ঘোরাঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (৪র্থ পর্ব)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: শুক্র, ০৭/০৩/২০০৮ - ৮:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪.
ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলা জাপানীদের দেশে থাকি বলে নয়, এখানে আসার আগেও ঘড়ির কাঁটা ধরে চলার একটা বিরক্তিকর অভ্যাস আমার ছিল; সেজন্য, যখনই প্রয়োজন হয় ঘড়ির কাঁটা মেপে চলতে আমার অসুবিধা হয়না। তবে, আগেরদিন যখন সুকেশদা আমাকে বলে দিল যে পরদিন সকাল ন'টার সময় আমাদের নিতে আসবে তাদের ড্রাইভার, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলামনা যে এক্ষেত্রে সময়কে কতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত। তাও, ন'টার কথা বলে তো আর দশটায় রওয়ানা দেয়া যায়না, বড়জোর সোয়া নয় কি সাড়ে নয় পর্যন্ত যাওয়া যায়। তাই সকাল সাড়ে আটটায়ই উঠে পড়ি। গিন্নী "ডাকে পাখী, খোল আঁখি ..." টাইপের মানুষ, ভোরে উঠে নিজে রেডিটেডি হয়ে বসে আছে, নাশতাও রেডি। শুধু চা টা নেই! কিছু করার নেই, কারণে হোটেলরূমে পানিগরম করার কোন ব্যবস্থা নেই। সরাসরি মেসেজ, খাওয়াদাওয়া সব রেস্টুরেন্টে করো।

জাপানে যেসব বিজনেস হোটেলে আমরা থেকেছি, সবগুলোতেই গরম পানি পাবার একটা ব্যবস্থা থাকে, কিছুদিন আগে বানিজ্যিক শহর ওসাকায় ঘুরে আসার সময় যে হোটেলে ছিলাম সেখানে এমনকি মাইক্রোওয়েভ ওভেনও ছিল ঘরে; আসলেই চমৎকার সিস্টেম ওসাকায়, বিশেষ করে ওসাকা হলো সেই অল্প কয়েকটি শহরের একটি যেখান থেকে প্রচুর সার্ভিস আইডিয়াগুলো পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। সেই তুলনায় সাইপানের এই প্লুমেরিয়া হোটেলের গরম পানির দুষ্প্রাপ্যতা খুব বাজে ঠেকছিল, এতবড় রূম, সত্যি বলতে জাপানী অধিকাংশ ফ্ল্যাটের চেয়েই আয়তনে বড়, অথচ রান্নাবাড়ির কোন সুযোগ নেই! এটা কি শুধু প্লুমেরিয়াতে, নাকি "ট্যুরিস্ট রিজোর্টে এসে কিসের ঘরে রান্না করে পয়সা বাঁচাবে?" এই পরোক্ষ মেসেজটি দিয়ে সাইপানের সব হোটেলেই এক অবস্থা -- সেটা যাচাই করার ভার এ লেখা পড়ে যিনি সাইপান ঘোরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁর উপরই ছেড়ে দিলাম। তাও ভাগ্য ভালো যে একটা ফ্রিজ তারা রেখে দিয়েছে, সেখানে বিশাল এক গ্যালন মিনারেল ওয়াটার এনে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। গরমের দেশ বলে কথা।

