এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি!

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: সোম, ২০/০৫/২০১৩ - ৪:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাহলে গল্পটা এভাবেই শেষ হচ্ছে?
বলতে পারিস।
মুকূল চারিদিকে নজর বোলায়। মুক্তো ঝরানো হাসির মতো পূর্ণিমা রাত। ডালিতে সাজিয়ে রাখা ফুল হয়ে হাজার হাজার তারায় ভরে আছে আকাশ। তাদের মাঝখানে মৌন ঋষির গভির দৃষ্টিতে দিনের আলো ছড়িয়ে চেয়ে আছে চাঁদ-
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে,- ডাইনে আর বাঁয়ে
মেঠো চাঁদ-কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা-

ও ওপরে তাকায়। বট গাছের প্রকান্ড শাখাগুলো জোছনাকে ফালি ফালি করে থম মেরে ওকে দেখছে। ও আনমনে বলে ওঠে-
যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে
অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনলি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে বলেনি কি: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?


ওর সামনে খানিকটা ফাঁকা মাঠ। একটু পর মাঠকে অর্ধবৃত্তাকারে ঢেকে দিয়েছে ফসলের ঢেউ। বাতাসে নেচে নেচে নুয়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে পাটের ছিপছিপে শরীর। আশেপাশেই কোথাও বোধ হয় নদী আছে। জলের নরম একটা ঘ্রাণ ওকে কারো চুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা- ও আউড়ায়। ঘন চুলে ডুবে বড় করে শ্বাস নেয়, আহ!
যায়গা পছন্দ হয়েছে?
পারফেক্ট। এক্কেবারে পারফেক্ট দোস্ত-
দ্যা উডস আর লাভলি, ডার্ক
অ্যান্ড ডিপ, বাট আই হ্যাভ
প্রমিসেস টু কিপ, অ্যান্ড মাইলস
টু গো বিফোর আই স্লিপ

ফ্রস্ট?
ভেরি গুড। ভুলিসনি তাহলে!
কী করে ভুলি! এসএমআই যেভাবে আবৃত্তি করে করে কবিতাগুলো মগজে ঢুকিয়ে দিতেন-
ও ওয়াইল্ড ওয়েস্ট উইন্ড, দাউ ব্রেথ অব অটামস বিঙ
দাউ ফ্রম হুজ আনসিন প্রেজেন্স দ্যা লিভস ডেড
অ্যান্ড ড্রাইভেন লাইক ঘোস্ট ফ্রম অ্যান এনচ্যানটার ফ্লিইং

স্বপ্নালুর মতো আবৃত্তি করে আজাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। সিগারেট খাবি একটা?
শেষ ইচ্ছা জানতে চাইছিস?
মনে কর সেটাই।
দে একটা ধরাই।
আজাদ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে।
ব্যানসন! শালা এখনো বুর্জোয়াই থেকে গেলি!
তাহলে কি তোর মতো চে’র ছেড়া গেঞ্জি গায়ে, আকিজ বিড়ি টেনে টেনে জীবনটা পথেঘাটে ফেরার হয়ে কাটিয়ে দেবো?
হো হো করে হেসে ওঠে মুকূল। হলের পুকুর পাড়ে বসে এককালেতো সেটাই চাইতি দোস্ত-
বাকানো চাঁদের গাঢ় ফলাটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে
চাঁদের শতক আজ নয়তো
এ যুগের চাঁদ হলো কাস্তে

তখন ইমম্যাচুউরড ছিলাম। দুনিয়াটা অন্যরকম ছিল।
তাই বুঝি! মুকূল কৌতুকের সুরে বলে। বল যে, নীলাকে পেলাম না তাই ও পথে আর গেলাম না!
হতে পারে, আজাদ মৃদু হেসে সিগারেট বের করে ঠোটে ঝুলায়। ব্যানসন খাবি, না খাবি না?
দে, কতো কিছুর সাথেইতো কমপ্রোমাইজ করলাম। এটাতো সামান্য ব্যানসন। তা, হাতকড়া পরে আয়েস করে টানবো কীভাবে?
চিন্তা করিস না, খুলে দিচ্ছি।
তাই! মুকূল অবাক হয়। তারপর হেসে ফেলে। ও এটাইতো তোদের নিয়ম। হাতকড়া খুলে দিবি। বলবি বাঁচতে চাইলে খিঁচে দৌঁড় লাগাও। এরপর পেছন থেকে গুড়–ম। আমি কিন্তু ওসবের ভেতর নাই বন্ধু। গুলি করলে সামনাসামনিই করবি। তবে খেয়াল রাখিস চে’র মুখটা যেন নষ্ট না হয়, আঙ্গুল দিয়ে ও গেঞ্জিতে আঁকা চে’কে দেখায়।

