রঙ্গীন দুনিয়া #১ [উড়াল পর্বঃ শেষ ভাগ]

অভ্রনীল এর ছবি
লিখেছেন অভ্রনীল (তারিখ: সোম, ২৫/০৮/২০০৮ - ৫:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেঘের রাজ্য

আকাশে মেঘ যে তিন স্তরে জানে এইটা জানতামনা। জানলাম যখন প্লেন মেঘের রাজ্যে ঢুকলো। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! মেঘের উপর মেঘ, তারও উপরে আরো মেঘ। কোন মেঘ ধূসর রঙা, কোন কোনটা ধবধবে সাদা, কোনটা দুধ সাদা, কোনটা আবার উজ্জ্বল সাদা, দেখলে মনে হয় ওগুলো থেকে ঠিকরে আলো বের হচ্ছে! মেঘের উপর মেঘ বসে মেঘের স্তম্ভ তৈরি করেছে। পেঁজা তুলার মত স্তম্ভগুলো যেন মেঘের রাজপ্রাসাদ। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো প্লেন থেকে নেমে মেঘের উপর একটু হেঁটে আসি!

অবশেষে হিথ্রো

দশ ঘন্টা মাটির সাথে কোন মোলাকাত নাই। তাই পাইলট যখন বলল যে প্লেন ইংল্যান্ডের আকাশ সীমায় পৌঁছে গেছে, নিজের ভেতর একধরনের ফুর্তি ফুর্তি ভাব কাজ করলো। প্রায় দশ ঘন্টা পর মাটির উপর পা রাখব অথচ মনে হচ্ছিল যেন যুগ যুগ পর মাটির দেখা পাচ্ছি! জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম নীচে – এই তাহলে লন্ডন শহর! কেবল রাস্তা আর বাড়ি আর কিছু দেখা যায়না! মাঝে মাঝে অবশ্য সবুজ রঙ চোখে পড়ে। টেমস্‌ নদীকে যত বড় ভেবেছিলাম তা আদৌ তত বড় না, অন্তত আমাদের দেশের নদীর কাছে কোন পাত্তা পাবেনা। নদীর পাশে বিখ্যাত লন্ডন আই দেখলাম। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন রঙের গাড়ি। বাড়িগুলোর গড়নে সেই আদ্যিকালের ছাপ এখনো স্পষ্ট। এক সময় প্লেন হিথ্রোতে নামলো।

আমার টিকেটে লেখা ছিল যে আমার প্লেন নামবে চার নম্বর টার্মিনালে আর আমস্টারডামের পরের প্লেন ছাড়বে টার্মিনাল ৫ থেকে। অনেকে হয়ত পাঁচ নম্বর টার্মিনালের কথা শুনেননি। টার্মিনালটা একদম নতুন। আমি ভেবেছিলাম টার্মিনাল দুইটা হয়তো পাশাপাশি, যেমনটা আছে ঢাকা এয়ারপোর্টে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি রীতিমত আমাদের জন্য বড়সড় বাস দাঁড়িয়ে আছে টার্মিনাল পাঁচে নিয়ে যাবার জন্য। বাসে উঠার পর পরই ড্রাইভার বললো যে টার্মিনাল চার থেকে টার্মিনাল পাঁচের এই যাত্রাটা হবে আঠার মিনিটের! প্রায় কাঁটায় কাঁটায় আঠার মিনিট পর টার্মিনাল পাঁচে এসে পৌছালাম। নেমে দেখি আর এক এলাহি ব্যাপার।শত শত লোক বোর্ডিং কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা কথা বলে রাখি- টার্মিনাল চার আর টার্মিনাল পাঁচ কেবল মাত্র ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের নিজেদের ব্যবহার করার জন্য, অন্য কোন কোম্পানী এগুলো ব্যবহার করতে পারেনা। এদিকে বোর্ডিঙের লাইনে এক চীনা শিশু বড়সড় ধরনের হিসু করে দিলো। সাথে সাথে দেখি এয়ারপোর্টের লোকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে এসে সেই হিসুকে গায়েব করে দিলো। তবে হিথ্রোতে নেমে বুঝতে কষ্ট হয় আমি ইন্ডিয়াতে আছি নাকি ব্রিটেনে আছি, চারদিকে কেবল ইন্ডিয়ান চেহারা, শিখ-নন শিখ সব ধরনের আদমিই আছে।

