অন্বেষা - ৩য় পর্ব (উপন্যাস)

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: রবি, ১৬/০৫/২০১০ - ১০:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ লিখে শেষ করলাম অন্বেষার ৩য় পর্ব। যারা উপন্যাসটি নিয়মিত পড়ছেন এবং মতামত জানাচ্ছেন, তাদের প্রতি রইলো অসংখ্য শুভেচ্ছা। আর যারা আজই প্রথম পড়ছেন, তারা আগের দুটো পর্ব এখান থেকে পড়তে পারবেন – ১ম পর্ব এবং ২য় পর্ব। বরাবরের মত আপনাদের মূল্যবান মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম।

অন্বেষা: ৩য় পর্ব


সকাল থেকে অন্বেষা খুব চুপচাপ। বিষয়টা অরিন লক্ষ্য করেছে। সকালে দুটা ক্লাস ছিল আজ। এখন শেষটা চলছে। ব্যস্ততার কারণে জানতে চাওয়া হয় নি কী হয়েছে। এখন মার্কেটিং ক্লাসের পেছনের দিকে বসে কথা বলার সুযোগ হওয়ায় অরিন জিজ্ঞেস করে। অন্বেষা মাথা নেড়ে বলে কিছু হয় নি।
“ভাব মারিস?” অরিন বিরক্ত হয়। সামনে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে আবার বলে, “কিছুতো হয়েছে আমি বুঝতে পারছি। কী হয়েছে সেটা বল।”
ক্লাস নিচ্ছে নায়লা খান। অন্বেষাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন তিনি। এরপর এ্যামেরিকার ইউনিভার্সিটি অব পেনসেলভেনিয়া থেকে MBA করে এসেছেন। “আইভি লীগ”-এর হাওয়া লাগার পর থেকে তার কাছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একদমই “যাচ্ছেতাই” হয়ে গিয়েছে। এদেশে আদৌ লেখাপড়ার পরিবেশ আছে কিনা সেটা নিয়ে তিনি বিশেষ চিন্তিত। ভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে বছর তিনেক আগে এখান থেকেই তিনি BBA শেষ করেছিলেন।
অরিন আবার অন্বেষাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই নায়লা খানের চোখে পড়ে।
“এ্যাই মেয়ে, তোমরা কথা বলছ কেন?”
অন্বেষা মাথা নিচু করে থাকে, কিছু বলে না। এতে নায়লা খানের মেজাজ আরো গরম হয়।
“কথা বলি, গায়ে লাগে না? দাঁড়াও, ঐ যে ব্যাক-বেঞ্চার, উঠে দাঁড়াও বলছি”।
অন্বেষা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “আমরা লেকচারের টপিক নিয়েই কথা বলছিলাম।”
“মিথ্যা কথা। তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছো। আমাকে শেখাতে এসেছো? আমি আইভি লীগ ভাজি করে রেখে এসেছি আর তুমি আমাকে শেখাও লেকচারের টপিক নিয়ে কেমন করে কথা বলে?”
এবার অন্বেষার মেজাজা খারাপ হয়। বিরক্ত হয়ে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা প্রেমের গল্প করছিলাম। তো কী হয়েছে? বের হয়ে যাবো? তবু আপনার আইভি লীগ কপচানো থামান।”
অন্বেষার জবাব শুনে নায়লা খানের মুখে কথা আটকে যায়। তোতলাতে তোতলাতে কোনক্রমে বলেন, “তুমি দুই মিডে কত পেয়েছো?”
“পঞ্চাশে আটচল্লিশ এবং পঁয়তাল্লিশ।” অন্বেষা ভাবলেশহীন গলায় জবাব দেয়।
“আমি দেখে নেব তুমি ফাইনালে কী করে এত মার্কস পাও। এখন ক্লাস থেকে সোজা বের হয়ে যাও।”
অন্বেষা কিছু বলে না। বেচারির ভাগ্যটাই এমন যে মিডটার্ম পরীক্ষায় খুব ভালো মার্কস পেয়েও ফাইনালে যে কী হয়, দেখা যায় A পাবার পরিবর্তে B+ পেয়ে বসে আছে। সে জন্যে ম্যাডামের হুমকি গায়ে মাখে না। এমনিতেও B+ পাবে, ওমনিতেও B+ আসবে। তাই নির্লিপ্ত ভাবে হেঁটে ক্লাস থেকে বের হয়ে চলে আসে।
অন্বেষা বের হয়ে আসার সাথে সাথে নায়লা খান আবার চিৎকার করে উঠেন, “এ্যাই মেয়ে। তুমি বসে আছো কেন? তুমিও বের হও।”
অরিন অবাক হয়ে বলে, “ম্যাডাম আমিতো কিছু করি নি।”
“কর নি মানে? এই যে মুখেমুখে তর্ক করছো? এখনি বের হয়ে যাও।”
অরিন দেখলো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই মেজাজ খারাপ করে বের হয়ে আসে।

