বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়: ধোঁয়াশা, তত্ত্বকথা ও মানুষের জবানি

নাশতারান এর ছবি
লিখেছেন নাশতারান (তারিখ: মঙ্গল, ৩০/০১/২০২৪ - ১১:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[লেখার উদ্দেশ্য হিজড়া, ইন্টারসেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় স্পষ্ট করা। কারো কারো কাছে লেখাটা একটু দীর্ঘ মনে হতে পারে। ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইল।]

বছরখানেক আগের কথা। আমি তখন ছয় মাসের সন্তানসম্ভবা। একটা ইভেন্টে মানুষজনের সাথে আলাপ করছিলাম। ইভেন্টের বিষয় বাংলাদেশের লিঙ্গবৈচিত্র্য এবং এর শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। আমি সেখানে সংগঠক এবং ডিজাইনার। কাজেই আমাকে থাকতেই হতো। সপ্তাহদুয়েকের সেই প্রদর্শনীতে আমি প্রতিদিনই যেতাম, দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলতাম। তেমনই একদিন এক বন্ধুর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। অন্যপাশে অচেনা একজন ভদ্রলোক চুপচাপ বসে ছিলেন। আড্ডার বিরতিতে ভদ্রলোক সবিনয়ে জানালেন তিনি লিঙ্গবৈচিত্র্য বিষয়ে আরো জানতে আগ্রহী। আমিও আগ্রহ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। অল্পবিস্তর আলোচনার পর তিনি খানিকটা দ্বিধা নিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির যৌনাঙ্গ কেমন হয়। সম্ভবত তিনি ইন্টারসেক্স ব্যক্তির যৌনাঙ্গ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। এই বিভ্রান্তিটা অনেকেরই হয়। বরাবর যা বলি সেদিনও সেটাই বললাম -- ইন্টারসেক্স জননাঙ্গ মেল ও ফিমেলের মধ্যবর্তী যেকোনোরকম হতে পারে। তাই শুধুমাত্র একজন ইন্টারসেক্স ব্যক্তিই বলতে পারবেন তার যৌনাঙ্গ দেখতে কেমন। ভদ্রলোক তখন বললেন যে তিনি আসলে আমার বন্ধুর সঙ্গে আমার আলাপের খানিকটা শুনে ফেলেছিলেন আর অবাক হয়ে ভাবছিলেন যে একজন আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তি কীভাবে গর্ভধারণ করতে পারেন। তাই নাকি জিজ্ঞেস করেছেন। বুঝলাম তিনি যে শুধুমাত্র ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্সের মধ্যে পার্থক্য জানেন না তা-ই নয়, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে লিঙ্গবৈচিত্র্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সকলে আন্তঃলিঙ্গ। যতবারই আমি এই ঘটনাটা মনে করি ততবারই আমার হাসি পায়। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে লিঙ্গ সম্পর্কে গড়পরতা ধারণা এমনই ধোঁয়াশাময় এবং ভুল তথ্যে ঠাসা। আমি আন্তঃলিঙ্গ না বলে ইন্টারসেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডার আলাদা করে বলি, কারণ সেক্স আর জেন্ডার এক নয়। অথচ বাংলাদেশে সেক্স এবং জেন্ডার একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। অনেকক্ষেত্রে মুখ ফুটে সেক্স বলতে দ্বিধা হয় বলে সেক্সের বদলে জেন্ডার ব্যবহার করা হয়। সেক্স এবং জেন্ডারের পার্থক্য না জানার কারণে ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্সের মধ্যকার পার্থক্যও অজানা রয়ে যায়। তার উপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, লিঙ্গপরিচয়ের কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা ছাড়াই। এতে নতুন ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্স ব্যক্তিদেরকে ঢালাওভাবে হিজড়া মনে করা এবং এই সমস্ত লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষকে সমকামী হিসাবে কোণঠাসা করে দেওয়ার প্রবণতা রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল মহল থেকে কিছুদিন পরপরই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সমকামিতা একটা ভিন্ন এবং ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ প্রসঙ্গ। বিশেষ করে ২০১৫ সালে সমকামিতা বইয়ের লেখক অভিজিৎ রায় এবং ২০১৬ সালে এলজিবিটি অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয়ের হত্যাকাণ্ডের পর সমকামিতা একটা ঝুঁকিপূর্ণ, বিস্ফোরক আলোচনা। বাংলাদেশে সামাজিক ও আইনগতভাবে শুধুমাত্র হেটেরোসেক্সুয়াল অর্থাৎ নারী-পুরুষের যোনী-শিশ্নের যৌন সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইন এবং সমকামিতার চর্চা আলাদা আলোচনা দাবি করে। অন্য কোনোদিন সেই আলাপ করব। আজকে শুধু বাংলাদেশে লিঙ্গপরিচয় নিয়ে লিখতে বসেছি। সমকামিতা, অর্থাৎ যৌনতার সঙ্গে লিঙ্গের প্রসঙ্গ মিলাতে চাই না। আমার উদ্দেশ্য ট্রান্স আইডেন্টিটিকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত ধোঁয়াশা দূর করার চেষ্টা।