ঘুম থেকে উঠে আলসেমি হয়, গরম পানি না পেলে সাথে সাথে মুখ ধুতে ইচ্ছে হয়না, আমি উঠে গিয়ে টিভির সামনে বসে হিলারী আর ওবামার ভোটফাইটের খবর দেখছি ফক্স নিউজে (তখন সবে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সম্ভবতঃ নিউহ্যাম্পশায়ারের ভোট নিয়ে তোলপাড় চলছিল), পৌনে নয়টার মত বাজে। তখনই সুকেশদা'র ফোন, বরিশালের টানে, 'হ্যালো মুকিত ভাই, সব ঠিক আছে তো? আমি কিন্তু ড্রাইভার পাঠাইয়া দিছি, নয়টার আগেই পৌঁছায় যাবেনে।" আমি ধড়ফড় করে উঠি, এখন আর এব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায়না। হুড়মুড় করে হাতমুখ ধুয়ে নাশতা মুখে দিতে দিতে বের হয়ে যাই আমরা, হঠাৎ মাথায় চেপে বসল নয়টার মধ্যে হোটেলের ফ্রন্টে থাকা চাইই চাই। নীচে নেমেই ফ্রন্টের কাছেই দেখি শান্ত, সৌম্যময় এক চেহারার বাঙালী দাঁড়িয়ে আছে ওখানে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, সম্ভবতঃ আমাদেরই খুঁজছে। চোখ পড়তেই এগিয়ে এসে পরিচয় দেয়, তার নাম তপন। ট্যাক্সি চালায় আজ বছর দশেক, কথাবার্তায় বোঝা গেলনা ওটা কি তার নিজের ট্যাক্সি, নাকি অন্য মালিকের। তবে গাড়ীতে বসে কমবেশী যেসব কথাবার্তা হলো, তার সবগুলোই জীবন-জীবিকা নিয়ে।

তপনদা প্রশ্ন করে গেলেন, আমি যতটুকু পারি তাকে উত্তর দিলাম। জাপানে কাজের কি অবস্থা, গেলে কাজ পাওয়া যাবে নাকি, কত বেতন, কি কি উপায়ে জাপানে ইন করা যায় -- এসব প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে হয়। কিছু প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও জানিনা, তবে আমার এসব প্রশ্ন শুনে ভালো লাগে, বিশেষ করে তপনদার মতো চল্লিশের কাছাকাছি চলে যাওয়া মানুষও যখন এরকম প্রশ্ন করে, আমি আশা খুঁজে পাই। কারণ, দিব্যচোখে দেখতে পাই, এই বয়েসে এসেও এদের প্রাণশক্তি কমে যায়নি, "এখন যেরকম আছি তারচেয়ে ভালো থাকতে চাই, সেই তারচেয়ে ভালো থাকার অবস্থানে গেলে আরো ভালো থাকার চেষ্টা" -- এই প্রেরণাটা বেশ ভালোভাবেই এই বয়েসেও বয়ে বেড়াচ্ছেন। এটাই হয়ত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, এই উদ্যমটা যাদের আছে তারাই হয়ত বিদেশে এসে কঠোর পরিস্থিতিতেও টিকে যায়। দেশে থাকতে আমার সামান্যও ধারনা ছিলনা বিদেশের জীবন কত কষ্টের হতে পারে, তার ওপর স্কলারশীপ নিয়ে জাপানে এসে মহাফুর্তিতে কাটাতে থাকা সময়ে শুধু এটাই ভাবতাম "এত কষ্ট মানুষ করে কিভাবে?", সেখানেই থেমে যেত চিন্তাভাবনা। এখন বুঝতে পারি, এত কষ্ট করেও টিকে থাকতে পারে কিভাবে, কারণ টিকে থাকার স্পৃহা আছে বলেই টিকে থাকতে পারে। এই স্পৃহাটাই একদিন আমাদের পুরো জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে হয়ত -- এরকম উচ্চমার্গের কিছু অপটিমিস্টিক চিন্তাভাবনার মাঝেই গাড়ীর সোফায় গা এলিয়ে দেই।

তপনদাকে জিজ্ঞেস করি, "আচ্ছা, তপনদা, শুনলাম সাইপানের সীপোর্টটা নাকি কাছেই কোথাও আছে?"

শোনার সাথেসাথেই তপনদা এমনভাবে কথাটা লুফে নিল যেন উনি এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সাথে সাথে বললেন, "যাবেন? যাইতে চাইলে নিয়া যাইতে পারি?"

