তাঁদের কাছে খোলা চিঠি

মর্ম এর ছবি
লিখেছেন মর্ম [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৬/০৩/২০১২ - ৭:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হারিয়ে গিয়ে চিরদিনের থাকার খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলা পূর্বসুরীরা আমার,

জানি না কেন হঠাৎ তোমাদের সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা করল! খবরের কাগজগুলো তোমাদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে থেকে থেকে, খবরে তোমাদের পুরনো ছবি, তোমাদের নিয়ে লেখা কেবল টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক কঠিন সেই দিনগুলোতে, আমাদের সাধ্য কি তোমাদের মত করে ভাবতে পারি, বুঝতে পারি, দেখতে পারি? কেবল জানতে চাইতে পারি- তোমাদের কথা, তোমাদের হারিয়ে ফেলার কথা, তোমাদের ফিরে পাওয়ার কথা।

শুনেছি আপনজনেরা হারিয়ে যান না কখনো, ওঁরা ফিরে ফিরে আসেন। চলে গিয়েও। ফেলে যাওয়া আপনজনদের আড়াল থেকে চুপটি করে দেখে যান- ওদের খুশিতে ওঁরাও শান্তি পান, দুঃখে ওঁদেরও মন ভার হয়।

সত্যি এ কথা? তোমরাও কি তবে এসে আমাদের দেখে যাও? আমাদের জন্য তোমাদের মন কেমন করে? আমাদের ভাল থাকতে দেখলে তোমরা খুশি হয়ে ওঠো? মন খারাপ করে একাকী বসে থাকা কোন একজনের অজানা কষ্টে কি তোমাদেরও মন ফেটে যায়? তোমাদেরও কি ইচ্ছে করে চুপচাপ সে মানুষটির পাশে বসতে? সে মানুষটার সমস্ত কষ্ট শুষে নিয়ে তার মনে শান্তি এনে দিতে?

পারি পারি করেও না পেরে ওঠার কদিন আগের রাতে, আমাদের বুক ভাঙ্গার রাতে, আমাদের চোখ ভাসানোর রাতে, নিজেদের নতুন করে চেনার রাতে- থমথমে মুখগুলোর ভিজে আসা চোখের পাতা মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল তোমাদেরও? আমাদের সাথে তোমরাও কি ছিলে তবে? আমাদের ব্যর্থতার কষ্ট কি তোমাদেরও ছুঁয়ে গেছে সে রাতে? নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার কঠিন চেষ্টাটুকু আমরা যখন সবাই মিলে করছি, তোমরাও কি পাশেই ছিলে? উত্তরসুরীদের সাহস যোগানোর চেষ্টা করে গেছ নিজেদের মত? পরম মমতায় এলো হাওয়ায় ছুঁয়ে গেছ ঘরফেরা মানুষগুলোকে? একটু কাছ থেকে চিনে নিতে চেয়েছ লাল-সবুজের একালের সেনানীদের? একে অন্যকে যেমন আশা যুগিয়ে গেছি আমরা, হাওয়ায় হাওয়ায় তোমরাও কি তেমনি ছড়িয়ে দিয়েছ তোমাদের আশীর্বাদ?

সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক চিরে হাইকোর্ট থেকে টিএসসি হয়ে রোকেয়া হল, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, অপরাজেয় বাংলা, বুদ্ধিজীবী চত্বর, মহসিন হল, জহুরুল হক হল আর স্যার এফ রহমান হল-কে হাতের এপাশে ওপাশে ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে তোমাদের কথা মনে পড়ল খুব। কার্জন হল আলোয় আলোকময়, ডাস-এর সামনে অনেক আগেই মনুষ্যত্ব হারিয়ে মানুষের খোলস পড়া কিছু অমানুষের বিচারের দাবী করে যাচ্ছে তোমাদের উত্তরসুরীরা, অপরাজেয় বাংলা আর বুদ্ধিজীবী চত্বরে প্রদীপ জ্বালিয়ে তোমাদের স্মরণ করা হচ্ছে- জহুরুল হক হল-এ বাড়তি আলোর ঝলকানী নেই, অন্ধকারকে খানিকটা দূরে ঠেলে রাখা নিয়নের আলোয় বাঁয়ে তাকিয়ে পুরোন ভবনটায় চোখ পড়ল- তোমাদের স্মৃতি কি এখনো ঘুরে বেড়ায় ওখানে? একালের বাঁধানো পুকুর, যত্নের খেলার মাঠ, বাগানের রং-বেরঙ্গের ফুল, সন্ধ্যার পাঁচমেশালী কৃত্রিম আলোয় পুকুরের জলে নারকেল গাছগুলোর ছায়া দেখে তোমরাও কি মুগ্ধ হও? তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাস হয়ে একপলকে সামনে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা কি তোমাদের পুরানো কথা মনে করিয়ে দেয়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় তোমাদের সময়ে?

কে যেন বলেছিল- চলে যান যাঁরা, ওঁদের বয়স বাড়ে না আর। তোমরা কি তবে আজও আমাদের বয়সেই রয়ে গেছ? আমাদের মতই কি তোমাদেরও মন কেমন করে? বন্ধুদের জন্য? বাবা মা-য়ের জন্য? বাঁদর আর ত্যাঁদর ছোট ভাইগুলোর জন্য? আদরের ছোট বোনটার জন্য? কিংবা এক্কেবারে খালি পড়ে থাকা ছেলেবেলা কাটানো বাসাটার জন্য? হাজার বার পা ফেলা আধাপাকা রাস্তাটার জন্য?

