অন্বেষা - ২য় পর্ব (উপন্যাস)

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/০৫/২০১০ - ৪:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত ২ মে থেকে লিখতে শুরু করেছি নূতন উপন্যাস অন্বেষা। ইচ্ছে আছে প্রতিটা পর্ব প্রথমে সচলায়তনে প্রকাশ করার। আজ প্রকাশিত হলো ২য় পর্ব। যারা ১ম পর্ব পড়েন নি, তারা এখানে ক্লিক করে পড়তে পারবেন।

অন্বেষা: ২য় পর্ব

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “চোখ গোল গোল করে তাকানো”। অন্বেষার ধারণা ছিল এই প্রবাদে “টেকনিকাল ফল্ট” রয়েছে। মানুষ চোখ গোল গোল করে তাকাতে পারবে না কারণ তার চোখ উপবৃত্তাকার। বড়জোর মানুষ চোখ ডিম্ব ডিম্ব করে তাকাতে পারবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেতে বসে অরিনের কাছে সায়েমের কথা বলার সময় অরিন যেভাবে অন্বেষার দিকে তাকিয়ে ছিল তাতে অন্বেষার মনে হচ্ছিল মানুষের এই ডিম্বাকৃতির চোখ কখনও কখনও গোল হলেও হতে পারে।

“তুই আমাকে এটা পরিষ্কার করে বল হঠাৎ এই ছেলের প্রতি এত আগ্রহ দেখাচ্ছিস কেন?”
প্রশ্নটা খুব কঠিন। অন্বেষা জবাব খুঁজে পায় না। মাত্র দুই দিন যার সাথে কথা হয়েছে তার প্রতি আগ্রহ দেখানোটা নিতান্তই ছেলেমানুষী। তবুও অন্বেষা দেখাচ্ছে। হয়তো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। অরিনের প্রশ্নের উত্তরে তাই অন্বেষা “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” ধরণের অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে, “আমার ছেলেটার প্রতি আগ্রহ নেই। তবে কিউরিওসিটি আছে।”
“আমারে বাল শিখাইতে আসছিস?” অরিন চরম বিরক্তি নিয়ে বলে। “তোর কোন রুমে ফিন্যান্স ক্লাস হয় সেটা ছেলেটা জানে বলে এত প্রেম?”
“দোস্ত, তুই ব্যাপারটাকে অনেক সিরিয়াসলি নিচ্ছিস। প্রেম-ট্রেম কোথা থেকে আসলো? আমার কিউরিওসিটি এ জন্যে যে ছেলেটা জানে কোন রুমে ক্লাস, কোন কোর্স এবং কোন স্যার ক্লাস নিচ্ছে। এত তথ্য সে কোথায় পেলো?”
“অন্বেষা, গ্রো আপ।” এবার অরিন চিৎকার করে উঠে। “এটা জানা কঠিন কিছু না। একটু খোঁজ নিলে আর ক্লাস শিডিউলের একটা কপি পেলে যে কেউ বলতে পারবে। শুধু তোরটা না। আমারটা, পোরশিরটা অথবা লিজারটা - যে কারোটাই পারবে। এটা খুবই তুচ্ছ একটা ব্যাপার”
অন্বেষা জানে অরিন যা বলছে সেটা ভুল না। তবুও এটা ভাবতে ওর ভালো লাগছে যে ছেলেটা ওর জন্যে কষ্ট করে এসব তথ্য জোগাড় করেছে। তারপর যেন নিজের মনের কথাটাকেই প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বলে, “তবুও ছেলেটার আগ্রহ আছে বলেই খোঁজ নিয়েছে। তুচ্ছ একটা ব্যাপার নিয়ে সে সময় নষ্ট করেছে।”
“সো হ্যোয়াট? তোর পেছনে সময় নষ্ট করার ছেলের অভাব কি NSU-তে কম আছে? কই, তাদের জন্যে তো তোর এত দরদ উথলে পড়ছে না?”
অন্বেষা এবার হতাশ ভাবে বলে, “আমি সত্যিই জানি না কেন এমন করছি। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ছেলেটা কে।”
এবার অরিন একটু নরম হয়। তারপর বলে, “ছেলেটা কী করে?”
“কলা। কলা তার নেশা এবং পেশা।” অন্বেষার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে আবার।
পর মুহূর্তে গলার কোমল স্বরটা অরিন হারিয়ে ফেলে আবার, “হ্যোয়াট? ব্যানানা! ব্যানানার ব্যবসায়ী?”
“না দোস্ত। এই কলা, ঐ কলা না। এই কলা মানে আর্ট। সে আর্টিস্ট মানুষ। ছবি আঁকে, ভাস্কর্য বানায়। পড়ালেখাও এটা নিয়েই করছে।”
অরিন এবার সত্যিই বোঝে না এই পাগলীকে কী বলবে। অন্বেষার হাতে একটা হাত রেখে বলে, “দোস্ত, তোকে তোর বাবা-মা অনেক আদর দিয়ে মানুষ করেছেন। গাড়ি ছাড়া তোকে রাস্তায় বের হতে দেন না। দেশের সবচেয়ে ব্যায়বহুল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছেন। মোবাইল চাওয়া মাত্র তোকে মোবাইল কিনে দিয়েছেন। এই ক্যাম্পাসেই তাকিয়ে দেখ, কয় জনের মোবাইল ফোন আছে। আর তুই এমন একটা ছেলের জন্যে পাগলামি করতে শুরু করেছিস যাকে তুই প্রথমতঃ চিনিসই না। তার উপর সে তোকে একদিনের জন্যেও হয়তো তোর মত করে চালাতে পারবে না। এ সব পাগলামি বন্ধ কর। ঐ ছেলে এরপর ফোন দিলে আর কথা বলবি না। আজ, এখানেই এই টপিকের দ্যা এন্ড।”