ভালোই বলেছিস পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জ থেকে শুট করি। পরে এই নিয়ে মিডিয়ায় হইচই। পত্রিকার হেডলাইন, ঠাণ্ডা মাথায় কমরেড মুকূলকে হত্যা। কেল্লা ফতে। ঘরে ঘরে বিপ্লবী মুকূলের ছবি। না দোস্ত, জীবিত মুকূলের চেয়ে মৃত মুকূলকে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ আমি দেবো না। আই মিন দিতে পারি না। তোর কাছে বারবার আমি হারতে পারি না, কী বলিস?
আমার কাছে হেরেছিস, স্বীকার করিস তাহলে! মুকূল ঝুঁকে আজাদের বাড়িয়ে দেয়া লাইটার থেকে সিগারেট ধরায়।
অস্বীকার করবো কেন? আমাদের দু’জনের ভেতর থেকে নীলাতো শেষতক তোকেই বেছে নিল। কপাল খারাপ মেয়েটার। তোকে পছন্দ করে কী লাভ হল? খেয়ে না খেয়ে বনে জঙ্গলে পলাতক লাইফ। কী যেন বলিস তোরা? মহান বিপ্লবী জীবন! আজাদের সিগারেটের আগুন প্রাচীন তারার মতো জ্বলে নিভে, কী কচুটা করতে পারলি? এখন দে, বেঘোরে জানটা দে। মেয়েটা সারাজীবন কাঁদুক।
কেন তুই আছিস না! নীলাকে বলবি, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আমিই তোমার সব। এসো নতুন করে শুরু করি। বাড়ি, গাড়ি, টাকা, শান শৌকত, ক্ষমতা কোন কিছুর অভাব নেই আমার, নীলা...হুবুহু নকল করে বাংলা সিনেমার ডায়লাগ দিয়ে মুকূল মিটিমিটি হাসে।
আজাদ হেসে ফেলে। তুই পারিসও। একটুও বদলালি না। মরার আগেও ফাযলামী!
মরা মানে কীরে শালা? আমিতো যেদিন থেকে এই পথে এসেছি সেদিন থেকেই মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছি।
যে জীবন শোষিতের, বিপ্লবের, নিপীড়িতের
সে জীবন মুকূলের নয়...

ওসব ভড়ং রাখ। কতো বড় বড় বিপ্লবীকে দিনের শেষে ন্যাংটা হতে দেখলাম। আমাদের আলতাফ ভাইয়ের কথা মনে নেই, সারাক্ষণ-
বেয়োনেট হোক যতো ধারালো
কাস্তেটা ধার দিও বন্ধু
শেল আর বম হোক ভারালো
কাস্তেটা শান দিও বন্ধু

সেতো এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সরকারের হয়ে বিদেশীদের সাথে ক্যাপিটাল দিয়ে দেনদরবার করেন!
এ আর নতুন কী! আলতাফ ভাইতো পুরান পাপী। তার কথা রাখ, নিজের দিকে চেয়ে দেখ। তুই পচিসনি, নষ্ট হসনি? তুই না বলতি, উই মাস্ট স্ট্রাগল এভরি ডে সো দ্যাট দিস লাভ ফর হিউম্যানিটি বিকামস রিয়েলিটি। কোথায় তোর স্ট্রাগল, মানুষজনকে ধরে ধরে মেরে ক্রসফায়ারের গল্প সাজাচ্ছিস, এর নাম বুঝি হিউম্যানিটি, মুকূল বিদ্রুপের সুরে বলে। তোদের মতো নষ্টদের কারণেই মানুষ বিপ্লবকে আর বিশ্বাস করতে পারে না। তোদের কারণেই লেখা হয়-
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেলিন
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে

হাউএভার আমি মনে করি যারা নষ্ট হবার তারা হবেই, ঝড়ে দূর্বলরা ঝরে পড়বেই। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মেই গাছের দু একটা আম পাকবেই। এখানেই আশা। তুইতো আমাকে অনেক আগে থেকে চিনিস। ইট ইজ বেটার টু ডাই স্টানডিং দ্যান টু লিভ অন ইওর নিইজ- আমি আগেও বিশ্বাস করতাম এখনো করি, আজীবন করবো। বুকে হাত দিয়ে বলছি পচে গলে পরিচয়হীন হবার চেয়ে আমি মুকূল চে’র মতো বুকে বুলেটের আদর নিয়ে বিদায় নিতে পারলেই বেশি তৃপ্তি পাবো, বুঝলি-
আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো
আমি হয়তো মারা যাবো কারো ঘুমের ভেতরে
একটি ছোট দীর্ঘশ্বাসের জন্যে