গত বছরের নভেম্বরের কথা। ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্টিভিস্ট হোচিমিন ইসলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে উইমেনস ক্যারিয়ার কার্নিভাল শিরোনামের একটি ইভেন্টে বক্তা হিসেবে যোগ দিতে গেছিলেন। তাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়নি একদল শিক্ষার্থী। তাদের বক্তব্য হলো হোচিমিন নাকি সেখানে এলজিবিটি আন্দোলনের প্রচারের জন্য সেখানে গেছেন এবং এটা তারা হতে দেবেন না। এই লেখাটার খসড়া যখন দাঁড় করাচ্ছিলাম, তখন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নতুন পাঠ্যক্রমের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে প্রকাশ্যে পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলার পর খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিযোগপ্রাপ্ত আসিফ মাহতাব উত্‍সকে বরখাস্ত করেছে এবং নানামহলের ধারাবাহিক বাদানুবাদের পর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের অবস্থানের সপক্ষে বিবৃতিও দিয়েছে। কিন্তু অনলাইনে নানারকমের ট্রল এবং ঘৃণার প্রকাশ এখনো স্তিমিত হয়নি। আসিফের অবস্থানের সমর্থনে কিংবা বিপক্ষে নানা মহলের মতপ্রকাশ এখনো চলমান। এ ধরনের ঘটনা জনসাধারণের মধ্যে ট্রান্স আইডেন্টিটি সম্পর্কে অজ্ঞতাই যে শুধু প্রকাশ করে তা নয়। বরং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী মহলের স্বঃপ্রণোদিত উসকানিও শক্তি সঞ্চয়ের অবকাশ পায়। ঘরপোড়া গরুর যেমন সিঁদুরমেঘ দেখে ভয় পায়, তেমনি মুক্তচিন্তার জন্য মৃত্যুর মিছিল দেখা ব্লগার হিসেবে এসব প্রতিক্রিয়াশীলতা আমার মনে আতংক জাগায়। বাংলাদেশে নারীপুরুষের প্রচলিত বাইনারি পরিচয়ের বাইরে এসে লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বুঝতে পারা এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের ভিত্তিতে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য শান্তিপূর্ণ, গঠনমূলক আলোচনার পরিসর বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশে লিঙ্গবৈচিত্র্য বিষয়ক আলোচনায় সবার আগে হিজড়া পরিচয়টা স্পষ্ট করা জরুরি। প্রথমত, হিজরা আদৌ কোনো লিঙ্গপরিচয় নয়। হিজড়া হলো বঞ্চিত ক্লীব, ইন্টারসেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটা অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়। হিজড়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব সামাজিক ব্যবস্থা, শ্রেণিবিন্যাস, অর্থনৈতিক চর্চা, ভাষা, পেশা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, এবং জীবনধারা রয়েছে যা মূলধারার থেকে স্বতন্ত্র। সেই অর্থে হিজড়া সংস্কৃতিকে একটা সাবকালচার বলা যেতে পারে। যদিও হিজড়া সম্প্রদায়ে অনেকেই ইন্টারসেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডার, কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স মানেই হিজড়া নয়। হিজরা হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নিতে হয় এবং সামাজিকীকরণের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তিকে যেতে হয়। হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়কে লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাতে হিজড়া সম্প্রদায় কিছুটা উপকৃত হলেও বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্বীকৃতি ও অধিকারকে কেন্দ্র করে নতুন সংঘাতের পথ তৈরি হয়েছে। হিজড়া সম্প্রদায়ের বাইরে যেসব ট্রান্সজেন্ডার এবং ইন্টারসেক্স ব্যক্তি রয়েছেন তাদের অনেকেই যেমন হিজড়া পরিচয়ে পরিচিত হতে অনীহা প্রকাশ করেন, তেমনি হিজড়া ব্যক্তিরা সচরাচর চান না তাদের সাংস্কৃতিক ও পেশাগত অধিকারে বহিরাগত কেউ অংশীদার হোক। ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া পরিচয়কে এক করে ফেললে এই বিভেদ আরো জোরদার হয়।

