গল্প চেষ্টা ১ঃ ভাঙনের শব্দ শোনা যায়

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৭/০৮/২০১১ - ৯:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘরে বসে মনোযোগের সাথে শাড়িতে সুঁই ফুটিয়ে যাচ্ছে পারুল। ঘর বলতে বস্তির একটা খুপড়ি। দুপুরের রোদ বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে অসহ্য গরমকে আরো তাতিয়ে তুলছে। বিরক্ত মুখে পড়ে থাকা একটা কাগজ দিয়ে কয়েকটা ফোকর ঢেকে দিল পারুল।

পঁচা জলের ওপর বাঁশের মাচা তুলে কিছু হতশ্রী মানুষের বাস এখানে। এই শহরের ভেতরে বস্তিগুলো কিন্তু বেশ মানিয়ে যায়। দিনের বেলা ব্যস্ত শহরবাসী খুব একটা লক্ষ করার সুযোগ পায় না। আর রাতে যখন সোডিয়ামগুলো জ্বলে ওঠে তখন আর লক্ষ করার মতো অবস্থা থাকে না। শুনেছি সোডিয়ামের আলোতে কোন কিছুর রং নাকি বোঝা যায় না। সে কারণেই হয়তো বস্তিগুলোর দারিদ্র্যের বিশ্রী রংটা চোখে পড়ে না। তবুও মাঝে মাঝে গাড়ির হেডলাইটের আলোতে জ্বলে ওঠা বস্তির গরীবিয়ানা চেহারা ক্ষণিকের জন্য পথচলতি মানুষের বিরক্তির কারণ ঘটায়। যদি কখনো বস্তিগুলোর উল্টো দিকে ট্রাফিক জ্যাম তৈরি হয় তখন আমাদের এই সমাজের আসল চেহারা মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে থাকে জ্যামে আটকা পড়া মানুষগুলোর দিকে। গাড়ির তীব্র হেডলাইটের আলোয় বস্তির অনেক দূর পর্যন্ত উলঙ্গ হয়ে পড়ে। যেন বৈভবের আলোয় উন্মোচিত হয় দারিদ্র্যের অন্ধকার।

এরকম একটি বস্তিতেই বাস স্বামী-স্ত্রী, রমিজ আর পারুলের। সেলাইয়ের ফাঁকে হঠাৎ করেই সুঁইটা ঢুকে পড়ে আঙুলে। উহ্ করে মুখের মধ্যে আঙুলটা পুড়ে ওপরের দিকে চোখ তোলে সে। সে সময় ফাঁক বন্ধ করার সময় কিভাবে যেন একটা বাদ পড়ে গিয়েছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার একটা কাগজ নিয়ে ওটার দিকে তাকাতেই চকচকে একটা আকাশ চোখে পড়ল। গরীব মানুষের উদাস হতে নেই, এটা বড়লোকদের কাজ। তবুও পারুল তার স্মৃতির পাতায় জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে উড়ানোর চেষ্টা করে।

যমুনার ওপর উদার আকাশ, পাড়ে বালি আর কাদায় একাকার, একটু সামনে শনের বন, তার ভেতরে বাতাসের ফিসফিসানি। শন্শন্ শব্দ করে বলেই কি এগুলোর নাম শন? হবে হয়তো - মনে হতেই মাথা নাড়ায় সে। গ্রামের নাম সাধনগঞ্জ। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। বাপ অন্যের জমিতে কামলা খাটতো, মাকে দেখার সুযোগ হয়নি Ñ এক ভাই, তার থেকে দুই বছরের বড়। বাড়ি থেকে নদী অল্প দূরেই - জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার। নদীর পাড়ে জলের অবিরাম শনবন নুয়ে পড়া, বাতাসে নদীর গন্ধ সবই প্রিয় ছিল ওর - সেই সাথে নদীটাও।

স্বামী রমিজের বাড়িও নদীর ধারেই পাশের গ্রামে। বিয়ের পর সব মেয়েদেরই নতুন করে জীবন গোছাতে হয় - যেন নতুন জন্ম। মানুষ জন্মায় একবার, মরেও একবার - নারীদের জন্ম বারবার, মরণও তাই। পারুলের জীবনটা নতুন হলেও নদীটা থেকে গেল একই। রমিজ একলা মানুষ। থাকার মধ্যে আছে কেবল ভিটেটা। বর্গা দেয় অন্যের জমিতে। বিয়ের পর মানুষটাকে ভালোই লাগে পারুলের। আহামরি কিছু নেই, আর দশটা মানুষের মতই। তাকে ঘিরেই স্বপ্নবক উড়ে চলে যমুনার শনবনে।

যে নদীটা পারুলকে এতদিন সব উজাড় করে দিয়েছে, একদিন সেই কেড়ে নিল সব কিছু। ভেঙে নিয়ে গেল তার বাড়ি-সংসার-স্বপ্ন-শান্তি ভালো লাগা। পাড় ভাঙা মানুষ হয়ে দেশান্তরী হল পারুল আর তার জীবন। ঠাঁই হল শহরের বস্তিতে। এক লহমায় বদলে গেল সব কিছু। স্বপ্নগুলো আটকে গেল বস্তির জীবনে। হারিয়ে গেল উদার আকাশ - শহরের আকাশটা বড়ই কৃপণ, উঁকি দেয় মাঝে মাঝে। নদীর গন্ধ হারিয়ে গেল - নিঃশ্বাস নিতে হয় সন্তর্পণে, যেন ঢুকে না পরে পঁচা জলের গন্ধ। মানিয়ে গেল সব কিছু - জীবন বয়ে চলল যমুনার জলের মতোই। পারুল মাঝে মাঝে এখনও শুনতে পায় ভাঙনের শব্দ - নদীর পাড় ভাঙার।

