রেখেছে কোনো এক হতচ্ছাড়া তীর্থস্থান, তাহলে সে তীর্থস্থান যতটুকু না অবাক হবার কারণ হবে, তার চেয়েও বেশি কি হবে না ‘ঈর্ষা’র কারণ। হ্যাঁ, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নই সে ঈর্ষনীয়, অনন্য তীর্থস্থান।

পুষ্প যেমন পাপড়ি মেলে একে একে মেলে ধরে তার ভেতরটা, পৃথিবীও তেমন করে, তার অন্তরাত্মা মেলে ধরেছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হয়ে। চারশো পঞ্চাশ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই ক্যানিয়নের গভীরতা এক মাইলের মত। সে গভীরতায় স্তরে স্তরে সজ্জিত আছে প্রায় দুই বিলিয়ন বছরের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস।

অবাক করা হলেও সত্য যে, এই মহাকাণ্ডের সৃষ্টিটা কোনো মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে হয়নি। বরং, হাজার হাজার বছর ধরে এক নিপুণ শিল্পী তার নান্দনিক শিল্পকর্মের মাধ্যমে ধীরে ধীরে খোদাই করেছে এই সুনিপুণ শিল্পকর্ম। অবিশ্বাস্য সেই শিল্পীর নাম 'কলোরাডো রিভার'। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সৃষ্টি হবার পেছনে অনেকগুলো মতবাদ থাকলেও কলোরাডো রিভার কর্তৃক সৃষ্ট হওয়ার মতবাদটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৃষ্টি প্রক্রিয়া কিংবা এর গঠনকে কয়েক স্তর বিশিষ্ট কেক এর গঠন প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এক-এক সময়ের পৃথিবীর আবহাওয়া, জলবায়ু এবং ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে এর উপরিভাগে সৃষ্টি হয়েছে স্তর-কেক এর মত এক-একটি স্তর। একটি কেকের উপরে যদি কোনো সরু সূতোকে আড়াআড়িভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হতে থাকে, তাহলে কেকের মাঝখানে সরু একটা লাইন বরাবর দু'পাশে দু'টো খণ্ডের সৃষ্টি হবে। সময়ের সাথে সাথে সে দু'পাশের দুখণ্ড হতে উপকরণগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাঝের সরু রেখাটিকে করে তুলবে আরও খানিকটা প্রশস্ত, আরও খানিকটা আঁকা-বাঁকা।

কেকের ক্ষেত্রে যেটি ছিলো সরু সূতো, আমেরিকার অ্যারিজোনা স্টেইটের ক্ষেত্রে সেটি ছিলো রিভার কলোরাডো। বহমান এই নদীই যুগ যুগ ধরে, অ্যারিজোনার বুক থেকে ধীরে-ধীরে, স্তরে-স্তরে থাকা পাথুরে মাটি কেটে তৈরী করেছে আজকের এই মহাকাণ্ড ‘গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’। শুধু মাটির গভীরে গিয়ে নদীর খোদাই কর্ম নয়, মাটিও এগিয়ে এসেছে নদীর কাছে। ভূগর্ভ থেকে উপরিমুখী চাপে অ্যাারিজোনার ভূমি উত্থিত হতে থেকেছে, যেন আকাশপানেই। প্রতিবছর পাঁচ মিলিয়ন পর্যটকের পদভারে মুখরিত হওয়া, প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্যের একটি হিসেবে বিবেচিত এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নদী আর মাটির একে অপরের গর্ভে বিলীণ হয়ে যাওয়ার উপাখ্যান, মহাউপাখ্যান।

এই সিরিজের বাকী পর্বগুলিঃ
পর্ব ১
পর্ব ২
পর্ব ৩
পর্ব ৪
পর্ব ৫
অন্যান্য সব লেখা

মইনুল রাজু
ফেইসবুক


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ভালো লেগছে আপনি ছবিগুলো এমনভাবে তুলেছেন যাতে ওখানের পরিবেশটা বোঝা যায়। সবাই শুধু ক্যানিয়নের ছবিই দেয়, আপনি তার বাইরে গিয়েছেন। চমৎকার।

মইনুল রাজু এর ছবি

ধন‌্যবাদ আপনাকে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

তিথীডোর এর ছবি

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের আধ পোটলা ছবি তাপ্পি পাওয়ার আশায় এখনো মেমরি কার্ডে জমে আছে। সেগুলো অবশ্য অধমের গরিবি ক্যামেরায় তোলা, ধরনে ঘুলাঘুলা, রঙেও ঈষৎ ঝাপসা। প্রসেস করেও বড় একটা মানুষি ফর্মে আনার আশা করা দুরাশা-ই।

কিন্তু চকচকে ছবিগুলো ছাড়া এই পর্বটা এ সিরিজের টেশলেস ওয়ান। খাদ দেখতে কবে গেলেন, ক্যামনে গেলেন, কী কী করলেন গিয়া-- কোন বর্ণনা নেই, শুধু একগাদা ছবি আর ইতিহাস।
এগুলোতো গুগল করলেও ইজিলি দেখতারি। খাইছে

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মইনুল রাজু এর ছবি

ঐ যে, মেমোরি কার্ড থেকে ছবি বের করে প্রসেস করতে করতেই 'কেমনে খাদ দেখতে গেলাম' সেটা বলার সুযোগ পেলাম না। তবে, পরের লেখাটা রেডি করছি। সেখানে খালি খোশ গল্প আর খোশ গল্প। দেঁতো হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

