তালেবান, জেএমবি'র ফিরে আসা এবং সাইবার খিলাফতের দানব-১

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: রবি, ২৪/০১/২০১৬ - ১০:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সম্প্রতি আফগানস্থানে আবারও তালেবানেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দু’ এক দিন পরপরই তারা এখানে ওখানে তুমুল হানা দিয়ে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করছে। একইভাবে বাংলাদেশেও জেএমবি (জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ) সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌলবাদী আক্রমণের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যাচ্ছে; সম্প্রতি তাদের বিভিন্ন আস্তানা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রপাতি : ধারণা করা হচ্ছে জেএমবি আবারও সংগঠিত হয়ে বাংলাদেশে ইসলামি শাসন কায়েমের সশস্ত্র লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছে।

আফগানস্থানের তালেবান এবং বাংলাদেশের জেএমবি- আপাত সংশ্লিষ্টতাহীন এই দুটি মৌলবাদী সংগঠন একসময় দুটি দেশের জন্যই হুমকির সৃষ্টি করেছিল। মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানরা আফগানস্থানের ক্ষমতা দখল করতে পারলেও, বাংলাদেশে জেএমবি তা পারেনি বরং জেএমবি’র শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। পরবর্তীতে তালেবানেরা আফগানস্থানের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয়, মোল্লা ওমরসহ তাদের প্রথম সারির নেতারা আত্মগোপনে পালিয়ে বেড়াতে থাকে; বহু বছর তারা কোন খবরে তেমনভাবে ছিল না।

একইভাবে, এক সময় বাংলাদেশ সরকার জেএমবির বিষদাঁত উপড়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছিল, তারপর অনেকদিন তাদের আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ধরেই নেয়া হয়েছিল যে জেএমবি আসলেই একটি মৃতপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে তালেবান এবং জেএমবি- দুটো সংগঠনই আবার দুটি দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের এই নবজাগরণে দক্ষিণ এশিয়ায় কট্টর ইসলামী মৌলবাদ যে নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজ নিজ দেশে এই দুটো সংগঠনের প্রবল জনসমর্থন না থাকা স্বত্ত্বেও কেমন করে তারা আবারও ছড়িয়ে পড়ছে- অনেকেরই এখন এ প্রশ্ন।

তবে, এই প্রশ্ন ছাপিয়ে বড় আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে সাইবার খিলাফতের দানব। বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত পথ তৈরি করে প্রভাব বিস্তার করা এই দানব তালেবান বা জেএমবির মতো কট্টরপন্থি সংগঠনের পুণরুত্থানে কতোটা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে- সেটাও ভেবে দেখার বিষয় হিসেবে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিষয়টিকে হালকাভাবে বিচার করার কোন সুযোগ নেই- কিন্তু কথিত মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে আসা তালেবান, জেএমবি বা অন্য আরো কট্টরপন্থী সংঠনের পিঠে সওয়ার হয়ে আস্তে আস্তে ধেয়ে আসা এই উন্মত্ত শক্তির ব্যাপারে আমরা ঠিক কতোটা মনোযোগী?

আফগান গৃহযুদ্ধ ঠেলে তালেবানদের উত্থান এতোটাই চমকপ্রদ ছিল যে নব্বই এর দশকে তারা বিশ্ব রাজনীতির মনোযোগের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায়। ১৯৯৬ সালে আফগানস্থানে সরকার গঠন করে তথাকথিত ইসলামি শরিয়া আইন কঠোরভাবে বলবতের মাধ্যমে তারা তাদের চরম কট্টরপন্থার মশাল এগিয়ে নিয়ে চলে। ৯/ ১১ এর পরে, আফগানস্থানে মার্কিন- ন্যাটো বাহিনী আফগানস্থানে হানা দেয়ার আগ পর্যন্ত, তালেবানেরা আফগানস্থানে বেশ দাপটের সাথেই টিকে ছিল। তারপর তারা পিছু হটতে শুরু করে। মার্কিন মদদপুষ্ট প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এর নেতৃত্বে আফগানস্থানে তালেবানবিহীন শাসন শুরু হয়। একসময় ঢাকঢোল পিটিয়ে আফগান সরকার বলতে থাকে যে, আফগানস্থানকে অবশেষে তালেবানমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

