আমাদের রূপকথা

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: শুক্র, ১৩/১২/২০১৩ - ১০:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
অন্তু এখন ঘুমাতে হবে, এসো, হেনা ডাক দেয়।
আরেকটু কার্টুন দেখি আম্মু, অন্তু সোফায় নড়েচড়ে আয়েস করে বসে। ওর চোখ টিভির পর্দায়। সেখানে ছোট্ট এক ইঁদুরের দাপটে তাগড়া গোফওয়ালা বিড়াল কুপোকাত।
আর না বাবা, এখন সোজা বিছানায়, চোখ বন্ধ করে ঘুম, হেনা রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে দেয়।
তুমি একটা পচা আম্মু! অন্তু বিরক্তি দেখিয়ে সোফায় সটান শুয়ে পড়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।
এখানে নয় বাবা, বিছানায় যেতে হবে, হেনা অন্তুর কপালে সোহাগের হাত বুলায়।
অন্তু সাড়া দেয় না।
ছেলেটা একদম বাপের মতো হয়েছে। কথায় কথায় মন খারাপ, কথা বন্ধ! হেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ঠিক আছে বাবা, আজ তোমাকে গল্প শোনাবো।
আমি শুনবো না, অন্তু মুখ না ফিরিয়েই জবাব দেয়।
কেন বাবা!
তুমি রোজ রোজ একই গল্প বলো!
আজকে অন্যটা বলবো, প্রমিজ, হেনা হাসে।
সত্যি! অন্তু এবার মুখ ফেরায়। আগ্রহে তার চোখমুখ চকচক করছে। হেনা সেখানে নিজের ছায়া দেখে। মানুষ কীভাবে একজন থেকে আরেকজনে রূপান্তরিত হয়! হেনা অবাক হয়ে ভাবে। অন্তু কি তার ফেলে আসা ছোটবেলা নয়? অন্তুর বয়সে নানীজানের বুকে শুয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাওয়া ছোট্ট রাজকুমারী হেনার সাথে আজকের রাজকুমার অন্তুর কি কোন তফাত আছে? অন্তুওতো তার মতো রাক্ষস, মামাদো ভূত, গেছো ভূত, পেত্নী, পরী, কানাবগি, রাজকুমার, শুয়োরাণী-দুয়োরাণী, ডালিমকুমারের রূপকথা শুনতে ভালোবাসে! নানীজান কতো গল্পই না জানতো! নানীজানের পান খাওয়া লাল টুকটুকে টিয়া পাখির ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে হেনা এখনো গল্পের দুলদুলের টগবগ শুনতে পায়। আর তখন গল্প থেকে নেমে এসে মা হেনার সামনে এসে দাঁড়ায়। হেনার মা ছিল লম্বা ছিপছিপে বাঁশপাতার মতো, তার গায়ের রঙে মিশে ছিল জোছনার দুধে আলতা, হাসলে মায়ের গালের টোলকে মনে হতো শান্ত দীঘির ঢেউ, মায়ের জলে ভাসা পদ্ম চোখে হরিণ দৌঁড়ে বেড়াতো, তার ঢেউ খেলানো মাটি ছুঁই ছুঁই চুলে এসে বসতো রংধনুর সাত রঙের প্রজাপতি, মা ছিল উচ্ছ্বল নদীর মতো; দুই পারের লোকালয়ে জীবনের উৎসব আনন্দ হাসি গান আবার ভরা বর্ষায় নদী যেমন গাল ফুলিয়ে ওঠে- মা তেমনি খুব অভিমানী ছিলো, কষ্ট পেলেই কেঁদে ফেলতো, সাদা কালো বিড়ালটা যাকে বুকে নিয়ে মা ঘুমাতো সেই মিনুর হারিয়ে যাবার দুঃখ মা কখনো ভুলতে পারেনি, হেনাকে কোলে নিয়ে আয় আয় চাঁদ মামা শোনাতে শোনাতে সে মিনুর দুঃখে বুক ভাসাতো, তারপর সমস্ত দুঃখ ভুলে হেনার কপালে টিপ এঁকে দিতো যেন হেনাই তার হারিয়ে যাওয়া মিনু, হেনার চোখে চোখ রেখে সে ছড়া কাটতো-
সবাই গেল মাছ ধরতে
থাকলো শুধু হেনা
মায়ের কোলে হেনা দোলে
সোনার দামে কেনা
মায়ের কাছে হেনা সত্যিই সত্যিই ছিল সোনার মতো দামী। একবার হেনার খুব জ্বর হলে মা তিন দিন তিন রাত টানা তাকে ছোট্ট চড়–ই ছানার মতো বুকের ভেতরে নিয়ে জেগে ছিল। হেনা ছিল তার খেলার পুতুল, সারাদিন তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা চাই, তাকে একবারের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতো না মা...ওইতো এখনও হেনার কাছেই বসে বসে অন্তুর কা- দেখে সে মিটিমিটি হাসছে। মায়ের পরণে আকাশী রংয়ের আকাশমাখা একটা শাড়ি। চুলগুলো খোঁপা করে বাধা। মুখে আজলা ভরা টলটলে জলের মতো স্নিগ্ধ একফালি হাসি। দেখলেই মেঘলা মন ভালো হয়ে যায়। হেনা হেসে ফেলে, হ্যা সত্যি।
তিনবার বলো, অন্তু আদেশ করে।
এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি, হেনা আঙ্গুল গুনে গুনে অন্তুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
আমাকে ছুঁয়ে বলো, অন্তু সজনে ডাটার মতো সরু ছোট্ট কচি হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
হেনা হাসতে হাসতে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু খায়, এই ছুঁয়ে বললাম- সত্যি। আড়চোখে সে দেখে মায়ের হাসিটা সকালের বকুল ফুল হয়ে ঝরে পড়ছে। সোফার নীল কাভারটা ফুলে ফুলে সকালের সাদা বকুলতলা হয়ে যাচ্ছে।