তানিম এহসান এর ছবি

আপনার ফোকাস’টা আলাদা, নিজস্ব একটা স্টাইল আছে, ভাল লাগলো।

মইনুল রাজু এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। চলুক

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

অতিথি লেখক এর ছবি

ছবিগুলো দেখে ঈর্ষান্বিত হা-হুতাশ করলাম কিছুক্ষণ মন খারাপ
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিভিন্ন স্তরের সাথে পৃথিবীর বয়স নিয়ে দারুণ একটা পর্ব দেখেছিলাম কসমসের কোন একটা পর্বে। মুগ্ধ হয়ে গিলেছিলাম পর্বটা। আপনার লেখা দেখে আরেকবার মনে পড়ে গেল। হাসি

আমার বন্ধু রাশেদ

মইনুল রাজু এর ছবি

কসমস সব পর্ব এখনো দেখা হয়্নি, প্রথম কয়েকটা দেখেছিলাম। যাক, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে পর্ব আছে শুনে কিছুটা এক্সাইটেড্ আমি। দেখতে হবে। ধন‌্যবাদ আপনাকে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পরে আপনার লেখা দেখলাম ভাইয়া। ছবিগুলো অসাধারণ চলুক তবে কিছু কিছু ছবির সাথে সেই সময়ের অনুভূতিগুলো থাকলে আরও ভালো লাগত হাসি

ফাহিমা দিলশাদ

মইনুল রাজু এর ছবি

আসলে এই ভ্রমণটা বেশ কয়েক মাস আগের। তখন ব্যস্ততার কারণে লেখতে পারিনি। তাই অনুভূতিগুলো ঠিক মনে নেই। মন খারাপ পরের কয়েকটা পর্ব হাওয়াইয়ের উপর লিখবো। অনুভূতিগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগেই লিখবো। ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কিছু ছবিতে ওরকম নীল টোন আসছে কেন?

মইনুল রাজু এর ছবি

আলোর তারতম্য থাকার কারণে হতে পারে। ছবিগুলো দুপুর আর বিকেলে তোলা। আকাশও মেঘলা ছিলো কিছু সময়ের জন্য। কয়েকটা ছবিতে আমি কন্ট্রাস্ট আর ব্রাইটনেস্ও চেইন্জ করেছিলাম, সেটাও কারণ হতে পারে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

মাসুদ সজীব এর ছবি

দারুণ বর্ণনার সাথে হিংসা উদ্রেক ছবি সব মিলিয়ে মুগ্ধ। সচলের নীড়পাতায় আপনাকে নিয়মিত দেখতে চাই হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

মইনুল রাজু এর ছবি

আমি নিজেও নিয়মিত লিখতে পারলে খুশি হই। কিন্তু, কেন জানি হয়ে উঠে না। নেক্সট লেখাটা তাড়াতাড়ি দেব, যেভাবেই হোক। হাসি ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

খুব সুন্দর।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মইনুল রাজু এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে

মইনুল রাজু এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

Sohel Lehos এর ছবি

আরে মিয়া দিলেনতো সব শেষ কইরা! ধুর! এইটা কিছু হইল? গত মাসে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ঘুরে এসে একটা লেখা শুরু করছিলাম। তার আগেই আপনি দিয়ে দিলেন। এখন আমি কি করুম? আপনের ছবি গুলা আমার গুলা থেকে বেশি সুন্দর চিন্তিত খাইছে

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

মইনুল রাজু এর ছবি

আমি ঘুরে আসার পর প্রায় একবছর অপেক্ষা করলাম। দেখি, কেউ কিছু লিখে না। তারপর বাধ্য হয়ে লিখে ফেললাম। খাইছে ব্যাপার না। আমার পোস্টে বর্ণনা কম, আপনি আরেকটু বিস্তারিত করে লিখে ফেলেন। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আপনার পোস্টে আগে মুগ্ধতা জানিয়েছি। আপনার লেখা, ছবি সবই অত্যন্ত চমৎকার এবং গোছানো থাকে। এবার হালকা ফাঁকি দিলেন হাসি

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাবার ইছে লুকিয়ে রেখেছি মনের মধ্যে, বড় হয়ে যাব। যখন যেথায় ছবি দেখি, চোখ ভরে দেখে নেবার চেষ্টা করি। এবারের ছবিগুলোতে তৃষ্ণা মেটে নি। আনাড়ি কমেন্টস

১। ছবিগুলো বেশিরভাগই বেশী নীলচে। আপনার হোয়াইট ব্যালেন্স ঠিক ছিলো না। হয়তো আগের রাতে ক্যান্ডেল লাইট মোডে ছবি তুলেছিলেন। সফটওয়্যারে ছবির টেম্পারেচার ঠিক করতে পারার কথা।

২। কয়েকটি ছবি রোদের প্রচন্ডতায় সাদাটে হয়ে গেছে। প্রতিফলিত রোদ আটকাবার উপায় হচ্ছে সার্কুলার পোলারাইজার ব্যবহার করা। পাঁচ ডলার থেকে শুরু করে তিনশো ডলার পর্যন্ত ফিলটার আছে। বাজেট অনুযায়ী একটা কিনে ফেলেন। পয়সা মার যাবে না।

পরের পোস্টের অপেক্ষায় পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

মইনুল রাজু এর ছবি

আপনাদের যন্ত্রণায় একটু ফাঁকিও দেয়া যায় না। খাইছে অনেক দিন পর লেখাটা লিখেছি। তাই, বিস্তারিতয় না গিয়ে ছোট একটা পোস্ট দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। হাসি
আমি নিজেও খেয়াল করে দেখলাম বেশিরভাগ ছবিই নীলচে। কিছু একটা ঝামেলা ছিলোই। দেখি পোলারাইজার কিনতে হবে মনে হচ্ছে। আর, আপনার কমেন্টসের জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি

ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।