মাতৃত্ব নিয়ে সমসাময়িক এলোভাবনা

নাশতারান এর ছবি
লিখেছেন নাশতারান (তারিখ: রবি, ১০/০৫/২০১৫ - ১১:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মা দিবস যাই যাই করছে। কোনো বিশেষ দিন মনে থাকে না। এই দিনটাও ভুলে যেতাম ফেসবুক না থাকলে। আমার মাকে আমি অহর্নিশ জ্বালাতন করি। আজন্ম বন্ধুত্ব, একসাথে বেড়ে ওঠা আমাদের। সন্তানেরা বড় হলে মা-বাবা'র আরেক শৈশব শুরু হয়। আমি বড় হতে হতে আমার মা এখন ছোট্ট মেয়েটি হতে শুরু করেছে। দিনশেষে পথ চেয়ে বসে থাকে আমার আশায়। আমরা গল্প করি, ঘুরিফিরি, খাইদাই। বছরের যেকোনো দিন, যখন খুশি। তার জগতজোড়া অভিমান, আবদার আমার কাছে। এই বিশেষ দিনগুলো তাই আমাদের জীবনে বিশেষ মূল্য সংযোজন করে না। আমার কাছে এই বিশেষ দিনগুলো বরং হিসেবের হালখাতার মতো। নারীদিবসে যেমন হিসেব করতে বসি এক বছরে নারী আসলে কতটুকু এগোলো, তেমনি মা দিবসে ভাবতে বসি মাতৃত্বের প্রতি আমাদের ভাবনা কতটুকু হালনাগাদ হলো।

আমাদের সংস্কৃতিতে মাতৃত্ব অতি মহিমান্বিত। নারীর পূর্ণাঙ্গতা মাতৃত্বে এই মতবাদ এখনো জনপ্রিয়। কোনো নারীর জন্য মা হতে না চাওয়া প্রায় অবাস্তব জ্ঞান করা হয় এখন পর্যন্ত। যে যুগে গর্ভকালীন ও প্রসূতি জটিলতায় দেদারসে মেয়েদের মৃত্যু হতো সে যুগেও মাতৃত্ব নারীর প্রশ্নাতীত নিয়তি ছিলো, আজকের আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাসম্পন্ন, আপাত নিরাপদ মাতৃত্বের যুগেও তার গুরুত্ব অপরিবর্তিত। যতদিন মানুষের বংশবিস্তারে নারীর জরায়ুর কোনো বিকল্প তৈরি না হবে ততদিন নারীর জীবনে মাতৃত্ব ওতপ্রোতভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এই অত্যাবশ্যকতাকে জিইয়ে রাখতে মাতৃত্বের অতি মহিমান্বিত মর্যাদাকে সামাজিকভাবে জিইয়ে রাখাও এক প্রয়োজনীয় কৌশল। "মেয়েরা মায়ের জাত" বলে নারীকে সম্মান করা আমাদের পুরোনো রীতি। কাউকে মৌখিক আঘাত করতে মা-বোন তুলেই গালি দিতে হয় এখনো। আমাদের জীবনে আজকের যুগে মাতৃত্ব আসলে কতখানি সম্মানিত?

আমি মা নই। কখনো হবো কি না জানি না। চেনা পরিমণ্ডলে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি মাত্র।

(১)
সন্তানের জন্য চাকরি ছেড়ে দেওয়া আমাদের দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। চাকরি করা বা না করা অবশ্যই একজন নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। সবাই চাকরি করতে পড়ালেখা করেন এমনো নয়। সামাজিক অগ্রগতির সাথে সাথে উচ্চশিক্ষিত মা, স্ত্রী, আত্মীয়া থাকা একটা সামাজিক চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর উচ্চশিক্ষা, মাতৃত্ব, মাতৃত্বের প্রয়োজনে কর্মজগত থেকে অব্যাহতি সবই সামাজিক ধারাবাহিকতায় স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় এখনো। ভুক্তভোগী হন সেসব নারী যারা কাজ ছাড়তে নারাজ। মাতৃত্ব এখনো নারীর মৌলিক এবং প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত। তার পেশা, তার শিক্ষা যতই দায়িত্বপূর্ণ ও গুরুত্ববহ হোক না কেন মাতৃত্বের দায়িত্বে ছাড় পান কম নারীই। কর্মজীবীকে মাকে তাই হতে হয় সুপারমম। এই বিজ্ঞাপনটি দেখুন।