২.
অনেক আগে এক ছিল এক দেশ। দেশটা ছিল খুব সুন্দর, সারা পৃথিবীতে অত সুন্দর আর কোন দেশ ছিল না, ফুল পাতা আঁকা বিছানায় ফলের মতো শুয়ে হেনা গল্প শুরু করে।
আমাদের দেশের মতো? অন্তু মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে থেকে জিজ্ঞেস করে।
হ্যা, আমাদের দেশের মতো। অনেক গাছগাছালি, নদী, পাহাড়, পাখি, ফুলের বাগান, সাগর- তুমি যে ছবিটা এঁকেছিলে না, ঠিক সেই রকম।
ওখানে কি প্রজাপতি ছিল?
ছিল, লাল নীল হলুদ বেগুনী সবুজ গোলাপী অনেক রংবেরংয়ের প্রজাপতি।
ফড়িং?
ফড়িংও ছিল।
বাচ্চারা কী ওদের সাথে খেলতো?
হ্যা, সেই দেশে বাচ্চারা সারাদিন খেলতো।
ঘুমাতে যেতো না?
ঘুমের সময় হলে ঘুমাতো। কার্টুন দেখার সময় হলে কার্টুন দেখতো।
আমার মতো?
হ্যা তারা তোমার মতো লক্ষ্মী ছিল, রেহানা অন্তুর কপালে ঝুঁকে পড়া চুলে বিলি কাটে।
তারপর?
সেই দেশের মানুষেরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিল। তাদের পুরো দেশটাই ছিল সোনার খনি। তাই তাদের কোন অভাব ছিল না। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর ইয়া বড় বড় দুধের নদীতে ভরা ছিল তাদের বাড়ি । তারা সারাদিন সেই নদীতে মনের সুখে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে নেচে গেয়ে আনন্দ ফূর্তি করে বেড়াতো। তাদের কোন দুঃখ ছিল না। একদিন সেই দেশে এলো কিছু দরবেশ।
দরবেশ কি?
দরবেশ হলো খুব খুব ভালো মানুষ।
তারা কি মানুষের দেশেই ছিল?
না তারা অন্য দেশ থেকে এসেছিল। দরবেশরা এসে মানুষের সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু মানুষ তাদের কথা একটুও বোঝে না। তারাও মানুষের ভাষা বোঝে না। দরবেশরা ইশারা ইঙ্গিতে বোঝালো, আমরা অনেক দূর থেকে এসেছি, আমদের পেটে খুব ক্ষিধে। তোমাদেরতো অনেক খাবার, আমাদের কিছু খাবার দাও।
মানুষের খাবারের কোন অভাব ছিল না। তারা দরবেশদের পেট ভরে খাওয়ালো।
খেয়েদেয়ে দরবেশরা বললো, আমরা অনেক ক্লান্ত। আমাদেরকে অনকে দূর যেতে হবে। একটু ঘুমুতে চাই।
মানুষেরা তাদের বাগানবাড়িতে দরবেশদের আরামে ঘুমানোর ব্যবস্থা করলো।
দরবেশরা কি নাক ডেকে ঘুমাতো?
অনেক জোরে জোরে নাক ডাকতো।
আব্বুর মতো?
হেনা হেসে ফেলে, তোমার আব্বুর চেয়েও জোরে জোরে। দরবেশরা আচ্ছামতো ঘুমিয়ে সকালে উঠে বললো, তোমাদের দেশটা মনে হচ্ছে অনেক সুন্দর। আমাদের একটু ঘুরিয়ে দেখাবে?
মানুষ মেহমানদের খুব সম্মান করতো। তারা বললো কোন অসুবিধা নেই। দরবেশদেরকে তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো দেশটা দেখালো। মানুষের দেশ দেখে দরবেশদের চোখ ছানাবড়া। এতো সুন্দর দেশ!
দরবেশদের দেশ কেমন ছিল, আম্মু?
দরবেশরা ছিল পাহাড় পর্বত মরুভূমির লোক। সেখানে না ছিল সোনা, না ছিল রূপা , না ছিল গাছ সেখানে ছিল খালি পাথর আর বালি। মানুষের দেশ দরবেশদের মনে ধরে গেলো। এতো শান্তি সুখের দেশ! তারা এখানে অনেকদিন থাকার ফন্দি করলো।
ফন্দি কী!
বুদ্ধি করলো আর কী।
ও তাই বলো।
দরবেশরা মানুষকে বললো, আমারা স্বপ্নে দেখেছি তোমাদের এই সুন্দর দেশে খুব তাড়াতাড়িই গজব নামবে। রাক্ষসেরা এই দেশ ছারখার করে দেবে। তোমাদের সব সোনা তারা লুটপাট করে নেবে।
দরবেশরো কি মানুষের ভাষা শিখে ফেলেছিলো?
না তারা ইশারা ইঙ্গিতেই কথা বলতো। রাক্ষস আসবে শুনে মানুষেরা খুব ভয় পেলো। তারা বললো আপনারা দরবেশ, আপনাদের অনেক ক্ষমতা। আপনারাই আমাদের রাক্ষসদের হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় বলে দেন।
দরবেশরা চোখ বুঝে ধ্যানে বসলো।
সেটা আবার কী?
সেটা হলো, তারা নিরিবিলি বসে মন দিয়ে লেখাপড়া করার মতো করে চিন্তা করতে লাগলো। ধ্যান শেষ হলে তারা বললো, আমাদের দাদা পরদাদারা সবাই তোমাদের মতো মাটির মানুষ ছিল। তোমাদের কোন ভয় নেই। তারা আমাদেরকে তোমাদের রক্ষা করতে হুকুম দিয়েছেন। খালি তোমাদের সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ওলোট পালট করতে হবে।
মানুষের দেশে সোনার কাঠি রূপোর কাঠিও ছিল?
হ্যা। মানুষের দেশে বিশাল একটা আকাশ সমান বটগাছ ছিল। হাজার বছরের পুরোনো। মানুষ বলতো বটগাছটা একসময় মানুষ ছিল। যুগ যুগ ধরে সেই গাছের মাথায় ছিল সোনার কাঠি আর রুপোর কাঠি। কেন ছিল মানুষ সেটা জানতো না। তারা শুধু জানতো-
বটের দুইটা হাত আছে
ডান হাতে তার সোনার কাঠি
বাম হাতে তার রূপোর কাঠি
মানুষ ঘুমায় শান্তিতে
বাম হাতে তার সোনার কাঠি
ডান হাতে তার রূপোর কাঠি
মানুষ জাগে ক্লান্তিতে
বটের দুইটা হাত আছে
হাতের ছায়ায় মানুষ বাঁচে।

বটগাছটা আবার মানুষের সব কথা বুঝতো। মানুষ যা চাইতো বট গাছটা তাই দিতো। ধরো মানুষের অনেক থালাবাটি দরকার। বটের নিচে এসে বললেই হলো-
কালকে আমার মেয়ের বিয়ে
বট আমার থালা চাই

থালাবাটি হাজির হয়ে যেতো। তারপর ধরো তোমার খেলনা দরকার। বটের নিচে এসে বলতে হবে-
বট আমি খেলা করবো
আমার অনেক খেলনা চাই

অমনি খেলনা হাজির হয়ে যাবে। মানুষ কিন্তু প্রথমে সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ওলটপালট করতে রাজি হলো না। তারা ভাবলো এতে তাদের ক্ষতি হবে। দরবেশরা তখন তাদের ভয় দেখালো, রাক্ষসেরা এলো বলে! তোমাদের জীবন আগে না ক্ষতি আগে?
মানুষ কী করবে ভেবে পায় না। শেষে তারা ভাবলো, কাঠি ওলটপালট করলে কী আর এমন হবে! রাক্ষসের হাত থেকেতো বাঁচা যাবে! এই ভেবে তারা কাঠি ওলটপালট করতে রাজি হলো। একদিন সকালে তারা বটের কাছে গিয়ে বললো-
বট বট বট ভাই
সোনার কাঠি বামে
আর রূপোর কাঠি ডানে চাই

বলা মাত্রই সোনার কাঠি রূপোর কাঠি বদল হয়ে গলো। আর ক্লান্তিতে মানুষের চোখ জুড়ে ঘুম আসতে থাকলো। তারা চোখ খোলা রেখেই ঘমুতে লাগলো।
দরবেশরা বললো, রাক্ষসেরা যাতে তোমাদের কোন ক্ষতি না করতে পারে সেজন্য আমাদেরকে তোমাদের দেশে থাকতে হবে।
মানুষ বললো, আপনারা যতোদিন ইচ্ছা থাকুন।
দরবেশরা মনে মনে হেসে বললো, আমরা সারাক্ষণ ধ্যান করি। আমরা কোন কাজকর্ম করতে পারবো না। তোমাদেরকে আমাদের সব কাজকর্ম করে দিতে হবে।
মানুষ বললো, আমরা রাজি ।
আমাদের খাবারও তোমাদের যোগাড় করতে হবে।
মানুষ বললো ঠিক আছে।
দরবেশরা মানুষের দেশে থেকে গেলো।
গল্প শেষ?
নারে পাগল, গল্প শুরু হলো কেবল। রেহানা আড়চোখে বিছানার পাশে তাকায়। তাকাতেই মার সাথে তার চোখাচোখি হয়। মা হাসে, তার হাতে কাটা দুটো ক্রমাগত সোয়েটার বোনে।

৩.
দরবেশরা মানুষের দেশে আরাম আয়াসে দিন কাটাতে থাকলো। মানুষেরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের সেবা করে, খাবার যোগায়।
আর বটের কি হলো?
বট যেখানে ছিল সেখানেই থাকল। কিন্তু মানুষ কোন কিছু চাইলে সে আর দেয় না। মানুষ ভাবলো বট ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা ছড়া বানালো-
মানুষ করে পরিশ্রম
বট ঘুমিয়ে আলুর দম!