অন্বেষা তখন চুপচাপ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর নির্লিপ্ততা দেখে অরিনের মেজাজ আরো খারাপ হয়।
“কী রে? তুই অমন করলি ক্যান? নিজেরটার সাথে তুই আমার গ্রেডটারও বারোটা বাজালি। আমারতো তোর মত এত মার্কস নাই যে B+ এমনি এমনি পাবো।”
“আমি কী করলাম?”
“বাহ! তিনি দুধের খুকি। জানেই না কী করলো।”
“দেখ অরিন, রাগ ঝাড়তে হলে আমার উপর সেটা করতে আসবি না, ভেতরের ঐ *গীটার উপর ঝাড়।”
অরিন কিছু বলতে গিয়েও আর বলে না। ও তখন রাগে কাঁপছে।

বেশ কিছু সময় কেটে যায়। দুজনের কেউ আর কথা বলে না। এটাই যেহেতু শেষ ক্লাস, তাই বসে থাকারও আর মানে হয় না। অন্বেষা ফোন দেয় ওর মাকে।
“গাড়ি কি পাঠিয়েছো? আমার ক্লাস শেষ। আমি বাসায় আসবো।”
“হ্যা, গাড়ি চলে গেছে আরো এক ঘণ্টা আগে। শৈলী ফেরদৌসি ম্যাডামের কাছে পড়ছে। আসার সময় নিয়ে আসবি।”
এই আরেক যন্ত্রণা। এখন বনানী থেকে যেতে হবে ফেরদৌসি ম্যাডামের বাসায় শৈলীকে নিতে! “নাহ, পারবো না। আমি আসার পর শৈলীকে আনতে পাঠাবো।” অন্বেষা বিরক্ত হয়ে বলে।
“আমি যেভাবে বলছি সেভাবে করবি। আমার গাড়িটা তোর কাছে পাঠানোই ভুল হয়েছিল। শৈলীর সামনে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা। ওকে নিয়ে তারপরই তুই বাসায় আসবি।” অন্বেষার মা কঠিন মানুষ। একবার তিনি যা বলবেন, এই জগতে সেটা হতেই হবে।
“আচ্ছা, আমি গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি বেবীটেক্সি দিয়েই আসতে পারবো। তোমাদের ঐ গাড়ির আমার দরকার নাই।” অন্বেষাও এবার এক হাত নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর রাগ ধোপে টেকে না মায়ের রাগের সামনে,
“তুই বেবীটেক্সী নিয়ে আস, মিশুকে আস, ট্রেম্পুতে আস, বাসে করে আস আর হেটে আস; আমার কিছু যায় আসে না। গাড়ি যেন শৈলীকে না নিয়ে আজকে বাসায় না আসে।” এই বলেই তিনি ফোন রেখে দেন।
অরিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে অন্বেষা আর ওর মায়ের কথোপকথন শুনছিল। এবার কাছে গিয়ে বলে, “অন্বেষা, তোর কোন একটা সমস্যা হয়েছে আমি নিশ্চিত। কী হয়েছে তোর? এরকম অস্থির হয়ে আছিস কেন?”
অন্বেষা অরিনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, “দোস্ত, আমি তোকে রাতে ফোন দিব। এখন যাই।” এই বলেই আর কথা না বাড়িয়ে অন্বেষা বের হয়ে পড়ে।