সেটাই দুঃখের কথা, সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে গোড়াটা ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে আজাদ কাধ নেড়ে শ্রাগ করে, কত্ত বড় ওয়েস্টেজ সেটা এই দেশও বুঝলো না, তুইও বঝবি না। যাই হোক সময় কম, রেডি হয়ে যা।
আমিতো সবসময় রেডিই দোস্ত। ঘর ছেড়ে যে বাইরে গেছে তার থাকে না ঘরবাড়ি- কী করতে হবে বল?
অস্তে আস্তে সামনের দিকে হাঁটতে থাক, আজাদ কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে। জোছনার আলোয় যন্ত্রটাকে যাদুর কোন এক আজব বাঁশী বলে মনে হয়।
.২২ বোর। রাশান, ভালো জিনিস। যায়গামতো লাগাতে পারলে এক শটেই খেল খতম, বলতে বলতে মুকূল সামনে পা বাড়ায়-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমূদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি

দাঁড়া, নীলার সাথে শেষবারের মতো কথা বললে বলতে পারিস। মোবাইল দিচ্ছি, আজাদ পকেট থেকে ফোন বের করে।
ভালোই বলেছিস!ওকে ফোন দেই, তারপর নম্বর ট্রেস করে ওকেও চৌদ্দ শিকে ঢুকা! ওই আশা ছাড় দোস্ত। আপাতত আমার জানই কবজ কর। পরে পারলে নিজে থেকেই নীলাকে খুঁজে বের করিস।
শোন, আজ হোক আর কাল হোক ওকে ধরা পড়তেই হবে। আই মিন বিপ্লবের নামে তোরা যারা সন্ত্রাস করে বেড়াস তাদের কারোরই রেহাই মিলবে না।
সন্ত্রাস! হো হো করে হেসে ওঠে মুকূল। ওর হাসি মাঠ পেরিয়ে ফসলে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। পাট ক্ষেতের ভেতর সরসর আওয়াজ হয়। হয়তো বিরক্ত হয়ে সরে যায় কোন শিয়াল।বটের পাতার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা পাখিদের দু’একজন চেঁচিয়ে ওঠে। তাদের কণ্ঠ ছাপিয়ে মুকূলের ভরাট কণ্ঠ গমগম করে, পাকিস্তানীদের কাছে জয় বাংলারাও সন্ত্রাসী ছিল রে! অশ্লীলতার যেমন কোন সংজ্ঞা নেই, তেমনি সন্ত্রাসীরও নেই। এই যে তোরা মানুষজনকে ধরে ধরে বিনাবিচারে গুলি করে ক্রসফায়ার বলে চালিয়ে দিচ্ছিস, এটাও তো এক ধরনের সন্ত্রাস। নাকি লাইসেন্স করা সরকারি পিস্তল আছে বলে তোদেরটা ঐশ্বরিক আর আমাদেরটা মানবিক?
ধূর শালা, সরাজীবন বেশি বকবক করে গেলি! কাজের কথায় আয়, নীলাকে ফোন দে, বিদায় বল।
নেভার।

ঠিক আছে, অমিই দিচ্ছি। মুকূলকে অবাক করে দিয়ে ফোনের বাটন টেপে আজাদ। নীলা, শালাতো বহু ত্যাদড় মাল। তাড়াতাড়ি ওকে চোখের সামনে থেকে সরা। মেজাজ ধরে রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
পাটক্ষেতের ডান দিক থেকে বেরিয়ে আসে নীলা। বুট, জিন্স আর কলো সাদা কামিজর ওপর লাল একটা জ্যাকেট জড়িয়েছে ও। চুলগুলো টানটান করে খোপা করা। হাতে একটা কাটা রাইফেল। ওকে দেখে আজাদের কেন যেন অপারাজেয় বাংলার ভাষ্কর্যের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। লম্বা পা ফেলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে গ্রিক পৌরাণিক দেবীর মতো নীলা ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়-
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন
আজাদের ভেতরটা ভাপ ওঠা পিঠার মতো নরম করে কেঁপে ওঠে-
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