ওদিকে দরবেশরা খালি খায় দায় ঘুমায়, মানুষের পালকিতে চড়ে বেড়ায়। মানুষকে দিয়ে হাত পা মাথা টেপায়। আর ছড়া কাটে-
দরবেশ মানুষ ভাই ভাই
দরবেশ থাকতে ভয় নাই
বাড়ি যাও খাও দাও
মনের সুখে ঘুম যাও

মানুষ তাদের কথায় সাহস পায়। তারা তোতাপাখির মতো আউড়ায়-
দরবেশ মানুষ ভাই ভাই
দরবেশ থাকতে ভয় নাই

আর খুশি হয়ে ঘর থেকে সোনার মোহর এনে দরবশেদের দেয়।
কেন?
যাতে দরবেশরা এই দেশ ছেড়ে না যায়।
দরবেশরা সোনা দিয়ে কী করতো?
তারা সেগুলো ঝোলায় জমিয়ে নিজের দেশে পাঠাতো, সেখানে সোনার প্রাসাদ বানাতো।
দরবেশদের দেশ কোথায় ছিল আম্মু?
সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে, পাথরের পাহাড়ের ভেতর।
এভাবে মানুষের সোনায় দরবেশদের ঝোলা ভরে যেতে থাকলো। দরবেশদের মন তবুও ভরে না। তারা একদিন মানুষকে বললো, তোমাদের জঙ্গলে অনেক জন্তু জানোয়ার। এদের জন্য তোমরা জঙ্গলে কাঠ আনতে যেতে পারো না, মধুর চাক ঙেঙ্গে মধু আনতে পারো না, মাঝে মাঝেই বাঘ সিংহ তোমাদের উপর হামলা করে। তাই বলছিলাম কী আমাদের দেশের চিড়িয়াখানাগুলো খা খা করছে। জন্তু জানোয়ারগুলোকে আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? মানুষ ভাবলো, তাইতো মানুষের দেশে বাঘ সিংহ ভাল্লুক না থাকলে ভালোই হয়, জঙ্গল সাফ করে মানুষ ঘর বানাতে পারে। তাই তারা দরবেশদের কথায় রাজি হয়ে গলো। দরবেশরা সেই দিনই জঙ্গলের বাঘ সিংহ হাতি গন্ডর ভাল্লুক জিরাফ জেব্রা হরিণ সব ধরে ধরে নিজের দেশে পাঠিয়ে দিলো।
এতোগুলো জানোয়ার কীভাবে পাঠালো? ওদের কি প্লেন ছিলো?
দরবেশদের ঝোলাগুলো ছিল জাদুর ঝোলা। ঝোলার মধ্যে কিছু ভরলেই সেগুলো ওদের দেশে চলে যেতো।
ও তাই বলো!
কদিন পর দরবেশরা আবার মানুষকে বললো তোমাদের খালবিল নদীনালায় অনেক মাছ। এসব মাছের গন্ধে ভুত প্রেত ডাইনীরা এসে তোমাদের দেশে ঘোরাফেরা করছে। আমাদের দেশের পুকূরগুলো খালি পড়ে আছে, মাছগুলোকে আমাদের দেশে নিয়ে যাই ভুত প্রেতের বাপের সাধ্য নেই তোমাদের আশেপাশে থাকে। আশেপাশে ভুতপ্রেত ঘোরাফেরা করছে শুনেই মানুষ ভয় পেলো। তারা দরবেশদের বললো যেখানে যতো মাছ আছে নিয়ে আমাদের তাড়াতাড়ি ভুত প্রেতের হাত থেকে বাঁচান। দরবশেরা তখনই ঝোলায় ভরে ইলিশ, মাগুর,বাম, বোয়াল, রুই, কাতলা, গুদুম, পুটি, কালবাউস, আইড়, চিতল- সব মাছ নিজের দেশে পাঠিয়ে দিলো। হেনা বলতে বলতে মায়ের দিকে তাকায়।
কোথায় যেন কেউ কেঁদে উঠলো। মায়ের পাশে দোলনায় ওটা কে? হেনা নিজে! মা তাকে কোলে নিতেই সে চুপ হয়ে গেলো। মা বলতে লাগলেন, তারপর সোনামনি কী হলো জানো? কদিন যেতে না যেতেই দরবেশরা পাখিদের কথা তুললো। দোয়েল, কোয়েল, ফিঙ্গে, শামা, চড়–ই, টিয়ে, বুলবুলি, মাছরাঙ্গা, কাকাতুয়া মানুষেল দেশে হাজার রকমের পাখি। এসব পাখির চেঁচামেচিতে ঠিকমত ইবাদত বন্দেগী করা যায়না। সব পাখিদের তারা নিজের দেশের খাঁচায় পাঠিয়ে দিলো। মানুষের দেশে আর কোন কোকিল ডাকলো না, হলুদ ঠ্যাং নেড়ে দুই শালিক ঝগড়া করলো না, তালের পাতায় বাবুই পাখির বাসা দুললো না, টোনা-টুনির চড়–ইভাতি হলো না, টিয়ারাও লাল ঠোঁট নাড়িয়ে মানুষের মতো কথা বললো না।
বক?
সব বকও শেষ।
পাখির গান শোনা যায় না বলে মানুষের দেশের সবুজ গাছগুলো রাতদিন কাঁদতেই থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে তাদের সবুজ পাতারা হলুদ হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো। গাছ মানুষকে অক্সিজেন দেয়। মানুষ নিঃশ্বাস নেয়। গাছের পাতা ঝরে গেলে মানুষ নিঃশ্বাস নেবে কীভাবে। মানুষ দরবেশদের বললো সব গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে, আমরা নিঃশ্বাস নেবো কীভাবে? দরবেশরা ছড়া কেটে বললো-
দরবেশ মানুষ ভাই ভাই
দরবেশ থাকতে ভয় নাই
বাড়ি যাও, খাও দাও
মনের সুখে ঘুম যাও

মানুষেরা ভাবলো তাইতো, দেশে দরবেশ থাকতে আবার ভয় কীসের! তারা নিশ্চিত মনে বাড়ি পেট পুরে ভাত খেয়ে দিলো লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে তারা কী দেখে জানো?
কী?
দেখে তাদের গরু ছাগল হাস মুরগী ভেড়া সব হাওয়া! মানুষ চিন্তায় পড়ে গেলো। তারা দরবেশদের বললো, আমাদের গরু ছাগল গেলো কোথায় গেলো?
দরবেশরা বললো আমাদের দেশে সামনে কোরবানী ঈদ। অনেক কোরবানী দিতে হবে। তোমাদের গরু ছাগল ভেড়া গুলোকে আমরা আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি।
মানুষ আর সহ্য করতে পারলো না। তারা বললো গরু ছাগল না থাকলে আমরা চাষ করবো কীভাবে, ফসল পাবো কোথায় ? খাবো কি? আমাদের বাচ্চারা দুধ কোথায় পাবে?
হেনা মায়ের চোখে কাজলমাখা বড় বড় চোখ রাখে, দরবেশরা কি করলো?
দরবেশরা আগের মতোই ছড়া কাটলো-
দরবেশ মানুষ ভাই ভাই
দরবেশ থাকতে ভয় নাই
বাড়ি যাও, খাও দাও
মনের সুখে ঘুম যাও।