গাড়ির এসির গ্যাস শেষ হয়ে গেছে। এসি কাজ করে না। গরমে সেদ্ধ হতে হতে অন্বেষা ফেরদৌসি ম্যাডামের বাসার সামনে এসে পৌঁছায়। মে মাসেই এবার যে গরমটা পড়ছে, তাতে জনু-জুলাইতে যে কী হবে সেটা ভেবে অন্বেষা আতঙ্কিত হয়।
শৈলীকে এখনও মোবাইল কিনে দেয়া হয় নি। তাই জানারও উপায় নেই কখন পড়া শেষ হবে। এভাবে বসে থাকাও বিরক্তিকর। সায়েম সবসময় অন্বেষাকে ফোন দেয়। অন্বেষা কখনও সায়েমকে কল করে নি। তাই সায়েমকে একটা ফোন দেবে কিনা সেটা নিয়ে যখন অন্বেষা ভাবছিল, ঠিক তখনই দেখতে পায় শৈলী বের হয়ে আসছে। সাথে একটা ছেলে। অন্বেষা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার সাথে শৈলী বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। গাড়ির কাছে এসে শৈলী যখন দেখে ভেতরে অন্বেষা বসা, তখন ছেলেটার থেকে সরে এসে গাড়িতে উঠে।
“কী রে? ছেলেটা কে ছিল?” অন্বেষা সন্দেহের সুরে বলে।
“কোন ছেলে?”
“কোন ছেলে মানে? এতক্ষণ তুই যার সাথে হেঁটে আসছিলি।”
“ওহ! ওটা অনিক। আমরা এক সাথে পড়ি।”
“কোন কলেজে পড়ে ছেলেটা?” অন্বেষা তখনও ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে শৈলীর দিকে।
“ঢাকা কলেজে।”
“কবে থেকে পরিচয়?”
এবার শৈলী অবাক হয়। “আপু তোর কী হয়েছে? অনিক আর দশটা ছেলের মতই একটা ছেলে যার সাথে আমি ম্যাডামের বাসায় একই ব্যাচে পড়ি। নূতন মোবাইল কিনেছে। আমাকে বলছিল কল করতে হবে কিনা।”

অন্বেষা আর কিছু বলে না। বুঝতে পারে আজ সব কিছুতেই বেশী বেশী করছে সে। ম্যাডামের সাথে বেয়াদবী করা, অরিনের উপর রাগ, মার সাথে ঝগড়া কিম্বা শৈলীকে অহেতুক সন্দেহ করা - সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু এক চরম অস্থিরতা, নিজের দুটো সত্তার মাঝে দ্বন্দ্ব। সায়েমের সাথে সেদিনের পর অন্বেষার আরো কয়েকবার কথা হয়েছে। প্রতিবারই সায়েম অন্বেষাকে ওর ফ্ল্যাটে যেতে প্রলুব্ধ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে একটা সারপ্রাইজের কথা। সায়েমের ফ্ল্যাটে নাকি অন্বেষার জন্যে একটা চরম সারপ্রাইজ আছে যেটা সায়েম চায় অন্বেষা গিয়ে দেখুক। এরকম অর্ধেক কথা অন্বেষা একদমই সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া অন্বেষা মনে করে সায়েম সিরিয়াস প্রকৃতির ছেলে। সে যখন বলেছে সারপ্রাইজ আছে, তবে একটা সারপ্রাইজ ওর জন্যে অবশ্যই অপেক্ষা করছে। সেটা কী, তা না জানা পর্যন্ত আর অন্বেষার শান্তি হচ্ছে না।
অন্বেষা লক্ষ্য করেছে সায়েম মোটামোটি ওকে কনভিন্স করে ফেলেছে। ওর মনের আশি শতাংশ এখন বলছে সায়েমের ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত। তবে বাকি বিশ শতাংশ বারবার অনাগত বিপদের সম্ভাবনা মনে করিয়ে দিয়ে সাবধান করে দিচ্ছে অন্বেষাকে।