আমি উদাস গলায় বললাম, "তাইলে যান।"

সীপোর্টের পার্কিংয়ে গাড়ী পার্ক করে তপনদা আমাদের নিয়ে গেল সাবমেরিন দেখাতে। আমেরিকান নেভীর সাবমেরিন, পোর্টের দক্ষিণপাশে, গতকালই নাকি এসেছে। গিয়ে দেখি ওটার সামান্য একটু অংশই দেখা যাচ্ছে পানির উপরে, দেখতে যেন একটা বিশাল সাইজের কুচকুচে কালো তিমি মাছ। জীবনে প্রথম সামনাসামনি সাবমেরিন দেখে উত্তেজিত হবার কথা, কিন্তু মনের মধ্যে একটা দাগ কেটে আছে আফগানিস্তান থেকে পাঠানো জাপানী বন্ধুর ইমেইলটি। ও লিখেছিল, শরণার্থী শিবিরে ওরা অপেক্ষায় আছে কখন বোমা এসে পড়বে, ওদেরকে মারবে, আমাদেরকে নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করবে। সেকারণেই হয়ত, সাবমেরিণ দেখে মনে হলো মানুষ মারার দানব, ঠিক যেটা মনে হয় জনপ্রিয় ব্র্যান্ড হ্যামার গাড়ী দেখে, ঘৃণায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। মনে হয় এই ইঞ্জিনের বুক থেকে ছোটা গোলা ধ্বংস করে দিয়েছে জনপদ, জনপদের সাথে অতলে হারিয়ে গেছে অসংখ্য মানুষ, একেকটা মানুষ জড়িয়ে ছিল একেকটা স্বপ্ন, স্বপ্নগুলো সব হারিয়ে যায় এক নিমিষেই। কেউ খোঁজও রাখেনা, পৃথিবী কত যত্ন করে তার মানুষ নামের এই প্রাণীগুলোকে দিয়ে একেকটা স্বপ্ন গড়ায়, সেটা ভাঙতে নেই। মাঝেমাঝে ভাবি, একটা মানুষও যদি যুদ্ধ নামক এই অবান্তর বস্তুটা দ্বারা না মরত, তাহলে কি পৃথিবীটা চলতনা? তাহলে সেভাবে চলেনা কেন?

ভালো হলো যেটা, সাবমেরিনটা দেখতে দাঁড়িয়েছি দশ সেকেন্ডও যায়নি, তখনই পোর্টেরই দারোয়ান টাইপের কেউ এসে আমাদের সরে যেতে বলল,ঈশারায় "দূর হ" টাইপের ভঙ্গি করল -- সম্ভবতঃ টেরোরিস্ট টাইপের কিছু ভেবেছে। আমরা নিরীহের মতো গাড়ীতে চলে আসলাম, আসার সময় পোর্টের উত্তর পাশে চোখ গেল, দেখলাম টিকেট বিক্রী হচ্ছে একটা কাউন্টারে আর পাশেই যাত্রী ছাউনী, প্রচুর লোক বসে আছে। আগেই জেনেছি, তখন আবারও বুঝলাম, যাত্রীরা সবাই একটু দূরেরই টিনিয়ান দ্বীপটাতে যাবে ঘুরতে। ওখানে ক্যাসিনোসহ হোটেল আছে, বিশেষ করে চীনারা এ অঞ্চলে ঘুরতেই আসে ক্যাসিনোতে খেলার জন্য। সম্ভবতঃ চীনে খেলাটা সরকারীভাবে নিষিদ্ধ, এমনও হতে পারে ফিলিপিনের পর সাইপানই ক্যাসিনো খেলার সবচেয়ে কাছের আস্তানা ওদের জন্য। জাপানেও নিষিদ্ধ, জাপানীরা স্লটমেশিনের কাছাকাছি ধরনের একটা জুয়োর চলন অবশ্য রেখেছে, নাম, "পাচিনকো"। জাপানী টিভিগুলো হরদম বলে বেড়ায় পাচিনকো খেললে আয়ু বাড়ে! আমরা মাঝেমাঝে দেখতে পাই থুরথুরে বুড়োবুড়ি, একটা হোঁচট খেলেই হয়ত শেষই হয়ে যাবে, অথচ লাঠিতে ভর দিয়ে পাচিনকো খেলতে ঢুকছে। আমি গরীব দেশের গরীবি তরিকার মানুষ, টিভির "আয়ু বৃদ্ধির গল্প"কে পুঁজিবাদী ফতোয়ার বেশী কিছু ভাবতে পারিনা, খালি ভাবি, "হায়রে! টাকার জোরে কি না হয়!!"