টেলিভিশনে দেখা যায়, কাবুলের জীবনযাত্রায় নতুনত্বের ছোঁয়া এসেছে: সেখানে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, নামী দামী এনজিও খুশিমনে পতাকা উড়িয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে, মাইন পরিষ্কার করে মাঠ বানিয়ে আফগানিরা ফুটবল খেলছে, ক্রিকেটের নতুন কোচ আনছে, সাধারণ মানুষ হাসিমুখে ব্যবসা বাণিজ্য করছে, বিদেশী পর্যটকেরা নির্ভয়ে বেড়াতে আসছেন, দেশ জুড়ে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে ( যেন আফগানস্থান ফিরে গেছে সেই ষাট এর দশকের চোখ ধাঁধানো দিনগুলোতে), সেই সাথে নানা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আফগান ন্যাশনাল গার্ডেরা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে- কট্টর তালেবান শাসনের নির্মমতা এখন শুধুই এক ধূসর স্মৃতি; নানা ডকুমেন্টারিতে তালেবানদের পুণ:উত্থানের শঙ্কা হাসতে হাসতে উড়িয়ে দেন সেদেশের কর্তাব্যক্তিরা- এসব দেখে বিশ্ববাসী আশ্বস্ত হন : তালেবান নামের মধ্যযুগীয় দানবটার হাত থেকে শেষ পর্যন্ত আফগানস্থানকে মুক্ত করা গেছে।

এগুলো বাইরের দৃশ্য। আদতে কিন্তু আফগানস্থানের এখানে ওখানে তালেবানরা ঠিকই টিকে ছিল। তাদের সাথে তলে তলে শান্তি আলোচনাও চলছিল। মার্কিন বাহিনী টাকা পয়সা বিনিয়োগের মাধ্যমে তালেবানদের মেইনস্ট্রিমে ফিরিয়ে আনার একটা চেষ্টাও করে যাচ্ছিল। অর্থাৎ আফগানস্থানকে কখনোই তালেবানমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।

তালেবানরা আসার আগে আফগানিরা বিভিন্ন দলে উপদলে ভাগ হয়ে একে অন্যের সাথে যুদ্ধ করছিল- এই ইতিহাস আমাদের সবার জানা। কাশিম- যার সাথে আমার কদিন আগে পরিচয় হয়েছে, যে তালেবানদের উত্থানের সময় কাবুলেই ছিল- তার ভাষায় যুদ্ধ এবং যুদ্ধের নানা অনাচারের ভেতর থাকতে থাকতে সাধারণ আফগানিরা অস্থির হয়ে উঠেছিল, তারা এমন একটি শক্তির কামনা করছিল যারা সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ও নায্যতা ফিরিয়ে আনবে; ইসলামপন্থী তালেবানদের উত্থানে তাই তারা অখুশি হয়নি, বরং মুক্তির একটা পথ খুলে গেল বলে ভেবেছিল। পরবর্তীতে দেখা যায় তালেবানেরা ইসলামের নামে যে শাসন কায়েম করেছে: হত্যা, লুণ্ঠন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা- তা আগেকার যুদ্ধের সমস্ত বর্বরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে, তালেবানদের দিক থেকে মুখ ফেরাতে সাধারণ আফগানিদের সময় লাগেনি।

তবে কট্টরপন্থা যাদের পছন্দ তারা বরাবরই তালেবানদের সমর্থন দিয়ে গেছে। এর মধ্যে যারা তালেবান আমলে ফুলে ফেঁপে লাল হয়েছিল, সেই সময়ের সেইসব ক্ষমতাবান গোষ্ঠীও রয়েছে। তার ওপর রয়েছে পাকিস্তান- যাদের হাতে ধরে তালেবানদের উত্থান; তালেবানকে পাকিস্তান বরাবরই সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে ( সামরিক বেসামরিক নানা প্রতিবেদনে বহুবার পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কে তালেবানদের উত্থানের জন্য দায়ী করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা সেদেশের সীমান্তে শত শত মাদ্রাসা খুলে ধীরে ধীরে সেগুলোকে চরমপন্থী তালেবান তৈরির কারখানায় পরিণত করে।) : তালেবান শাসনকে যে তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল তাদের মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম; বলা হয়ে থাকে, তালেবানকে সামনে রেখে পাকিস্তান আফগানস্থানে তাদের প্রচ্ছন্ন শাসন কায়েম করতে চেয়েছিল, পাকিস্তানের সেই ইচ্ছা এখনো তালেবানদের সহায়ক শক্তি; আফগানস্থানে ক্রমবর্ধমান ভারতীয় সামরিক, বেসামরিক বিনিয়োগ ও প্রভাবের বিপরীতে পাকিস্তান তালেবানদের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে সেখানে একটি ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত আছে- যা তালেবানদের ফিরে আসতে রসদ যুগিয়ে যাচে্ছ।

