হাসান মোরশেদ-এর শমন শেকল ডানা

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: শুক্র, ০৩/০৭/২০০৯ - ৮:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
প্রকাশক শুদ্ধস্বর
প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪+৬০
দাম ৯০ টাকা

মুক্তাদির ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, বিরাট প্রতিপত্তি তার। নাসিমা তার স্ত্রী, যিনি বিয়ের পর বিসর্জন দিয়েছেন তাঁর সব ইচ্ছে, আকাঙ্খা। অনিচ্ছায় নিজেকে জড়িয়েছেন বোরকার আবরণে। ঘুমের মাঝে নায়ক খুন করে সেই মুক্তাদিরকে। এভাবেই বইটির শুরু। পুরোটা পড়ার পরেই বুঝতে পারি গল্পের শেষ অংশটুকুই প্রথম লেখা হয়েছে, আর তা ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে বাকী কথামালা।

বইটা পড়তে পড়তে কখনো ভালো লাগেনি আবার কখনো ভালো লেগেছে। বর্ণিত কাহিনীর অতি ফিকশায়ন হয়তো ভালো না লাগার কারণ। আবার পরক্ষণেই ভালো লেগেছে, লেখকের লেখনীর শক্তিতে, ঘটনার চমৎকার বর্ণনায়।

টুপুরের সাথে নায়কের টুপুরটাপুর উপভোগ করার মতো, যদিও তার প্রতি নায়কের প্রচ্ছন্ন নিরাসক্তিটা টের পাওয়া যায়। সেটা হয়তো টুপুরের সামাজিক অবস্থানের কারণে। লেখক যেমনটা বলছেন:

টানা বারান্দা পেরিয়ে আমাকে নিয়ে আসা হয় যে ঘরে, সেটা ঠিক ড্রইং রুম নয়। অনেকটা ডাইনিং রুমের মতো। প্রায় বৃত্তাকার টেবিল ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার। একটু দূরে দামি সোফা ছড়ানো। প্লাজমা টিভি স্ক্রিন। একপাশে পুরো দেয়াল জুড়ে শোকেসের মতো। সম্ভবত পারিবারিক আড্ডা ও খানাপিনার ঘর এটা।

আমি কি এ পরিবারের কেউ?

টুপুর তার নায়ককে তার পরিবারে গ্রহণযোগ্য করতে অন্তপ্রাণ। নায়কের দ্বন্দ্বটা কিসে তা ঠিক পরিস্কার হয়নি। পুরো গল্পের মাঝেই নায়ক কেমন একটা নির্লিপ্ততা নিয়ে সবকিছু করছে, যেন এই আগ্রহ নেই তো আবার আগ্রহ আছে। যেমন, টুপুরদের বাড়িতে ছাদে উঠে যায় টুপুর ও গল্পের নায়ক--

এ পাশে তুমুল নির্জনতা। সন্ধ্যার ছায়া। ছাদের ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াই। টুপুরের কোমরে আমার হাত। ও মেয়ের শরীরের ঘ্রাণ পাই।

ও মেয়ের বলার মধ্যেই আমার মনে হয়েছে প্রেমটা একতরফা-- নায়ক তাকে কাছেও চাইছে না, আবার দূরেও ঠেলছে না। তার কোমর জড়ানোতে ভালোবাসা কিংবা কামনার চেয়ে সেই মুহূর্তে তার কাছে অন্যকিছু বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, যেটাও গল্পে পরবর্তীকালে উঠে এসেছে। এর প্রমাণ পাই পরবর্তী বর্ণনায়-

কোমরে জড়ানো হাত টান মেরে ও মেয়েকে নিয়ে আসি আমার বুকে... এরকম সময় বড় বেশি ভুল হয়। ভুল করে বুকে জড়াতে ইচ্ছে করে গোটা পৃথিবীকে।

নায়ক প্রাণপনে চেয়েছিল নাসিমাকে মুক্তি দিতে। যে মুক্তি নাসিমা হয়তো চায়নি। গল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক এটি। নায়ক চাইছে নাসিমাকে বুঝিয়ে তাকে বিয়ে-পূর্ব জীবনে ফিরিয়ে দিতে। সেকারণেই সিডির দোকানে দেখা হওয়ার পর নাসিমা বলে

কী বলব? বলার মতো কিছু তো নয়। মেয়েদের এরকম কত কিছু বদলাতে হয়। এ আর এমন কী?