অনেক দিন পর? কেমন আছো নীলা?
বাহরে কার্টিসি করে কথা বলা হচ্ছে, অবাক হবার রেশ কাটিয়ে মুকূল নিজেকে সামলে নিয়েছে। জীবনে ওকে তুই ছাড়া তুমি ডেকিছি আমরা?
নীলা হাসে। থ্যাঙ্কস আজাদ। তোর এই ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারবো না, এক হাত দিয়ে সে শীমের লতার মতো মুকূলের হাত পেঁচিয়ে ধরে।
আজাদের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে-
সুরঞ্জনা ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে


অনেকগুলো ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ে ওর স্মৃতিতে। ওর মনে হয় ঢেউয়ের ভারে ও হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ছে। বটের প্রাগৈতিহাসিক শরীরে ভর দিয়ে ও নিজের পতন ঠেকাতে চেষ্টা করে, ঋণ শোধ টোধ পরে হবে। এখন তাড়াতাড়ি ভেগে যা।
ঠিক। বেশি দেরী করা উচিত হবে না, নীলা চারিদিকে একবার সতর্ক নজর বুলিয়ে নেয়।
সত্যিই ছেড়ে দিচ্ছিস? মুকূল চোখ নাচায়।
শেষবারের মতো। আগামীবার আর ছাড়বো না।
নীলা যদি আবার রিকোয়েস্ট করে?
আজাদের গলাটা শুকিয়ে আসে। আড় চোখে ও নীলাকে এক ঝলক দেখে নেয়- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! সে তখন দেখা যাবে, এখন তাড়াতাড়ি পা চালা।
ধন্যবাদ বন্ধু, মুকূল ওকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে- আবার দেখা হবে, হয়তো মানুষ নয় শঙ্খচিল শালিকের বেশে..
তাড়াতাড়ি, নীলা তাড়া দেয়। ছেলেরা নৌকায় অপেক্ষা করছে।
বিশ্বস্ততো? আজাদ সরু চোখে তাকায়।
চিন্তার কিছু নেই। ওরা সবাইকে আমি ভালোভাবে চিনি। প্রয়োজনে মুকূলে জন্য জান দিয়ে দেবে, নীলা অভয় দেয়।
অবিশ্বাস হলো শোষনের হাতিয়ার। ও দিয়ে বড়জোর পুলিশ অফিসার হওয়া যায় আজাদ সাহেব, বিপ্লবী হওয়া যায় না। আর তাই..
আবার শুরু করলি! আজাদ অধৈর্য হয়ে ঘড়ি দেখে, এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। নে এটা ধর, নিজের পিস্তলটা মুকূলে দিকে বাড়িয়ে দেয় ও। যাবার আগে আমার পায়ে একটা গুলি করে যাবি। গল্পটা হবে আমার পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে গুলি করে তুই পালিয়ে গেছিস।
তোর চাকরি নিয়ে টান পড়বে না?
অসুবিধা নেই। আলতাফ ভাইকে ম্যানেজ করে রেখেছি।
শেষ পর্যন্ত ওই শুয়োরটার কৃপায় বাঁচতে হচ্ছে আমাকে, মুকূল ঘৃণায় মুখ কোঁচকায়।
শুয়োরটাতো একসময় তোর মহান নেতা ছিল!
ছিল। এখন আর নেই। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে অকারণে বদলায়, মুকূলের দৃষ্টি অনেক দূরে হারিয়ে যায়।

দলছুট হবার পরও উনি কিন্তু তোকে এখনো অনেক স্নেহ করেন।
তাই নাকী! মুকূল তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। বুর্জোয়াদের ভালোবাসা আর সাপের চুম্বনের মধ্যে আমি কোন তফাত দেখি না।
ওসব হিসাব নিকেশ পরে করিস। এখন আপাতত ফিরে পাওয়া জীবনটা উপভোগ কর।
ফিরে পাওয়া জীবন, খারাপ বলিসনি। লাইফ ইজ অ্যান অপারচুনিটি, বেনিফিট ফ্রম ইট।
ঠিক আছে, আসি তাহলে, মুকূল ওর সাথে হাত মেলায়। নীলাও হাত বাড়িয়ে দেয়। নীলার হাতটাকে নিজের মুঠোর ভেতর একটা ছোট্ট প্রজাপতির মতো মনে হয়। হাতটাকে আর না ছাড়ার প্রবল লোভ জেগে ওঠে ওর ভেতর-
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার
দূর থেকে দূরে- আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।

