প্রবাসের কথামালা: উড়াল পর্ব

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: রবি, ২৬/০৮/২০০৭ - ১০:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি পুরাদস্তর গোছানো, সিস্টেমেটিক আর ডিসিপ্লিন্ড মানুষ। সেই আমিও বিদেশে আসার তোড়জোড় আর গোছগাছের হুল্লোরে হারিয়ে ফেললাম পাসপোর্ট। কানাডিয়ান হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেছি। ইন্টারভিউ হয়েছে। এখন যেকোন সময় ডাক পড়বে পাসপোর্ট নিয়ে হাজির হওয়ার। আর এর মধ্যেই একদিন আবিষ্কার করলাম ওটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

হেথায় খুঁজি, হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে- বাড়ি, অফিস, খাটের তলা, ড্রয়ারের চিপা কোথাও বাদ রইলনা। কিন্তু পাসপোর্ট পাওয়া গেলনা। ওকে, নো চিন্তা-- আবার পাসপোর্ট করতে হবে। সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা হল পাসপোর্ট নাম্বার হাইকমিশনে দেয়া আছে, তার কী হবে? ঠিক হল দুই নম্বরি না করে যথানিয়মে দ্বিতীয়টির আবেদন করা হবে। তার জন্য থানায় জিডি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হবে।

অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নিলাম। দুই কপি জিডি'র দরখাস্ত লিখা হল। লিখলাম "আজ সকালে আনুমানিক ১০টার দিকে পল্লবী বাজার থেকে আমার পাসপোর্টখানা হারিয়ে গেছে..."। কী হাস্যকর কথা-- পল্লবী বাজারে কেন পাসপোর্ট হারাবে? তা যাই হোক, পল্লবী থানায় জিডি যেহেতু করছি তাই এটাই লিখা নিরাপদ। আর পাসপোর্ট যদিও হারিয়েছে ৪-৫দিন হয়, লিখতে হবে আজই হারিয়েছ। এটাই নিয়ম। বেশি বেনিয়ম করলেই সমস্যা!

আমি দরখাস্ত হাতে নিয়ে পল্লবী থানায় বসে আছি। এক মহিলা পুলিশ, সম্ভবত ওসি, একটা টেবিল নিয়ে বসে আছে। আরো বেশ কয়েকজন পুরুষ পুলিশ আর দুইএকজন আমজনতা। টেবিলের উপর একটা বেতার যন্ত্র। সেখান থেকে অনবরত হরবর করে মেসেজ ভেসে আসছে। শুনেছি জিডি করতে টাকা লাগে। কিন্তু আমি টাকা-পয়সা দেবনা সে সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি। দেখা যাক কী হয়। একসময় টেবিলে ২ কপি দরখাস্ত এগিয়ে দিয়ে বললাম আমার একটা জিডি করতে হবে। উনি দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন না করে দুটা কপিতেই সিল মেরে নম্বর দিলেন। এক কপি নিজের জন্য রেখে আরেক কপি আমাকে ফেরত দিলেন। এত সহজে জিডি হবে তা আমার আশা ছিলনা। আমি খুশি মনে বের হয়ে এলাম।

জিডি'র কপি নিয়ে ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। তারপর এলজিইডিতে আছেন এমন এক আত্নীয়কে ধরে কম সময়ে পাসপোর্ট করার ব্যবস্থা হল। অতপর পাসপোর্ট পাওয়ার দুই দিনের মাথায় হাইকমিশন থেকে ফোন এল। পাসপোর্টে ভিসা পড়ল।

উড়াল দেওয়ার দিনটি হালকা রকম মেঘলা। ইমিগ্রেশন শেষ করে ভেতরে চলে গেলাম। পেছনে দাঁড়িয়ে আমার মা- হাসিখুশি মুখ। তার পাশে ছলছল চোখে আমার স্ত্রী আর তার ভেতরে আনগত সন্তান। একবার তাকিয়েই আর পিছনে চাইনি। পিছুটানের সময় নয়, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই এখন সবচেয়ে বড়।