যে টিনিয়ান দ্বীপের কথা বলছিলাম, এটার আরেকটা বিশেষত্ব আছে, ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই হয়ত টিনিয়ান নামটা শুনেই খেয়াল করেছেন। টিনিয়ান হলো সেই অভিশপ্ত দ্বীপ যেখান থেকে হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলার জন্য যুদ্ধবিমানে বোমা ভরা হয়েছিল, টিনিয়ান সেই হতভাগিনী দ্বীপ, যে দ্বীপ মাটির আশ্রয়ে থাকা মানুষগুলোকে নিমিষে শেষ করে দেবার সেই নৃসংশতম অপব্স্তুগুলোকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল -- আমি কল্পনা করতে পারিনা নিরূপায় এদ্বীপ সেসময় কতটুকু কেঁদেছিল। আমাদেরও সফরের পরিকল্পনায় টিনিয়ান ঘোরার ব্যাপারটা অন্তর্ভুক্ত, পরদিনই যাব। যাত্রীছাউনিতে বসা লোকদের উদ্দেশ্যে মনে মনে বললাম, "যাও, টিনিয়ানের কান্না শুনে এসো।"

শেষ!! গাড়ীতে উঠে কর্পুরের মতো উবে গেল মনখারাপ হওয়াটা। এমনই হয় সবসময়, পুঁজিবাদী নীতিবোধ, সামনে পড়লে একটু হাহুতাশ, পেছনে চলে গেলে কিছুই মনে থাকেনা -- সেজন্যই হয়ত বেঁচে থাকতে পারছি। সেজন্যই আমরা ম্যারিনস্পোর্টসের আমোদে ভেসে যেতে পেরেছি। তপনদা উড়িয়ে নিয়ে যায় গাড়ী, ফিয়েস্টা রিজোর্ট হোটেলের সৈকতের বালুতে একদম সুকেশদার পায়ের সামনে গিয়ে গাড়ী থামে। হার্ড ব্রেক!!

৫.

ফিয়েস্টার সৈকতে পৌঁছানোর পর বুঝলাম আরো আরাম করে ঘুমিয়েটুমিয়ে হেলেদুলে আসলেও হতো, অথবা নিদেনপক্ষে তপনদাকে নিয়ে শহরটা ভালো মতো ঘুরে দেখলেও খারাপ হতোনা। কারণ, সুকেশদা আমাদের পাক্কা চল্লিশ মিনিট বসিয়ে রাখলেন। অবশ্য আমলাতান্ত্রিক ছোঁয়া তার মাঝে এখনও লাগেনি, চল্লিশ মিনিটের মধ্যে অন্ততঃ দশবার এসে বললেন, "ভাইয়া কোন সমস্যা নাই তো, এই একটু পরেই শুরু করব।" আমরা উদারভাবে বলি, "না না, কি সমস্যা"। আসলে সমস্যাও ছিলনা, সাগরের পাড়ে বসে এমনিই কাটিয়ে দেয়া যায় একদিন। আর এখানে বসে আমরা দেখতে পাচ্ছি সাগরের বুকজুড়ে নানরকম খেলায় মত্ত সবাই -- প্রাকৃতিক এ্যামিউজমেন্ট পার্ক যাকে বলে।