কানের কাছে কে যেন ফিসফিসিয়ে ওঠে, লুকানো আরেকটা পিস্তলতো আছেই, দে শালা মুকূলকে খতম করে। প্রতিশোধ নে। নীলাকে ছিনিয়ে নেয়ার এই সুযোগ। অনেক কষ্ট করে ইচ্ছেটাকে গিলে খায় আজাদ। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে হাতটা ছেড়ে দেয় ও। নীলা ঘুরে দাঁড়ায়। ওর চোখে কি একটু জল চাঁদের আলোয় রুপোলী হয়ে উঠলো! নাকি দেখার ভুল? মুকূলের কোমর জড়িয়ে হেঁটে যায় ও। আজাদের মনে হয় পাশাপাশি উড়ে যাচ্ছে ঘন দুটো মেঘ, ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, একটার সাথে আরেকটা মিশে জাগিয়ে তুলছে বৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা। আজাদ মুগ্ধ চোখে বৃষ্টির খানিকটা ছাট এসে লাগে। শেষবারের মতো ওর বলতে ইচ্ছে করে-
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

ছোট্ট মাঠটুকু পেরিয়ে পাট ক্ষেতের সামান্য দূরে থাকতে ওরা দু’জন ঘুরে দাঁড়ায়। বাতাসে মুকূলের লম্বা চুলগুলো পতাকার মতো দুলছে। বুকের চে’কে টানটান করে এক হাত তুলে ও হাত নাড়ে, আরেক হাতে পিস্তল। আজাদের মনে হয় স্বয়ং চে’ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ওকে সম্মোহিত করতে চাইছে। নিজের অজান্তেই ও দু’পা সামনে এগিয়ে যায়। চে’র সাথে বাকি জীবনটা জঙ্গলে জ্ঙ্গলে কাটিয়ে দিলে কেমন হয়? মুকূল, নীলা আর ও- পুরোনো সেই দিনগুলোর মতো! ওর ভাবনার মাঝপথেই গুলির শব্দ শোনা যায়। ওর বিস্ফোরিত চোখের সামনে মুকূলের ভাঙ্গা প্রতিমা লুটিয়ে পড়ে। ট্রেনিংয়ের সহজাত বশে নিমেষেই আজাদের হাতে পিস্তল বেরিয়ে আসে। পাটক্ষেতের বাম থেকে গুলি হয়েছে। ঝুঁকে সেদিকে দৌঁড় দিতেই ওর চোখ নীলার চোখে আটকে যায়। একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে নীলা ওর দিকে তাকিয়েই বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দেয়। বাড়িয়ে দেয়া হাতের তালু ভেদ করে ছোট্ট একটা আগুনের পি-কে খসে পড়ার তারার ভঙ্গিতে নিজের একটা চোখের দিকে ছুঠে আসতে দেখে আজাদ। অন্য চোখে ও কপালে লাল একটা টিপ নিয়ে নীলাকে ঢলে পড়তে দেখে।

বারুদের কড়া গন্ধের নিচে গুটিয়ে যায় শিশির মাখা ঘাসের মিষ্টি ঘ্রাণ। বটের মাথা থেকে হৈ হৈ করতে করতে মিলিয়ে যায় একদল পাখি। কোথাও একটা একটা ব্যাঙের ডাক মাঝপথেই আর্তনাদ হয়ে মিলিয়ে যায়। পাটক্ষেতে সরসর শব্দ তুলে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ডেকে ওঠে একটা পেচা। শেকড়ের আরো গভিরে জড়িয়ে যায় সাপের অবশিষ্ট লেজ। টাকি মাছের পোনারা দল বেধে কাদার আরো গভিরে সেধিয়ে যেতে চায়। দূর থেকে অস্পষ্ট কুই কুই ডেকে ওঠে পলায়নপর কোন শেয়াল। পা গুলো মুকূল আর নীলার মাথার কাছে এসে থামে। বন্দুকের দীর্ঘ নলের খোঁচায় ওরা নিষ্প্রাণ নড়ে ওঠে। শালা দালালের বাচ্চা, ওদের মুখে একদলা থুতু ছুঁড়ে কেউ একজন বলে। কছুক্ষণ সময় নিয়ে পা গুলো এগিয়ে যায় আজাদের কাছে, তারপর পাটক্ষেতে ছপছপ শব্দ তুলে ফিরে যায়। চারিদিকে শুনশান খনিকের নিরবতার চাদর ভেঙ্গে একসময় গর্জে ওঠে ইঞ্জিন, নদীতে ঢেউ তুলে ক্রমশ দূরে সরে যায় বিপ্লবের নৌকা। পেছনে ঢেউগুলো একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে পাড়ের শুমুকের খোলে বাড়ি খেয়ে বিষণ্ণ হু হু শব্দ তোলে। আস্তে আস্তে সেই শব্দ রক্তের ঘ্রাণ মেখে ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরে। এক টুকরো মেঘে মুখ লুকানো চাঁদের দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত নক্ষত্র গুনে যাওয়া তিন জোড়া চোখে চোখ রেখে সে শুধায়-
এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি!

