ডিসেম্বর ৬ : ভুলিনাই, ভুলবনা

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৬/১২/২০০৭ - ৪:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ ৬ই ডিসেম্বর ছিল, স্বৈরাচারের হাত থেকে আমাদের মুক্তির দিন।

মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন আমাকে ভীত করে তোলে। এই যে বিদেশে আছি, চাকরি বাকরি করছি, অথবা দেশে থাকলেও হয়ত ভাল কোন চাকরী করতাম; তখন হঠাৎ যদি একটা যুদ্ধ লাগত? ঠিক ৭১ এ যেমন দেশ আক্রান্ত হয়েছিল পাক হানাদের দ্বারা, সেরকম কিছু? তাহলে কি এই নিরাপদ/নিশ্চয়তামূলক জীবন ছেড়ে দেশের জন্য লড়ার রিস্কটা নিতাম? এখনই যদি যুদ্ধ লাগে, তাহলে কি দেশে গিয়ে অস্ত্র ধরব, না নিয়মিত অফিস করে রাতে ইন্টারনেটে এখানে সেখানে গনসংযোগ করেই দেশের প্রতি দ্বায়িত্ব শেষ করব? খুব কঠিন প্রশ্ন। ভয় হয়, সাধারন চিন্তায় ভাবলে মনে হয় যে, দেশে ফিরে যাবনা। হয়ত দেশকে ভালবেসে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা তখন করব, কিন্তু সবটাই এখনকার নিশ্চয়তাটুকুকে অটুট রেখে। আমি জানিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে আপনি পাঠক কি ভাবছেন।

তবে এটা বুঝি যে, সমস্যাটা দেখা না দিলে বলা যায়না কি করব; মানে যুদ্ধ লেগে গেলে তখনই শুধু বলা যাবে কি করব। যুদ্ধ করার জন্য যে ছুটে যাবনা সেটা আমি পুরো নিশ্চিত নই। মনের যে অংশটুকু যুদ্ধে যাবার জন্য সায় দেয়, সেখানে বাস করে এক অদ্ভুত স্মৃতি। হুমায়ুন আহমেদ তার 'জোছনা ও জননীর গল্প' বইয়ে লিখেছিলেন ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের খবর যখন তিনি পেলেন, তখন ঢাকার খোলা রাস্তায় তিনি আর তাঁর বন্ধু (সম্ভবতঃ আনিস সাবেত) প্রাণখুলে দৌড়েছিলেন, আর কতক্ষণ পরপরই হেসে উঠেছিলেন। তাঁর বর্ণনাটা যতবার পড়েছি ততবারই মনে হয়েছে 'ইস্, আমি যদি তখন থাকতাম।' পড়তে পড়তে অদ্ভুত অনুভুতি হতো, আনন্দে হাসতে থাকি। আমরা এই প্রজন্ম সেই ১৬ই ডিসেম্বর পাইনি, আমাদের দুর্ভাগ্য। তবে এরকম ছোটখাটো একটা স্বাদ আমরা পেয়েছিলাম। সেটা ছিল ৯০ এর ৬ই ডিসেম্বর। সেসময় আমাদের ভয় হতো এই এরশাদকে হয়ত কোনদিনই সরানো যাবেনা গদি থেকে, কিন্তু ৬ই ডিসেম্বর সেই ভয় দূর করে দিয়েছিলো। সাথে সাথে এক আত্নবিশ্বাস দিয়েছিলো আমাদের যে, সামরিক স্বৈরাচার এদেশে আর জাঁকিয়ে বসতে পারবেনা।

আজ, আমাদের সেই ভয় আবার কবরের ঘুম ভেঙে মোটাতাজা তাগড়া হয়ে ফিরে আসছে, আমাদের সেই আত্নবিশ্বাসকে একদল লুটেরা, যাদের হাতে আমরা বিজয়কে ছেড়ে দিয়েছিলাম, তারা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

আমরা যাদেরকে বিশ্বাস করেছিলাম, তারা সেই একই স্বৈরাচারকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে, আমরা মুখ লুকাই কোথায়? ... শুধু তাইনা, যেকারনে এই কাড়াকাড়ি, সেই একই কারনে দেশের সাথে সবচেয়ে বড় হারামীপনা করা রাজাকার/আলবদর/আলশামসদেরও আঁচলের তলায় ঢুকিয়েছে ... তারপর আবারও সামরিক শাসনের কাছে দেশকে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা এখন নতুন ধান্দায় ব্যস্ত ...

আর সেই সামরিক শাসকেরা আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মৌন মিছিল, হ্যাঁ জনাব, মৌনমিছিলের মতো "মহাঅপরাধের" দায়ে জেল-জরিমানা করেছেন ...

আমরা এখন কোথায় যাব?

