দিকশূন্যপুর

মির্জা এর ছবি
লিখেছেন মির্জা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১১/২০১৮ - ১২:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিক্ষিপ্ত
২০০০ সালের পর আর দেখা হয়নি। যার জন্যে এত অপেক্ষা, এত উত্তেজনা, এত এত ভালবাসা, তার সাথে দেখা নেই দীর্ঘ ১৮ বছর! এর মধ্যে আমার বয়স বেড়েছে, প্রেম হয়েছে, দেশ-বিদেশ ঘোরাও হয়েছে কিন্তু সেই আগের ভালবাসা কমেনি এতটুকু। খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, কিন্তু কাছে যাওয়া হয়নি। ১৮ বছর পর হঠাত করেই আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা। খানিকটা যেন 'অপরাধী লজ্জা’ এতদিন দুরে থাকার। আমাকে কে মনে রাখল বা ভুলে গেল সেটা এখানে গৌণ, এতদিন যে আসিনি, সেটাই এখানে আবেগের কাণ্ডারি। খুব প্ল্যান করে না, হয়ত তাই আসা হল; এয়ারপোর্ট থেকে সেই একই রকম উত্তেজনা…শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত ট্যাক্সি ক্যাবের জানালা নামিয়ে বুক ভরে দুষিত অক্সিজেন নিয়ে নিজেকে পরিচিত করে নেয়ার ছেলেমানুষি চেষ্টা। এতদিন পর....... সব আগের মত আছে কি? সেই আকর্ষন, সেই মাদকতা........এই হল সংক্ষেপে আমার দ্বিতীয়বার কোলকাতা দর্শন।

কোলকাতার মানুষদের অন্তত একটা বিষয়ে আমার মত বাংলাদেশিদের নিয়ে হিংসে থাকা উচিত- আমাদের মত মুগ্ধতা নিয়ে বুভুক্ষের মত কোলকাতা দেখার অপেক্ষা এবং অভিজ্ঞতা আপানদের নেই। এই ভালবাসা মাথাচাড়া দেয়া প্রথম প্রেমের ভাললাগা। যুক্তি, বাস্তবতার সীমানার বাইরে এর জন্ম এবং বসবাস। কৈশোর পেরিয়ে যে কৈশোরেই থেকে গিয়েছে।

সারাজীবন ধরেই জানি প্যারিস হচ্ছে সিটি অব লাভ (লোকসান কাদের কে জানে)। প্যারিস সুন্দর, আইকনিক এবং মোহনীয় কোন সন্দেহ নেই তাতে, কিন্তু আমার জন্যে কোলকাতাই প্রথম ভালবাসার শহর। বড় হয়েছি মফস্বল শহরে, সেই হিসেবে সিলেট কিংবা অন্তত ঢাকা হওয়ার কথা ছিল আমার মুল ভাললাগা-ভালবাসার বড় শহর। পশ্চিম বঙের ডুয়ার্স-এর চা বাগান যদিও এখনো কৈশোর বেলার মেঘে মিশে যাওয়া স্বপ্নের দেশ, কিন্তু আমার সিলেটের চা বাগানকে সেটা ছাপিয়ে যেতে পারে নি কখনো। বরং নিজের চা বাগানের অভিজ্ঞতা ডুয়ারসের প্রতি ভাললাগা বাড়িয়েছে অনেক; চা বাগানের তো আর পাসপোর্ট লাগে না তাই এরা একে অপরের ভাললাগার অনুঘটক। কিন্তু এই প্রশ্নে ‘কলকাতা’র উত্তরপত্র ভিন্ন! প্রকৃতিকে যে ভালবাসা যায় সেটা শিখেছি সিলেটের চা বাগান আর মেঘালয়ের আবছা মেঘের পাহাড়ের কাছ থেকে; ভাষা, চা বাগান এবং দার্জিলিং দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে ভালবেসেছি আর শহরকে যে ভালবাসা যায় সেটা বুঝেছি কোলকাতাকে দিয়ে।