২০/০৫/১৩
সিডনী, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

কাজি মামুন এর ছবি

ঘটনাগুলো বা চরিত্রগুলো নতুন নয়, কিন্তু এ এক কথাশিল্প- আর এ গল্পের আবেদন সেখানেই। এজন্যই 'আজাদের সিগারেটের আগুন প্রাচীন তারার মত জ্বলে আর নিভে' বা 'বন্দুকের নলের খোঁচায় ওরা নিষ্প্রান নড়ে উঠে' বা ' 'শেকড়ের আরো গভীরে জড়িয়ে যায় সাপের অবশিষ্ট লেজ'।
এভাবে পুরো গল্পটি পড়ার পর পাঠকের প্রাপ্তিযোগ হয় অসাধারণ কিছু শব্দ, বাক্য!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পটা পড়ে বর্তমান বাংলাদেশের কতিপয় তথাকথিত বাম চরমপন্থী দল নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন আবারও মনে পড়লোঃ

- এই দলগুলো আদৌ কোন রাজনৈতিক দল কিনা
- রাজনৈতিক দল হলে তাদের আদৌ বিপ্লবী দল বলা যায় কিনা
- নিজেরা রাখা দলের একটা রাশভারী নাম বাদ দিলে একটা সাধারণ খুনে-ডাকাত দলের সাথে এদের পার্থক্যটা কোথায়
- এতগুলো বছরে এরা সাধারণ মানুষ বা দেশের স্বার্থে কোন কাজটা করেছে বা কী অবদান রেখেছে
- এদের হাতে লুটেরা-বুর্জোয়াঁ-শোষক-কালো টাকার মালিক-ধনিকদের বদলে কেন কেবল নিজেদের দলছুট সদস্য বা পুলিশের হতদরিদ্র কনস্টেবলকে খুন হতে দেখা যায়
- এদের ভাষায় লুটেরা-বুর্জোয়াঁ-শোষক-সাম্রাজ্যবাদের দালাল সরকার যখন বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন দেয় তখন এদের কেন কালো টাকার মালিক-সন্ত্রাসী ভোটপ্রার্থীদের ভাড়াটে হয়ে খাটতে দেখা যায়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

তোমার প্রশ্নগুলোর কোনও ইতবাচক উত্তর পাওয়া কঠিন বিশেষ করে গত ধরো ২ দশকের প্রেক্ষাপটে।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

বরাবরের মতোই সুলিখিত, সাথে বাড়তি পাওনা গল্পের সাথে কাব্যের যুগলবন্দী।

এই গুপ্ত বিপ্লবীদের ওরিয়েন্টেশন বা ব্যাকগ্রাউন্ড জানা মুস্কিল। তবে বাংলাদেশের সবথেকে বেশি 'গুপ্ত বিপ্লবী' প্রবন এলাকার মানুষ হিসেবে এদের অত্যাচার দেখেছি। একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দেই- এই গুপ্ত বিপ্লবীদের একাংশের খুলনা বিভাগীয় কমান্ডার ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সহদর শোয়েব-সুমন দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ধর্মপিতা বুলবুলে বাংলাদেশ মাওলানা আব্দুল ওয়াহাবের ছেলে। দুজনেই এখন গত। বিপ্লবী চেতনা রাতারাতি জন্ম নেয়না, বহু বছরের উপলব্দী, আত্মীকরণ, ও চর্চায় বিপ্লবী চেতনার জন্ম হয় ও এটা শাণিত হয়। অন্তত আমি বলতে পারি এরা দুই ভাইয়ের কেউই কোনদিন বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলোনা। মুকুল-শিমুল ভাতৃদ্বয়, রশিদ-রিতাদেরও বামসংশ্লিষ্ঠতার কথা শোনা যায় না। যাইহোক, পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গল্প ভালো লেগেছে।
কিন্তু কবিতাংশগুলো বোল্ড করে না দিলেও চলতো। চোখে লাগছে।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।