স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী। বাড়িতে অন্য সদস্যও রয়েছেন। তাও ডায়পারটুকু পরাকে মাকেই ছুটে আসতে হয়। খারাপ মা হিসেবে অপরাধবোধে ভুগতে হয়। এই অপরাধবোধ কত নারীকে কর্মজগত থেকে শেষমেষ বিচ্ছিন্ন করে ছেড়েছে তার হিসেব নেই। অথচ মাতৃত্ব নিয়ে মানসিকতার পরিবর্তন আনতে পারলে নারীর একচ্ছত্র দায়িত্বের ভার লাঘব করে তার গ্লানিমুক্ত কর্মজীবন নিশ্চিত করা সম্ভব।

(২)
শুধুমাত্র বাড়িতে শিশুপালনের কেউ নেই বলে প্রতি বছর কত নারী কর্মজগত থেকে ঝরে পড়ছে তার পরিসংখ্যান নিলে আশংকাজনক হিসেব পাওয়া যাওয়ার কথা। আমার মায়েরা ঘরভর্তি ভাইবোন ছিলো। বড় ভাইবোনদের কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে ছোটরা। আজকের শহুরে ছোট পরিবারে মায়ের অনুপস্থিতিতে সন্তান লালনপালন করেন তার নানীদাদীরা। নানীদাদীর কাছে পালিত শিশুরা যখন বড় হবে, তাদের সন্তানদের প্রতিপালনের দায়িত্ব কার উপর বর্তাবে? কাজের সূত্রে নারী যেমন ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে, তেমনি শিশুপালনের দায়িত্ব ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনের তুলনায় এদেশে ডে কেয়ার সেন্টার অপ্রতুল। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার হওয়া জরুরি।

(৩)
আমাদের দেশে সরকারিভাবে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসের। বেসরকারি ক্ষেত্রে সেটা কখনো তিন, কখনো চার মাস। দেশভেদে ছুটির দৈর্ঘ কোথাও ছয় মাস, কোথাও এক বছর। ঠিক কমাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পর্যাপ্ত আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। চেনাশোনাদের দেখে যতদূর বুঝি, জন্মের পরে শিশুকে যেহেতু বছর দুয়েক মায়ের বুকের দুধ খেতে হয়, মাতৃত্বপরবর্তী মনোদৈহিক পরিবর্তন সামলে ছয় মাস পরে কাজে যোগ দিতে একজন নারীকে দুরূহ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়। বাড়িতে উপযুক্ত সাপোর্ট সিস্টেম না থাকলে সেই চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায় বহুগুণে। মাতৃত্বকে যেখানে ধরেই নেওয়া হয় নারীর মূখ্য কাজ, কয়েক মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিকে অর্থ ও সময়ের অপচয় ভেবে সেটা যৎসামান্য করার প্রবণতা দেখা যায়। একজন নারী নিজের শরীর, সময় ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতকে বিনিয়োগ করে সন্তান ধারণ করে, জন্ম দিয়ে, পালন করে একটি বিশেষায়িত দায়িত্ব পালন করছেন। এই সত্যটুকু সভ্য চোখে দেখতে শিখলে হয়ত আমরা উপলব্ধি করতে পারব একজন নারীকে মাতৃত্বকালীন ও মাতৃত্বপরবর্তী বিশেষ সুবিধা দেওয়া পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নীচতার কোন তলানিতে আমাদের অবস্থান তা বুঝতে এই খবরটি পড়ুন। এখানে প্রসব বেদনায় কাতর নারীও কাজ থেকে অব্যাহতি পায় না।