বঙ্গদার সাথে

কেউ কেউ চোখে ডুবুরীর চশমা আর মুখে শ্বাসপ্রশ্বাসের নল ঢুকিয়ে নেমে পড়ছে সমুদ্রে, অগভীর পানিতে ডুবে ডুবে ভাসছে আর দেখছে সাগরের উদ্ভিদগুলোতে। সাইপানের বীচগুলোর এই একটা বৈশিষ্ট্য, উপকূলের খুব কাছেও হালকা মিষ্টি নীল পানির নীচেই ধবধবে নুড়িপাথরের পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ, শ্যওলা বললে ভালো শোনায়না, কারণ পানির নীচে এই শ্যওলার গোলাকেই অসম্ভব সুন্দর দেখায়। এভাবে অগভীর পানিতে ডুবে ডুবে সমুদ্র দেখাকে বলা হয় স্নোকেলিং। অগভীর পানিতে বিনা অক্সিজেনে স্কুবাডাইভিং হিসেবে কল্পনা করা যাতে পারে। আবার কেউ কেউ সাগরের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জেটস্কী, সাঁই সাঁই করে যেন বিশালাকায় মোটরবাইক চলছে। আরেকটা মজার জিনিস দেখলাম, নাম ব্যানানাবোট। কলার আকৃতির বিশাল একটা ফোলানো বেলুন বলতে পারেন, তার ওপর লাইন ধরে বসে কয়েকজন, তারপর সেই কলার ভেলাকে টেনে নিয়ে যায় ইঞ্জিনের নৌকা। এটাও ধাঁইধাঁই করে দাপিয়ে বেড়ায় সাগর। তবে জেটস্কীর চেয়ে যেটা আলাদা সেটা হলো ব্যানানাবোট খানিকটা বিপজ্জনক। ইঞ্জিনবোট যখন ব্যানানাবোটকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়, তখন ব্যালান্স হারাতেই পারে, তাই উল্টে সাগরে পরে যাওয়ার ভয় আছে। সেজন্য ব্যানানাবোটে চড়ার আগে সবাইকে লাইফজ্যাকেট পরিয়ে নেয়া হচ্ছে।

চামোরো মাঝি, ডরাইছে কিনা কইতে পারিনা হাসি

খানিকপরেই চোখ গেল আকাশের দিকে, চোখে পড়ল আকাশের বুকে বিশালাকায় পাখীর মতো ভেসে বেড়ানো প্যারস্যুটগুলোর দিকে। হুমম, এটাই তাহলে সেই প্যারাসাইক্লিং!! আমি শিহরিত হলাম, আবার খানিকটা উদ্বিগ্ন। বলতে গেলে জীবনে কখনও পানিতেই নামিনি সেভাবে, সেখানে আজ সাগরকে টেক্কা দিয়ে তার ওপরে আকাশে উরে বেড়াব!! যা আছে কপালে ভেবে দুশ্চিন্তাটাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
সাগরের নীল, বিশুদ্ধ নীল
খানিক পরেই বঙ্গদা চলে এলো, এই লোক কাজের। এসেই স্ক্যাজ্যুলিং করে ফেলল, কোন আইটেমের পর কোন আইটেম করা হবে। প্রথমে আমাদের বোটে করে নিয়ে যাবে মানাগাহা দ্বীপে, সেখানে একটা পর্যন্ত আমরা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াব, সাথে দিয়ে দেয়া হবে স্নোকেলিংয়ের জিনিসপত্র, একটা বড়সড় ভিনাইলশীট আর দুপুরের খাবার। ও, যেটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আগেরদিনই বঙ্গদা বলে রেখেছিলেন, মানাগাহা দ্বীপে খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও দাম সাইপানের তিনগুন। ছোট্ট দ্বীপ, মানুষ থাকেনা, দ্বীপের মাঝখানে একটা রেস্টুরেন্ট টাইপের কিছু আছে। কাজেই উনিই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করবেন। বঙ্গদা, সুকেশদা, দুজনেরই স্ত্রী জাপানিজ। মেয়েগুলো সাইপানে ঘুরতে এসেছিল, বাঙালী ছেলেদের উদ্যম দেখে পছন্দ করে ফেলেছিল। লাজুক হাসি হেসে হেসে বঙ্গ আর সুকেশ তাদের পুরোনো স্মৃতিও কিছুটা রোমন্থন করেছিল।