হিথ্রোর চেকিং আবার ভয়াবহ ব্যাপার। জুতা, বেল্ট, জ্যাকেট সবই খুলে ফেলতে হয় [আল্লাহ বাঁচাইসে যে প্যান্ট খুলতে হয়না]। সেই চেক পোস্ট পাড়ি দিয়ে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন দেখি আরেক জগত। ডিউটি ফ্রি এলাকায় ঢুকে গেছি আমি। কি নাই সেই এলাকায়! পারফিউম, জামা, জুতা, বই, ম্যাগাজিন, খাবার দাবার থেকে শুরু করে মায় আস্ত লাল রঙের ফেরারি পর্যন্ত আছে। ওহ... এই প্রথম আমি জীবনে সামনাসামনি ফেরারি দেখলাম; দেখার মত জিনিস একটা! আমি যখন হিথ্রোতে পৌঁছাই তখন ওইখানকার লোকাল সময় হল বিকেল তিনটা। আমার পরের প্লেন সন্ধ্যা ছয়টায়। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে অবশেষে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। নেট ব্যবহার করব ভেবেছিলাম, ল্যপটপ অন করার পরই দেখি সে বেশ কিছু ওয়াইফাই ডিটেক্ট করতে পেরেছে, কিন্তু কোনটাই ফ্রী না! কী আর করা বসে বসে তখন এই লেখাটার প্রথম অংশটুকু লিখলাম।

আমস্টারডামের ডাক

একসময় আমার প্লেনের ডাক পড়ল। গেলাম নির্ধারিত গেটের কাছে। এসে দেখি বিশাল স্ক্রীনে বিবিসি দেখাচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাপার! স্পেনে এক প্লেন টেক অফ করার সময় বিদ্ধস্ত হয়েছে। কী অবস্থা! প্লেনে উঠার সময়ই প্লেন দুর্ঘটনার খবর। ভয়ে ভয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে প্লেনে উঠলাম। ঢাকা থেকে যেটাতে এসেছিলাম সেটা ছিল বোয়িং। আর এবার যেটাতে উঠলাম সেটা হল এয়ারবাস। এগুলোর সাইজ ছোটখাট। প্লেন টেক অফ করার সময় দেখি প্লেন ঝিরঝির করে কাঁপছে! হাতের খবরের কাগজে তখনো প্লেন ক্র্যাশের খবর জ্বলজ্বল করছে। প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে ছিলাম সারাক্ষন। এবার প্লেনে শরমা টাইপের বিদ্ঘুটে এক জিনিস নাস্তা হিসেবে দিল। খেতে অবশ্য খারাপ লাগেনাই। ঘন্টা খানেক পর প্লেন আমস্টারডামের শিপল্‌ এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁল। আমার ঘড়ি বলছে তখন স্থানীয় সময় রাত আটটা, কিন্তু বাইরে দেখি তখনো সূর্য উঁকি দিচ্ছে। শিপল হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম অত্যাধুনিক এক বিমানবন্দর যেখানে সরাসরি আন্ডারগ্রাঊন্ড রেলওয়ে আছে একেবার বিমানবন্দর থেকেই। ঐ রেলে করে যে কেউ পুরো নেদারল্যান্ডস ঘুরে আসতে পারে। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর আমার অবাক হবার পালা। সামনে একসাথে চব্বিশটা কনভেয়ার বেল্ট ঘুরতে দেখলাম! কখনো এতগুলো কনভেয়ার বেল্ট একসাথে কখনোই দেখিনাই। তবে নেমেই বুঝলাম আমি পৃথিবী সবচেয়ে লম্বা মানুষদের দেশে এসে পৌঁছেছি। কী লম্বা একেকজন!

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ষোল ঘন্টা জার্নি করে অবশেষে জায়গামত পৌঁছালাম। খারাপ লাগেনাই জার্নিটা। তবে একটা জিনিস একটু খারাপ লাগলো; সবখানেই দেখি বাংলাদেশী পাস্পোর্ট দেখলে একটু নাক কুঁচকায়। যাহোক... জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি হিসিবে জার্নিটা ভালোই ছিলো।

[...শেষ]


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।