ভাষা ভাবনা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২২/১০/২০১১ - ১:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শুরুতেই বলে নেই, আমি লেখাটা শুরু করেছিলাম তাসনীম ভাইয়ের শিশুপালন-১২ এর একটা প্রতিমন্তব্য করতে গিয়ে। দৈর্ঘ্য বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে মনে হল, পোস্ট দিয়ে দেই, দেখা যাক আলোর মুখ দেখে কিনা। হলে তো উদ্বোধন করেই ফেললাম।

আমি ওনার লেখার বিশেষ ভক্ত (অনেকের মাঝে একজন আরকি)। শিশুপালন কিংবা মার্কিন মুল্লুকে পড়তে পড়তে প্রায়ই আনন্দিত হই, বর্ণনার গুণে ঘটনাগুলো যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাভাষার কথা এলেই একটু হলেও খারাপ লাগে, মেয়েদুটো মোটামুটি পুরোই ভুলে গিয়েছে শুনে।

আমি নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছি, প্রবাসে এসে ছেলেমেয়েরা যদি বাবা মায়ের ভাষা ভুলে যায়, তাহলে আমার নিজের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত? যুক্তি কি বলে?

যুক্তি বলে ভুলে যাওয়া খুব স্বাভাবিক, একেবারে প্রথম কথা হচ্ছে, বাঙ্গালী বেশ ভুলোমনা জাতি। কোন কারন ছাড়াই যে কোন কিছু ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের একটা আর্টবিশেষ। আর এখানে তো কারন রয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ স্কুল, হাসপাতাল, দোকান, প্রতিবেশী, পার্ক, সিনেমা সবখানেই স্থানীয় ভাষা (যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পড়ুন ইংরেজী) চলে, এমনকি বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও দেখা যায় অনেকে স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে বেশি ভালু পান, কারন তাদের বাংলাতে কড়া আঞ্চলিক টান রয়েছে (টান ছাড়াও বাংলার প্রতি একটা অবহেলাও দায়ী হতে পারে, আমি ঢাকার অনেককে চিনি যারা অপ্রয়োজনে ইংরেজী বলে, শুধু ইংরেজী বেশি জানে এটা প্রমানের জন্য। এইজাতীয় লোক বিদেশে এলে মুখ দিয়ে বাংলা বলতে চায় না)। বিদেশে বাংলার চর্চা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই ব্যবহার করার যায়গা সীমিত বলে। পরিস্থিতিই বাধ্য করছে বাংলা ভাষাকে দ্রুত ভুলে যেতে।

তৃতীয়তঃ বাংলা ভাষার কোন অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই, বাংলাভাষা জানার কারনে কাউকে বিশেষ কোন সুবিধা দেয়া হয় না। যারা বাংলাদেশে ছিলেন তাদের কাছে বাংলা যতখানি প্রিয়, প্রবাসে জন্ম নেয়া বা খুব ছোট থেকে বেড়ে ওঠা কারো জন্য তা ততখানি প্রিয় নাও হতে পারে। বাচ্চাদের আসলে দোষ নেই। তবে কি দোষ বাবা মায়ের? তারও আগের প্রশ্ন, আদৌ কি এটা দোষ? আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, দোষ নির্দোষের ব্যাপার নয়, ব্যাপার দৃষ্টিভঙ্গি ও মুল্যবোধের। যিনি ঠিক করেছেন বাংলাদেশের বাইরে স্থায়ী হবেন, তিনি দেশের টান থেকে মুক্ত হয়েই সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছেন। বাংলাদেশ আসলে তার দেশ নয়, বাংলাদেশ তার জন্মস্থান মাত্র। নতুন ভুখন্ডের প্রতি ভালোবাসা কিংবা আকর্ষন কে কি দোষ বলা যায়? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ মাইগ্রেট করছে, দেশ বদলানো মানেই কি দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা? আমি অল্প বুদ্ধিতে বুঝে উঠতে পারি না। যদি ধরে নেই এটা খারাপ কিছু নয়, সেক্ষেত্রে ভাষা বদলানো দোষের কিছু হওয়া উচিত নয়। আবার এটাকে স্রেফ মুখের কথায় খারাপ বলেও ধরে নেয়া যাচ্ছে না, তাহলে শুধু বাংলাদেশী নয়, সারা দুনিয়ার সব স্থায়ী প্রবাসীকেই খারাপ বলতে হয়। খারাপ বলতে হয় তাদেরও যারা প্রতিনিয়ত সুযোগ খুঁজছে নিজের দেশ ত্যাগ করে অন্য কোন দেশে পাকাপাকিভাবে চলে যাওয়ার, তা সে যে কারনেই হোক। এত সহজ বোধহয় না ব্যাপারটা। ভালো কে ভালো বলতে কারন লাগে না, কিন্তু খারাপকে খারাপ বলতে হলে লাগে।

আমার দুর্বল যুক্তিগুলো বলছে, আমার প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত উদার এবং সহনশীল। কে কি ভাষা বলবে এটা তার একান্তই নিজের ব্যাপার। আমি বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছি ঠিকই, কিন্তু আমি কি ফিরে যেতে চাই? আমি কি উন্নত দেশের সুযোগ সুবিধা কোনওভাবে ছেড়ে যেতে প্রস্তুত? আমি কি চাই আমার পুত্র দেশে ফেরত গিয়ে বাংলা ভাষাভাষী কোন স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করতে থাকুক? না, আমি চাই না, শেষেরটা তো কোনভাবেই না, দেশে আবার পড়ালেখা হয় নাকি? আমি তো কোন চ্যাবা, আমার দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই যখন অপারগ...............

