মানুষের বিশ্বাস

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০৫/২০০৮ - ১১:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিশ্বাসীদের প্রধান অবলম্বন তাদের অন্ধবিশ্বাস, তাদের প্রধান দুর্বলতাও তাদের অন্ধবিশ্বাস। অন্ধবিশ্বাসের ছুঁড়িতে ফালি ফালি হয়ে যায় মানবিক বোধ, নান্দনিকতা, সৃষ্টিশীলতা, তবে অন্ধবিশ্বাসের অন্ধত্বের মত্ততা কাটে না তাদের।
সৃষ্টিশীলতারহিত একদল বিশ্বাসী আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মম হত্যার পন্থা বেছে নিচ্ছে অনায়াসে। এবং এতে তাদের মানবিকতাবোধ বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন হচ্ছে না। এমনই বিশ্বাসের জোর তাদের।
আদর্শিক জঙ্গীদের আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নির্মম বলি হচ্ছে যেসব নিরীহ সাধারণ মানুষ তাদের স্বজনদের জন্য সমবেদনা রইলো। আদর্শের অনুসরণ সবসময় সরল পন্থা নয়। প্রশ্নবিহীন আত্মসমর্পনের মানসিকতা না থাকলে কেউই আদর্শ আদর্শনিষ্ঠ কর্মি হয়ে উঠতে পারে না। কোনো আদর্শেই প্রশ্নকারী অনুসারিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেই। এইসব নীতিগত প্রশ্নকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানুষগুলো বিশ্বাসীদের নির্মমতায় আদর্শচ্যুত ভ্রান্ত এবং অচ্ছুত হয়ে পড়ে খুব দ্রুতই। যুক্তিনিষ্ঠ কোনো মানুষই দীর্ঘ মেয়াদে একটা নির্দিষ্ট আদর্শে ন্যস্ত থাকতে পারে না।

অমানবিকতার জন্য কোনোরকম মনঃস্তাপে পুড়ে না কোনো আদর্শিক জঙ্গী, শ্রীলঙ্কায় তামিল অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব মানুষ গায়ে বোমা বেঁধে ঝাপিয়ে পড়ছে জনসমুদ্রে তাদের এই আত্মবলিদানকে মহান বলছে তামিলঅধিকারবাদীরা। বিবাদীরা বলছে এটা নেহায়েত বর্বরতা।
ইসরাইলের বাজারে গিয়ে গায়ে বোমা বেঁধে মানুষ উড়িয়ে দেওয়া এবং নিহত হওয়া জঙ্গীকে সম্মানিত করা হচ্ছে, একই কারণে কিংবা এর প্রতিক্রিয়ায় ইজরাইলের বোমা হামলায় মারা যাচ্ছে নিরপরাধ মানুষেরা। ইজরাইলের নির্মমতায় মুক হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। ইজরাইল অবশেষে ঘোষণা দিচ্ছে- তাদের এই বর্বর হামলায় শুধু নিরপরাধ কেয়েকজন মানুষ মারা যায় নি, সাথে আরও একজন জঙ্গী নেতাও নিহত হয়েছে।
ইজরাইল নামক রাষ্ট্রের জাতিয়তাবাদী আদর্শ প্যালেস্টাইনের মানুষের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। এবং এর প্রতিক্রিয়া, পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় শুধু ভুল সময়ে ভুল স্থানে অবস্থানরত নিরপরাধ নিহত মানুষের তালিকা বাড়ছে।
একই ঘটনা ঘটছে ইরাকে, একই ঘটনা ঘটছে সুদানে, একই ঘটনা ঘটছে আফগানিস্তানে। এই আদর্শিক অনড়তা কখনও সুফল বয়ে আনে?
ক্রমাগত মৃত্যুর পরে হয়তো মানুষ একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থান চায়, সরকারও নেহায়তে আদর্শিক সংঘাতে ক্লান্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান চায়। নরওয়ে ব্রিটেন কিংবা অন্যসব উন্নত দেশ থেকে একজন শান্তি আলোচক গিয়ে সেই শান্তির বানীতে টিপ সই দিয়ে আসেন।
আদর্শ অবিচল থাকে। আদর্শের মৃত্যু হয় না। এমন সব অন্ধবিশ্বাসীদের কাছে নিজের বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠতের গরিমা অনেক বেশী, তারা অনেক দুর যেতে রাজি এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠায়। নিজেদের অমানবিকতা তাদের ভেতরে বিন্দুমাত্র অনুশোচনার জন্ম দেয় না।

বিশ্বাসীর জিহ্বা আর চেতনার তরবারী মাঝে মাঝে আদর্শের পরবর্তকে উপরে গিয়ে পড়ে। তাদের অমানবিকতার ভেতরে তারা বিশ্বাসের অবস্থান খুঁজে পান সহজেই।
মুহাম্মদের জীবনের সবচেয়ে করুণ বিষয় ছিলো , সে একাধারে ধর্মপ্রচারক, নিজেকে শান্তির সপক্ষের লোক বলতে বাধ্য হচ্ছে এবং একই সাথে তাকেই তার জীবনদশায় কঠোর বিশ্বাসীদের হঠকারিতার মুখোমুখি হয়ে তাদের শান্ত করতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
একই সাথে যে বিচারক এবং বিধির প্রতিষ্ঠাতা। এবং মাঝে মাঝে তার মানবিকতার বোধ সেই বিধিকে ভঙ্গ করতে তাকে প্রলুব্ধ করছে।

