হুমায়ূননামা: দুটি কথা, একটি উদাহরণ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: বুধ, ১৪/১১/২০০৭ - ৮:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই লেখাটি অনেকদিন আগেই লিখা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে অন্য এক সচলও প্রায় একই সময়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তাঁর লেখা আমার আগেই সচলায়তনে পোস্ট করে দেন। ফলে আমি সেসময় লেখাটি পোস্ট করা থেকে বিরত থাকি। আজ বেশ কদিন পরে কৌতূহলী সেই সচলের আগ্রহ দেখে এটি সচলায়তনে প্রকাশ করলাম। লেখাটিতে প্রকাশিত বক্তব্য আমার একান্তই নিজের। লেখাটির ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে পুরাপুরি ধারনার জন্য নিচের লেখা-দুটিতে ঢুঁ মারতে পারেন
১। অনিকেতের ব্লগে
২। অতিথি লেখকের ব্লগে

ভূমিকা
বাংলা সাহিত্যে থাকবে কী-না জানিনা, তবে আমি নিশ্চিত বাংলা সাহিত্য পাঠকের মনে হুমায়ূনের নাম থাকবে দীর্ঘকাল। আর সেটা হবে হুমায়ূনের রচনা ও তার রচিত উল্লেখযোগ্য কিছু নাটকের গুনে। হুমায়ূন বড় না ছোট লেখক তা নিয়ে অন্তহীনভাবে বিতর্ক করা যাবে। অন্তত সেভাবেই হয়ে এসেছে। আমি নিজেও একটা সময় বহু হুমায়ূন হুমায়ূন করেছি। এখনো হুমায়ূনের বই হাতে পেলে অন্য সব বাদ দিয়ে সেটা পড়তে বসব তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু লেখক মানেই সম্ভবত কল্পবিলাসী। তাই হয়তো সত্যের সাথে কল্পনার (বা মিথ্যার) অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তারা পাঠককে ভুলিয়ে তাদের হৃদয়ে একটা আসন গড়ে তোলেন। পাঠকও তার মনোসিংহাসনে লেখককে দেয় যথাযথ স্থান। হুমায়ূন সম্ভবত সেদিক থেকে সবচেয়ে স্বার্থক। তাঁর লেখায় নাকি সাহিত্যের অলঙ্কার নেই-- আমি বলি হুমায়ূনের সাধারণ কথাই তার লেখার অলঙ্কার; তোমার ভাল না লাগলে তুমি পড়োনা। হুমায়ূন কাউকে সেধে এসে তাঁর বই পড়তে বলেননি। তার লেখায় একঘেয়েমি মাদকতা আছে, তবুও ভাল লাগত; হয়তো এখনো লাগবে।

লেখক-সত্বা বনাম ব্যক্তি-সত্বা: পাঠকের চোখে
লেখকের লেখাকে একেকজন পাঠক একেকভাবে নেয়। কেউ লেখক-সত্বার সাথে লেখকের ব্যক্তিগত জীবন একাকার করে দেখতে চায়। এই বোধ পাঠক ইচ্ছে করে আনেনা, এই বোধ আসে নীরবে। বোদ্ধা পাঠক হয়তো এটাকে অনভিপ্রত ভাববেন; কিন্তু কারো নিজস্ব চিন্তাভাবনা করার, নিজের মত করে লেখককে দেখার অধিকার আছে। হুমায়ূন শুধু একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নন, তাঁর লেখা কেবলমাত্র উপন্যাস হিসেবেই পাঠক পড়েনা; হুমায়ূনের বিভিন্ন লেখায় নানা সময়ে তাঁর বর্তমান-পূর্ব ব্যক্তিগত জীবনের দিকগুলি নানা ভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে তাঁদের সংসারের হাসি-কান্না, আনন্দ বেদনা, সন্তানদের সাথে তাঁদের সম্পর্কের বিষয়গুলি এমনভাবে তিনি লিখতেন যে সাধারণ পাঠক হুমায়ূনের পরিবারকে নিয়ে একটা সুন্দর চিত্র কল্পনা করতে বাধ্য। সেই হুমায়ূন যখন আগের স্ত্রীকে তালাক দেয়ার জন্য লেখেন "বিয়ের পর থেকেই তাঁর সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না" তখন সাধারণ পাঠক বিভ্রান্ত হয়, ভেঙে যায় তাদের স্বপ্নছবি। সেই পাঠক যদি হুমায়ূনের বর্তমান ব্যক্তিজীবন নিয়ে দুই কথা বলে, তাকে কি খুব দোষ দেয়া যায়?