নায়কের সিদ্ধান্ত বা মতামতকে অগ্রাহ্য করে নাসিমা চলে যায়। তখন নায়ক ভাবছে--

নাসিমা চলে গেলে আরো অনেকক্ষণ আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটে। কী আশ্চর্য, কোন তাড়নায় আমি এত প্রশ্ন রেখেছিলাম?

হাসান মোরশেদ তাঁর লেখনীর কাব্যিক ধাঁচ এ গল্পেও ছড়িয়ে দিয়েছেন। নাসিমার সাথে সেদিনের ঘটনার পরে আর দুদিন দেখা হয়নি। পাঠকদের জন্য বলা দরকার যে, নায়ক নাসিমার ছোট মেয়ে মায়িশাকে পড়াতে যেতো। দুই দিন পরে নাসিমার সাথে তার আবার দেখা হয়। নাসিমা তার পুরনো কথার ডালি খুলে দেয়, বলে যায় তার বিয়ের গল্প, তার আগের জীবনের গল্প। তারা একসাথে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল তখন।

হু হু তুমুল বাতাস অপার্থিক আবহ তৈরী করে। জমাট বাঁধা অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়ায়। বৃষ্টি, তুমুল বৃষ্টি ভেতরে বাইরে। বৃষ্টিস্নাত সেই সন্ধ্যায় আমার হাত স্পর্শ করে এক থোকা বিজনব্যথা, মাটির ফুলদানি।

পুরো কাহিনীর বেশ কয়েক জায়গায় লেখক ঘটনার উল্লেখ করেছেন আগে, তার পরে হয়তো তার বর্ণনা দিয়েছেন। মুক্তাদিরকে খুন করার ঘটনা যেমন একদম প্রথমেই বলে ফেলেছেন, তেমনি মাটির ফুলদানি বুঝতে আমাকে পরের অধ্যায়ে যেতে হয়েছে। যেখানে লেখকের বর্ণনায়--

আমি জানতে থাকি তার চুলের খোঁপা, খোঁপায় বাঁধা বেলি ফুলের মালা, সাদা শাড়ির আঁচল, টানটান দুধসাদা ব্রা'র বাঁধন, তার ভেতরে সাজিয়ে রাখা আশ্চর্য ঘ্রাণময় মাটির ফুলদানি।

এর পর নাসিমার সাথে নায়কের আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি, তার মেয়েকেও আর পড়াতে যায়নি।

বইটির সাত এবং নয় নাম্বার অনুচ্ছেদ আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। লেখক তার সমস্ত ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে এই অধ্যায়গুলো লিখেছেন। মনে হয়েছে লেখক একদম সামনে থেকে দেখেছেন ঘটনাগুলো। পাঠককেও তাই সেখানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন তার লেখনীর মুন্সিয়ানায়। নতুন পাঠকের স্বার্থে সেগুলোর বর্ণনা আর এখানে তুলে না দেই।

লেখক কবিতা ভালোবাসেন তার যথেস্ট প্রমাণ দিয়েছেন বইটির অধ্যায়ে অধ্যায়ে। তুলে দিয়েছেন তাঁর প্রিয় কবিতার অংশবিশেষ। কাব্যিক বর্ণনাও এসেছে মাঝেমধ্যেই। মুক্তাদির তেলতেলে হাসেন, চিটচিটে হাত বাড়িয়ে ঝাঁকান এমনই একটা উদাহরণ। কিংবা টুপুরের রাগ ভাঙাতে নায়ক বলছে-- মেয়েকে ভাঙলে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না, আমি তাকে ভাঙতে এবং গড়তে জানি ভালোবাসা দিয়েই--সত্যিই অসাধারণ।