মানুষ বাড়ি ফিরে এলো। এবার আর তাদের মনে শান্তি নেই। তাদের পুকুরে মাছ নেই। গোলায় ধান নেই। পকেটে সোনার মোহর নেই। মনে সুখ নেই। মানুষের বাচ্চাগুলোর না খেতে পেয়ে শুকিয়ে পাটকাঠি হয়ে যেতে লাগলো! এরই মধ্যে দরবেশরা আবার এলো। এবার তারা আবদার নয় হুকূমের সুরে বললো, এই দেশে অনেক মানুষ। মানুষের ভারে দেশটা ময়লা নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে কাজের লোকের খুব অভাব। আমরা তোদেরকে আমাদের দেশে পাঠাবো। এই বলে তারা ঠেলে ঠেলে মানুষকে ঝোলার মধ্যে ভরতে লাগলো। ঠিক তখুনি এগিয়ে এলো এক রাজপূত্র।
মানুষের দেশে রাজপূত্র ছিল?
ছিল, কিন্তু কেউ তাকে চিনতো না। সে যে রাজপূত্র সেটা সে নিজেও জানতো না। লোকটা ছিল রাখাল। খুব ভাল বাঁশী বাজাতো। বটগাছটা ছিল তার খুব প্রিয়। সময় পেলেই সে তার প্রিয় বটগাছের ছায়ায় বসে বাঁশীতে নানা সুর তুলতো। তার বাঁশী শুনলে ফুল পাখি গাছপালা মানুষ সবার সব মন খারাপ ভালো হয়ে যেত। দরবেশেরা মানুষের সহায় সম্পত্তি নিয়ে যাবার পর একদিন সে ভরদুপূরে বটগাছের ছায়ায় শুয়ে ছিল। ঘুমে তার চোখ ঢুলঢুল। কিন্তু মানুষের দুঃখ কষ্ট তার মনটা সেদিন অনেক খারাপ, তার বুক ফেটে কান্না আসছিল। সবসময় সে তার বাঁশীতে মন ভালো করার সুর তুলতো। মনের দুঃখে বাঁশীতে সেদিন সে মন খারাপ করা একটা সুর তুললো। সেই সুরে আকাশের মন খারাপ হয়ে গেল। কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেল। নদীর ঢেউ উথাল পাথাল করতে লাগলো। বাতাস হু হু করে উঠলো। কষ্টে মাটির বুক ফেটে চৌচির হয়ে গেল। রাখালের কোন দিকে খেয়াল নেই। সে বাঁশী বাজিয়েই চললো আর তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে বট গাছের শেকড় বাকড় ভিজিয়ে দিতে থাকলো। একসময় রাখালের কষ্ট বট গাছ আর সহ্য করতে পারলো না। তার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। তার ডালপালা গুলো নুয়ে পড়ে রাখালকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। বাঁশী বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে রাখাল তখন ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ সে শুনলো বটগাছটা তাকে বলছে-
ও রাখাল বাঁশীর রাজা
ঘুমিয়ে হসনে কাদা
এক ডুবে ঘুরে আয়
সোনা রূপা নিয়ে আয়
সোনার কাঠি রূপোয় দে
রুপোর কাঠি সোনায় দে
আমার শরীর তুই নে
তোর শরীর আমায় দে
নিজের চোখের ঘুম ভাঙ্গা
সব মানুষের চোখ রাঙ্গা।

ঝট করে রাখালের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে অবাক হয়ে বট গাছের দিকে তাকাল । গাছটা তার সাথে কথা বলেছে এটা সে বিশ্বাস করতে পারল না। গাছ কীভাবে কথা বলবে! সে ভাবল, সে স্বপ্ন দেখেছে। এই ভেবে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমুতেই সে শুনতে পেল বটগাছটা আবারও তাকে একই কথা বলছে। এবার সে সজাগ হলো। তার ভেতর থেকে কেউ বললো, বটগাছটা আসলেই তাকে কিছু বলতে চাইছে। সে বটের বলা কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করলো। সোনার কাঠি, রূপোর কাঠিতো বুঝলাম কিন্তু এক ডুবে কোথায় যাবো আর বটের শরীর আমার কীভাবে হবে আর আমার শরীরই বা বটের কীভাবে হবে, সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে চিন্তা করতে লাগলো।
ঠিকইতো মানুষ কি গাছের ভেতর ঢুকতে পারে?
সেটাই। কিন্তু বটগাছতো রাখালকে বলেছে আমার শরীর তুমি নিয়ে নাও আর তোমার শরীর আমায় দিয়ে দাও। রাখাল অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই এই কথার মানে বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। গাছটাকে সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে একসময় সে খেয়াল করলো বটগাছটার শরীর কেমন যেন মরা মরা, সবুজ পাতাগুলো হলুদ হয়ে এসেছে, শক্তপোক্ত ডালগুলো কাঠিকাঠি, ক্লান্তিতে বটগাছটা যেন খানিকটা নুয়েও পড়েছে। রাখাল আগে কখনো এতো মনযোগ দিয়ে বটগাছটাকে দেখেনি। দরবেশরা আসার পর মানুষের দেশের সব গাছ মরে গিয়েছিল। কেবল বটগাছটাই সবুজ পাতা নিয়ে বেঁচেছিল। এবার সেও মরে যাচ্ছে। রাখাল ভাবলো বটগাছটা আসলে তাকে এই খবরই দিতে চাচ্ছিল। প্রিয় বটগাছ মারা যাচ্ছে এই শোক তাকে পাগল করে তুললো, আমি তোমাকে কিছুতেই মরতে দেবো না বটগাছ, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সে বাঁশীতে অচিন একটা সুর তুললো। সেই সুরে মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি এলো, নদীর পানি দুকূল ছাপিয়ে উপচে পড়লো, পাগলের মতো দাপাদাপি করতে লাগলো বাতাস, চৌচির মাটির ভেতর থেকে জল এসে ভিজিয়ে দিল শুকনো মাঠ ঘাট, আকাশ ফুটো করে সেই সুর বেহেশতের ফেরেশতাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল। একসময় বিশাল বটের পুরো শরীরটাও সেই সুরে কেঁপে উঠলো, কাঁপতে কাঁপতে হাজার বছর ধরে বন্ধ থাকা তার চোখটা হাট হয়ে খুলে গেল।
বটের কয়টা চোখ ছিল আম্মু?
একটাই। তবে সেই চোখটা ছিল অনেক বড় আর কাজলমাখা। সেই চোখে সে রাখালের চোখে চোখ রেখে ডাকলো, আয়। রাখালের মনের ভেতর কেউ একজন বলে উঠলো, যাসনে ওটা তোকে গিলে খাবে। আরেকজন বললো, যা বটের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেসা কর মানুষের দুঃখ কষ্ট কবে শেষ হবে? মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা মনে হতেই রাখাল চোখের দিকে এগিয়ে চললো। তার মন বললো, বটের চোখের ভেতরই মানুষকে বাঁচানোর মন্ত্র রাখা আছে। সেই মন্ত্র পেতে সব ভয় ডর দূরে ঠেলে সে বটের চোখের দিকে এগিয়ে চললো।
চোখটা কি রাখালকে জাদু করেছিল?
ওইরকমই। যেতে যেতে তার মনে হলো চোখটা যেন অন্য কোন দুনিয়ার দরজা। এক ধাক্কা দিয়ে সেই দরজা খুলে সে বটের চোখের ভেতরে ঢুকে গলে।
তারপর?
রাখাল যেই না চোখের ভেতর ঢুকলো, সাথে সাথে বট চোখ বন্ধ করে ফেললো।
চোখটা কি রাক্ষস?
শোনোই না। রাখাল দেখলো তার সামনে বিশাল একটা নদী। সেই নদীর পানি কাচের মত। তাকালেই নিচে দেখা যায়। রাখাল তাকিয়ে দেখে নদীর নিচে সোনার কাঠি রূপার কাঠি পড়ে আছে। কাঠিদুটো দেখে তার বটের বলা কথা মনে পড়ল-
এক ডুবে ঘুরে আয়
সোনা রূপা নিয়ে আয়