(৪)
হাতে গোনা যে কয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি এখন পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে তা নারীকে কতখানি সুফল এনে দেয়?
চাকরির বাজারে খোঁজ করলে জানবেন অবিবাহিত বা নববিবাহিত নারীদের চাকরিতে নিতে, রাখতে অনীহা অনেকক্ষেত্রেই। অবিবাহিত নারী বিয়ে করে সন্তানধারণ করে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে ফেলবে এই আশংকায় তাকে চাকরিতে না নেওয়া বা অগুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি করিয়ে দেওয়া, অথবা কোনো মেয়ে সন্তানসম্ভবা হলে তার মাতৃত্বকালীন ছুটির বেতন দেওয়া থেকে বিরত থাকতে তাকে ইস্তফা দিতে চাপ দেওয়ার মতো নীচ আচরণ এখানে প্রচলিত। যে নারী মাতৃত্বকালীন ছুটি পায়, ছুটি শেষে ফিরে এসে কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি হওয়া ফাঁকটুকু পূরণ করতে নাভিশ্বাস উঠে যায় তার। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলে অ্যাপ্রাইজালে রেটিং কমিয়ে দিয়ে দেয়ালে তার পিঠ ঠেকিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলে নীরবে। নারীবিদ্বেষী মনোভাবের পরিবর্তন আর আইনের প্রয়োগ ছাড়া এই নীচতার কোনো সুরাহা দেখি না।

(৫)
আমাদের দেশে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাট চুকতে বয়স পঁচিশ হয়ে যায়। চাকরি খুঁজে ক্যারিয়ার গড়তে গড়তে ত্রিশ। এদিকে প্রকৃতিগত হিসেব কষে নারীকে ত্রিশের আগেই সন্তান ধারণ করতে বলা হয়। তাই বিয়ের হুড়ো লেগে যায় পাশ করতে না করতেই। এরপর আসে সন্তান নেওয়ার তাড়া। সন্তান একবার এসে গেলে তার প্রতিপালনের দায়ও নারীর উপরেই বর্তায়। প্রকৃতি, পরিবার ও সমাজের চাহিদা মেটাতে গিয়ে হাতে গোনা কজন নারী হয়ত কাজের বাজারে ঠাঁই করে নিতে পারে। তুলনামূলকভাবে কম সুবিধা ও সৌভাগ্যের অধিকারী নারীরা পিছিয়ে পড়ে কিংবা ঝরে পড়ে। সেই "ব্যর্থতা"র দায়ও নারীকেই বহন করতে হয়। একটি শিশু কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একার সম্পদ নয়। সে ভবিষ্যত নাগরিক, দেশের সম্পদ। তার এবং তার মায়ের প্রতি সকলের দায়িত্ব থাকার কথা। "সঠিক" বয়সে সন্তান ধারণ আবশ্যিক হলে সন্তান ধারণ ও প্রতিপালনে নারীকে প্রয়োজনীয় সামাজিক ও আর্থিক সমর্থন জোগানো, নারীর শিক্ষাগত ও পেশাগত জীবনের সামঞ্জস্য রক্ষায় বিশেষায়িত ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন।

মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শরীরটি যেহেতু নারীর, মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকারও নারীর। সব নারীর জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য মাতৃত্ব নাও হতে পারে, সেটা অধিকাংশই ভাবেন না, ভাবতে চান না। মাতৃত্বকে অতি মহিমান্বিত করে নারীকে অপরাধবোধে ভোগানোর সামাজিক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসার সময় অনেক আগেই হয়েছে। অন্য যেকোনো প্রাণীর তুলনায় মানবসন্তানের গর্ভকালীন সময়কাল দীর্ঘ। মানবশিশু স্বাবলম্বী হতেও সময় নেয় আরসব প্রাণীর থেকে অনেক বেশি। একটি মানবশিশুর জন্য একজন মা যে সময়, শ্রম আর সম্ভাবনা খরচ করে তা জীবনের দৌড়ে তার গতি মন্থর করতে বাধ্য। এরপরেও যেসব নারী স্বেচ্ছায় গর্ভধারণ করেন, কিছুটা ক্ষতিটা স্বীকার করে হলেও ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তোলেন তাদের জন্য যুগোপযোগী সমর্থন ব্যবস্থা গড়ে তোলা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই আবশ্যক।

পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা। আমাদের ভবিষৎ প্রজন্ম আলোকিত হোক।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আলোকিত হোক।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

চলুক ""মেয়েরা মায়ের জাত" বলে নারীকে সম্মান করা আমাদের পুরোনো রীতি।" আর সেই সম্মানের ঘেরাটোপে তাকে আটকে দিয়ে "মাতৃত্বকে অতি মহিমান্বিত করে নারীকে অপরাধবোধে ভোগানোর সামাজিক চর্চা"-ও চলছে জোরদার। তবে দিদি, দিনকাল ধীরে হলেও পাল্টাচ্ছে। এখন বেশ কিছু তরুণ বাবার দেখা পাই যাদের সংসার চালনায়, শিশুপালনে অংশগ্রহণ দেখলে নিজে যে কি পরিমাণ অপদার্থ ছিলাম সেটা একেবারে গোদা ভাবে বুঝতে পারি। কিন্তু, এখনও দুনিয়াজুড়ে এ লেখায় দেখানো ছবিগুলোই বাস্তব।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

হামিদার বাচ্চাটা মরে গেল যে আজ!

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আয়নামতি এর ছবি

ভালো একটা বিষয় নিয়ে বলেছেন। আলোচনায় চোখ রাখছি

রানা মেহের এর ছবি

প্রথম অ্যাডটা দেখেই মাথা গরম হয়ে গেল। এসব অ্যাড কীকরে বানায় মানুষ?

শুধু মাতৃত্বকালীন ছুটিই নয়। প্রেগনেন্সির সময়ও একটা মেয়ের জন কাজে একটু বিশেষ অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন, খুব কম সময়ই দেখেছি মেয়েদের জন্য এই অ্যাডজাস্টমেন্ট করা হয়।

পূর্ণ বেতনে ছয়মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি খুব খারাপ নয়। তবে যথেষ্ট নয়তো অবশ্যই। ভাল হতো যদি একে পূর্ণ বেতনে ছয়মাস, অর্ধেক বেতনে তিন মাস আর বিনা বেতনে তিন মাস করে পুরো এক বছরের ছুটির ব্যবস্থা করলে। ইউকেতে মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ম মানা হয়।

বাংলাদেশে কি নতুন বাবাদের জন্য কোন ছুটি আছে? মায়ের প্রসব ও বাচ্চা লালন পালনের ঝক্কি থেকে নিজেকে সামলে কাজে আসার জন্য তৈরি হতে প্যাটারনিটি লিভ খুব জরুরী। দেয়া না হলে এই জিনিসটা চালু করা উচিত।

মাদের অনুরোধ থাকবে নিজেকে সুপার মম হিসেবে প্রমানের চেষ্টা না করে পরিবারের বাকি সদস্যদের একইভাবে শিশুপালনে অংশগ্রহনে বাধ্য করার। বাচ্চা কেঁদে উঠলে বাবাকে ঘুমাতে বলার কোন যৌক্তিকতা নেই। একদিন বাবা জাগুন একদিন আপনি।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাংলাদেশে কি নতুন বাবাদের জন্য কোন ছুটি আছে?