সন্ধ্যায় অন্বেষা অনেক সময় নিয়ে শাওয়ার নেয়। তারপর নিজের উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এনে টিএন্ডটি ফোন থেকে অরিনকে ফোন দিয়ে সব কথা খুলে বলে। এবার অরিন গতদিনের মত প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সে অন্বেষার থেকে খুঁটিনাটী বিষয়গুলো সব জেনে নেয়ার চেষ্টা করে। অরিন বোঝে অন্বেষাকে ছেলেটার সাথে কথা বলতে মানা করাটা বৃথা। যেহেতু অন্বেষা ঐ ছেলের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ থেকেই অরিন বুঝতে পারে ছেলেটার প্রতি ওর ভালোলাগাটা কোন পর্যায়ে পৌছেছে।
“দেখা যদি করতেই হয়, তাহলে সেটা আমাদের ক্যাম্পাসের আশেপাশেও করা সম্ভব। হ্যালভেশিয়াতে চলে আসতে বল।”
“সেটাতো সে করতে পারছে না। কী কাজে নাকি সে অনেক ব্যস্ত।”
“সে যদি তোকে এতই ভালোবাসে, তাহলে এটাইতো আসল সময় পরীক্ষার। দেখা যাক সে তার ব্যস্ততাকে এক পাশে রেখে ভালোবাসার সাথে দেখা করতে আসতে পারে কিনা।”
অন্বেষা বুঝতে পারে অরিন কথাটা খারাপ বলে নি। এ দিকটা অন্বেষা কখনও ভেবে দেখে নি, তবে ভাবা উচিত ছিল।
অরিন অন্বেষাকে আরো কিছুক্ষণ বোঝায়। সারপ্রাইজ পরে দেখা যাবে, আগে দেখা হওয়া জরুরী। তাছাড়া প্রথম দিনই একজনের বাসায় চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া সায়েমের সাথে ওদের পরিচয়ও করিয়ে দিতে বলে। সবশেষে ওদের পরিকল্পনা দাঁড়ায় এরকম যে সায়েমকে যেভাবেই হোক NSU-র ক্যাম্পাসে এনে হাজির করবে ওরা।

রাতে অন্বেষা ফোন দেয় সায়েমকে। এই প্রথম অন্বেষা সায়েমকে কল করলো। রিং হয়ে হয়ে লাইন কেটে যায় কিন্তু সায়েম ফোন ধরে না। অন্বেষা বারবার কল দিতে থাকে কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। অন্বেষার অস্থির লাগতে শুরু করে কিন্তু কিছুই করার নেই। সে রাতে নির্ঘুম অন্বেষা একটু পরপর কল করে ভোর পর্যন্ত চেষ্টা করে সায়েমের সাথে কথা বলার কিন্তু অন্যপাশ থেকে কেউ আর ফোন ধরে নি।

একই রাতের ঘটনা। আঙ্গুল কাটা জগলু একটা পুরানো গ্যারেজে চেয়ারে বসে টলছিল। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। হাতে গ্লাস। মাতালের মত সে গ্লাসের তরল গলায় ঢালছে আর বারবার বলছে, “ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড।”
এমন সময় একজন স্যুট-টাই পরা ভদ্রলোক গ্যারেজে ঢোকেন। তাকে দেখে জগলুর সাগরেদ আলাউদ্দিন উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু জগলু তখনও নেশাগ্রস্ত। ভদ্রলোক আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জানতে চান, “কয়টা?”।
আলাউদ্দিন বাম হাতের কনিষ্ঠা এবং অনামিকা উঁচু করে দেখায়। ভদ্রলোক চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে থাকেন কিছু সময়। তারপর বের হয়ে যান গ্যারেজ থেকে।

জগলু তখনও মাতালের মত বলে চলেছে, “ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড।”


মন্তব্য

পলাশ রঞ্জন সান্যাল [অতিথি] এর ছবি

সাথে আছি। ফেরদৌসি ম্যাডাম?কোনজনকে বোঝালেন?মোহাম্মদপুর না শান্তিনগর?মনে তো হয় শান্তিনগর।
ভালো লাগলো। অপেক্ষা পরের পর্বের।
পলাশ রঞ্জন সান্যাল

এ. কে. এম. ওয়াহিদুজ্জামান এর ছবি

ভালই লাগছে নিয়াজ। কোন ফেরদৌসী ম্যাডাম? একজন তো ঢাকা কলেজে আমার কলিগ ছিলেন। তিনি নন তো?

হাসনাত এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।