এবার সে বটের কথার মানে বুঝতে পারলো। এক ডুবে নদীর তলে নেমে তাকে সোনার কাঠি রূপোর কাঠি নিয়ে আসতে হবে। সে ভাল করে তাকিয়ে দেখে নদীটা অনেক অনকে গভির। খবরদার যাসনে, মারা পড়বি, তার মনের ভেতর একজন বলে উঠল। আরেকজন বললো, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি নিয়ে এসে অদলবদল করতে পারলেই মানুষেরা তাদের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। জীবন যায় যাক, মানুষকে দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্ত করতে হবে। হ্যাঁ তাইতো, রাখাল ভাবলো, মানুষকে বাঁচানোর মন্ত্র জানার জন্যই আমি এখানে এসেছি। মানুষের জন্য এতদূর যখন এসেছি, জীবন বাজি রেখে আরো যাবো, মানুষের মুক্তির মন্ত্র নিয়েই আমি ফিরবো, বলে সে চোখ বুজে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তারপর কি ও মরে গেল?
নদীতে ডুব দিয়ে যেতে যেতে যেতে রাখালের দম প্রায় ফুরিয়ে আসতে লাগলো। একসময় তার মনে হলো সোনার কাঠি রূপোর কাঠি না নিয়েই সে ফিরে যাবে। তারপর মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা মনে হতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগুতে লাগলো। এভাবে ডুবতে ডুবতে ডুবতে রাখালের একসময় মনে হলো যে সে অনেক লম্বা হয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। ঘাড় ফেরাতেই সূর্যের সাথে তার চোখাচোখি হলো। মেঘের দল তাকে সালাম করলো। খুশিতে তারা হাততালি দিয়ে উঠলো, রাজপূত্র এসে গেছে। সে দেখলো তার বিশাল বিশাল দুই হাতে সোনার কাঠি রূপোর কাঠি। স্বপ্নের কথা তার মনে পড়লা-
সোনার কাঠি রূপোয় দাও
রুপোর কাঠি সোনায় দাও

সে ডান হাতে সোনার কাঠি নিলো, বাম হাতে রূপোর কাঠি। তারপর সে বজ্রকণ্ঠে দরবেশদের মুখের উপর বললো, দেখো দরবেশ অনেক হয়েছে। আমাদের দেশটাকে তোমরা ইচ্ছামতো লুটেপুটে খেয়েছো। আমরা না খেতে পেয়ে শুকিয়ে গেছি, তোমরা মোটাতাজা হয়েছো।এখন আমাদেরকে তোমাদের ঝোলায় ভরছো।! এভাবে চলতে পারে না। আমরা তোমাদের ঝোলায় ঢুকবো না, তোমরা তোমাদের ঝোলায় ঢুকে বিদেয় হও। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বদল হওয়ায় মানুষের ঘুম তখন ভেঙ্গে গেছে, সমস্ত মানুষ রাজপুত্রের সাথে চেঁচিয়ে উঠলো, বিদেয় হও।
দরবেশরা খুব রেগে গেলো। তারা বললো, তোর এতো বড় সাহস! আমাদের মুখের উপর কথা বলিস! তুই কেরে?
রাজপূত্র বললো আমি মানুষের রাজপূত্র। সমস্ত মানুষ তার সাথে সাথে বললো, মানুষের রাজপূত্র।
দরবেশরা বললো, রাজপূত্র না কচু! তোর মুকূট কই?
রাজপূত্র বললো মানুষই আমার মুকূট। সমস্ত মানুষ তার সাথে সুর মেলালো, আমরা মানুষ, মানুষই ওর মুকূট।
দরবেশরা বললো, মানুষই তোর মুকূট! ভালো বলেছিস। তা তোর মুক্তাবসানো তরবারী কই!
রাজপূত্র বললো, মানুষই আমার তরবারী। সমস্ত মানুষ তার সাথে সুর মেলালো, আমরা মানুষ, মানুষই ওর তরবারী।
দরবেশরা টিপ্পনী কাটলো, এহ্ মানুষই আমার তরবারী! রাক্ষস এলে কী করবি।
রাজপূত্র বললো... কী বললো? মা হেনার ঠোঁটে চুমু খায়, বললো, মানুষ দিয়ে রাক্ষসদের কচুকাটা করবো। সমস্ত মানুষ তার সাথে সুর মেলালো, আমরা মানুষ, মানুষ দিয়ে রাক্ষসদের কচুকাটা করবো।
রাজপূত্রের সাহস দেখে দরবেশরা থমকে গেলো। তারা বুঝতে পারলো এবার তাদের আসল রূপ বের করতে হবে। তারা হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ বলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। মানুষ অবাক হয়ে দেখলো, দরবেশদের মাথায় শিং গজিয়েছে, কান কুলার মতো লম্বা হয়ে গেছে, গা ভর্তি কালো কালো রোম, হাত পায়ে নখ, জিভ দিয়ে টপ টপ করে রক্ত ঝরছে-
দরবেশরাই তাহলে রাক্ষস! অন্তুর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।
হ্যা, দরবেশরা আসলে ছদ্মবেশ নিয়ে মানুষের দেশে এসেছিলো। ওদের আসল মতলব ছিল মানুষের সোনার দেশ দখল করা।
তারপর?
মানুষ রাক্ষসদের দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলো। তারা ভাবলো এবার তাদের আর রক্ষা নেই। তাদের কেউ আর বাঁচাতে পারবে না, হেনা খানিকটা দম নেয়।
কিন্তু আমার সোনামনি ভয় পেলো না, হেনার কথা ধরে মা বলে। সে হেনাকে কোমল বুকে চেপে দোল খাওয়াতে থাকে, কারণ সোনমনিটা জানে তার একটা রাজপূত্র আছে। তাই না মামনি, মা হেনাকে টপাটপ চুমু খায়।
তারপর কী হলো বলো না, অন্তু তাড়া দেয়।
মানুষের ভয় পাওয়া দেখে রাক্ষসেরা খ্যাক খ্যাক করে হাসলো, হেনা মায়ের গল্প ধরে এগিয়ে যায়। বললো, দেখ মানুষের বাচ্চারা তোরা হলি শুকনা পটকা। ইতর প্রজাতির। চাইলেই আমরা তোদের মট করে ভেঙ্গে ফেলতে পারি। কিন্তু আমারা তা করবো না। কারণ আমরা রাক্ষস, আমাদের মনে অনকে অনেক দয়া। তোদের কোন ভয় নাই তোরা খালি আমাদের কথামতো চলবি, আমাদের সেবাযতœ করবি, আমদের সব কাজকর্ম করবি, আমাদের রাজপ্রসাদ ধোয়ামোছা করবি, সোনার খনি থেকে সোনা তুলে আমাদের দিবি, আমাদের ভাষায় কথা বলবি, আমাদের মতো গান গাবি, বলে রাক্ষসেরা নাকী সুরে গান ধরে-
রঁক্ত পাঁক, রঁক্ত স্বাঁদ, রঁক্তে মোঁদের জঁমিন গঁড়া
রঁক্ত চাঁই রঁক্তের সাঁধ, আঁমরা রাঁক্ষস জিঁন্দাবাদ

