তীর্থের কাক ৫

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: শুক্র, ৩০/০৯/২০১১ - ১:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তীর্থের কাক ১ তীর্থের কাক ২ তীর্থের কাক ৩
তীর্থের কাক ৪

খাবার ঘরটাতে দাবার কোর্টের মতো টেবিল পাতা। সবদিকে একটা করে চেয়ার। অর্ধেক টেবিলই ফাঁকা। আশেপাশের সব টেবিল ফাঁকা দেখে সেখানেই বসলাম আমরা। ছোট্ট থালায় করে রুটি, বাটার, জেলি নিয়ে এলো শামিম। আমাদের গ্রামের চায়ের দোকানের বনরুটির মতো দেখতে। কিন্তু খুব শক্ত। বাটার মাখালে কিছুটা নরম হয়। ডিমের খোশার মতো রুটির বাইরের আবরনটা শক্তই থাকে। গলা দিয়ে নামতে চায় না। খুব বেশী ক্ষিধাও তার কারণ হতে পারে। গলায় পানি ঢালার কোন ব্যবস্থা নেই। বিশাল দুটো ষ্টিলের গামলার একটাতে দুধ ছাড়া চা। আরেকটাতে কালো কফি। এ ছাড়া আর কোন তরলের সন্ধান পেলাম না। ইচ্ছে করেই কফি নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দফায় দফায় দুধ চিনি ঢেলেও কফির তিক্ত স্বাদ মিষ্টি করতে পারলাম না। তিক্ত ঘোলের মতো একটা তরল গলায় ঢেলে পেটে চালান করলাম শক্ত রুটি।

এর পর শুরু হলো সিগারেটের যনন্ত্রনা। খুব নেশা ধরেছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। শামীম সিগারেট খায় না। জয়নালের ভাগিনাকে সকালে পুলিশ ডেকে নিয়ে গেছে। আমরা এখনো বিমান বন্দরের অস্থায়ি আশ্রয় কেন্দ্রে আছি। মাঝে মাঝে দু’একজন ডেকে নিয়ে যায় পুলিশ। ধারণা করি তাদের স্থায়ী কোন আস্তানায় বদলি করা হয়।

এই হাপিত্যেসের মধ্যে আমাদেরও ডাক এলো। ছোট্ট ব্যগটার ভেতর তেমন কিছু নেই। গোছাতে তেমন সময় ও লাগেনি। বাইরে ঝলমলে রোদ। ঘর থেকে বের হতেই একটু ঠাণ্ডা বাতাস লাগল। কিন্ত শীত তেমন টের পেলাম না। আমাদের দেশের শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বাসের মতো দেখতে একটি বাসের সামনে আমরা সাত-আটজন মানুষ। একটি কালো মেয়ে, দুটি ছেলে। সাদাকালোর মাঝামাঝি রং নিয়ে দুটো শিশু মায়ের দু’হাত ধরে আছে। এসিষ্ট্যান্ট, কণ্ডাক্টার, হেলপার কিছু দেখলাম না। আমাদের দেশে বাসের যেখানে জানালা প্রায় তার সমান কয়েকটা দরজা টং দোকানের দরজার মতো খুলে দিয়েছেন এক সাদা ভদ্রলোক। একপাশ দিয়ে আরেকপাশ দেখা যায়। সম্ভবত মালপত্র রাখার জন্য বাসের নীচের দিকটা এভাবে তৈরী হয়েছে। বাসের ছাদে উঠার সিঁড়ি বা এজাতীয় কিছু দেখলাম না।

কিছু কাগজপত্র এক ভদ্র মহিলা সাদা লোকটার হাতে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মাথাগুনে আমাদের বাসে তুলে তিনি বসলেন চালকের আসনে। এ দেশে বাসের কোন হেল্পার, এসিস্টন্ট নেই! দরজা জানালা সব বন্ধ। কেমন যেন দম বন্ধ একটা ভাব। বাসের ভেতরে অর্ধেকের বেশী সিট খালি। ব্যাপরটা ভালই লাগছে।

