সত্যিকারের মৃত্যুঞ্জয় পি'হস্কি ! (-- দ্বিতীয় অংশ-- )

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৯/০৯/২০১১ - ৪:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত পর্বের পরঃ
তখনো আমার মাথায় পালানোর চিন্তা আসেনি , কিন্তু একদিন আমার এক বন্ধুর নাম ডেথ লিস্টে চলে আসল । অশভিত্‌স এর অন্যসব স্কাউটদের মতন আমিও প্রতিরোধে যোগ দিলাম । স্কাউটরা যেহেতু জার্মান ভাষা জানত তাই তারা অনেক গুরুত্বপুর্ন যায়গায় ছিল , এমনকি তারা নাৎসি কারারক্ষীদের সাথেও ছিল , তাই বন্দীদের গোপন ফাইলথেকে তথ্য চুরি করা বেশ সহজ ছিল ! ক্যাম্পের গ্যারেজের এক মেকানিক ইউজেনাস বেন্ডেরা । একদিন আমাকে এসে একটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ দিল সে , সে ওই গোপন ফাইল মারফত জানতে পেরেছে শীঘ্রই তাকে মেরে ফেলা হবে ! সাথে সাথে এই মৃত্যুপুরী থেকে পালানোর এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা আমার মাথায় জীবানুর মতন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। "আমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি , কিন্তু গাড়ির ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয় " বেন্ডেরা জানাল আমাকে । কথাটা পুরোপুরি সত্য ,কারণ বন্দীদের রাখা হয় Auschwitz I এ , বিদ্যুতায়িত তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে এটা , তার উপর কয়েকমিটার পর পর গার্ড থাকে আর এখান থেকে বের হতে হলে কুখ্যাত "Arbeit macht frei" গেটের ভিতর দিয়ে বের হতে হবে আমাদের ! আর সর্বোপরি সীমানার গেট টপকাতে হবে ! তবুও আমি বেন্ডেরার অনুরোধ বাতিল করিনি , বেন্ডেরাকে যেহেতু "ওয়াল অফ ডেথ" এর সামনে দাড় করিয়ে গুলি করা হবে তাই কিছু করতে হলে অবশ্যই তাড়াতাড়ি কিছু ভাবতে হবে । আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম , যেখানে আমাকে কাজ করতে হত ওখানেই নাৎসিদের ইউনিফর্ম আর গোলাবারুদ রাখা ছিল । ধীরে ধীরে মাথায় একটা পরিকল্পনা আসল !
পরেরদিন বন্দীদের একটা নতুন "চালান" আসল , সেই উপলক্ষে নাৎসি ডেপুটি কমান্ড্যান্ট একটা ভাষন দিলেনঃ
" সবাই শোন , কেউ যদি বেকুবের মতন পালানোর চেষ্টা করে থাক তাহলে জেনে রাখ প্রত্যেকটা পলাতক বন্দীর বিনিময়ে তার দলের(ওয়ার্কিং গ্রুপ) এবং তার ব্লকের ১০ জনকে গুলি করে মারা হবে"!! আমার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল ! আমাদের জন্য কেন নিরাপরাধ কেউ মরবে ? ব্যাপারটা সমাধানের জন্য আমি আর বেন্ডেরা মিলে চার জনের একটা ভুয়া গ্রুপ বানালাম । একজন বয় স্কাউট জেস্টার, আর একজন যাজক ল্যাম্পার্টকে আমাদের এই দুর্দান্ত প্ল্যানে রিক্রুট করলাম ।
২০ জুন ১৯৪২ , অশভিত্‌সএ বেন্ডেরার ২ বছর হয়ে গেল ! আমরা চার ষড়যন্ত্রী একটা নির্মাধীন ব্লকের চিলেকোঠায় জড়ো হলাম আমাদের পরিকল্পনা শেষবারের মতন ঝালাই করার জন্য । দিনটা ছিল শনিবার , দুপুরে গ্যারেজ আর স্টোর রুম ফাকা থাকে । যাওয়ার আগে আমরা প্রার্থনায় বসলাম , পরিবারের জন্য প্রার্থনা করলাম সবাই, সবাই ঠিক করলাম যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে নিজেদের মাথায় গুলি করব ! আমরা যদি এই প্ল্যান না করতাম তাহলে বেন্ডেরা স্রেফ মারা পড়বে , এই ব্যাপারটা আমাদের প্রেরণা যোগাচ্ছিল । শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু মনে মনে সবাই বলছিলাম "নিজের উপর বিশ্বাস রাখ , এটা পারতেই হবে আমাদের "!