খাবারটা প্রস্তুত করে দিয়েছে বঙ্গদার স্ত্রী, জাপানী স্টাইলে, যেটাকে জাপানীরা বলে "বেনতো", ইংরেজিতে লাঞ্চবক্স বলা যায়। তবে শুনেছি এখন "বেনতো" শব্দটাই নাকি লিঙ্গুয়াফ্রাঙকায় ঢুকে গেছে। ইংরেজী অন্যান্য ভাষাতে ঘুন ধরিয়েছিল, আজ ইংরেজীতেই ধরতে বসেছে। অবশ্য ব্যাপারটা হয়ত আজ না, অনেকদিন ধরেই হয়ত এভাবেই একভাষা আরেক ভাষাতে ঘুন ধরাচ্ছে, এটাই হয়ত নিয়ম, প্রচলনের সাথে সাথে ভাষার বিবর্তন। এখন মনে হচ্ছে, ঘুনে ধরা শব্দটা না ব্যবহার করে বরং প্রলেপ দেয়া শব্দটাও ব্যবহার করা যায়। বেনতোর বাক্স ধরিয়ে দিল বঙ্গদা, খুলে দেখলাম। ভাত, সালাদ, ভাজির সাথে বিশাল সাইজের একটা বীফ স্টেক (হামবুর্গ স্টাইলের মিন্সড মাংস দিয়ে তৈরী, এই হামবুর্গ স্টেক কে জাপানীরা অগ্যাত কারণে হামবাগ বলে, হ্যামবার্গারের সাথে প্যাঁচ লেগে যায়; জাপানে আসলে হ্যামবার্গার খেতে চাইলে তাই "হ্যাম" বা "হাম" না লাগিয়ে শুধু বার্গার বলাটাই নিরাপদ, নাহলে রুটি ছাড়া এলকটা স্টেক চলে আসতে পারে পাতে )।

সাগরের সাথে দিগন্তের দেখা

ঠিক দশটা দশে আমরা নৌকোয় উঠি, হাতে বঙ্গদার ধরিয়ে দেয়া বেনতো আর স্নোকেলিংয়ের জিনিসপত্র। নৌকার মাঝি একজন চামোরো, বিশালদেহী মোটাসোটা লোক, সেই একইরকম বুঁদ হয়ে বসে আছে। আরেকজন হেলপার আছে তার, সেও চামোরো, দেখেই বোঝা যায় সারাদিনই সে সমুদ্রেই কাটায়, পোড়া শরীর চোখে কালো চশমা। এলোকটা অবশ্য শুকনো ধরনের, আর বুঁদ হয়ে বসে না থেকে বরং লাফালাফি করছিল, পথেই দুএকবার নৌকা থেকে লাফ দিয়ে কতক্ষণ সমুদ্রে সাঁতরে আবার ফিরে আসল, কেন কে জানে। হয়ত সুমিং এ্যাডিকশন নামে কোন সমস্যার কথা বিজ্ঞানীরা এখানে খুঁজে পাবেন। ওদের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখন মনে করতে গিয়ে দেখি বেমালুম ভুলে গেছি। গিন্নীও তাও। হেল্পার লোকটার আবার ভাবসাবও সেরকম, মারমার কাটকাট, দেখে মনে হবে জেমস বন্ডের ব্ল্যাক ভার্সন। আমি খানিকটা ভয় গিলি, এদেরকে তো কিছু বলতেও পারবনা, মাঝসাগরে নিয়ে যদি উপুড় করে ফেলে দেয় তো হাসিমুখে সেটাই মেনে নিতে হবে। মনে মনে যতরকম দোয়াদুরূদ জানি পড়া শুরু করি, অবশ্য সেটা মাঝিদের চেয়েও সাঁতার না জানার ভয়ে।