কখনো কখনো মনের অজান্তেই ভাবতে বসি- চলে যাওয়ার সময় কেমন ছিলে তোমরা? কী করছিলে? খুব কি ভয় হচ্ছিল তোমাদের? খুব করে কি চাইছিলে- থেকে যেতে? কী কথা বলছিলে তোমরা নিজেদের মধ্যে? অসহায় লাগছিল খুব? কষ্ট হচ্ছিল? সাহসের সবটুকু সঞ্চয় করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলে? নাকি কিছু হারানোর নেই জেনে শঙ্কাহীন ছিলে একদম? ভাবতে পারি না, একেবারেই- আমাদের কল্পনার, জানা সত্যেরও সাধ্য কী তোমাদের সেই সময়কে মনের চোখের সামনে ধরে?

আরো ছোট ছিলাম যখন- নানা ডাকটিকিট এনে দিয়েছিলেন পোস্টঅফিস থেকে- বুদ্ধিজীবী দিবসের বিশেষ ডাকটিকিট- ডাকটিকিটে লেখা ক’টি কথা মনে গেঁথে দিয়েছিলেন তিনি-

“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই,
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তাঁর ক্ষয় নাই”

বিশ্বাস বলে একটা কথা আছে, জান তো? উপরের কথাটুকুতে আমার অগাধ বিশ্বাস।

এজন্যই হয়ত- আমার খুব মনে করে নিতে ইচ্ছে হয়, যেখানেই আছ তোমরা- ভাল আছ। খুব খুব ভাল। ওখানে এতটুকু কষ্ট নেই। ওখানে কেবল আনন্দ আর আনন্দ।

খুব ভেবে নিতে ইচ্ছে হয় আমাদের ভাল খবরটুকু তোমরা পাও- সে তোমাদের আরও আরো খুশি করে। আমাদের মন্দটুকু তোমরা মেনে নাও ছোটদের ভুল বলে- আমরা একে একটা অন্যায় করি, অপরাধ করি- তোমরা ওখান থেকে আমাদের আশীর্বাদ করতে থাক, শুভকামনা জানাতে থাক।

এত যন্ত্রণা আমাদের, এত দুর্বিপাক- তবু তো দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তবু তো হাসি ফুটে যায় আমাদের মুখে। তবু তো কখনো কখনো মানুষের কষ্টে কষ্ট হয় এখনো, পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। কে জানে, তোমাদের ত্যাগ আমাদের অমন করে ঘিরে রেখেছে বলেই হয়ত।

না-দেখা না-চেনা তোমরা আমাদের কাছে। সময় আমাদের কাছাকাছি আসতে দেয়নি। কিন্তু তোমাদের সময়টা ছিল বলেই আমাদের সময়গুলো আমাদের মত করে গড়ে উঠেছে। তোমাদের না পাওয়ার আক্ষেপগুলো আমাদের পাওয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে- তোমাদের না পাওয়া আগামী আমাদের পেয়ে যাওয়া বর্তমান হয়ে তোমাদের দিকেই ফিরিয়ে নিচ্ছে আমাদের- তোমরা নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে দেখে যাচ্ছ সব?

আজকের রাতে চলে গিয়েছিলে তোমরা, জানি না আজকে রাতে আবার তোমাদের ফেলে যাওয়া দেশটাতে ফিরে আসার সুযোগ হয়ে যায় কি না- জানি না তোমাদের আশা আর আমাদের বর্তমানের পার্থক্য দেখে তোমরা হতাশ হয়ে পড় কি না- জানি না আমাদের ভুলের পর ভুল তোমাদের নিরাশ করে ফেলে কি না-

কেবল জানি-

পথ হারানো আমরা কখনো না কখনো ঠিকই পথে ফিরব, তোমার যে পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছ সে পথ আমরাও ঠিকই খুঁজে পাব- সময় লাগবে আরো- কিন্তু পাব- সেদিন আমাদের ‘বাংলাদেশ’টা তোমাদের চাওয়া ‘বাংলাদেশে’র মত হবে- সেদিনও তোমরা হয়ত আমাদের আশীর্বাদ করে যাবে, সেদিন হয়ত আমাদের খুশি তোমাদের আরও অনেক বেশি ছুঁয়ে যাবে!

সেই সুখের বাংলাদেশ হয়ত আমার দেখা হবে না, তোমাদের হবে- জানি আমি। তোমরা যে চিরঞ্জীব!

যেখানেই আছ তোমরা, ভাল থেকো- নিরন্তর এই কামনা।

ইতি-

এখনো যোগ্য হয়ে উঠতে না পারা তোমাদের এক উত্তরসুরী


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

আমরা তোমাদের ভুলবো না....
শ্রদ্ধা

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মর্ম এর ছবি

মনে রাখব।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

শ্রদ্ধা
ভুলিনি, ভুলব না।

মর্ম এর ছবি

ভুলে গেলে তাঁদের সেটুকু অপমান করা হয় যা সে অমানুষগুলোও তাঁদের করতে পারেনি।

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।