তাহলেই তোরা তোদের মতো করে বেঁচে থাকতে পারবি। নইলে সকাল বিকাল রাতের নাস্তায় আমরা তোদের হালুয়া বানিয়ে খাবো। বলে, রাক্ষসেরা বিকট জোরে হুঙ্কার ছাড়ে। তাদের হুঙ্কারে মানুষের দেশে দিনের আলো নিভে যায়। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে, বলে হেনা একটু থামে, মার দিকে তাকায়। মা হেনাকে বুকের সাথে মিশিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, তার চোখে মুখে রাজ্যের অন্ধকার। মার কী মন খারাপ?
থামলে কেন? বলো, অন্তু তাগাদা দেয়।
রাক্ষসেরা ভেবেছিলো মানুষ তাদের হুঙ্কারে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করবে। সব দাবী মেনে নিয়ে রাক্ষসদের চাকর হয়ে থাকবে। কিন্তু রাজপূত্রকে পেয়ে মানুষ তখন সাহসী হয়ে উঠেছে। তারা বললো, আমরা তোমাদের ভাষায় কথা বলবো কেন! আমরা কী রাক্ষস!
তুমিই বলো কেউ কি নিজের ভাষা বাদ দিয়ে অন্য ভাষায় কথা বলতে চায়? ধরো তোমাকে যদি বলা হয় তোমার আম্মু যে ভাষায় কথা বলে তুমি সেটা আর বলতে পারবে না। তাহলে কি তোমার ভালো লাগবে?
তখনতো তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হবে। আমি যা বলবো তুমি সেটা বুঝবে না আবার তোমার কথাও আমি বুঝবো না। তাই না?
সেটাই। মানুষেরা তোমার মতোই ভাবলো। তারা রাজপূত্রের সাথে সুর মিলিয়ে রাক্ষসদের মুখের উপর বললো, আমরা মানুষ, আমাদের মন আছে। আমরা আমাদের মতো করে নাচবো, গাইবো, আমাদের মায়ের মতো করে কথা বলবো। পারলে তোমরা বরং মানুষের মতো হও। রক্ত খাওয়া বন্ধ করে দুধ ভাত মাছ খাওয়া শেখো।
রাক্ষসেরা সবসময় মানুষদের ঘৃণা করতো, ছোটলোক ভাবতো। মানুষের শক্তি নিয়ে হাসাহাসি করতো। তাই মানুষ যখন ওদের রক্ত খেতে বারণ করলো ওরা খুব রেগে গেলো। হুঙ্কার দিয়ে বললো, আমরা মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। আমরা ঘুষি মেরে পাথর গুড়ে গুড়ো করে ফেলতে পারি। আমরা তোদের বেয়াদবীর চরম শিক্ষা দেবো।
রাজপূত্র বললো তোমরা শক্তিশালী তাতে কী? আমরা মানুষ, আমাদের মন আছে, আমরা যা চাই তাই করতে পারি। আমরা তোমাদের ভয় পাই না।
তারপর? অন্তুর আগ্রহ আরো গাঢ় হয়।
হেনা মার দিকে তাকায়। মাও হেনাকে এক দৃষ্টিতে দেখে।। দুজনের দৃষ্টি বেয়ে রূপকথার লতাপাতা চোখে চোখ রেখে ঠোঁটে নেমে আসে, এরপর রাক্ষসেরা ধরে ধরে মানুষের রক্ত খাওয়া শুরু করলো। পথে ঘাটে মানুষের লাশ পড়ে থাকতে লাগলো। বাচ্চারা বাগানে খেলাধূলা বন্ধ করে দিলো, বড়োরা তালা মেরে ঘরের ভেতর নিজেদের বন্ধ করে রাখলো, বুড়োরা ঈশ্বর ভগবান আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। রাক্ষসের বিকট গর্জন আর লাশের পচা গন্ধে দেশের সমস্ত ফুল মরে যেতে লাগলো, ফুলের দুঃখে ফড়িং প্রজাপতি মৌমাছিরাও ঘুমিয়ে পড়লো আর জাগলো না, তাদের দুঃখে গাছেরা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো, নদীর পানি শুকিয়ে যেতে লাগলো, সাগর বোবা হয়ে গেলো, সূর্য ঢেকে গেলো মেঘে, আকাশ থেকে চাঁদটাও হারিয়ে গেলো, আস্তে আস্তে সবুজ শ্যামল সুন্দর দেশটা পোড়া কয়লার মতো হতে থাকলো। রাক্ষসেরা তাতেই খুশি। তারা বললো, মানুষ না মাটি হলেই আমাদের চলবে।
এই যখন অবস্থা তখন মানুষেরা বুঝতে পারলো যে বাঁচতে হলে তাদের যুদ্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। তারা তখন হাতের কাছে যা পেলো তাই নিয়েই রাক্ষসদের সাথে লড়াই করতে লাগলো।
মানুষের সোর্ড ছিলো না?
ছিল। কিন্তু রাক্ষসরাতো অনেক শক্তিশালী, তাদের কাছে জাদুর কামান বন্দুক ছিল।
ইস! আমার ম্যাজিক সোর্ডটা যদি মানুষ পেতো! অন্তু ওর পাশে রাখা প্লাস্টিকের লম্বা তরবারির বোতামে টিপ দেয়। তরবারিটা গর্জন করে জ্যান্ত হয়ে উঠে লাল সবুজ আলো ছড়ায়।
ইস তাইতো, তরবারিটা যে ওই সময় কোথায় ছিল! হেনা অন্তুর সোর্ডটাকে আদর করে।। তারপরও কিন্তু রাক্ষসেরা মানুষের সাথে পারছিলো না।
কেন?
কারণ মানুষের মন আছে। মানুষ চাইলেই অনেক কিছু পারে। রাক্ষসের তো মন নেই। তাদের আছে পাথর। মনের কাছে পাথরতো নস্যি। একসময় রাক্ষসেরা এটা বুঝতে পারলো। তখন তারা আরেকটা বুদ্ধি বের করলো। তারা মানুষ দিয়েই মানুষকে ঘায়েল করার ফন্দি আটলো।
কীভাবে? মানুষতো রাক্ষসের সাথে যুদ্ধ করছে!
জাদু। রাক্ষসেরা জাদু করে কিছু মানুষের মনে পাথর ঢুকিয়ে দিলো। তারপর ঐ মানুষগুলো রাক্ষসদের পুতুল জোম্বি দৈত্য হয়ে গেলো। রাক্ষসরা যা বলে ওরা তাই শোনে, উঠতে বললে ওঠে, বসতে বললে বসে, খেতে বললে খায়, ঘুমাতে বললে ঘুমায়।
জোম্বি দৈত্যদের কী শিং ছিলো?
হ্যা। ওদের মাথায় হাতির দাঁতের মত ইয়া লম্বা চোখা শিং ছিল, থুতনীতে ছিল চোখা চোখা পেরেক, ওদের চোখদুটোতে ইটভাটার দাউদাউ আগুন জ্বলতো, চোখের কোনে কালো রঙ দিয়ে আঁকা ছিল মানুষের মুন্ডু, ওদের ঠোঁট বেয়ে সবসময় লাল লাল রক্ত গড়াতো, ওদের জিভ ছিলো সাপের মতো লম্বা আর ওরা কথাও বলতো সাপের মতো হিসহিস করে, ওদের কানে কোন ফুটো ছিলো না।
কেন?
যাতে ওরা মানুষের চিৎকার আর্তনাদ শুনতে না পায়। ওদের দাঁত ছিল নেকড়ের মতো বড় বড়, ওদের শরীর জুড়ে ছিল ধারালো নখ, ইয়া লম্বা জামা পরে ওরা সেগুলো ঢেকে রাখতো। ওদের হাতের আঙ্গুলগুলো আক্টোপাসের মতো কিলবিল করতো। এক হাতে মানুষের মাথা উঁচু করে আরেক হাতে মানুষকে জবাই করতো ওরা।
দৈত্যদের বর্ণনা শুনে অন্তু ভয়ে সিটকে যায়। গুটিশুটি মরে সে হেনার বুকের ভেতর ঢুকে যেতে চায়, যেন দৈত্যগুলো ওর আশেপাশেই আছে। হেনা অন্তুকে জড়িয়ে ধরে অভয় দেয়, ভয় কীসের বাবা, মা পাশে আছে না! আড়চোখে হেনা মার দিকে তাকায়। মার পাশে বাবা এসে বসেছে। বাবা ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। মা কী একটু ভয় পেলো! বাবাকে একহাতে আঁকড়ে ধরে আছে মা- কী হলো মা, থামলে কেন? রাক্ষসদের কী হলো বলো না, রাজপূত্রের কী হলো বলো না মা, ও মা দৈত্যদের কী হলো বলো না, হেনা ছটফট করে হাত পা ছোড়ে। মা চুপ, তার চোখে মুখে রাজ্যের অন্ধকার। হেনা সেই অন্ধকারে ঢুকে পড়ে, দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে সামনে এগোয়....ওই জোম্বি দৈত্যগুলোতো আসলে একসময় মানুষ ছিলো। তাই ওরা মানুষের সব খবর জানতো। মানুষের বাড়ি ঘর, লুকানোর যায়গা সব ওরা চিনতো। ওরা করলো কী পথ চিনিয়ে রাক্ষসদের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে নিয়ে গেলো।
রাক্ষসদেরতো খুব সুবিধা হলো তাহলে! মায়ের বুকের ভেতর থেকে এক চোখ বের করে বাবুই পাখির ছানা হয়ে বলে ওঠে অন্তু।
হ্যা, রাক্ষসেরা দৈত্যদের সাথে নিয়ে মনের সুখে মানুষ মারতে লাগলো। লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষ মরতে থাকলো। মরলে কী হবে, মানুষ ঠিক করেছে রাক্ষসদের তাদের দেশ থেকে না তড়িয়ে তারা থামবে না, তাই তারা হাল ছাড়ে না।
আর রাজপূত্র?
যুদ্ধ শুরু হতেই রাজপূত্রকে রাক্ষসরা তাদের প্রসাদে আটকে রেখেছিলো। রাজপূত্রকে মুক্ত করতে মানুষ জান প্রাণ দিয়ে লড়তে থাকে। মাঠে ঘাটে সুযোগ পেলেই তারা রাক্ষস, দৈত্যদের উপর হামলা করতে থাকলো। এভাবে যুদ্ধ চলতে চলতে, রাক্ষসেরা মানুষ মারতে মারতে মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেল। তারপর তারা একসময় বুঝতে পারলো যে এতো মানুষের সাথে যুদ্ধ করে তারা জিততে পারবে না। তখন তারা ঠিক করলো মানুষের ভেতর যারা বুদ্ধিমান, যারা খেলনা বানাতে পারে, যারা গান গাইতে পারে, তোমার মতো সোর্ড চালাতে পারে, কার্টুন বানাতে পারে, বই পড়তে পারে তাদের সবাইকে মেরে ফেলতে হবে।
যারা তোমার মতো গল্প বলে, তাদের?
তাদেরও।
কেন?