পানিতে আলোর কিলবিল

আমাদের বোটের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি ব্যানানা বোট, সেখানে চার জাপানীজ লাইফজ্যাকেট গায়ে চড়ে বসেছে। নৌকা রওয়ানা হয়, একসময় সৈকত ছাড়িয়ে ছুটে যায় মানাগাহার দিকে। যতই সমুদ্রের ভেতরে ঢুকতে থাকে, সাগরদেবী যেন ততই তার রূপে মুগ্ধ করতে থাকে আমাদের। দিনটি ছিল অসম্ভব রৌদ্রজ্জ্বল, সুর্য্যের আলো সাগরের হালকা নীল পানিতে এসে পড়ে, ঠিক যেন আলোর কিলবিল চলে সাগরের বুকে। ভিডিও করার চেষ্টা করি, পরে দেখে বুঝি সেটা যন্ত্রের পক্ষে বোঝা বা ধারন করা সম্ভব না, সেটা শুধু মানব আর প্রকৃতির পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব। মিনিট দশেকের মধ্যেই আমরা মানাগাহা দ্বীপে পৌঁছে যাই, দুই মাঝি আমাদের কুলে নামতে সাহায্য করে। মজার ব্যাপার হলো পুরোটা পথ দুজন মাঝি আমাদের সাথে পুরোপুরি ইশারা ইঙ্গিতেই কথা বলেছে, কখন কোথায় ধরতে হবে, কখন ভিডিও ক্যামেরা সামলাতে হবে এরকম সবকিছু। মানাগাহা দ্বীপে ঢোকার পথে একটা চেকপোস্ট আছে, চেকপোস্টের সাথেই কংক্রীটের একটা রাস্তা। রাস্তা ধরে মূলদ্বীপে যাওয়া লাগে। চেকপোস্টে দুজনের প্রবেশমূল্য দশ ডলার দিয়ে যেই কংক্রিটের রাস্তা ধরে দ্বীপের অভিমুখে রওয়ানা হলাম, আমি বিস্মিত! এত সুন্দর দ্বীপ হয়!!!!

(ভেবেছিলাম ম্যারিন স্পোর্টস নিয়েও এই পর্বেই লিখব; ওমা! এত বড় কখন হয়ে গেল লেখাটা !! ...পরের পর্বে মিস নাই:))


মন্তব্য

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

প্রকৃতিদা, স্যরি, আবারও সেই বড়ই হয়ে গেল মন খারাপ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বড় মানে? বিশাল হয়েছে। শুরু করতে দেরী হয়ে গেল। সাবমেরিন পর্যন্ত এসে আর পড়তে ভাল্লাগলোনা, মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাকীটা পরে পড়ে নেব। মনে হচ্ছে আকাশ ভ্রমনের বর্ণনা আছে বাকীটাতে।

শেখ জলিল এর ছবি

ভ্রমণকাহিনীর প্রতি আমার বেশ দুর্বলতা আছে। সময় নিয়ে পড়ার মতো লেখা।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ জলিল ভাই ,,, বেশ বড় হয়ে গেছে বুঝতে পারছি ,,,সময় করে পড়ে মতামত জানাবেন
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এইটা পড়ে পাঁচিনকো খাইতে অথবা খেলতে মন চাইতেছে । হাসি

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

পাচিনকো তো খেলার জিনিস ,,, তবে নাবিসকো খেতে খেতে খেলটে পারেন ,,,, অথবা তাকাকো/মিকিকো-দের সাথে হাসাহাসি করতে করতেও খেলতে পারেন চোখ টিপি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।