সত্যিকারের মৃত্যুঞ্জয় পি'হস্কি !

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৯/০৯/২০১১ - ২:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


(ছবিঃ কাযিমিরেয পি'হস্কি)

কাযিমিরেয পি'হস্কি যখন অশভিতস(Auswitch) থেকে তার কিছু সহবন্দীদের সঙ্গে নিয়ে পালানোর ফন্দি আঁটছিলেন তখন কেউ ভাবতেই পারেনি এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসাহসী জেল পালানোর পরিকল্পনা হতে যাচ্ছে । সবাই জানে এই Auswitch ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের সবচেয়ে বড় আর সবচাইতে কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তবে এটা কত ভয়াবহ ছিল তা হয়ত অনেকে জানেন না । বন্দিদের মালবাহী ট্রেনে এই ক্যাম্পে আনা হত , আর সেই কুখ্যাত "সিলেকশন প্রসেস" এর মাধ্যমে তাদের দুই ভাগে ভাগ করা হত, যারা কাজের অনুপযুক্ত বিবেচিত হত তাদের সাথে সাথে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হত , আরেকভাগ যাদের শ্রমিক হিসেবে বাছাই করা হয়েছে তাদের লেবার ক্যাম্পে হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে পাঠানো হত। এইখানে মেডিকেল এক্সপেরিমেন্টেশন ব্লক ছিল যাতে বন্দিদের উপর ভয়াবহ আর উদ্ভট সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরিক্ষা চালানো হত , যেমন জীবিত মানুষের উপর এক্সরের তীব্রতা পরীক্ষা , জোর পুর্বক মানবদেহে রোগের সংক্রমণ ঘটানো, বামন অথবা জমজ বাচ্চা নিয়ে অবৈধ সব এক্সপেরিমেন্ট ! পি'হস্কির সাখ্যাৎকারে এর ভয়াবহতা কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায় !
এখন চলুন পি'হস্কির দৃষ্টিতেই দেখার চেষ্টা করিঃ
" পোল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের তি'শাফ এ পার্কে দুই ভাইয়ের সাথে তীর-ধনুক খেলে আর বন্ধুদের সাথে ভিস্তুলা নদীতে সাতার কেটে বেশ কেটে যাচ্ছিল আমার ছেলেবেলা । মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম আর বাবা রেলের চাকুরে ছিলেন । প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পোল্যান্ডকে কাঠিন্য , ভ্রাতৃত্ব আর দেশপ্রেমের মাধ্যমে গড়ে তোলার জন্য তখন স্কাউট বেশ কাজ করে যাচ্ছে । দশ বছর বয়সে স্কাউটে নাম লেখালাম আমি , কারণ আমার এই পোল্যান্ডকে বড্ড বেশি ভালবাসতাম। কে জানত তখন এই একটা সিদ্ধান্ত আমার পুরো জীবনটাই বদলে দেবে ! আমার মনে আছে মা আনন্দে কেদে ফেলেছিলেন আমার এই স্কাউটে যাওয়াতে ! নয় বছর পর ১৯৩৯ এ যখন নাৎসিরা পোল্যান্ড দখলে নিল তখন এই স্কাউটকে ওরা জাতীয়তাবাদী শক্তি আর তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে ধরে নিয়েছিল । তখন আমার বয়স ১৯ , যুদ্ধ শুরু হওয়ার ৪ দিনের মধ্যেই জার্মান সৈন্য আমাদের এলাকায় আসে । তারা স্কাউটদের দেখলেই গুলি করে মারত ! এইসব কিশোরদের যাদের এক জায়গায় জড়ো করার পর গুলি করে হত্যা করেছিল তাদের অনেকেই ছিল আমার বন্ধু । আমরা সমবয়সীরা সবাই দারুণ আতঙ্কে ছিলাম , আমি জানতাম একদিন আমিও ঠিক এইভাবেই মরব তাই বুঝলাম আমাকে পালাতে হবে । অন্যান্য স্কাউটদের মতন আমিও হাঙ্গেরিয়ান বর্ডারের উপর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ধরা পড়ে গেলাম ! দীর্ঘ আট মাস বিভিন্ন কারাগারে কাটানোর পর আমাকে অশভিতস এ পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পে যেসব বন্দীদের আনা হয়েছিল তাদের মধ্যে আমরা ছিলাম ২য় দলের অন্তর্ভুক্ত , তাই আমাদের দিয়েই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটা বানানো হচ্ছিল ।পুরানো বিল্ডিং এর মূল ক্যাম্পটা এত মানুষ রাখার জন্য যথেষ্ট বড় ছিল না তাই তার পাশেই আরেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানানোর জন্য আমাদের দিনে ১২-১৫ ঘন্টা কাজ করাতো , আমাদের বন্দীদের দিয়ে বানানো এই ক্যাম্পটাই পরে নাৎসিদের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর বড় ডেথ ক্যাম্প হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠে ! প্রথম তিন মাস আমরা ভয়াবহ একটা শক এ ছিলাম ! পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে লাগল , ১৯৪০ এর জুন থেকে ১৯৪১ এর ছয় মাস SS সৈন্যরা সমানে মানুষ হত্যা করত , তারা ব্যাটন দিয়ে পিটিয়ে মারত বন্দীদের ! নাৎসিদের জন্য এটা ছিল ক্যাম্পে ক্রমবর্ধমান বন্দীর ভীড় বাগে আনার সবচেয়ে সহজ উপায়। বন্দীদের অনাহারে রাখা, অচিন্ত্যনীয় নির্মমতা , কল্পনাতীত দৈহিক খাটুনি ... যা একে এক সাক্ষাত নরক বানিয়ে ছেড়েছিল এই সব ইতিহাসে ভালভাবেই তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু এইসব ইতিহাস এখনো বিস্ময়ে হতবাক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ! স্যুপ খাওয়ার জন্য তোমাকে স্রেফ একটা টিনের বাটি এবং একটা চামচ দেওয়া হবে , কিন্তু এটা শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য নয় প্রস্রাবের জন্যও তোমাকে এই বাটি ব্যবহার করতে হবে ! যদি তুমি চামচটা হারিয়ে ফেল তাহলে তোমাকে কুকুরের মতন বাটি থেকে স্যুপ খেতে হবে ! আর যদি বাটিটা হারিয়ে ফেল তাহলে উপোস থাকতে হবে ! অবসর উদযাপনের জন্যও নাৎসি সৈন্যরা মানুষ হত্যা করত ! কোন জার্মান সৈন্যের হয়ত সবকিছু খুব অনুত্তেজক , সাদামাটা , একঘেয়ে লাগছে তখন সে করত কি কোন একজন বন্দীকে ডেকে নিয়ে আসত , তারপর তার টুপিটা খুলে দূরে ছুড়ে দিত আর বন্দিকে বলত দৌড়ে টুপিটা নিয়ে আসতে , যেই বন্দী দৌড়ে টুপি আনতে যেত জার্মান সৈন্য তাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলত ! মেরে ফেলার পর সে তার উচ্চপদস্থ কর্তাদের বলত বন্দি দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল তাই তাকে গুলি করে থামানো হয়েছে ! ফলস্বরুপ ওই সৈন্য পুরস্কার হিসেবে ছুটি পেত ! এই ক্যাম্প থেকে কেউ পালালে এবং ধরা পড়লে শাস্তি হত মৃত্যুদন্ড , আর পালিয়ে ধরা না পড়লে র‍্যান্ডম স্যাম্পলিং এর মাধ্যমে দশজন বন্দিকে গুলি করে মারা হত , আর যে পালিয়েছে তার আত্মীয় অথবা অভিবাবকদের ধরে এনে মারা হত !