ঘরের বাইরে খিস্তি-খেউরের শব্দে সম্বিৎ ফেরে। এই বস্তি তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। তার মধ্যে এটাও একটা। শিখে নিয়েছে ভালোই। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে দুই মহিলার অদ্ভুত আস্ফালন। বাড়ির পুরুষ দুজন ঘরের সামনে বসে বিড়ি ফুঁকছে, যেন কিছুই চলছে না সামনে। টিংটিঙে পেট নিয়ে উদাম শরীরে দৌড়ে গেল বস্তির দুই বাচ্চা। বস্তির সামনে রাস্তায় একটা ট্রাক বিকট শব্দে হর্ন বাজালো। সেই শব্দে পাশের ঘরের দুই মাসের বাচ্চাটা কান্না জুড়ে দিল। বাচ্চাটার মা কাজে গেছে। তার চার বছরের মেয়েটার কাছেই বাচ্চাটা থাকে। ঘরের সামনে বাঁশের উপরে পা ঝুলিয়ে কী যেন করছিল সে। কান্নার শব্দে দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকলো। পারুল নিজেও কয়েকবার কাজ করতে চেয়েছে, রাজী হয়নি রমিজ। রিকশা চালায় সে। কখনো দিনে কখনো বা সন্ধ্যার পর। খাওয়া জুটে যায়। বস্তিও ঘরের ভাড়া মাসে দুইশ টাকা। প্রতি মাসে সর্দার এসে টাকা নিয়ে যায়। শুনেছে লোকটার ক্ষমতা অনেক - সরকারি জমি দখল করে এই বস্তি। ওরা আসার কয়েকদিন পরেই বস্তিতে আগুন লাগে। পুড়ে যায় সব কিছু - দুজন মানুষও পুড়ে মরে। পরে শুনেছিল সর্দারের লোকজনই আগুন লাগায়। টাকা আসে তাতে, নতুন ঘর তুলতে হয় যে। রমিজকেও টাকা দিতে হয় নতুন ঘর তোলার জন্য।

আজ রমিজ সকাল থেকে ঘরেই ছিল, ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যায় বের হবে রিকশা নিয়ে। দুপুরের পর সর্দার এসে অনেককে নিয়ে গেছে। আজকে নাকি নেতার মিছিল আছে। যেতেই হবে, অবশ্য তিরিশ টাকা করে দেবে। এই নেতার দয়াতেই নাকি এই বস্তি। সর্দার বলছে মিছিল ভালো করে করতে হবে। পারুলের ভালো লাগে না। যেতে দিতে মন চায় না। রমিজ বোঝায় কিছু টাকা তো পাওয়া যাবে। রান্না করে রাখতে বলে, ফিরে খেয়ে রিকশা নিয়ে বের হবে। পারুলের রান্নার কথা মনে পড়ে। বস্তির সামনে একটা খড়ির দোকান আছে, খড়ি না আনলে রান্না বসানো যাচ্ছে না। শাড়িটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় বের হয়ে এসে লোকজনের মধ্যে একটা ব্যস্ততা চোখে পড়ে পারুলের। এদিক ওদিক তাকিয়ে রমিজ ফিরল কিনা দেখার চেষ্টা করে। খড়ির দোকানটার পাশে একটা চায়ের দোকান। এক লোককে বলতে শুনলো - বড় রাস্তায় নাকি গণ্ডগোল চলছে, পুলিশ গুলি করছে। এ আর নতুন কি - এই শহরে এ তো লেগেই আছে। ভ্রুক্ষেপ না করে খড়ি বেছে নিতে মনোযোগ দেয়। কাঁচা খড়িতে ধোঁয়া হয়, এই নিয়ে সারাদিনই খুটখাট লেগে থাকে। খুঁজে খুঁজে কিছু শুকনো খড়ি নিয়ে ফিরতে শুরু করে। মাটির চুলাটা জ্বালিয়ে নিয়ে রান্নার যোগাড় করতে বসে পরে। ভাত আর ছোট মাছ দিয়ে একটা কিছু করবে। সকালে মাছ কিনেছে পারুল, বেশ সস্তা।

বাইরেটা লাল হয়ে আছে - সূর্য ডুবছে। যমুনার ওপাড়ে সূর্যটা যখন ডুবতো নদীর জল কি যে সুন্দর হতো দেখতে -- শহরের সূর্য ডোবার সময় কেমন যেন মন খারাপ করা আলো হয়। কেন হয়? অনেক লোকের শোরগোল শুনে বাইরে তাকালো পারুল। কী হল আবার এখন? অনেক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা দেখছে। বস্তির এক মহিলা দৌড়ে এসে ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পরে। মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা মনে হয় পারুলের। ভিড়ের মাঝাখনে কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে। চিনতে পারে লোকটাকে - রমিজ। পাশ থেকে মহিলাটা বলে ওঠে Ñ মিছিলে গুলি - কথা যেন ওখানেই ফুরিয়ে যায়। অনেক প্রশ্ন নিয়ে পারুল ফিরে তাকায় মহিলার দিকে - ঘরের উনুনে ধোঁয়া উঠতে থাকে - দূরে কোথায় আবারো ভাঙনের শব্দ শোনা যায়।

------------------------
আমি তোমাদেরই লোক


মন্তব্য

দিগন্ত বাহার () এর ছবি

চলুক চলুক।

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

হাততালি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।