কিন্তু আমার মন কেন যেন দুর্বল বা সবল কোন যুক্তিই মানতে চায় না। ফিসফিস করে বলে, “বাংলাভাষা ছাড়া কি বাঙ্গালী হয়? বাংলাভাষা ছাড়া কি বাংলাদেশের প্রতি কারো টান থাকে? তুই কি চাস তোর ছেলের গা থেকে বাংলাদেশের গন্ধ মুছে যাক? তুই কি চাস তুই মরে যাওয়ার সাথে সাথে তোর আর বাংলাদেশের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাক”? আমি বলি, “না, তা কেন হবে”? মন বলে, “তুই থাকবি বিদেশে, কথা বলবি বিদেশী ভাষায়, প্রত্যেক কথায় দেশের সিস্টেমের বদনাম করবি, তারপরও আশা করিস তোর ছেলে বাংলাদেশকে ভালোবাসবে”? আমি জোর গলায় বলি, “আমি ওকে নদীর গল্প বলব, নৌকার গল্প বলব, মেঠোপথ আর সোনালী ফসলের কথা বলব, ফেলে আসা দাদা-দাদী, নানা-নানী, খালা-ফুফু, চাচা-মামার কথা বলব, বৃষ্টির কথা বলব, শীতের পিঠা খাবার গল্প শোনাবো, জোনাকি আর চাঁদের কথা বলব। ও বাংলাদেশকে অবশ্যই ভালোবাসবে”। এই পর্যায়ে ফিসফিসানী বাদ দিয়ে মন উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তারপর হাসি সামলে বলে, “দেখা যাক। তিন চার বছর পরে এই আলোচনাটা আমরা আবার করব ঠিকাছে”?

অপ্রয়োজনীয় ভাবাবেগ বাদ দিই। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, প্রবাসে নিজের বা অন্যের ছেলেমেয়েকে বাংলায় কথা বলতে দেখলে যে অপরিসীম আনন্দ হয় সেটা কি কেউ অস্বীকার করবেন? আমার মনে হয় যদি কেউ চায় দেশের সাথে তার একটা যোগসুত্র থাকুক, সন্তানদের বাংলাভাষা শিক্ষা দেয়া একটা গুরুত্বপুর্ণ ধাপ। পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ রাখবে কিনা, এটা অনেকখানিই নির্ভর করবে তার প্রাপ্ত শিক্ষা আর ব্যক্তিগত অভিমতের কম্বিনেশনের ওপর। কিন্তু বিশেষ যত্ন নেয়া না হলে বাচ্চারা বাংলা ভুলে যাবে এটা একরকম নিশ্চিত।

সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখা শেষ করি, কিছুদিন আগে বেলজিয়াম প্রবাসী এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তিনি অনেকদিন যাবত দেশের বাইরে, বিয়ে করেছেন বেলজিয়ান এক শ্বেতাঙ্গিনী ভদ্রমহিলাকে। তাদের একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। পরিচিত হবার পর হ্যালো, হাউ আর ইউ বলে হাত বাড়িয়েছি, ভদ্রমহিলা বাড়ানো হাতটি ধরে বললেন, আসসালামুয়ালায়কুম, আমি ভালো, আপনি কেমন আছেন? বিস্মিত চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকাতে তিনি বললেন, “আপনাদের ভাবী খুব ভালো বাংলা বলে, শুধু তাই না, বেশিরভাগ বাংলাদেশী রান্নাই সে জানে”। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেমেয়ে? তিনি বললেন, “খুব জোর দাবী করব না, কিন্তু আমার হিসাবে ওরা শতকরা পঁচানব্বই ভাগ শুদ্ধ বাংলা বলে”।

অবাক হলাম। এই বাচ্চাগুলো ইংরেজীও বলে, পাশাপাশি তাদের মায়ের ভাষা ফ্লেমিশ তো আছেই। বোঝা যায় দম্পতিটি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিশ্রম করেছেন। “পরীক্ষায় রেজাল্ট খারাপ করবে” এই অজুহাতে বাচ্চাদের “অপ্রয়োজনীয় কাজে” সময় ব্যয় করা থেকে সরে আসেননি। বাচ্চারা রেজাল্ট খারাপ করেছে এমনও কিন্তু নয়।

তাদের এই প্রচেষ্টাকে জানাই সবিশেষ শ্রদ্ধা। আমার ভালো লেগেছে এবং বাচ্চার ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে আমি ওই ভদ্রলোকটিকে অনুসরন করার দৃঢ় আশা রাখি।

অঅসাধারন
২১ অক্টোবর, ২০১১


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

বাউণ্ডুলে এর ছবি

চলুক
ভাল লাগলো।

তাদের এই প্রচেষ্টাকে জানাই সবিশেষ শ্রদ্ধা। আমার ভালো লেগেছে এবং বাচ্চার ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে আমি ওই ভদ্রলোকটিকে অনুসরন করার দৃঢ় আশা রাখি।

সবারই এই রকমের প্রচেষ্টা থাকুক...

অঅসাধারন এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

যুমার এর ছবি

আপনার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আশা রাখি। চলুক

অঅসাধারন এর ছবি

পড়া এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।