এমিরেটস এয়ারলাইনস-এর বিশাল উড়োজাহাজ। এর আগে এত কাছ থেকে প্লেন দেখিনি। জানালার পাশে সীট নিয়েছি। সেখান দিয়ে দেখা যায় ছোট্ট আকাশ, জিয়া বিমানবন্দরের অনুচ্চ বিল্ডিং আর সবুজ ঘাসের মাঠ। ইঞ্জিনের বিজ-বিজ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গেট থেকে ট্যাক্সিং করে প্লেন কয়েক মিনিট পরেই রানওয়ের একদম শুরুতে। আর কয়েক মুহূর্ত, তার পরেই ছুটে চলবে আকাশ ফড়িং।

প্লেনটা নড়ে উঠল। আস্তে আস্তে গতি বাড়ছে, আরো বাড়ছে, অসম্ভব দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে প্লেন। মনিটরে দেখাচ্ছে ২০০মাইল/ঘন্টা। নোজ হুইল সম্ভবত উঠে গেছে। পেছনের অংশকে কে যেন এখনো রানওয়ের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আমি আগামি দিনের সুখস্বপ্ন আর হাজারো পিছুটান-- এ দুয়ের মাঝখানে পড়ে রইলাম। মা-বাবা-ভাই, স্ত্রী আর অনাগত সন্তানকে ছাপিয়ে মাটির টানই শক্ত মনে হল। জানালা দিয়ে আবারো বাইরে তাকাই। সবুজ ঘাসের মাঠ ঝাপসা হয়ে গেল টপটপ করে পড়া নোনা জলে। এমিরেটস ততক্ষণে এয়ারবোর্ণ।

পরের পর্ব
প্রবাসের কথামালা: "ক্রীম অর সুগার?"


মন্তব্য

কেমিকেল আলী এর ছবি

ডাবল ডাবল,
আর ট্রিপল ট্রিপলের আশায় থাকলাম

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হায় হায়, এই লেখাটা এই মুহূর্তে বোধহয় ভাল হলনা। লিখেছিলাম আগেই, এবং স্কেজিউল করা ছিল। এর মধ্যে দেশের অবস্থা যাচ্ছেতাই। যাহোক, কেউ চাইলে আমি সরায়ে দিতে পারি।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

থাকুক। খানিক বৈচিত্র্য আসুক।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

শামীম এর ছবি

লিখুন। পিছুটানটা খুবই শক্ত ... ... ওটা আগে বুঝা যায় না।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

থাকুক। ভাল লাগলো। ক্রিম/সুগারের অপেক্ষায় থাকলাম। জিডি ও কানাডা বাদে মিলে গেল সবই। ওহ, আমার দুর্ভাগ্য হয়েছিল কোরিয়ান এয়ারে আসার! লেখা আছে সেগুলো, জানাবো কখনও।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

ইশতিয়াক রউফ লিখেছেন:
লেখা আছে সেগুলো, জানাবো কখনও।

এখনই না কেন? দেঁতো হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আমারো একই দাবি, এখনই নয় কেন? আমার মনে হয় এধরনের লেখাগুলো বইএর পাতা হিসেবে দিলে ভাল হয়। কি বলেন সবাই?

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমার ক্ষেত্রে সময়ের অভাব এবং জড়তা না লেখার বড় কারণ। বইয়ের পাতায় দিতে ভয় লাগে। অযথা বইটাকে নিচে নামাতে চাই না। বইয়ের সম্পাদনার সময় কারো কিছু ভাল লাগলে তুলে দেওয়া যায়।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে, পড়ার জন্য।

আচ্ছা কেউ কি জানেন এই লেখাটা মন্তব্যগুলি সহ কিভাবে বইএর পৃষ্ঠায় নিবো?

...........
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা

ঝরাপাতা এর ছবি

স্বদেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলি। ভালো লেগেছে।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।