আকাশ চুম্বী দালান-কোঠার ভীড় ঠেলে ডান-বাম ঘুড়ে ড্রাইভার একটা চলন্ত জ্যামে ভেসে চললেন। একদিকে চলাচলের চারটি সারি। তবে সর্ব ডানের সারিতে কোন গাড়ী নেই। ছোটছোট গাড়িতে বাঁ দিকের সারি পূর্ণ। আমাদের আগে পিছে ট্রাক-লড়ি। কোন হর্ণের শব্দ শুনলাম না। বিপরীত দিক থেকেও অনুরূপ গাড়ির মিছিল। মাঝখানে হাটু সমান উঁচু একটা দেয়াল। গাড়ি চলছে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে। আমাদের মতো অনেক মাটি ফেলে উঁচু রাস্তা বানানোর দরকার বোধ হয় এদের নেই। জমি থেকে শুধু পিচ-টাই যা উঁচু। মাটির কালচে কেঁচোর মতো রং মাঠের। সবুজের হাতছানি কেবল দিগন্তের ওপারে গাড়হ সবুজ গাছের সারি।
এতো উঁচু-নীচু ভূমি! ধীরে ধীরে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে জমি-গাছ-পালা, রাস্তা, গাড়ি! পৃথিবী গোলাকার বলেই বোধ হয়। এতদিন পৃথিবীর গোলাকৃতি কেবল বইয়ে পড়েছি। এবার স্বচক্ষে দেখলাম।

বাঁয়ে রাস্তা থেকে অনেক নীচে লাল টালির ছাদ দেখলাম কয়েকটা। ডানে মাথা ঘোড়াতেই বাড়ি গুলো যেন পাহাড়ের উপড়ে উঠে গেল! হঠাৎ করে মরুভূমির মাঝে ভেসে উঠা নগরের মতো তিন-চারটা একচালা ঘরের অস্তিস্ব দেখলাম। পেছনের টয়োটা গাড়ীটা আমাদের ফেলে রেখে ছুটে পালালো। জাপানী গাড়ীটা এতক্ষণ চেনে প্রতিবেশীর মতো ছিল আমাদের সাথে। বিদেশের ঠাকুর ফেলে দেশের কুকুর ধরতে অনেক দূর যেতে হয় তবে! জাপানের ভৌগলিক অস্তিত্ব মজগের পাশে কানের মতো মাথায় ছিল। কিন্তু কখনো আপন কিছু মনে হয়নি। দূর প্রবাশে এখন জাপান কতো কাছের! এমনও হতে পারে যে; এই উন্নত বিশ্বের কোন কিছুর সাথে পাল্লা দেবার সাধ্য কেবল আমাদের এশিয়ান এই প্রতিবেশীরই আছে। গরীবরা অকারণেই ধনী আত্মীয়ের গৌরব করে।

চলবে...


মন্তব্য

বলাই(যাচাই করা হয়েছে) এর ছবি

বাসের ছাদে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছেন, হা হা হা!
ডঃ ইউনুসের নোবেল পাওয়ায় আমরা যেকারণে গর্ববোধ করি, গরীবের ধনীপ্রতিবেশীর জন্য গর্ববোধ করাও কাছাকাছি জিনিস। মানুষ সফল হওয়ার জন্য যুক্তি খোঁজে, এগুলোও যুক্তির খঁড়কুঁটো।

এটা আর আগের পর্ব পড়লাম। শুরুর গুলো পড়তে হবে। চলুক।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ বলাই,
বাসের ছাদেই তো বেশীরভাগ ভ্রমন করে এসেছি। পেছনের বাম্পারে দাড়ানোটা ছিল বিলাসিতা, কারণ ভাড়া না দিয়ে নেমে যেতে পারতাম। ঢাকায় এসে রামপুরা-সদর ঘাট লাইনের বাসে দেখেছি পেছনের বাম্পারটা নাই।
আর এখানে এসে দেখি পুরাই ফাঁকা!

ডঃ ইউনুসের নোবেল পাওয়ায় আমরা যেকারণে গর্ববোধ করি, গরীবের ধনীপ্রতিবেশীর জন্য গর্ববোধ করাও কাছাকাছি জিনিস। মানুষ সফল হওয়ার জন্য যুক্তি খোঁজে, এগুলোও যুক্তির খঁড়কুঁটো

খুব ভাল লাগল আপনার পর্যবেক্ষণ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

চমৎকার লাগলো ভাইয়া, একটানে পড়লাম...............অবশ্যই চলবে................. চলুক