বাংলাদেশে যৌনতা বিষয়ক আলোচনা এবং যৌনশিক্ষাকে কেন্দ্র করে যে ঢাক গুড়গুড় আবহ, তাতে সেক্স এবং জেন্ডার নিয়ে খোলামেলা আলাপ যে কত কঠিন তা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে ধারণা করা যায়। স্পষ্ট আলোচনা এবং যথাযথ শিক্ষার অভাবে সেক্স এবং জেন্ডারকে কেন্দ্র করে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা দীর্ঘদিন ধরে। তাই একদম শুরু থেকে শুরু করতে চাই। ইন্টারসেক্স এবং ট্রান্সজেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্য সেক্স এবং জেন্ডারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। সেক্স হলো জৈবিক বা শারীরিক। জেন্ডার হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্বিক। ইংরেজিতে মেল আর ফিমেল হলো সেক্স, ম্যান আর ওম্যান হলো জেন্ডার। বাংলায় যেহেতু সেক্স এবং জেন্ডারের জন্য শুধু লিঙ্গ শব্দটিই রয়েছে, সেহেতু আমি এই দুয়ের পার্থক্য বুঝাতে ইংরেজি কিছু শব্দ ব্যবহার করতে চাই। একজন শিশু মেল না ফিমেল তা বোঝা যায় তার বাহ্যিক যৌনাঙ্গ অর্থাৎ শিশ্ন ও যোনী দিয়ে। আরেকটু গভীরে বুঝতে গেলে এক্স ওয়াই বা এক্স এক্স ক্রোমোজোম দিয়ে। এই শিশু বড় হয়ে ম্যান হবে নাকি ওম্যান সেটা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। যদি মেল হিসেবে জন্মানো ব্যক্তি নিজেকে ওম্যান হিসেবে উপলব্ধি করে তাকে বলা হবে ট্রান্সজেন্ডার নারী বা ট্রান্স-ওম্যান। যদি ফিমেল হিসেবে জন্মানো ব্যক্তি নিজেকে ম্যান হিসেবে উপলব্ধি করে তাকে বলা হবে ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ বা ট্রান্স-ম্যান। তিনি শিশ্ন এবং এক্স ওয়াই ক্রোমোজোম নিয়ে জন্মেছেন নাকি যোনী এবং এক্স এক্স ক্রোমোজোম নিয়ে এই বাস্তবতার সাথে ট্রান্স আইডেন্টিটির কোনো সম্পর্ক নেই, অর্থাৎ ট্রান্স আইডেন্টিটি যৌনাঙ্গ দ্বারা নির্ধারিত হয় না। হালের “আমি বাইরে থেকে দেখতে অমুক হলেও মনে মনে তমুক” ধারার যে ট্রলিং অনলাইনে চলছে তা দেখে অনভিজ্ঞ মানুষ ভাবতে পারেন ট্রান্স আইডেন্টিটি হয়ত একটা অলীক কল্পনা, চাইলেই মনে মনে যা খুশি বুঝি ভেবে নেওয়া যায়। পেশাগত অভিজ্ঞতা এবং ব্যক্তিগত অনেক অনেক আলাপের সূত্রে আমি বলতে চাই যে ট্রান্স আইডেন্টিটি মোটেও খেয়ালবশত নিজের শরীরকে অস্বীকার করার খেলা নয়। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা বলেন তারা নারীর আত্মা নিয়ে পুরুষের শরীরে জন্মানো কিংবা পুরুষের আত্মা নিয়ে নারীর শরীরে আটকা পড়া মানুষ। কেউ কেউ বলেছেন সেক্স এবং জেন্ডারের যে সমন্বয়হীনতা এটা অনেকটা হার্ডওয়্যারের সাথে সফটওয়্যার না মেলার মতো একটা ব্যাপার, যেখানে হার্ডওয়্যার হলো শরীর আর সফটওয়্যার হলো ব্যক্তির সত্তা। এই জায়গায় সমন্বয় আনতে কিছু ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি এবং হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির মাধ্যমে হয়ত শারীরিক পরিবর্তনের পথ বেছে নেন। তবে সবাই নয়। এই রূপান্তর একদিকে যেমন ব্যয়বহুল ও শারীরিক কষ্টে ভরা, অন্যদিকে অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি এই রূপান্তর আদৌ চান না। অনেকের কাছেই জেন্ডার একটি নন-বাইনারি, প্রবহমান ধারণা। বন্ধু, পরিবার, সমাজ, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে মানুষকে সহজে গ্রহণ করতে পারলে অনেক ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিই হয়ত আত্মপরিচয় নিয়ে আদৌ ভাবতেন না।