কারণ তাদের মারলে ভবিষ্যতে মানুষ খেলার জন্য খেলনা পাবে না, পড়ার জন্য বই পাবে না, কার্টুন সোর্ড কিছুই পাবে না, মানুষকে কেউ গল্পও বলতে পারবে না, কেউ গানও শেনাবে না। তখন কী হবে? তখন মানুষ একটা রোবট হয়ে যাবে। ওই যে তোমার একটা রোবট আছে না- রোবোকপ, বোতাম টিপলে কথা বলে, হাঁটে, বোতাম অফ করে দিলে আর চলতে পারে না।
ও বুঝেছি, মানুষ রোবট হয়ে গেলেতো রাক্ষসেরা তাদের নিয়ে খেলতে পারতো, তাই না?
ঠিক বুঝেছো। তো রাক্ষসদের অর্ডার পেয়ে দৈত্যরা খুঁজে খুঁজে ওই ধরনের মানুষদের মুরগীর মতো জবাই করতে লাগলো। তাই না মা? হেনা মাকে জিজ্ঞেসা করে। মা কোন জবাব দেয় না। মা তুমি শুনতে পাচ্ছো? হেনা আকুল হয়ে মাকে ডাকে। দরজায় প্রচন্ড শব্দ হয়। মা বাবাকে আঁকড়ে ধরে। দরজা ভেঙ্গে দুটো দৈত্য ঘরে ঢোকে। তাদের গায়ের ভয়ঙ্কর দূর্গন্ধ হেনার মগজের কোষে কোষে বিছিয়ে যায়। তার বমি পায়। সে মাকে বুকের ভেতর মুখ গুজে কেঁদে ওঠে। দৈত্যগুলো বাবাকে টেনে হিচড়ে নিতে থাকে। মা বাবাকে এক হাতে আরো জোরে আঁকড়ে ধরে। দৈত্যদের একজন বিকট হাসি দিয়ে মায়ের কোল থেকে হেনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হেনা আরো জোরে কেঁদে ওঠে। মায়ের আঁচল সরে গেছে। দৈত্যটা মায়ের বুকে দাঁত বসিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। মায়ের চিৎকারে হেনা ক্ষনিকের জন্য চুপ মেরে যায়। অবাক চোখে লাল একটা রক্তের ধারাকে হামাগুড়ি দিয়ে সে তার দিকে আসতে দেখে। খুশিতে আটখান হয়ে সে হাত পা ছোড়ে। মায়াবী একটা খেলনায় প্রলুব্ধ হয়ে রক্তের মুখটা ধরতে সে হাত বাড়িয়ে দেয়। মুখটা অন্তুর মুখ হয়ে যায়!
গল্পের শেষটা বলো না, অন্তু মাকে তাড়া দেয়।
গল্পের শেষটা কী মা? হেনা মাকে জিজ্ঞেস করে। মা কোন জবাব দেয় না।
আম্মু কথা বলো, অন্তুর ঝাকুনীতে রক্তের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে হেনা, তারপর...আড়চোখে সে দেখে দৈত্যদুটো আবার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চকচকে সাদা দাঁতে লাল লাল রক্তের ছোপ। তারা দুই হাত দিয়ে চোখ বাধা একটা লোককে উঁচু করে ধরে। তার কাটা গলা থেকে গল গল করে রক্ত ঝরছে। দেখতে দেখতে ঘর ঘর জুড়ে রক্ত থৈ থৈ করে। দৈত্যগুলো রক্তের ভেতর লুটোপুটি খায়, এর ওর দিকে রঙের মতো রক্ত ছিটায়। ওদের একজন হেনার দিকে এক আজলা রক্ত ছুঁড়ে দেয়। হেনা রক্তের হাত থেকে বাঁচাতে অন্তুকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে।
আম্মু কী হলো! অন্তু অবাক হয়।
কিছু না, হেনা হাত দিয়ে দৈত্যগুলোকে আড়াল করে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে গল্পে....এভাবে একসময় যুদ্ধ শেষ হয়। রাক্ষসেরা লেজ গুটিয়ে ঝোলার মধ্যে ঢুকে নিজের দেশে ফিরে যায়। মানুষের দেশ আবার মানুষের হয়ে যায়।
রাজপূত্র?
মানুষ রাজপূত্রকে মুক্ত করে আনে।
আর দৈত্যরা?
রাজপূত্র ফিরে আসার পর দৈত্যরা তার পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। তারা বললো, রাক্ষসরা আমাদের জাদু করেছিল, আমাদের কোন দোষ নেই। আমাদেরকে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দেন।
মানুষ হচ্ছে এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার মধ্যে সেরা। আল্লা নিজে যেমন মানুষকেও তেমনভাব বানিয়েছেন। তাই মানুষের মনে অনেক দয়া। আমাদের রাজপূত্র ছিল মানুষের রাজা। তার মনে দয়া আরো অনেক বেশি। তাই সে দৈত্যদের ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিল।
দৈত্য কীভাবে ভালো হবে! ওদের মনেতো পাথর ভরা?
সেটাই। রাজপূত্রের দয়াকে কাজে লগিয়ে দৈত্যরা গোপনে গোপনে রাক্ষসদের সাথে যোগাযোগ করে জাদু শিখতে লাগলো। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে তারা রাজপূত্রকে মেরে ফেললো।
মেরে ফেললো, মানুষ কিছু বললো না?
দৈত্যরা রাজপূত্রের হাতে থাকা সোনার কাঠি রুপের কাঠি ওলোট পালট করে মানুষকে তখন ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই তারা বুঝতেই পারেনি যে তাদের রাজপূত্র নেই। তারা নাক ডেকে ঘুমাতেই থাকলো। ওদিকে রাজপূত্রের লাশ মাটি চাপা দিতেই সেখানে একটা গাছ গজিয়ে উঠলো। চোখের পলকে গাছটা বড় হতে হতে বিশাল একটা বটগাছ হয়ে গেলো।
আগের বটগাছটার মতো?
তার চেয়েও বিশাল, তার চেয়েও অনেক অনেক উঁচু। সেই গাছের কাছে যাতে কেউ না আসতে পারে সেজন্য দৈত্যরা সেখানে দিনরাত পাহারা বসাল। পাহারার জন্য অনেক দৈত্য দরকার। তাই তারা তোমার মতো ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে তাদেরকে জাদু করে দৈত্য বানাতে থাকলো।
ও দৈত্যরা তাহলে ছেলেধরা?
ঠিক। তারা মানুষের ছদ্মবেশ ধরে এসে বাচ্চাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে জাদু করে ফেলে। সেজন্যই তোমাকে বলি খবরদার অপরিচিত কেউ যদি তোমাকে ডেকে বলে, বাবু চকলেট খাবা-খবরদার যাবে না।
জানো আম্মু, আমি সেদিন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছি একটা লোক বলে, বাবু তোমার নাম কী? আমি দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেছি।
গুড বয়, রেহনা অন্তুর কপালে চুমু খায়। দৈত্য দুটো খ্যাক খ্যাক করে হাসে। রেহানা চোখ তুলে দেখে দৈত্যগুলো বেশভূষা পাল্টিয়ে আলাভোলা ভালোমানুষের চেহারা নিয়ে ফুলের তোড়া, চকলেট, নানা রকমের খেলনা হাতে খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাসি হাসি মুখ অনুসরণ করে রেহানা ঘরময় আরো অনেক ছোট ছোট দৈত্য ঘুর ঘর করতে দেখে। ছোট ছোট কিলবিলে পা ফেলে মেঝেতে, দেয়ালে, অন্তুর সমস্ত খেলনায় তারা একেঁ দিচ্ছে তাজা রক্তের ছোপ।
অন্তু, রেহানা অস্ফূট স্বরে বলে।
হু, অন্তু সাড়া দেয়।
ঘুম এসে গেছে বাবা?
অন্তু হাই তোলে, না । আচ্ছা আম্মু, দৈত্যগুলো যদি জাদু করতেই থাকে তাহলেতো একদিন সব মানুষ দৈত্য হয়ে যাবে ! মানুষের দেশ তখন দৈত্যদের দেশ হয়ে যাবে, তাই না? অন্তু যেন এতোক্ষণ চুপ করে এটাই ভাবছিলো
সেটাই হওয়ার কথা, হেনা দৈত্যগুলোর চোখে চোখ রেখে বলে। দৈত্যগুলোর হাসি কান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাদের ঝকঝকে সাদা দাঁতে রক্তের দূর্গন্ধ হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়।
আমি দৈত্য হতে চাই না আম্মু। দৈত্যরা দেখতে পচা হয়, হাউ মাউ খাউ করে কথা বলে, কার্টুনে দেখায় দৈত্যরা সব শয়তান, মিথ্যুক।
অন্তুর কথা শুনে খাটের পাশে দাঁড়ানো দৈত্য দুটোর চেহারা হঠাৎ করে রাগে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কোটরের অন্ধকার থেকে তাদের চোখ দুটো আগুনের গোল্লা হয়ে দাউ দাউ জ্বলে ওঠে। গলার ভেতর থেকে উঠে আসা লাল টকটকে জিভ সাপের ফনা তোলে। দেখতে দেখতে তাদের হাতের আঙ্গুলগুলো অক্টোপাসের মতো কিলবিল করে নেকড়ের থাবা হয়ে ওঠে। চোখের পলকে মানুষের বেশ ছিড়ে খুঁড়ে তারা রক্তপিপাসু পিশাচ হয়ে ওঠে। তাদের রক্তমাখা হাত অন্তুকে ধরতে এগিয়ে আসে। হেনা অন্তুকে শক্ত করে জগিয়ে ধরে, না কিছুতেই না। অন্তু বাবা সোনা কিছুতেই দৈত্য হওয়া যাবে না।
তাহলেতো দৈত্যকে মারতে হবে, অন্তু ঘুম ঘুম চোখে বলে।
হ্যা, দৈত্যকে আর সুযোগ দেয়া যাবে না, মারতেই হবে। অন্তুর কথায় দৈত্যের থমকে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে রেহানা জবাব দেয়।
দৈত্য কীভাবে মরবে? ওরা না জাদু জানে?
তোমার কাছেওতো জাদুর সোর্ড আছে, আছে না?
আমার সোর্ড, অন্তু হাত দিয়ে তার তলোয়ার আঁকড়ে ধরে, এটা দিয়ে দৈত্য মারা যাবে?
হ্যা, শুধু রাজপূত্রের মতো সাহস করে দৈত্যগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। তারপর ওদের বুকের ভেতরের পাথরে সোর্ড ঢুকিয়ে দিলেই ওরা শেষ। তারপর বটকে বলতে হবে-
সোনার কাঠি রূপোয় দেবো
রুপোর কাঠি সোনায় দেবো
আমার শরীর তোমায় দেবো
তোমার শরীর আমি নেবো
নিজের চোখের ঘুম ভাঙ্গাবো
সব মানুষকে আজ রাঙ্গাবো।