_____________________
Give Her Freedom!

পুতুল এর ছবি

আগের পর্বে করা মন্তব্যের জবাব এখানেই দিচ্ছি;
আসলে সচলাতনের সবাই আমার কাছে বস। যে যার ক্ষেত্রে এত এগিয়ে আছেন, গর্ব হয় যে আমার মত মূর্খও এখানে লেখার সুযোগ পাই। তাই বস বলেছিলাম। ভইয়া যখন বলেছেন তখন আর এই সম্বোধন করব না।
সাথে আছেন জেনে ভাল লাগছে কবি।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

ভাইয়া, আপনি যদি নিজেকে মূর্খ বলেন এত সুন্দর লিখেও, তাহলে আমি যে নিজেকে কী বলবো ভেবে পাই না।

অবশ্যই সাথে আছি। আর পরের পর্ব 'মজারু' হবে বলেছেন, এখন তো আরো উৎসুক.............. হাসি

শুভেচ্ছা নিরন্ত।


_____________________
Give Her Freedom!

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই,
এই এতটুকু লেখাও সচলায়তনেরই দান।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কল্যাণF এর ছবি

আরে পুতুল ভাই কি যে কন! আমি এক ওতি লো-লেভেলের প্রাণী, কোন ক্ষেত্রেই আগায়া নাই দেঁতো হাসি । এটলিস্ট আমারে তো পাইলেন আপনার নিচে। সুতরাং এইসব আর কইয়েননা। আমি কিন্তু শির উচ্চ রাইখা সমানে আপনাদের লেখা পড়তেছি আর মন্তব্য করতেছি।

পুতুল এর ছবি

ঠিক আছে আর কমুনা।
আমি কিন্তু শির উচ্চ রাইখা সমানে আপনাদের লেখা পড়তেছি আর মন্তব্য করতেছি।
ঠিক কাজ করছেন। (আমারটা বাদ দিয়ে) সচলায়তনে অনেক অনেক ভাল লেখা আসে।
কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেও লিখুন। লিখতে লিখতেই একদিন...

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কল্যাণF এর ছবি

পুতুল ভাই, আপনার পোষ্টের সাথে লেগে আছি, ভাল লাগছে পড়তে, চলুক।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ কল্যাণ,
তীর্থের কাক কী ভাবে তীর্থে এলো, এই নিয়ে আরো দু'টি পর্ব হতে পারে। পাঠকের ধৈর্যের কথা ভেবে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করেছি।
আর দু'টি পর্ব পরেই ঘটনা একটু মজারু লাগতে পারে।
শুভেচ্ছা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কল্যাণF এর ছবি

পুতুল ভাই, তীর্থের কাকের অভিযান আমার খুব ভাল লাগছে। এধরনের ঝুঁকিবহুল, সংঘাত আর কঠিন পরিশ্রমের দিনপঞ্জি পড়তে অসাধারন লাগে আমার। সত্যি বলতে প্রেরণাও পাই। এ যেন নিরন্তর যুদ্ধ। নিজের সাথে মিলও খুঁজে পাই বেশ।

পুতুল এর ছবি

এ যেন নিরন্তর যুদ্ধ।
চমৎকার কথা। কুড়ি বছর পরেও মনে হয়, সেই প্রথম দিনের মত যুদ্ধ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তাসনীম এর ছবি

অনেক আগে প্রথম দু-তিনটি পর্ব দিয়েছিলেন। এর পর আমাদের তীর্থের কাকের মত বসিয়ে আপনি উধাও। আজ আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম। আশাকরি এখন পর্বগুলো দ্রুতই আসতে থাকবে।

জীবনের গল্প কল্পনাকে হার মানায়। অপেক্ষায় রইলাম।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

পুতুল এর ছবি

আপনাদের যাতে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা না করতে হয় সে চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ তাসনীম ভাই।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

খুব ভালো লাগছে জীবনের গল্প শুনতে। সাথে আছি।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ আসমা খান,
শুভেচ্ছা নিন।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

পাগল মন এর ছবি

পুতুল ভাই, প্রথমেই ধন্যবাদ এত তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দেওয়ার জন্য।

পড়ছি। মজারুর জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ পাগল মন।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তারেক অণু এর ছবি

চলুক চলতে থাকুক

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ তারেক অনু।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

রিশাদ_ময়ূখ এর ছবি

চমৎকার লাগল পড়তে

পুতুল এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ রিশাদ_ময়ূখ আপনাকে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।