আছে, আমার জানামতে দু সপ্তাহ। সরকারী নিয়ম। অন্যখানের কথা জানিনা।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসে এখন অবধি কোনো প্যাটার্নিটি লিভের বিধান নাই। চাকরিজীবী বাবাগণ তাই অর্জিত ছুটি নিয়ে থাকে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হ্যাঁ, দুঃখিত। আমিই ভুল করেছিলাম। দু'সপ্তাহ পিতৃত্ব ছুটির সুপারিশসহ একটা প্রস্তাবনা মন্ত্রীসভায় উঠেছিল এমন খবর শুনেছিলাম প্রায় বচ্ছর দুই আগে। ভেবেছি এতদিনে নিশ্চয় প্রজ্ঞাপন-টজ্ঞাপন হয়ে গেছে। বিএসআর ঘেঁটে কিচ্ছু পেলাম না। মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ওডিন এর ছবি

মানে আর বইলেন না। প্রথম একদিন এই অ্যাডটা চোখে পড়ার পরে মনে হইলো এইরকম হৃদয়হীন একটা অ্যাড কেমনে বানাইওলো মানুষজন। এরপরে যে মেয়েটা ভয়েস দিয়েছে, সে কি কিছু ভাবেও নাই। মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কেতাবে অনেক কথা লেখা থাকে, বাস্তবে তার কতোটা মানা হয় সেটা খোঁজ নিলেই বুঝবেন। আমাদের সন্তান জন্মানোর সময় আমার স্ত্রী সবেতন ছুটি পেয়েছিলেন দুই মাস আর বেতনছাড়া আরো এক মাস, আর আমি ছুটি পেয়েছিলাম এক দিন। একটা গার্মেন্টসে কাজ করতাম। সেখানে আমার সহকর্মী এক নারী ছুটি পেয়েছিলেন ৪০ দিন। কর্তারা 'ছটি ওঠা' পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন আরকি! আমার স্ত্রী, আমার ঐ সহকর্মী ডেলিভারির আগের দিন পর্যন্ত অফিস করেছেন। প্রেগনেন্সি-ডেলিভারি-মেটার্নিটি লিভের প্যাঁচে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি দিন শয়ে শয়ে নারী চাকুরি হারায়। একটা হামিদার গল্প কেবল পেপারে এসেছে আর লাখ লাখ হামিদার গল্প সবাই জানে কিন্তু কর্তারা কিছু করে না। যে দেশে চাকুরিবিধি, কারখানা আইন, শ্রম আইন ইত্যাদিকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রায় সবাই চলে সেই দেশে সুন্দর গোল গোল আইন প্রণয়ন করলেই বা কী লাভ!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

স্বয়ম

ওডিন এর ছবি

দারুণ লিখেছো বুনো। চলুক মায়ের (বা বাবার) কাজের জায়গায় ভালো ডে কেয়ার সার্ভস খুব খুব দরকার।

একজন নতুন বাবা হিসেবে প্রথমেই যেই কাজটা করেছিলাম, সেইটা হলো টোটাল ওয়ার সিনারিও তৈরী করা। পরিবারের সবাইকে নতুন বাচ্চার কাজে লাগায়া দিছিলাম, বাচ্চার মা এর কাজ হলো শুধু রেস্ট নেয়া আর বাচ্চাকে খাওয়ানো। ছুটি নিয়েছিলাম জন্মের আগে সাতদিন আর জন্মের পরে দুই হপ্তা।

তবে এখন তিন মাস পরে অবস্থা একটু টাফ। এখন আমি আর বউ আর পিচ্চি আর একজন কাজের মানুষ ছাড়া বাসায় আর কেউ নাই। বউ কাজে জয়েন করেছে, চারমাসের ছুটি নিয়েছিলো একমাস আর তিনমাস ভাগ করে, সেইটা শেষ। সকালে সে একটু তাড়াতাড়ি আসে , এরপরে আমি বের হই। পিচ্চি যত বড় হচ্ছে দিন তত কঠিন হবে বলে আমার ধারণা।