অন্বেষা কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। অরিনও চুপ। হঠাৎ যেন চরম নীরবতা নেমে আসে ওদের টেবিলে। অন্বেষা অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে দেখে সবাইকে।ক্যাফেতে ছেলেমেয়েদের ভিড়। কেউ কেউ দল বেধে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার জোড়ায় জোড়ায়। অন্বেষা লক্ষ্য করে অনেক নূতন মুখ ঢুকেছে এবার। যদিও এখনও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজের নাগালেই আবদ্ধ, তবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো সবার জন্যে ধীরেধীরে উন্মুক্ত হয়ে যাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দ্বার। সেটা ভালো হবে নাকি খারাপ সময়ই বলে দেবে। তবে এটা ঠিক এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়তো কিছু মেধাকে দেশে ধরে রাখতে পারবে যারা এই সুযোগ না পেলে বিদেশে পাড়ি জমাতো।

সেদিন দুপুরে রাযি অন্বেষাকে জানায় একটা সুখবর আছে। সেই নাম্বারের যাবতীয় তথ্য বের করে এনেছে সে। তবে সমস্যা হচ্ছে, ট্রিট না দিলে কিছুই সে বলবে না! অন্বেষা হচ্ছে অস্থির প্রকৃতির মেয়ে। এ ধরণের অর্ধেক কথা শুনলে বেচারির অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। কিন্তু রাযিও এমন যে এটারই ফায়দা তুলবে সে সব সময়। অতঃপর কী আর করা। রাযিকে নিয়ে অন্বেষা যায় বুমার্সে। তারপর কঠিন গলায় বলে, “সাবধান, থ্রি আইটেমের দিকে নজর দিবি না। টু আইটেম নিয়ে বস, তারপর বল কী কী জানলি।”
“একটা আইসক্রিম হলে ভালো হতো। অনেক গরম পড়েছে আজ।”
অন্বেষা প্রায় চিৎকার করতে গিয়ে হেসে ফেলে। তারপর যেই আইসক্রিম আনতে উঠতে যায় তখনই রাযি হাত ধরে বসিয়ে দেয় আবার।
“আমি মজা করছিলাম দোস্ত। আর এই ট্রিটটা কেন নিলাম জানিস?”
“কেন?”
“দেখলাম ছেলেটার প্রতি তোর আগ্রহ কত।”
অন্বেষা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে যায়। ভাবতে থাকে, এসব কী হচ্ছে ওর সাথে? কেন এমন পাগলামি করছে? কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। তবে এটা বোঝে এসব পাগলামি করতে ওর ভীষণ ভালো লাগছে।
রাযি অন্বেষাকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দেয়। তাতে একটা নাম লেখা - তাহযিব চৌধুরী এবং একটা ঠিকানা। ঠিকানাটা নীলক্ষেত এলাকার। একটা ফ্ল্যাটের চার তালায় থাকে হয়তো সায়েম, অন্তত ঠিকানা তাই বলছে।
“তুই নিশ্চিত এটাই সেই ছেলের নাম এবং ঠিকানা?”
রাযি একটু চিন্তিত ভাবে বলে, “ফোনটা অন্য কারো নামে হলে ভুল হতেও পারে। তবে চান্স নিতে ক্ষতি কী? দেখ মেলে কিনা।”
অন্বেষাও মাথা নাড়ে। দেখা যাক চান্স নিয়ে।