একজন সংগঠক হিসেবে এবং জেন্ডার বিষয়ক কর্মশালার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু উদাহরণ দিই। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে ট্রান্সজেন্ডার হওয়া একটি রোগ যা ওষুধ দিয়ে 'নিরাময়যোগ্য' বা এটা এক ধরনের যৌনবিকৃতি যা বিয়ে করলে 'ঠিক' হয়ে যায়। যেমন ধরুন মৌমিতা হিয়ার কথা, জন্মের পর যার নাম রাখা হয়েছিল গোলাম রুবায়েত। অনেক সাহস করে যেদিন বাবাকে নিজের ভিন্ন সত্তার কথা জানান, তখন তিনি বিএসসির ছাত্র। বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার তাদেরকে বুঝিয়ে বললেন যে মৌমিতার মস্তিষ্ক তাকে নারী হিসেবে পরিচালিত করছে এবং এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার, মৌমিতাকে পুরুষে রূপান্তরিত করার কোনো বিজ্ঞানসম্মত উপায় তাদের জানা নেই। এ কথা মানতে না পেরে মৌমিতার পরিবার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে আনা এন্টিডিপ্রেসেন্ট আর স্লিপিং পিল দিয়ে ছয় মাস নজরবন্দি করে রাখে তাকে। মৌমিতার ভাষ্যমতে, “আমি বসে বসে ঝিমাতাম। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো যে ওষুধে আমার কোনো কাজ হচ্ছে না। আমি ওষুধ বাদ দিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার বাসার মানুষদেরকে তো বুঝাতে হবে যেন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। নাহলে তারা আমাকে বের হতে দিবে না। আমি তখন থেকে আবার ম্যানলি বিহেভিয়ার শুরু করে দিলাম।” তবে সুযোগ পেলে তিনি নারীর মতো জীবনযাপন করেন এবং একজন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে অন্যদেরকেও নিজের মতো করে বাঁচতে অনুপ্রাণিত করেন।

আরেকজন ট্রান্সওম্যান নীলিমা। তিনি একজন নারীকে বিয়ে করে ছাপোষা গার্হস্থ্য জীবনযাপন করলেও হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে একজন নারীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, “আমি দেখতে সাধারণ অন্য মেয়েদের মতো নই। আমার কমনীয় ত্বক নেই, লম্বা চুল রাখি না, কথা বলা বা চলা ভঙ্গিতেও এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই যাকে মেয়েলি বলা চলে। কিন্তু এটাও সত্যি সুযোগ এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমি নিজেকে আপাদমস্তক বদলে দিতে চাইতাম। কিছুদিন আগে বেপরোয়ার মতো জন্মবিরতিকরণ বড়ি খেয়েছিলাম কয়েকদিন। জেনেছিলাম ওতে ইস্ট্রোজেন থাকে, শারীরিক আপাদমস্তক পরিবর্তন না এলেও একটু কমনীয়তা কিংবা সামান্য মেয়েলি গড়ন আমার হবে এটা হয়ত আশা করেছিলাম। কিন্তু কিছুটা ভয়ে এবং কিছুটা শারীরিক অসুবিধার কারণে বেশিদিন সেটা চালিয়ে যেতে পারিনি। জানি এত অল্পে কিছু হয় না, নিজেকে কাঙ্ক্ষিত রূপে কখনোই আমি পাবো না। চাওয়া এবং তা অর্জনের ব্যবধান আমার স্থায়ী অবসাদের জন্য হয়ত দায়ী। জানি নিজেকে মেনে নেয়াটাই আসল, কিন্তু সমাজবদ্ধ জীব তো আমরা। তাই অন্যের কাছে একটু স্বীকৃতি পেলে সেটাও অনেক তৃপ্তি দেয়। একারণেই হয়তো নারী হিসেবে অল্প কিছু নিরাপদ মানুষের কাছ থেকে হলেও একটা গ্রহণযোগ্যতা চাই, খুব করে চাই।”