জানি ব্যপারটা ঘটেছে বই, গান এবং ‘দেশ' থেকে। ছোট এবং কিশোরবেলায় আমার সিলেট শহরটিকে নিয়ে কেউতো আর গর্ভধারিণী লিখেনি; কেউতো আর ‘দেশ’-এর মত করে ঢাকার কথা বলেনি। কেউ লিখেনি কিংবা লিখতে পারেনি "এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু”; ‘দূরবীন' হাতে আমার শহরের ‘কালবেলা’র কথাও কেউ বলেনি। তাই যত রোমান্টিকতা, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সে সবই কোলকাতাকে ঘিরে। আমার মা আর বড় দুই মামার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে কোলকাতায়। দেখেছি মেজ মামার কোলকাতা বিষয়ক নস্টালজিয়া আর তীব্র প্রেম (তার বই কৃষ্ণ শোলই এবং কমলালয় কলিকাতা পড়ে দেখতে পারেন) । কিন্তু কেন জানি না সেসব আমাকে খুব একটা স্পর্শ করেনি। আমাকে প্রভাবিত করেছে বই, ‘দেশ’ আর গান। কলেজ স্ট্রীট থেকে ডুয়ার্স, সুনীল থেকে সত্যজিত; নীল লোহিত আর ফেলুদার সাথে আমি ঘুড়ে বেরিয়েছি কোলকাতায়, চা বাগানে আর দিকশুন্যপুর-এ।

বিছিন্ন
আমি বরাবরই শহর এবং কোলাহল প্রিয় মানুষ। গ্রামের সৌন্দর্য, প্রাকৃতি, ইত্যাদি ইত্যাদি আমার ভাল লাগে তবে সেটা দেখার জন্যেই, সেখানে থাকতে আমার ইচ্ছে হয় না কখনই। আমাকে অরণ্য না, শহর ফিরিয়ে দিলেই আমি খুশি, একমাত্র ব্যাতিক্রম, 'আমু বাগান’। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আর বড় চা বাগানের মধ্যে আমু একটি। ইংরেজিতে এর নামের বানান অবশ্য ‘Amo’। এর থেকে নিশ্চয়ই বোঝা যায় এই চা বাগানটি কতটা রূপবতী হলে ইংরেজরা এর নামটাই দিতে পারে (আমার) 'ভালবাসা’ (আমরা সিলেটিরা যে কোন ‘ওকার'-কে ‘উকার’ এবং ‘উকার'-কে ‘ওকার' বানাই জেনেটিক কোডিং-এর সরলতায়)।

চন্ডিছড়ায় বাস থেকে নেমে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেতে খেতে আমু বাগানে পৌছুতেই মনে হত পৃথিবী থেকে আমি বিচ্ছিন্ন।সাইন্স-ফিকশন থ্রিলারের মত যতই এগিয়ে যেতাম আমুর দিকে, ততই ঘড়ির কাটাগুলো একটু একটু করে পিছিয়ে পরত।সেখানে সবকিছু চলত খানিকটা ধীর লয়ে। আমুতে কখনও কারো মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো দেখেছি বলে মনে পরে না শুধুমাত্র শীত এবং সন্ধ্যা নামা ছাড়া! চা বাগানে এই দুই বন্ধু ঘাপটি মেরে থাকা বেড়ালের মত অপেক্ষায় থাকে, একটু আনমনা হলেই ঝুপ করে নেমে পরে। এর পরপরই শুরু হয় তুমুল প্রতিযোগিতা- অন্ধকার না শীত কার দাপট বেশি। এই দুই বন্ধুর মল্লযুদ্ধের ফাঁকে অবলীলায় জয়ী হত অন্য কেউ- সর্বময় নৈশব্দ! সন্ধ্যার পর আমু বাগান ছিল সম্পুর্ন মৃত! কোথাও কোন সারা-শব্দ নেই; মাঝে-মাঝে শুধু ভুতুড়ে ছবির মত সময় বলে দেয়ার ঘণ্টা পেটার শব্দ। সেই নীরবতা খুব নির্মম, নিষ্ঠুর নীরবতা, মন বিষণ্ণ করা থেকে ভয় ধরিয়ে দেয়া নীরবতা। তবে সেই নীরবতার আরেক পিঠেই ছিল জম্পেশ আড্ডা, চা, মুড়ি চানাচুর, পিয়াজি আর গানের আসর। রাত একটা-দুটো পর্যন্ত চলত সেই আড্ডা। সপ্তাহান্তে সেই আড্ডা তক্ষকের সময় পেরিয়ে পৌঁছে যেত পাখির ডাকে। অবশ্য যারা ঔপনিবেশিকদের শিখিয়ে দেয়া দ্রাক্ষা সুধায় মজে যেতেন, তারা বঞ্চিত হতেন মাতলামো ছাড়া আর সব আনন্দ থেকে। তবে চা বাগানের মাতলামো দেখাও বড় আনন্দের! মারামারি কাটাকাটির চেয়ে আবেগি কথার উচ্ছলতা অনেক বেশি। তবে সে আরেক দিনের গল্প।

আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অত্যাচারের একটি হল সকালে ঘুম থেকে ওঠা।আর সেটা যদি হয় শীতকালে তবে মৃত্যুদণ্ডের সাথে অর্থ দণ্ডের মত অবস্থা। কিন্তু আমু বাগানে আমি শীতকালে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতাম, আমাকে কেউ ডাকতে হত না। শীতকালের চা বাগানের এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ভাল লাগানোর; গ্রীক দেবীর জাদুর মত সেই ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে আসার সাধ কিংবা সাধ্য আমার ছিল না। সকালবেলা কুয়াশার ভেদ করে পরিষ্কার কিছু দেখা যেত না। এককাপ চা নিয়ে বসে যেতাম বারান্দার রেলিঙে; চোখের সামনে ধীরে-ধীরে একটার পর একটা আবরণ খসিয়ে সামনের বাগান, ধানের খেত, চা বাগান আর পাহাড় স্পষ্ট হতে থাকতো। মনে হত ফেলুদা কিংবা শার্লক হোমসের শেষ চ্যাপ্টার পড়ছি আর চোখের সামনে প্রাকৃতি একটা একটা করে ধীরে লয়ে তার রহস্য উন্মোচন করছে। তেমন আহামরি কিছু না হয়ত, কিন্তু সেই পরিবেশ, সেই শুনশান নীরবতা, কুয়াশা, গরম চা সব মিলিয়ে যে ভাল লাগা তৈরি করত তার জন্ম এই ভুবনে ছিল না!

এই চা বাগানের মুল উৎসব কালি পূজা, সে সময়ে আমুতে যেতে পারলে আমোদের কোন অভাব ছিল না। সারারাত জেগে থাকতো আমু। চারিদিকে উৎসব, হই-হল্লা; সারি-সারি দোকানিরা মাটিতে বিছিয়ে বসেছেন কুপি বাতি, খাবার, খেলনা, চুড়ি, শাড়ি…… হ্যাজাকের আলো দেখে বোঝা যেত ভিআইপিদের বসার যায়গা। উৎসবের কেন্দ্রস্থলে রুদ্রমূর্তি মা কালী থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল কিন্তু সেখানে অবস্থান ছিল একেবারে পুরনো কেতার সরল সহজ যাত্রা-পালা। মজার ব্যাপার হল, সেই উৎসবমুখর স্থানটুকু বাদ দিলেই পুরো বাগান আবার শুনশান!

একটু দুরে নীরবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কুয়াশা ভেদ করে সেই উৎসবের দিকে তাকিয়ে মনে হত আমি যেন অন্য কারো স্বপ্ন দেখছি! এ যেন চোখের সামনে পরাবাস্তব দেখা! অন্যভুবনের দিকে তাকিয়ে থাকা! কি যা অবাক করা সে দৃশ্য!

দিকশূন্যপুর
শুনেছি এখন আমু বাগানের প্রায় সব যায়গাতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে এসছে, সবার হাতে-হাতে মোবাইল, ঘণ্টা পিটিয়ে হয়ত আর এখন সময় জানাতে হয় না; হিন্দি সিরিয়ালের সাথে গ্রামীনফোনের বিজ্ঞাপনের নাকি চমৎকার সহবাস। আমি আর তাই এখন আমু বাগানে যাই না কিংবা যেতে চাই না।
মধ্য বয়সে এসে বুঝেছি আমু বাগান আসলে ছিল আমার বাস্তবের ‘দিকশুন্যপুর’। সেই দিকশুন্যপুরের ঠিকানা পেয়েছে যারা, তাদের সাথে আমি আমার ঘোর লাগা, মামুলি রহস্য ভাগাভাগি করতে চাইনা। আমি জানি একদিন সেই সাধারণ পর্দার পেছন থেকে আবছা ভাবে আমি আবার দেখে নিব আমার আসল দিকশুন্যপুর!


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মায়াময়, আপন ............. এমনসব উপমা এমন লেখার ক্ষেত্রে খাটে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।