সায়েমের যে স্বভাব তাতে অন্বেষা ভেবেছিল হয়তো সে আবার একটা ডুব দেবে। তারপর বেশ কিছুদিন পর কল দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলবে, “কেমন আছ?”। তবে এবার সেটা হলো না। সায়েম পরদিনই আন্বেষাকে ফোন দিল। নাম্বারটা দেখেই অন্বেষা বুঝতে পারলো ওর পালস রেট বেড়ে যাচ্ছে। নিজের উপর যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ এনে ফোনটা ধরেই বলল, “কী খবর তাহযিব চৌধুরী?”
অন্য দিক থেকে সায়েম একদম চুপ। কিছুক্ষণ পর চাপা স্বরে বলল, “আমার নাম জানলে কী করে?” সায়েমের গলায় বিস্ময়ের লেশ তখনও রয়ে গিয়েছে।
“আপনি স্মার্ট হতে পারেন, তাই বলে আমাকে ডাম্ব ভাবার কি কোন কারণ আছে?”
“তাই নাকি? আর কী কী জানলে আমার ব্যাপারে?”
অন্বেষা এবার একটু সময় নিয়ে রহস্য করতে শুরু করে। হাতে যখন খুব কম তথ্য থাকে এবং কাউকে সেটা দিয়েই নাচাতে হয়, তখন তথ্যগুলো খুব ধীরে ধীরে ছাড়তে হয়।
“আর কী কী আপনি আপনার ব্যাপারে জানতে চান?”
“মনে হচ্ছে আমার সব তথ্য বের করে ফেলেছ?”
“কেন সেটা কী অসম্ভব নাকি?”
“না, তা না। তবে আমার ধারণা ছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা ফার্মের মুর্গি হয়। স্কুলে যাবার সময় মা যেমন টিফিন রেডি করে দেয়, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পরও চলটা বহাল থাকে। তাদের পক্ষে এত তথ্য বের করা একটু বিস্ময়কর।”
অন্বেষা মনে মনে বলে, ওরে নাদান! প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের, বিশেষতঃ NSU-এর মেয়েদের এখনও তোমার চেনাই হয় নি। তবে মুখে বলে, “নিজেদের খুব স্মার্ট মনে হয়, তাই না? অথচ বিয়ে করার সময় কিন্তু ঘুরে ফিরে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েকেই পছন্দ হলো।”
এবার সায়েম হেসে বলে, “আচ্ছা, আমরা পাবলিক-প্রাইভেট নিয়ে ঝগড়া করছি কেন?”
“ঝগড়াতো আমি শুরু করি নি। কী আজব! যে শুরু করেছে, সেই বলে কেন ঝগড়া করছি। বাসার চারতালার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আসেন একটু। পরিষ্কার বাতাস লাগলে মাথার এলোমেলো লজিক ঠিক হবে আবার।”
“আমি চার তালায় থাকি সেটাও জানা হয়ে গিয়েছে তাহলে?”
অন্বেষা সায়েমের কথার জবাব না দিয়েই আবার বলে, “নীলক্ষেত এলাকার যেই চিপা গলিতে আপনি থাকেন, সেখানে বাতাস চলে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন বটে।”
“এ্যাই মেয়ে, তুমি এত তথ্য কোথা থেকে পেলে?” এবার সায়েম নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না।
“বলা যাবে না এখন।” অন্বেষা আমুদে গলায় জবাব দেয়।
“কেন?”
“কারণ আছে।”
“কী কারণ”
অন্বেষা জোরে হাসতে হাসতে বলল, “সেই কারণটাও যে এখন বলা যাবে না।” অন্বেষার মনে হলো সে দাবার বোর্ডে সায়েমের রাজাকে তাড়া করে করে শেষ পর্যন্ত চেক মেইট করে দিল। কয়েকদিন আগে সায়েম যে ভাবটা নিয়েছিল, আজ যেন সেটাই সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিল অন্বেষা।
সায়েম আর কিছু বলে না। বোঝে মেয়েটা যথেষ্টই বুদ্ধিমতী। অন্বেষা আবার খোঁচা দিয়ে বলে, “কী? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের থেকে এই ব্যবহার আশা করেন নি, তাই না?”
“না, তা না। তোমাকে ঠিক ফার্মের মুরগী মনে হচ্ছে না।”
“তো কী মনে হচ্ছে? ফার্মের দরজা খুলে বের হয়ে যাওয়া মুরগী?” অন্বেষা নিজের কথায় নিজেই হাসতে থাকে।
হঠাৎ সায়েম প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “তোমার স্কুল-কলেজ কোনটা ছিল?”
“আমার সম্পর্কেতো আপনি অনেক কিছু জেনেছেন। এটা জানেন নি?”
“জানা হয়ে উঠে নি। তখন মাথায় ছিল না প্রশ্নটা।”
“হবে বেইলী রোডের দিকের কোন একটা।”
“ওহ, ফকিরুন্নেসা?”