এমন সব সময় কঠোর বিশ্বাসীরা তাকে ভিন্ন রকম প্রতিরোধের মুখোমুখি করছে। মুহাম্মদ কোনো এক সময় ঘোষণা দিয়েছিলো অবিশ্বাসীদের সৎকারে বিশ্বাসীরা অংশগ্রহন করতে পারবে না। পুত্র পিতার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় নি এমন অনেক পরিবারই ছিলো। যেসব পরিবারের পিতারা পৌত্তলিকতা ছাড়ে নি কিন্তু তাদের সন্তানেরা ধর্মান্তরিত হয়েছে। তাদের জন্য পিতার মঙ্গলকামনা করে বিশ্বাসীদের নেতার কাছে অনুরোধও পৌঁছাতো না বিশ্বাসীদের জঙগী মনোভাবের কারণে।
তবে মুহাম্মদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রজিক উপাখ্যান হলো তার সন্তানহীনতা।

মুহাম্মদ অনেকগুলো সন্তানের পিতা ছিলেন, তবে একমাত্র ফাতিমা ভিন্ন অন্য কোনো সন্তান দীর্ঘজীবি হয় নি, ফাতিমার মৃত্যুও হয়েছে ৩০ বছর বয়েসের আগেই, সুতরাং এটা বলা যায় মুহাম্মদের জীবনে সন্তান হারানোর কষ্ট অনেক বার সহ্য করতে হয়েছে তাকে।

তবে আলাপচারিতা প্রসঙ্গে যখন বিশ্বাসীরা বলে বসে মুহাম্মদ নিঃসন্তান ছিলেন আল্লাহর অভিপ্রায়ে তখন এই ইশ্বরকে আমার ভ্রান্ত মনে হয়। ইশ্বর তার পেয়ারা বান্দাকে বারংবার সন্তানহারানোর কষ্ট দিচ্ছেন। এটার চেয়ে নির্মম ইশ্বরের ছবি আর কোথায় পাওয়া যাবে।

বিশ্বাসীরা ইশ্বরের এই কঠোরতার যৌক্তিকতাও খুঁজে পাচ্ছেন এই সান্তনাবলে-

যদি মুহাম্মদের কোনো সন্তান থাকতো তবে তাকে মুহাম্মদের কারণেই খলিফা বানানো হতো। সেটা শিশু ইসলামের জন্য ভালো কোনো বিষয় হতো না। যেনো মুসলিমরা একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের নেতা বেছে নিতে পারে তাই ইশ্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর আগেই তার সন্তানদের হত্যা করেছেন।

কথাটা প্রতিষ্ঠিত করবার ঝোঁক দেখে খানিকটা দমে যাই আমি নিজেই। নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠ পুরুষটিকে সামান্য অবমাননার জন্য যেই অন্ধবিশ্বাসীরা আগুন জ্বালিয়ে নগর পোড়াতে তৎপর তারাই আবার মোহাম্মদের প্রতি সামন্য সহানুভুতি বোধ করে না।
বড়ই আশ্চর্য এই মানবজীবন।
মোহাম্মদের জীবনে বাৎসল্যবোধের কমতি ছিলো না । এমন কি ফাতিমার ব্যপারে তার বাৎসল্য বোধ কোরানের আদেশকেও অমান্য করতে প্রলুব্ধ করেছে তাকে। শেষ পর্যন্ত কোরানের বানীর স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করেও তাকে মানবিক পিতৃত্ব দেখাতে হয়েছে।
একই মুহাম্মদ যখন তার শিশুপুত্রের মৃত্যুর পরে ঘোষণা দিচ্ছে আমি নিশ্চিত এতক্ষণে বেহেশতের দাইয়েরা তার দেখভাল শুরু করেছে। সেখানেও এক পিতার আর্তি বুঝা যায়, তার পিতৃত্বের কোমলতা বুঝা যায়।
মৃত সন্তন যে তাৎক্ষণিক বেহেশতে যাবে না এটা সে নিজেই জানতো। সে নিজেই এই কথা প্রচার করছে সব সময়, তবে তার সন্তানের মৃত্যুর পরে তার প্রথম ভাবনা ছিলো মৃত্যুর পরে এই শিশু সন্তনের দেখভাল করবে কে? ইশ্বরে প্রণত মুহাম্মদ প্রথমেই ধরে নেন এই শিশুকে কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই স্বর্গে স্থান দেওয়া হবে এবং সৎকারের পরপরই এই কাজ সমাধা হয়েছে।

ধন্য মানুষের বিশ্বাস। তারা মোহাম্মদের এই পিতৃত্ববোধকে অস্বীকার করে, কোনো গুরুত্ব না দিয়েই নেহায়েত শিশু ইসলামের আদর্শের কলুষতা মুক্তির জন্যই মুহাম্মদের সন্তানের অকালমৃত্যুকে ইশ্বরের অভিপ্রায় ভাবছেন এবং এই কথা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

খুবই ভাল লিখেছেন । 'ইশ্বর' বানানটা কি ইচ্ছাকৃত ?

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মুশফিকা মুমু এর ছবি

আসলেই খুব ভালো লিখেছেন, অনেক কিছু জানতাম না। হাসি জানতে পারলাম।
--------------------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍--@

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটি পড়ে ভাল লাগল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

~~~টক্স~~~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।