ও তাই! ইয়াহু, আজ সব দৈত্যকে আমি শেষ করে ফেলবো, অন্তু সোর্ডটা উঁচু করে সুইচ টিপতেই ওটা থেকে অলৌকিক আলোর এক ঝলকানি বের হতে থাকে। সেই আলোয় ঝলসে যায় দৈত্যদের মুখ। দৈত্যরা পিছু হটে। অন্তু ঘুম ঘুম চোখে বনবন করে তলোয়ার চালাতে চালাতে ডানায়ালা পঙ্খীরাজে চেপে বসে। সময় বেশি নেই, ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সোনার কাঠি রূপোর কাঠি বদলে মানুষের ঘুম ভাঙ্গাতে হবে। অন্তুকে জাপটে থাকে হেনা; টের পায়, মা তাকে কোলে নিয়ে ছড়া কাটছে-
রাজপূত্র আসবে বলে
রাজকন্যা ঘুমায় না
সোনার কাঠির রূপোর কাঠির
গল্প তাই ফুরায় না।

১৩/১২/১৩
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

গুরু গুরু পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

খাঁটি বাংলার রূপকথা --- দারুন লাগছে। তাড়াতাড়ি শেষ করেন, আমিও আমার ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর সময়ে এই গল্পটা বলবো।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ। অপেক্ষায় আছি।

স্বয়ম

এক লহমা এর ছবি

ভাল লাগছে। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।