এরপরেও। ইটস আ টাফ গিগ আর এইটা তো জানা ছিলোই যে এই কাজ কঠিন হবে। হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই বিষয়ে লম্বা আলোচনা হোক। সবাই মিলে আলাপ করে একটা ইশতেহার টাইপ বানানো যায়। চলুক আলোচনা।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

কর্মক্ষেত্রে নারীর গ্রেগন্যান্সি নিয়ে যে পরিমাণ 'তামাশা' করা হয়, সেটা রীতিমত অমানবিক।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই ব্যাপারে একবার ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। সেটা খুঁজে পেলে নিজেই একটা পোস্ট দেবো। কেবল মেটাব্লগিং-এর ধারায় ফেঁসে না গেলেই হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ধুসর জলছবি এর ছবি

প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে আমার মনে হয়েছে আমি মেয়ে হিসেবে ডিস্ক্রিমিনাইজ আরও বেশি করে হওয়া শুরু করেছি। প্রেগন্যান্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি মেয়ে এই ব্যাপারটা হাইলাইট হয়নি যেহেতু আমি যেখানেই কাজ করি ছেলে মেয়ে যারাই থাকে সবার চাইতে বেশি বা সমান করি, কম কখনো না। কিন্তু প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে খুবই আজব কিছু কথা শুনেছি। আমি কোন বাড়তি সুবিধা নেই নি যেহেতু মোটামুটি সুস্থই ছিলাম তবুও আমার সামনেই সবাই বলে বসবে ' কাজ করতে না চাইলে প্রেগন্যান্ট হয়ে যাও ' একদিন একজনকে বললাম সরাসরি ' আমিতো প্রেগন্যান্ট হয়েও আপনার চেয়ে বেশি এক্টিভ' সে বলে 'আরে না না তুমি না অন্য মেয়েদের বলেছি আর কি' কাহাতক আর ঝগড়া করা যায় এদের সাথে! আর বাচ্চা হলে তো আরও বিপদ কাজে মন দিলে খারাপ মা, আবার বাচ্চাকে মনযোগ দেয়ার সময় খারাপ এম্পলয়ি।

মাতৃকালীন ছুটি আমাদের দেশে একটা প্রহসন। ছুটি দেয়া উচিত অন্তত ১ বছর্। বাচ্চা হওয়ার পর একজন মা নিজে শারীরিক মানসিক ভাবে ফিট হতেই ১/১,৫ বছর লেগে যায়। আর বাচ্চাকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং, এরপর সলিড ফিডিং এ অভ্যস্ত করানোর জন্য ফুলটাইম মা বা বাবার কাছে না থেকে উপায় নেই। কিন্তু ৬ মাস ছুটিই তো দিতে চায় না কেউ। আর ছুটি দুই মাস কাটিয়ে আসার পরও উঠতে বসতে পুরুষ সহকর্মীদের খোচা খেতে হয়। যাদের বউরা চাকরি বাকরি করে তারা তাও কিছুটা বুঝে বাকিরা তো কথা শুনিয়ে অস্থির বানিয়ে দেবে।

চাকরির ক্ষেত্রে যত ভাল রেসাল্ট থাকুক, বাচ্চা হবে বা বাচ্চা ছোট এটা শুনলেই আর কেউ নেয় না। আমি নিজেই গত কয়েক মাস যাবত এই ঝামেলা ভোগ করছি।

আর বাচ্চা পালনের দায়িত্ব তো মা ছাড়া আর কারও হতেই পারে না। আমার বর বাচ্চার ডায়াপার বদলায় এটা দেখে তো আমার পরিবারের লোকজনই পারলে তাকে মেডেল দিয়ে দেয়। মার জন্য দায়িত্ব আর বাবা সেটা করলে হল মহত্ব। এই হল অবস্থা।

নিজের অভিজ্ঞতা গুলো নিয়ে একটা ব্লগ লেখার ইচ্ছে ছিল। আরও অনেক কথা বলার আছে যেটা এই মুহুর্তে মাথায় আসছে না।

