দেশে কি নামের অভাব পড়ছে?

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: রবি, ০৪/০৭/২০১০ - ৪:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাবেক অর্থমন্ত্রী, প্রয়াত সাইফুর রহমান সিলেটে সবার কাছে শ্রদ্ধেয় এবং জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।নিজের এবং তার পরিবারের নামে সিলেটের নবনির্মিত সবকিছুর নামককরণ শুরু করে সেই সাইফুর রহমানই জোট সরকারের আমলে সিলেটবাসীর কাছে উপহাসের পাত্র হয়ে ওঠেন।ক্রমাগত তার জনপ্রিয়তা পড়তে থাকে।চাটুকারদের বদৌলতে সাইফুর সাহেব অবশ্য সিলেটবাসীর মতামতকে গুরুত্ব না দিয়েই সিলেট জুড়ে তার পরিবারের ব্র্যান্ডিং চালাতে থাকেন।এর ফলাফল হলো নির্বাচনে তার গো-হার এবং মৃত্যুর পরও কৌতুকের চরিত্র হয়ে থাকা।

সাইফুর সাহেবের মতোই আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজের ঢোল নিজে বাজাতে পছন্দ করেন।জনগণ না চাইলেও তারা চান জীবদ্দশাতেই নিজের নামে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে।আর এই নাচুনী বুড়িদের পেছনে ঢোলের বাড়ি দিতে সবময় প্রস্তুত হয়ে থাকে একদল তেলবাজ চাটুকার।কেন জানি না শিক্ষকরা এই তেলবাজি খুব পছন্দ করেন।যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকেরা সেই দলের মহান নেতাদের নামে কিছু একটা বানাতে উঠে পড়ে লাগেন।

সে কারণেই দেখা যায় বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হল হবে, শিক্ষকদের সিন্ডিকেট সর্বসম্মত হয়ে প্রস্তাব দিলো এ হলের নাম হোক ম্যাডামের নামে অর্থাৎ "বেগম খালেদা জিয়া হল"।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণই বা রাজশাহী থেকে পিছিয়ে থাকবেন কেন? তারবো একটি নতুন একটি ছাত্রী হল বানানোর পরিকল্পনা করে হলের নাম প্রস্তাব করলো বেগম জিয়ার নামে।বেগম জিয়ার আশেপাশের লোকজনও তাকে বোঝালো “ম্যাডাম, জনগণ চায় আপনার নামে কিছু হোক, তাদেরকে নিরাশ করাটা আপনার জন্য হবে বড় রকমের একটি বড়আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত”।জনগণ চাওয়াকে দেশনেত্রী কিভাবে এড়ান! অতএব বেগম জিয়াও এই প্রস্তাবে সায় না দিয়ে পারলেন না।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।দেশে এতো নাম থাকতে বেগম জিয়ার নামে ছাত্রী হলের নামকরণের প্রয়োজনীয়তা আমি তখন বুঝতে পারছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তখন এ নিয়ে হাসাহাসি করতো। এমনকি আমার যেসব বন্ধু ছাত্রদল করতো তারাও তাদের ম্যাডামের নামে হলের নামকরণকে একটা বাজে সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করে তেলবাজ শিক্ষকদের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতো।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই তেলবাজ অধ্যাপকেরাই আবার ভোল পাল্টে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হলের নামটি আবার পরিবর্তনের আবেদন জানায়।এবং যথারীতি সে আবেদন সাদরে গৃহিত হয়।

নাম পরিবর্তনের এই সংস্কৃতি এদেশে বহুকাল আগে থেকেই চালু রয়েছে।এরশাদের নামে উদ্বোধন করা ফলক সরিয়ে খালেদা জিয়ার নাম বসানো হয়েছে। আবার তার নাম সরিয়ে বসানো হয় শেখ হাসিনার নাম।তবে শেখ হাসিনা তার প্রথম শাসনামলে পিতার নামে নতুনপুরাতন সবকিছুর নামকরণ করে দেশব্যাপী আলোড়ন তোলেন।বিএনপি পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে সেইসব নাম বদলে জাতীয়তাবাদী রং দেয়া শুরু করে।শুধু প্রয়াত জিয়ার নামেই নয় এই সুযোগে সাইফুর রহমানসহ অনেক জীবিত নেতা ও তাদের পরিবারের নামেও তারা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ শুরু করে। আমার জানামতে সম্ভবত সেবারই সমস্ত আলোচনা সমালোচনা থোড়াই কেয়ার করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে খালেদা জিয়ার নামে স্থাপনা তৈরি হয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দিনবদলের বুলি আউড়ে ক্ষমতায় আসা চৌদ্দ দলীয় সরকারও থোড়াই কেয়ার করার নীতি অব্যাহত রাখে।দিন বদলের চমক হিসেবে তারা ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে পূর্বসূরী জোট সরকারের পথেই হাঁটতে শুরু করে।সেই হাঁটাকে তরান্বিত করতে এবার এগিয়ে এসেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিন্ডিকেট।দলবাজী এবং তেলবাজীর চূড়ান্ত উদাহরণ রেখে সেখানে প্রস্তাবিত একটি ছাত্রী হলের নাম তারা দিয়েছে "http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-07-02/news/75498শেখ হাসিনা ছাত্রী হল"এবং একটি বিজ্ঞান গবেষণাগারের নাম দেযা হয়েছে “ড.ওয়াজেদ মিয়া গবেষণা কেন্দ্র”।খালেদা জিয়ার চাটুকারদেরর মতো এবার শেখ হাসিনার আশেপাশের চাটুকারেরাও তাকে নিশ্চয়ই বোঝাবেন “ আপা দেশের জন্য আপনার মহতী ভূমিকার স্বীকৃতি পাবার এইতো সুযোগ!”আর আপা্ও মাথা ঝাঁকিয়ে বলবেন তাইতো “খালেদা জিয়ার নামে হল আছে আর আমার নামে নেই তাতো হতে পারে না”।এসব ফালতু কাজের কারণেই খালেদার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিলো এটা কি তিনি একবারও ভাববেন বা তার উপদেষ্টারা তা তাকে ভাবতে বলবেন?

তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন, সোনায়া গান্ধীর মতো দুএকজন বাদে তারা কেউই এসব নিয়ে ভাবেন বলে আমার মনে হয় না।আর উপদেষ্টারাও তেল দিয়ে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এসব অজনপ্রিয়তা উৎপাদনকারী ফালতু কাজে নেতানেত্রীকে উৎসাহ যোগান।দীর্ঘ পোড় খাওয়া রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে শেখ হাসিনার অন্তত এসব বিষয় বোঝা উচিৎ।এদেশের ইতিহাসে মহান নামের কোন কমতি নেই।তার কিংবা খালেদা জিয়ার অবদানের জন্য তাদের নামে কি হবে না হবে তা তারা নয় ভবিষ্যত প্রজন্ম ঠিক করবে।নিজ নিজ ক্ষমতার বলে নিজেরা নিজেদের নামে কিছু করলে সেটা খুবই নির্লজ্জ হাস্যকর দেখায়।এবং জনগণ তা ভালোভাবে নেয় না।

খালেদা জিয়া, সাইফুর রহমানরা এটা বোঝার চেষ্টা করেননি বলেই জনগণ তাদেরকে প্রবলভাবে উপেক্ষা করেছে, দেশের রাস্তাঘাটে কান পাতলেই তাদের নামকরণ কর্মকাণ্ড নিয়ে হাসাহাসি শুনতে পাওয়া যায়।“ খালেদা অধম বলে আমি উত্তম থাকিবো কেন” বলে নিজের নামে জনগণের টাকায় তৈরি স্থাপনার নামকরণ করে শেখ হাসিনাও যদি সে পথে হাঁটেন তবে সেটা হবে খুবই বাজে একটা উদাহরণ যা আমাদের জন্য হতাশার এবং প্রকৃত অর্থেই দিন বদলের স্বপ্নের সাথে বেমানান।

৪/০৭/১০
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সাধারণ মানুষ দিনবদল বদল চায়, নাম বদল নয়। এই সত্যটা বুঝতে এতো সময় কেন লাগছে সেটাই আমাদের প্রশ্ন। লেখকেকে ধন্যবাদ এই বহুল আলোচিত, পরিচিত অজনপ্রিয় কর্মকাণ্ডটির সুন্দর বিশ্লেষণের জন্য। উপদেষ্টা পরিষদে সাধারণ বুদ্ধির কোন মানুষ কি থাকবেনা কখেনোই যারা নিজের কার্জ হাসিলের জন্য চাটুকারিতার আশ্রয় নেবে না?

শারমিন শিমুল

অতিথি লেখক এর ছবি

মনে হয় আমাদের বুঝ হবে না! কামের চেয়ে নাম দরকার।

সাহাদাত উদরাজী

তার্কিক [অতিথি] এর ছবি

ড. ওয়াজেদ মিয়ার নামে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্র হওয়ার মাঝে আমি দোষের কিছু দেখি না।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। আমাদের দেশে আসলেই এই নামকরন নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের মাতামাতি চলে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হিমু এর ছবি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলটির নাম শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীন কিংবা গণআন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের নামে হতে পারে।



বুকে BOOK রেখে বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

অতিথি লেখক এর ছবি

সাইফুর রহমান সিলেটবাসীর কাছে এখন উপহাসের পাত্র এই তত্ত্বটা আপনাকে কে দিল!
আর তার জনপ্রিয়তা যে নামকরনের জন্য পড়ে গেছে এই আজব তত্ত্বই বা পেলেন কোথায়!

সাইফুর রহমানের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছিল তার ছেলের দুর্নীতির জন্য।সাইফুর রহমান সিলেটের জন্য অনেক করেছেন।সিলেটবাসী এখনো তাকে সম্মানের চোখেই দেখে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।