হুমায়ূন তাঁর প্রথম দিকের কোন এক লেখায় বলেছিলেন তিনি শুধু নিজের জন্য লেখেন, অন্য কে কী ভাবল তা নিয়ে তিনি ভাবেননা। এটা লেখকের অহংবোধের একটা পরিচায়ক। সম্ভবত সব লেখকই তার জনপ্রিয়তার শুরুর দিকে এমন কথাই বলেন। সেই হুমায়ূনই তাঁর নব-পরিণয়ের পরে যখন পাঠকের ক্ষোভে নানা ভাবে আক্রান্ত, তখন পত্রিকার মাধ্যমে প্রশ্ন রাখেন "আমি কি তাদের জন্য কিছুই করিনি?" সম্ভবত তিনি তাঁর সৃষ্টির প্রতি নির্দেশ করে পাঠকের মনোকষ্টকে লাঘব করার প্রয়াস নিয়েছিলেন।

পাঠকপ্রিয়তার উদাহরণ
হুমায়ূন কতটা জনপ্রিয় তার একটা প্রমান দেই। আপনারা যাঁরা ফটোগ্রাফি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন বা করেন তাঁরা জানেন গোলাম কাশেম ড্যাডী'র কথা। রোকেয়া সরনী আর ইন্দিরা রোডের সংযোগস্থলে "ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব" নামে তাঁর একটা ক্লাবের মত কিছু ছিল। সম্ভবত ওটাই তাঁর বাসা। তখন আমি কলেজে পড়ি। রিয়াজ স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতাম হেঁটে হেঁটে। তল্লাবাগ থেকে ফার্মগেট পার হয়ে রেলস্টেশনের কাছাকাছি স্যারে বাসা প্রায় আধা ঘন্টার পথ। শুক্রবারে জুমার পরে ভর দুপুরে ওই পথ দিয়ে হাঁটতে আমার অসাধারণ লাগত। যাই হোক, সেই গোলাম কাশেম ড্যাডীকে একদিন দেখেছি বাইরে বারান্দায় বসে হুমায়ূনের বই হাতে। ঠিক মনে নেই, তবে "মেঘের ছায়া" বা এ ধরনের নামের একটা বই সেসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন আমি কিভাবে নিশ্চিত ছিলাম ওটা হুমায়ূনের বই। আমি বলব ভালই নিশ্চিত ছিলাম। কারণ হুমায়ূনের বইয়ের পোকা ছিলাম আমি। প্রচ্ছদ দেখে আমার মনে হয়েছিল ওটা সেই বই। ওই চিত্র আজো আমার মনে আছে।

শেষকথা
গোলাম কাশেম ড্যাডি মারা গিয়েছেন অনেকদিন হয়। সময় অনেক গড়িয়েছে। পুরানো পাঠক হয়তো বলবেন হুমায়ূন আগের মত আর লেখেননা। কিন্তু নতুন পাঠক কি একই রকম ভাবছে? হুমায়ূনের লেখার ধরন হয়তোবা বদলেছে, বিংবা বদলায়নি; কিন্তু ব্যক্তি হুমায়ূন তো বদলেছেন অনেকটাই। একজন সামান্য পাঠক তাতে কষ্ট পেলে লেখকের কি?