নজমুল আলবাব এর ছবি

মাতৃত্ব বিষয়ক পুরা বিষয়টা আমার কাছে ভয়ংকর। তুলিকে যে কস্টের মাঝ দিয়ে সময় পার করতে হয়েছে, এখনও সেটা ভাবতে পারি না। সন্তান জন্ম দেবার সময়টাতো বিভৎস। বাবাইর জন্মের আগে এসব নিয়ে ভেবে টেবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ওপারেশন করাবো। ডাক্তারের সাথে কথা বল্লাম। তিনি জানালেন, ভয়ে এই কথাটা তিনি বলছিলেন না। নর্মাল ডেলিভারি হলে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোতে অপারেশন নিয়ে নানা কথা থাকে, তাই ডাক্তাররা একটু বিব্রতই থাকেন। বেশিরভাগ সময় একদম শেষ বেলাতে এসে এসব কথা বলা হয়। অপারেশন যখন করাই লাগবে, তখন একটু আগেভাগেই সেটা করতে বল্লাম। সেই যখন কাটাছেড়া করতে হবে, তাহলে তীব্র কস্টের মাঝ দিয়ে যাবারতো দরকার নেই। ১০ দিন আগে বাবাইর জন্ম হলো তাই।

যৌথ পরিবারে থাকার জন্য শিশু পালনে আমাদের সেরকম কোন কস্ট হয়নি। কিন্তু অন্য মায়েদের কস্ট আর হেনস্থাতো সারা জীবন ধরেই দেখছি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঘটনা কী, সব 'কষ্ট'রে 'কস্ট' বানাইছেন ক্যান?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

পরপর দুটো বাচ্চার জন্ম, চাকরি প্রাপ্তি, চাকরি রক্ষা, কলিগদের গালগপ্পো, কাজের মেয়ে পালন, কাজের মেয়ের প্রেম পিরিতি নিয়ে ফোন বিল ওঠা, সাত বছর লেখালেখির জগত ছেড়ে অস্থিরতায় নিমজ্জন, হাইপারটেনশন, নির্ঘুম রাত--------------ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে লিখতে গেলে কয়খানা যে উপন্যাস হবে জানি না। তবু বলি, মাতৃত্ব আমি দারুণ উপভোগ করি। হাসি
আর হ্যাঁ, চমৎকার লেখা।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নাশতারান এর ছবি

আপনার ভালো লাগা, খারাপ লাগা, আনন্দ আর কষ্টগুলো নিয়ে লিখুন। হাসি

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

চলুক

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

অনেক কথা, পর্যায়ক্রমে বলি
১) চাকরীতে অন্তঃসত্বাকালীন সময়ে সহমর্মী সহকর্মী পাওয়া বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়
২) শ্বশুরবাড়ির লোকদের আচরন থাকে "এটা খুব ই নরম্যাল, আহা উহু করার কিছু হয়নি, সব কাজ ই করা যায়, আমরা করিনি !"
৩) "বাচ্চা মানুষ করা মায়ের একার দায়িত্ব" "যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে" এই টাইপের কথা দেবর ননদ বা শ্বাশুড়ি এদের কাছে যে শোনেনি তার কপাল আসমান সমান বড়

থাক আর বলবো না, এত বেশি ক্ষুব্ধ আমি এই ইস্যু তে যে আর বলতে ইচ্ছে করছে না। মানসিকতা পরিবর্তন যে কবে হবে !

সিদ্ধার্থ মাঝি  এর ছবি

পড়লাম। কিছু উপলব্দি চমৎকার লেগেছে। যেমন - যতদিন সন্তান উৎপাদনের জন্য নারীর জরায়ুর বিকল্প বের হবেনা ততদিন মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার প্রক্রিয়া জারী থাকবে, কিংবা মাতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শরীরটা যেহেতু নারীর তাই এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারও নারীর, কিংবা মাতৃত্বকে অতি মহিমান্বিত করে নারীকে অপরাধবোধে ভোগানোর চেষ্টা থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।