অন্বেষা এবার চেচিয়ে উঠে, “সব NDC'র শয়তান যে কেন আমার ভাগ্যে পড়ে।”
“আমি কিন্তু নটরডেমের না।”
“ওহ। আমাদের ফকিরুন্নেসা সাধারণত নটরডেমের ছেলেরা বলে। আমি ভেবেছিলাম আপনিও তাই।”
“নাহ, আমি নটরডেমের ছাত্র না। তবে আমি যেখানকার ছাত্র সেটা নটরডেম থেকে খুব একটা কমও নয়।”
“তাই নাকি? শুনি আপনি কোথাকার ছাত্র?” অন্বেষা একটু খোঁচার স্বরে বলে।
“ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ।”
“কী? আপনি ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হয়ে চারুকলায় পড়েন?”
এবার সায়েম বিরক্ত হয়, “ক্যাডেটে পড়লে চারুকলায় পড়া যাবে না, এমন যুক্তি তুমি কোথায় পাচ্ছ? আমাদের সমাজে ফাইন আর্টসকে অস্পৃশ্যা ভাবা হয়। এই মানসিকতার পরিবর্তনের সময় এসেছে। তাছাড়া আমি চারুকলায় পড়ি এটা কখনও বলি নি।”
“আচ্ছা বাবা, আপনার শিল্পকলাকে আর অস্পৃশ্য ভাববো না। কিন্তু আপনি কোথায় পড়েন সেটাতো বলবেন এবার।”
“আমার সম্পর্কে এত কিছু জানো, এটা জানো না?” অন্বেষার প্রশ্ন এবার সায়েম ফিরিয়ে দেয়।
“চ্যালেঞ্জ করছেন? আমি যদি চাই, দুই দিনে জেনে জানাতে পারবো।”
“আচ্ছা, তাহলে চ্যালেঞ্জই থাকল। জানা হলে আমাকে বলো।”
অন্বেষা বোঝে, এই ছেলে যতটা সহজ সরল ভাবে কথা বলে আসলে ততটা না। সে কোথায় পড়ে সেটা আবারও লুকিয়ে ফেলার জন্যে এই কাজটা করলো।
অন্বেষাকে চুপ করে থাকতে দেখে সায়েম প্রশ্ন করে, “কী হলো? চুপ করে আছো যে?”
“আপনাকে আমার খুব রহস্যময় মনে হয়।”
“কেন?”
“আপনি আমাকে পছন্দ করেন, রীতিমত বিয়ে করতে চান অথচ এখনও নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে আমার সামনে প্রকাশ করেন নি।”
“আসলে আমিতো নিজেকে তোমার কাছে প্রকাশ করতেই চাই। তুমি শুধু সুযোগটা গ্রহণ করলেই হয়ে যাবে।”
“সেটা কেমন?” অন্বেষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“আমার ফ্ল্যাটে চলে আসো একদিন। আমাকে জেনে যাবে পুরোপুরি।”
“মাথা ঠিক আছে?”
“মাথা ঠিক না থাকার কী আছে এখানে? আমি ব্যস্ত থাকি ইদানীং। সময় করে কোথাও যাওয়া সমস্যা। তুমি চলে আসলে দুজনের জন্যেই সুবিধা। তাছাড়া দিনের বেলা আমি একাই থাকি ফ্ল্যাটে। যতক্ষণ খুশি থাকতে পারবে, গল্প করতে পারবে। আমি কাজ করবো, তুমি দেখবে।”
অন্বেষা হঠাৎ অনুভব করে সায়েম আসলে কথাটা সিরিয়াসলি বলছে, মজা করে না। সাথে সাথেই যেন একটা ইঙ্গিত দেখতে পায় অন্বেষা। এটাই কি তবে সায়েমের অন্বেষার সাথে কথা বলার মূল কারণ? ভদ্রলোকের মত কথা বলে প্রথমে আকর্ষণ করা, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা - তারপর একা ফ্ল্যাটে আমন্ত্রণ জানানো? আমন্ত্রণটাও এমন ভাবে জানানো হচ্ছে যেন বিষয়টা খুব স্বাভাবিক - সকালে উঠে দাত ব্রাশ করার মত ব্যাপার। “একটা ছেলে একটা মেয়েকে একা ফ্ল্যাটে ডাকতেই পারে। এতে অবাক হবার কী আছে” ধরণের।
অন্বেষা সায়েমকে কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। সায়েমও একদম চুপ। যেন সে একটা জবাব এখনই চাচ্ছে। অন্বেষা জানে জবাবটা অবশ্যই “না” হওয়া উচিত। কিন্তু এই কদিনে সায়েম অন্বেষাকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে, তাতে ওর ভেতর থেকে যেন অন্য এক অন্বেষা বলছে “তুমি যাও, সায়েমের ফ্ল্যাটে যাও”। বাস্তবতা এবং প্রলোভন - এই দুয়ের মাঝে হঠাৎ অন্বেষার অস্থির লাগে। তাড়াতাড়ি সে সায়েমকে বলে, “আমার আরেকটা ফোন আসছে। আমি আপনাকে পরে জানাবো।” তারপর ফোনটা কেটে স্থির হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
কী হচ্ছে এসব? কেন হচ্ছে? অন্বেষা বোঝে ওর আবেগ নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে। একে বশে আনতে হবে, তা না হলে সামনে সমূহ বিপদ।