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

চমৎকার লাগল।

তীরন্দাজ এর ছবি

লেখকের রচনা আর তার ব্যক্তিগত জীবনকে জড়ানো অনেক সময়েই বিভ্রান্তি আনে। মনে হয় লেখকের প্রতিও এক ধরণের অবিচার।

আমি নিজেই একবার প্রতিষ্ঠিত এক লেখকের সাথে পরিচিত হবার পর কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য কাটিয়ে নিতে পেরেছি।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

বিপ্রতীপ এর ছবি

লেখাটা পড়লাম...ভালো লাগলো...একটা কথা খুব ভালো লেগেছে...

একজন সামান্য পাঠক তাতে কষ্ট পেলে লেখকের কি?

হুমায়ুন আহমেদের 'মধ্যাহ্ন' বইয়ের রিভিউ লিখেছিলাম সচলায়তনে...সেখানে এ নিয়ে আমিও কিছু মতামত লিখেছিলাম

তানভীর এর ছবি

হুমায়ুন আহমেদের বই অনেক দিন পড়া হয় না। অনলাইনে মাঝে মাঝে নাটক দেখি। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আর দেখতে পারি না, এতই অ-খাদ্য। মনে হয় তার ব্যক্তিজীবনের ছাপ, তার কর্মজীবনেও পড়েছে। আমার দুই পয়সার অভিমত।

পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

========
"পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে আমি, পথহীন পথে"

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

গোলাম কাশেম ড্যাডি'র উদাহরণ দিয়েছি অত্যন্ত বয়সকালেও তাঁকে হুমায়ূনের বই পড়তে দেখে। এটা হুমায়ূনের পাঠকপ্রিয়তার একটা বড় উদাহরণ হিসেবে আমি মনে করি।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অলৌকিক, আপনার মন্তব্য পড়ে নতুন অনেক কিছু জানলাম। হ্যাঁ, 'তুই রাজাকার' হুমায়ূনেরই সৃষ্টি।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

সর্বতোভাবে সহমত আপনার মন্তব্য/অনুভূতির সাথে। বড় করে লিখে আমার কষ্টটা বাঁচিয়ে দিলেন। খাইছে

??? এর ছবি

দুইটা জিনিস ঘটে বিদ্বত্ সমাজে। এক, কোনো কিছু জনপ্রিয় হয়ে গেলে সুধীসমাজ তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। আর, কেউ আইকন হয়ে গেলে তার শিল্প ও ব্যক্তিগত জীবনকে আমরা সাধারণ পাঠকেরা সমার্থক/সিনক্রোনাইজড ভাবতে আরম্ভ করি। এই দুইই ঘটেছে হুমায়ুনের ক্ষেত্রে, দুর্ভাগ্য তার, কারণ এই দুয়ের কোনোটাই তিনি ডিজার্ভ করতেন না।
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!

বিপ্লব রহমান এর ছবি

অনেকদিন হুমায়ুন আহমেদ পড়া হয় না। এমন কি তার নাটক দেখাও সময় পাই না। ...

হুমায়ুন আহমেদের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে আহমদ ছফার একটি কথা মনে পড়ে গেলো। ...

১৯৯২ সালে আমি সাপ্তাহিক প্রিয় প্রজন্মের জন্য আহমদ ছফার একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম (পরে ব্রাত্য রাইসুর সম্পাদনায় তার সাক্ষাতকারভিত্তিক একটি বইও প্রকাশিত হয়। সেখানেও সাক্ষাতকারটি আছে। শিরোনাম -- আমার লেখা এখন অনুবাদ করার সময় হয়েছে: আহমদ ছফা)।

তখন বই মেলায় লাইন দিয়ে হুমায়ুনের বই কেনার রীতি মাত্র শুরু হয়েছে।..

তো সেই সাক্ষাতকারে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কী মনে করেন হুমায়ুন আহমেদ এখন শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের সমান জনপ্রিয় লেখক?

জবাবে আহমদ ছফা মুচকি হেসে বলেছিলেন, হুমায়ুন আহমেদ এখন
শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের চেয়েও জনপ্রিয় লেখক। কিন্তু মেরিটের দিক দিয়ে সে নিমাই ভট্টাচার্যের সমান। হি রাইটস ওনলি ফর বাজার!


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।