( ছবিঃ অশভিতস এ বন্দি পি'হস্কি )
মানুষ কিভাবে এখানে টিকে থাকত ? অনেকেই প্রার্থনা করত কিন্তু পুরানো বন্দীরা যারা ইতিমধ্যেই অনেক প্রার্থনা করেছে , বলতঃ অশভিতস যতদিন থাকবে ততদিন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।
ছয়মাস পর্যন্ত আমি লাশ বইতাম ! গনহত্যার পর লাশ গুলো বয়ে নিয়ে যেতাম ! ডেথ ওয়ালটা ছিল ব্লক ১০ আর ১১ এর মাঝখানে , বন্দীদের লাইন ধরে দাড় করিয়ে মাথায় গুলি করা হত এবং তার শেষে ওখানে নগ্ন মৃতদেহের স্তুপ হয়ে যেত । আমরা লাশ ধরাধরি করে গাড়িতে ছুড়ে দিতাম পোড়ানোর উদ্দেশ্যে !কোনদিন ২০ , কোনদিন ১০০ টা আবার কোন কোন দিন আরও বেশি লাশ, মানুষের লাশ ! নারী, পুরুষ বাচ্চা , শিশু!! ...............
(আগামী পোস্টে সমাপ্ত করা হবে )
(ব্লগারঃ হেমন্তের ঘ্রাণ)

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

কলঙ্কজনক অধ্যায় আমাদের ইতিহাসের। এত যুগ পরেও কোন নাৎসী কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গেলে শরীর শিউরে ওঠে

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

নাৎসিদের বর্বরতা জানতে পেরে গা শিউরে উঠেছিল আমার !
ছবি গুলা আপলোড করার পর পোস্টে এইরকম ঝাপসা আসল কেন বুঝলাম না !! ছবি পোস্ট করার জন্য আলাদা কিছু করতে হয় নাকি ? ইয়ে, মানে... ইয়ে, মানে...

কল্যাণF এর ছবি

মন খারাপ

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

মন খারাপ মন খারাপ

শিশিরকণা এর ছবি

প্রায় বছর দশেক আগে হঠাৎ একটা সিনেমা দেখেছিলাম টিভিতে, অশউইৎযের উপর, এক মহিলা ডাক্তারের কাহিনী, যাকে ঐ মেডিকেল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কাজ করতে বাধ্য করানো হয়েছিল, তার পরিবারকে আটকে রেখে। অনেকদিন ঘুমাতে পারি নাই সিনেমাটা দেখার পর।
দেখি লিঙ্ক পাওয়া যায় কি না।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

শিশিরকণা এর ছবি

ইউটিউব লিঙ্ক পাইলাম. সিনেমার নাম "Out of the Ashes" . এইখানে প্রথম পর্বের লিঙ্ক।

http://www.youtube.com/watch?v=6YCD-kXNZTY&feature=related

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

ধন্যবাদ !! চলুক

কর্ণজয় এর ছবি

মন দিয়ে পড়ছি...

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ ! পরের পর্ব শীঘ্রই আসছে ।

সুমন তুরহান এর ছবি

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক অংশটি তুলে আনার জন্যে লেখককে ধন্যবাদ।

হলোকস্ট নিয়ে কোনো ডকু দেখলে বা লেখা পড়লে আমি অনেকদিন পর্যন্ত দু:স্বপ্ন দেখি। এক গোত্র মানুষের পক্ষে, দলবেঁধে, দেশবাসীর সমর্থন নিয়ে, ঠাণ্ডা মাথায়, বছরের পর বছর ধরে অন্য আরেক গোত্র অসহায় মানুষের ওপর এই অকথ্য নির্মমতা আমাকে শঙ্কিত করে।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।