অথবা আরেকজন ট্রান্সওম্যান ব্যক্তি পিউর কথা যদি বলি - "ছোটবেলায় আমি সাজগোজ করতে ভালবাসতাম। আমি খেলতাম পুতুল দিয়ে। মানুষ বলত আমার নাকি চালচলন মেয়েদের মতো, হাসি মেয়েদের মতো। আমি নাকি লজ্জাও পাই মেয়েদের মতো। যদিও মেয়েদের মতন লজ্জা পাওয়া কী আমি এখনো জানি না। চুল বড় রাখতাম বলে কটু কথা শুনতাম। খারাপ লাগত। তো, এসব আঘাত পেতে পেতেই নিজেকে বাঁচাতে আমি পুরুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমি মার্শাল আর্ট জানি। তার উপর শরীরচর্চা করতাম। নিজের হাঁটাচলা বদলে পুরুষালি করে ফেলেছিলাম। আবার আমি থিয়েটারও করতাম। কারণ অভিনয়ের প্রতি, শিল্পের প্রতি দুর্বলতা ছিলো। এতে করে নিজের উপর কাজ করাটা আমার জন্য সহজ হয়। অভিনয় করে করে নিজেকে চালিয়ে নেওয়ার মতো একটা মাচো বয় হয়ে গিয়েছিলাম তখন।”

সাম্য একজন ট্রান্সম্যান, অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডার পুরুষ – পুরুষের সত্তা নিয়ে নারীর শরীরে জন্মেছেন তিনি বয়ঃসন্ধির শুরুর দিকে হরমোনের পরিবর্তনগুলো খুব স্পষ্ট না হলেও তিনি কিছুটা আঁচ করতে শুরু করেন যে তার ফিমেল শরীরটা আরো প্রকাশিত হচ্ছে। এতে তিনি আতংকিত এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। সাম্যর ভাষায়, “যখন আমার চেস্ট গ্রোথ শুরু হলো, আমি মোটা মোটা বই বুকে চেপে রাখতাম। মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে শিল-পাটা নিয়ে বুকের উপর চেপে রাখতাম আর ভোর পর্যন্ত প্রার্থনা করতাম যাতে আমার বুক না বাড়ে। ভালো অনুভূতি না এটা। সবসময় কাঁদতাম তখন। সকালগুলো, ভোরের মিষ্টি আলো আমার কাছে ফিকে, অর্থহীন মনে হতো। এভাবে আমার হাজারো মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বেঁচে আছি।”