কাগজে কলমে এটুকু বলা হলেও, তালেবানদের ফিরে আসার পেছনে আরো তাৎপর্যপূর্ণ কারণ রয়েছে: মার্কিন মদদপুষ্ট তালেবান পরবর্তী আফগান সরকার পশ্চিমের অনুদানের টাকায় বছরের পর বছর ধরে আফগানস্থানে যে উন্নয়ন পরিচালনা করে আসছে, সেই টাকায় যতো না সাধারণ মানুষের উন্নয়ন হয়েছে তার চেয়েও বেশি বেশি লালে লাল হয়েছে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ মানুষজন; হামিদ কারজাই এর পরিবারের অনেকের নামেই দুর্নীতি করে অঢেল টাকা পয়সা কামানোর অভিযোগ রয়েছে; বিভিন্ন শহরের গর্ভনরদের আয়েশি জীবনযাপনের উৎস সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠেছে; বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহের ভিত দিনে দিনে শক্ত হয়েছে (২০১২ সালে নিইউয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রবন্ধে দুর্নীতিকে আফগানস্থানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণণা করেছিল); বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও, চোখের পড়ার মতো কোন অবস্থা তৈরি হয়নি।

যার ফলে, সাধারণ মানুষ আবারও আগের মতো হতাশ হয়ে পড়েছে; দেশের তরুণ সমাজের এক অংশ বড় ধরণের পরিবর্তন কামনা করছে; বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের তরুণেরা যারা কর্মসস্থানের অভাবে ক্ষুব্ধ, তালেবানেরা তাদেরকে “পরিবর্তনের ধোয়া” তুলে আবারও দলে ভেড়ানোর প্রয়াস পাচ্ছে- ফলাফল হলো: তালেবানরা ক্রমবর্ধমান হারে আবারো আফগানস্থানের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।

ছবি সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Taliban#/media/File:Taliban_beating_woman_in_public_RAWA.jpg

(চলবে)

ছবি: 
11/05/2008 - 10:01অপরাহ্ন

মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

একইভাবে, এক সময় বাংলাদেশ সরকার জেএমবির বিষদাঁত উপড়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছিল, তারপর অনেকদিন তাদের আর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ধরেই নেয়া হয়েছিল যে জেএমবি আসলেই একটি মৃতপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

এরকমটা মনে করার ভিত্তি কী? কে ধরে নিয়েছিলো জেএমবি মৃতপ্রায় সংগঠনে পরিণত হয়েছে? জেএমবির শত শত কর্মী নিয়মিতভাবে গ্রেফতার হচ্ছে। একটু গুগল করলে তেমন কোন আলোড়ন তোলেনি এরকম বহু খবর পাওয়া যায়। এই খবরের আলোকে মনে করার কারণ নেই যে জেএমবি মৃতপ্রায়।

লেখায় আনসারুল্লাহর উপস্থিতি দেখলাম না। বাংলাদেশে তালেবান মতাদর্শের দল আনসারুল্লাহ। জেএমবি হলো আইএস মতাদর্শের দল। দুটো গ্রুপের কাজের পদ্ধতি, টার্গেট আলাদা।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশের নাম 'আফগানস্থান' লিখেছেন কেন? ইংলিশে Afghanistan (আফঘানিস্তান) লেখা হলেও দেশটার নাম পশ্‌তু বা দারীতে افغانستان বাংলায় যার উচ্চারণ দাঁড়ায় 'আফগানিস্তান'। বাংলা ভাষাতেও দেশটা আফগানিস্তান নামেই পরিচিত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।