রান্নাঘরের কিছু আবর্জনা ঠেলা গাড়িতে তুলে নিয়ে আমরা চারজন Arbeit macht frei গেটের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম , গার্ডদের বললাম "আমরা একটা স্কোয়াডের সদস্য , ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে নিচ্ছি " , আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন গার্ড রেজিস্ট্রি চেক না করে । ভাগ্য আমাদের সাথেই ছিল আমরা মেইন ক্যাম্প পার হয়ে স্টোরের দিকে এগুতে লাগলাম । এইসময় আমার মাথায় অন্য কিছুই ঢুকছিল না , স্রেফ "জীবনের শেষ পরীক্ষায়" পাস করতে চাচ্ছিলাম আমি ! ওই মুহুর্তে শুধুমাত্র সাহসই যথেষ্ট ছিল না, সাথে বুদ্ধিরও দরকার ছিল । স্টোরে আমাদের তিনজন ট্র্যাপ ডোরের দিকে এগিয়ে গেল ,কয়লার সেলারে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি লুকিয়ে রেখেছিলাম , আর আমি ২য় তলায় উঠার জন্য বোল্ট খুলে রেখেছিলাম । ২ তলায় উঠে গেলাম আর নাৎসি অফিসারদের ইউনিফর্ম গুলো পরে নিলাম সবাই। ইতিমধ্যেই বেন্ডেরা ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা নিয়ে আসল , স্টেয়ার ২২০ , অশভিত্‌স এর সবচাইতে দ্রুতগামী গাড়ি । কমান্ড্যান্টরাই ব্যবহার করে এই গাড়ি । দ্রুতগামী গাড়িই দরকার ছিল , যদি কেউ ধাওয়া করে তাহলে আমাদের দ্রুত পালাতে হবে আর অবশ্যই যথাসম্ভব কম সময়ে বার্লিন পৌছতে হবে।
গাড়ি নিয়ে প্রধান ফটকের দিকে আগাচ্ছি আমরা , পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া SS সৈন্য চিৎকার করে স্যালুট করল আমাদেরঃ "হেইল হিটলার" ! সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এখনও বাকী , ভয়ঙ্কর একটা সমস্যা ছিল, ঠিক কোন ব্যারিয়ারের সামনে কখন আমাদের পাস দেখানোর জন্য দাড়াতে হবে সেটা আমরা জানতাম না !প্রধান ফটকের আরো ৮০ মিটার বাকী , কিন্তু গেটটা এখনও বন্ধ , ৬০ মিটার... , তবুও বন্ধ... , বেন্ডেরার দিকে তাকালাম তার কপাল ঘেমে উঠেছে আর মুখ ভয়ে সাদা ! ......স্বাধীনতা থেকে ২০ মিটার দুরে আমরা ! বেন্ডেরা গাড়ি থামাল , শুন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালাম আমি ! বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কি করব , ঘাড়ে কার যেন নিঃশাস পড়ল , শুনলাম ল্যাম্পার্ট কানে ফিসফিসিয়ে বলছে " প্লিজ কাযিক, কিছু একটা কর " ! এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় মুহুর্ত ! আমি শুনলাম আমার গলা গার্ডের উদ্দেশ্যে জার্মান ভাষায় চিৎকার করছেঃ " হেই বাগার্‌স , গেইটটা খোলা হবে নাকি গাড়িটা তোমার উপর দিয়ে চালিয়ে দেব"? আমার গায়ে ছিল Untersturmführer (লেফট্যানেন্ট ) এর পোশাক আর গলার জোড়ে নিশ্চয় আত্মবিশ্বাস ছিল , কারণ SS গার্ড বেশ ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাড়াহুড়ো করেই গেইটটা খুলল !
.......স্বাধীনতা!!! SS গার্ড তখন জানতেও পারলনা ১৪৪ জন বন্দির ৪জন এইমাত্র অশভিত্‌স এর ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসাহসিক একটা পরিকল্পনা সফলভাবে প্রয়োগ করেছে ! ২ ঘন্টা আমরা রাজপথ ছেড়ে জঙ্গলের পথটা ধরে Wadowice এর পথে ছুটলাম । স্টেয়ারটা ওখানেই ফেলে রেখে আমরা এবার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাটা শুরু করলাম , পালা করে পাহারা দিতাম আমরা । শেষ পর্যন্ত আমরা যে যার দেশে ফিরে গেলাম , আমি পোল্যান্ডে ফিরে এসে আর্মিতে যোগ দিলাম আর বিশ্বযুদ্ধের বাকী সময় নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেই ছিলাম ।
আমাদের পালানোর খবরটা যখন নাৎসিরা টের পায় তার ফলাফল ছিল ভয়াবহ ! জেস্টারের মা-বাবা কে অশভিত্‌সএ বন্দি করা হয়েছিল , ওখানেই মৃত্যু হয় তাদের । আর অশভিত্‌স এর অন্যান্য বন্দিদের উল্কির মাধ্যমে মার্ক করা হয়েছিল যাতে পালাতে না পারে আর পারলেও সহজেই চেনা যায় ! যদিও তার পর আমি আর ধরা পরিনি কিন্তু সেই বন্দি জীবনের দুঃস্বপ্ন এখনও আমাকে তাড়া করে !
(ব্লগারঃ হেমন্তের ঘ্রাণ।)
( গার্ডিয়ানে প্রকাশিত Kazimierz Piechowski এর সাক্ষাৎকার থেকে )


মন্তব্য

কর্ণজয় এর ছবি

রুদ্ধশ্বাস একটা সিনেমা দেখা হলো...

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

ধন্যবাদ ! হাসি

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

ধন্যবাদ । হাসি

কাজি মামুন এর ছবি

যদিও গল্পটির কলেবর ছোট এবং অনেক প্রশ্ন রেখে গেছে মনে, তবু উত্তেজনা কিন্তু ঠিকই টের পাইয়ে দিয়েছে!

হেমন্তের ঘ্রাণ এর ছবি

সাক্ষাৎকারটাই অনুবাদ করসি তো তাই ! হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।