নয়নতারা একজন ট্রান্সওম্যান। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে নারী বলেই জানেন, যদিও তার শরীরটা পুরুষের। তবে এখনো সবার সামনে নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করেননি। মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের নারীত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত দেন যাতে কাছের মানুষেরা অল্প অল্প করে সইয়ে নেয় নিজেদের, এক ধাক্কায় যেন সবাই তাকে দূরে ঠেলে না দেয়। তিনি বলেন, “আমি মনে করি জেন্ডার, সেক্স এবং সেক্সুয়ালিটির ব্যাপারে স্কুলের কারিকুলাম থেকেই সংবেদনশীলতা তৈরি করা উচিত। একটা সংবেদনশীল, সমানুভূতিসম্পন্ন, বৈচিত্র্যবান্ধব জাতি হতে গেলে এর বিকল্প নেই। আমাদের মতো মানুষের সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য পরিবারের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন খুবই দরকারি। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের মতো গ্রামে বসবাসকারী মানুষের কাছ থেকে সমর্থন পেতে হলে দরকার পরিবারগুলোর কাছে সেক্স বা জেন্ডার, সেক্সুয়ালিটি সম্পর্কে জ্ঞান বা তথ্য পৌঁছানো।” প্রায় একই কথা মৌমিতারও। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় গ্রহণযোগ্যতা পরিবার থেকে শুরু হওয়া উচিত। তার জন্য সমাজের মানুষগুলোর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হলেই পরিবারও গ্রহণযোগ্যতা দেবে। তার জন্য শিক্ষা খুব জরুরি।”

সবশেষে সমুদ্রের কথা বলি যেটা আমাকে ভীষণ নাড়া দেয়। সমুদ্র নারীদেহে বন্দি একজন পুরুষ। তিনি বলেন, "মাঝেমধ্যে মনে হয় একটা এয়ারটাইট প্লাস্টিক ব্যাগে আপনাকে মুড়িয়ে রাখলে ঠিক যেমন অনুভূতি হবে, আমার পুরোটা জীবন এইভাবে দমবন্ধ হয়ে কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। জানেন? আপনারা একটু ভালোবাসলে বাকি জীবনটা বাঁচার মতো করে বেঁচে থাকতে পারতাম আমরা!”

এক বছর আগের সেই ইভেন্টে যে ব্যক্তি আমাকে একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি ভেবেছিলেন তিনি সেদিন আমার লিঙ্গপরিচয় না জেনেই বিদায় নিয়েছিলেন। আমি বলিনি আমার জেন্ডার কী। আমি মনে করি যেকোনো আন্দোলনে ‘আদারিং’ ক্ষতিকর। “আমি নাস্তিক নই কিন্তু…”, “আমি সমকামী নই, কিন্তু…” বলে বলে আমরা ভিন্নমতকে ভিন্ন পথকে যতই সমর্থন জানিয়ে থাকি না কেন, কিন্তু’র আগের বাক্যটুকু বঞ্চিত সংখ্যালঘু মানুষদেরকে নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর করেছে। যতদিন জেন্ডারের ভিন্নতার কারণে মানুষের নিরাপত্তা এবং মর্যাদা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ততদিন আমার জেন্ডার পরিচয় ঘোষণা দেবার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। আমি একটা সাম্যের ভবিষ্যত চাই যেখানে সকল প্রাণের জন্য মায়া এবং সহিষ্ণুতা লালন করতে পারে মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে যখন দাবানলের মতো ঘৃণা এবং ভুল তথ্য ছড়ানো সম্ভব তখন অন্ধবিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অনুমানভিত্তিক ধারণাকে প্রশ্ন করার কিছুটা সাহস এবং ভিন্ন পরিচয়ের মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে সহমর্মিতা রাখতে পারা ভীষণ প্রয়োজন মনে করি। বুঝতে পারতে হবে যে জেন্ডার কোনো চয়েজ নয়। এটা খাবার কিংবা পোশাকের মতো শখ বা রুচিভেদে পছন্দ করে নেওয়া যায় না। যদি সেটা করাই যেত, তাহলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে জন্মানো একজন পুরুষ কেন তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সুবিধাগুলো ঝুঁকির মুখে ফেলে নারী হতে চাইবেন? কেনই বা একজন নারী পুরুষ-অধ্যূষিত এই সমাজে পুরুষ হিসেবে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের নাম লেখাবেন?

আসুন, ভেবে দেখি।
-

তৃষিয়া নাশতারান
নারীবাদী সংগঠক এবং ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট

ছবি: 
13/11/2009 - 10:46অপরাহ্ন

মন্তব্য

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

তৃষিয়া নাশতারান, অনেকদিন পরে সচলে ঢুকে আপনার গুরুত্বপুর্ণ ও অসাধারণ লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লাম । আপনাকে অজ্জস্র ধন্যবাদ লেখাটির জন্য। ভালো থাকুন । কলম চলুক ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।