সে রাতে অন্বেষা যখন নিজের সাথে যুদ্ধ করছিল তখন ঢাকার অন্য এক প্রান্তে দুজন মানুষ মুখোমুখি বসে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্যে একজনের নাম আঙ্গুল কাটা জগলু। পুরান ঢাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী। একটা মানুষ যে দেখতে এতটা বীভৎস এবং ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা জগলুকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ফুল গাছের ডাল কাটার কাচি দিয়ে মানুষের আঙ্গুল কাটায় জগলুর বিশেষ পারদর্শিতা। বলাবাহুল্য, নামটা সেখান থেকেই এসেছে।

জগলুর সামনে যে মানুষটা বসে ছিল সে দেখতে ভদ্র। স্যুট-টাই পরা অফিসার শ্রেনীর মানুষ। তবে গত চব্বিশ ঘণ্টায় তার উপর দিয়ে যা যা গিয়েছে সেসবের ধকল সামলে সে এখন ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত।
জগলু একটা প্লাস হাতে নিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ডান হাতের তর্জনীর নখটা এক টানে তুলে ফেলে। চিৎকার দেয়ার সামান্য সুযোগ পায় না লোকটা। পেছন থেকে একজন একটা গামছার অংশ বিশেষ তার মুখে ঢুকিয়ে চেপে রাখে। গলগল করে আঙ্গুল থেকে রক্ত পড়তে থাকে। সে দৃশ্য দেখে জগলু হাসতে হাসতে বলে,
“এইটা সবে শুরু। আমার নাম আঙ্গুল কাটা জগলু। আমি আঙ্গুল কাইটা মজা পাই। তয় তোর আঙ্গুলগুলা অনেক সুন্দর। তুই বসের লগে কথা কইলে কাটুম না। বাকি তোর ইচ্ছা। কী, বসরে ডাকমু?”
তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া মুখটা কোনক্রমে উপর নিচে নেড়ে সায় দেয় লোকটা।