৯০ এর গনআন্দোলনে এই সামান্য আমার কোন অংশগ্রহনই নেই বলতে গেলে। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। কারফিউ চলত, আমরা কলোনীর গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পুলিশের গাড়ী দেখা গেলে দূর থেকে ইট-পাটকেল ছুড়তাম; গাড়ী কাছাকাছি এলে ভোঁ দৌড়। এই সামান্য অংশগ্রহনেই আমি এক অদ্ভুত অভিমান বোধ করি, হতাশ লাগে।

তখন ভাবি,
যারা আত্নদান করেছেন, নিরলসভাবে নিঃস্বার্থভাবে স্বৈরাচারের বিরোধিতা করে দিনরাত আন্দোলনে ছিলেন, সরাসরি যুদ্ধে ছিলেন, তারা কি ভয়াবহ অভিমানে আছেন?

নুরহোসেনের বাবা-মা বা ডাঃ মিলনের স্ত্রী-সন্তানেরা আজ কিভাবে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন।

তারপর ভাবি,
৭১ এর রাজাকরের গাড়ীতে যখন দেশের পতাকা উড়ে/ একাত্তরের সবচেয়ে বড় ক্রিমিনালদের একটাকে যখন "দেশের প্রতি বিশেষ অবদানের" জন্য বনানীতে জমিদেয়া হয় -- তখন সেই মুক্তিযু্দ্ধের সময়ের মানুষেরা কিভাবে অভিমানে ডুকরে উঠে! মুক্তিযোদ্ধাদের পবিত্র আত্নায় কি কঠিন কষ্ট অনুভূত হয়!!!ভাবতে পারিনা, গায়ে কাঁটা দেয়।

শেষপর্যন্ত কি, একদল নীরব অভিমানীতে ভরে যাবে এদেশ?
আরেকবার জেগে উঠবেনা?


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বাংলাদেশ বনপোড়া হরিনীর আর্তনাদ করে ।

জ্বিবাঃ ব্যাস্ত নাকি খুব? কমলে নিয়মিত হোন আবার । ভালো থাকেন ।
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হুমমম ... ঘরপোড়া গরু, বনপোড়া হরিনী সবই ... আতঙ্কিত এইভেবে যে কোথায় যাচ্ছে সব!

মোরশেদ ভাই, একটু ব্যস্ততায় ছিলাম ...খানিক হতাশাও বলতে পারেন ...রাহেলা কেইস, সিডর, ৩রা ডিসেম্বর ,,,সব কেমন এলোমেলো ,,,সিডরের জন্য ভালো ফান্ড উঠছে ,,, শুধু জাপানী প্রবাসীরাই হয়ত ২ কোটি ইয়েনের মতো পাঠাচ্ছে ,,,এখন চিন্তা সদ্ব্যবহার হবে তো? ,,, ৩রা ডিসেম্বর নিয়েও হতাশ ,,, সরকার হিজবুত তাহরীরকে আন্দোলন করতে দিতে পারে, আর নায্য দাবী/বেসিক দাবীর সময় অনুমতই দিতে পারেনা ,,,আর কত খেল দেখাবে?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কিন্তু সবটাই এখনকার নিশ্চয়তাটুকুকে অটুট রেখে।
যথারীতি বাদশাহী লেখা। আমার যতটা মনে পড়ে নব্বইয়ের বিজয়ের পরেই (তখন আমি নাইনের ছাত্র) অনেককেই বলতে শুনেছি (পরিবারের লোকজন, আত্নীয় স্বজন) এই এরশাদকেই আবার এরা (খালেদা-হাসিনা) মাথায় তুলবে।

সময় কত দ্রুত চলে যায়, আর সেই ভবিষ্যতবানীও মিলে যায় অক্ষরে অক্ষরে। কী আশ্চর্য! হয়তো আশ্চর্য নয়, এটাই স্বাভাবিক। তাই রাজাকাররা পতাকা তোলা গাড়ীতে চড়লেও অবাক হওয়ার কিছু নাই। হয়তো এমন দিনই আসবে যখন মুক্তিযুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার হবে (সম্ভবত ... ভাই বলেছিলেন কথাটা)।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

এখন দেখে মনে হচ্ছে অন্ততঃ সেটা হবেনা, কিন্তু কে জানে? ,,, আমি স্বপ্নেও ভাবিনাই এরশাদ আবার কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে ,,, সেদিন বেশ কয়েক জায়গায়ই ছেলেরা প্রস্তুতি নিয়েছিল স্বৈরাচারের দালাল দুএকটাকে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেবে ,,, আর এখন?
মাঝে মাঝে ভাবি, গোলাম আজমকে ঝুলাইয়া দিলেই হয় ,,, একটা উদাহরন তৈরী হওয়া দরকার ,,, জামাতীদের জন্য অপমানের উদাহরন
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দ্রোহী এর ছবি

যথারীতি চমৎকার লেখা।


কি মাঝি? ডরাইলা?

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ, দ্রোহী
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ভ্রাত:
অনেকদিন পর দেখলাম। সবাই বোধ হয় ব্যস্ত থাকছে ইদানিং। এই স্বৈরটাকে নিয়েই তো দুই প্রধান নেত্রী বছর খানেক আগে নাটুকেপনা করলো। শহীদ মিলনের প্রতিকৃতি তখন কেবলই অসহায় হয়ে থাকে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।