জগলু হাসে। তারপর আস্তে করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে “গুড বয়”। নূন্যতম দুই শব্দের ইংরেজী বাক্য জগলু দুইটা জানে। একটা এই “গুড বয়” আরেকটা “ভেরি ব্যাড”। শেষেরটা সাধারণত জগলু আঙ্গুল কাটা শেষে বলে। (চলবে)


মন্তব্য

এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এ্যাপোলো এর ছবি

গতি কি মাঝে মাঝে বদলে যাচ্ছে? তবে ভালো লাগছে। তোমার অন্বেষার মতই অস্থির লাগছে পরের পর্ব পড়ার জন্য। চালিয়ে যাও।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ভাইয়া, এই উপন্যাসে গতিটা অন্য রকম করার চেষ্টা করছি। নিরন্তরের পর্ব গুলো ছিল ছোট ছোট, কিন্তু এখানে পর্বগুলো বড়, প্রায় দ্বিগুন। ঘটনাগুলো সিকুয়েন্সিয়ালি না চলে কিছুটা জাম্প করে চলছে। সে জন্যে হয়তো এমন মনে হচ্ছে।

পড়ার জন্যে এবং মূল্যবান মতামত দেয়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।

এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান এ্যাপোলো এর ছবি

গতি কি মাঝে মাঝে বদলে যাচ্ছে? তবে ভালো লাগছে। তোমার অন্বেষার মতই অস্থির লাগছে পরের পর্ব পড়ার জন্য। চালিয়ে যাও।

স্নিগ্ধা এর ছবি

এই পর্বও ভালো লাগলো! ধারাবাহিক লেখায় পাঠকের ঔৎসুক্য বজায় রাখার কাজটা দেখা যাচ্ছে আপনি ভালই পারেন হাসি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

হ!

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

আপু, সাথে থাকার জন্যে আবারও অনেক ধন্যবাদ। হাসি

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

স্নিগ্ধা, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম। চেষ্টা করবো এভাবে সাসপেন্স ধরে রেখে এগিয়ে যেতে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

পড়লাম
---------------------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

শুভেচ্ছা রইলো।

কাকুল কায়েশ এর ছবি

ভাল লাগছে, এটা আগেও বলেছি! আগের পর্বের মতই ভাল হয়েছে এ পর্বটা! তবে শেষের তিন প্যারার দরকার ছিল কি এই পর্বে?
যাই হোক, তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দিয়েন......অপেক্ষা করছি!

==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!

==========================
একটাই কমতি ছিল তাজমহলে,
......তোমার ছবিটি লাগিয়ে দিলাম!

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

প্রথমেই শুভেচ্ছা রইলো আগ্রহ ভরে পড়ার জন্যে। শেষের প্যারাটা গল্পের আগামী ঘটনার সংকেত স্বরুপ। এটা যে নিতান্তই একটা প্রেমের উপন্যাস নয়, সেটা বোঝানো হয়েছে। চতুর্থ পর্ব থেকে উপন্যাস সিরিয়াস হতে শুরু করবে।

ইশতিয়াক আহমেদ [অতিথি] এর ছবি

জোস হইতেসে ভাইয়া. . . .next part এর জন্য করতেসি. . . . হাসি

ইশতিয়াক আহমেদ [অতিথি] এর ছবি

জোস হইতেসে ভাইয়া. . . .next part এর জন্য wait করতেসি. . . . হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের জন্য।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল

অতিথি লেখক এর ছবি

পরপর দুইটা পর্ব পড়ে ফেললাম। মজা পাচ্ছি পড়ে।
শাহেদ সেলিম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।