বইটি আকারে ছোট হওয়ার কারণে দাম কম রাখা গিয়েছে বলে প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই। কম্পোজ করার পরে আর রিভিউ হয়নি সেটা বেশ বোঝা যায়। দাঁরি দেয়ার পরে প্রায় সবখানেই স্পেস দেয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় কোন যতি চিহ্নই বসেনি, অথচ দরকার ছিলো। যুক্তাক্ষরগুলো, বিশেষ করে "ন্ড"-গুলো একবারো ঠিকমতো আসেনি। কোথাও কোথাও অযাচিত লাইনব্রেক হয়েছে (পৃ ২৮, দ্বিতীয় প্যারা, লাইন ৩)।

ধর্মের কিছু কিছু উদাহরণ আরোপিত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে ইচ্ছে করেই এসব প্রশ্নের অবতারণা, যেগুলোর পারিপার্শিক অবস্থাভেদে অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। হয়তো চরিত্রের সাথে মানানসই ভেবেই লেখক সেগুলো এনেছেন, তাই কোন অভিযোগ নেই। ধর্মের ব্যাপারে আমার রিজার্ভেশন আছে; সেটা বাদ দিলে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বহুদিন পর অলংকার সমৃদ্ধ একটা সাহিত্য পড়া হলো। ধন্যবাদ মোরশেদ ভাই চমৎকার এক বই আমাদের উপহার দিয়েছেন বলে।


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

চিন্তাভাবনার প্রকাশ সুন্দর হয়েছে, বুলবুল ভাই। হাসি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মামুন হক এর ছবি

তোরা যে যাই লিখিস আমি কোন রিভিউ পড়ব না, হাসান ভাই আমাকে বইটা পাঠাবেন বলেছেন, হাতে পেলে পড়ে নিজে রিভিউ লিখব দেঁতো হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আমার ভালো লাগে উপমা, ভালো লাগে শব্দের অলংকার, সেজন্যই আমার ভালো লেগেছে। তুই পড়ে তোর মতো রিভিউ করবি। তার আগে না পড়াই ভালো।

মামুন হক এর ছবি

তবু বন্ধু হিসাবে তোকে তারা দিয়ে গেলাম , এখন যাই গিয়ে হাসান ভাইকে তাড়া দেই হাসি

কনফুসিয়াস এর ছবি

আপনার রিভিউ ভাল লাগলো। আমি সদ্যই পড়লাম বইটা। তাই মাথায় যা কিছু এসেছে লিখে ফেলেছি।
আপনারটা পড়ে বুঝলাম, আমি বোধহয় একটু কাঠখোট্টা আছি। হাসি
-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

না বস, আপনারটায় পুরা গল্পের সামারি হয়েছে। আমি দেখেননা আসল জিনিস বাদ দিয়ে কী রিভিউ দিলাম চোখ টিপি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

সেদিন উইন্ডজরে শমন শেকল ডানা পড়া শেষ করেই প্র/প্রে ভাইকে বলছিলাম -
১) এই বই নিয়ে সচলে যতো আলাপ হওয়া দরকার ছিলো ততো হয়নি
২) বইমেলার সময় নানান রিভিউয়ে বলা অতি ফ্যান্টাসী বা অতি শরীরির কিছু আমার চোখে লাগেনি।

ভালো লাগলো - পরপর দুটো রিভিউ আসলো কনফু এবং প্র/প্রে ভাই থেকে। দুজনকেই জাঝা।

একটা বই পড়ে পাঠক নানান মন্তব্য দিবেন, নানান কোণ থেকে ঘটনা দেখবেন, নিজের মতো করে সাজাবেন - এটাই স্বাভাবিক। তবুও আমি প্র-প্রে ভাইয়ের কাছে জানতে চাই - 'বর্ণিত কাহিনীর অতি ফিকশায়ন' ঠিক কোন অংশটা? কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়, স্রেফ আগ্রহ থেকেই জানতে চাওয়া, খুব কাছাকাছি সময়ে আমরা বইটি পড়লাম বলেই জানতে চাওয়া। প্র-প্রে ভাই শুধু ঘটনার ক্লু দিলেই চলবে হাসি

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হা হা এটাতো তোমাকে বলেছিই-- হাসপাতালে কবিতার দেয়া তথ্যটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। তার পর তোমার সাথে আলোচনা হলো, পরে ভাবলাম হতেও পারে।

রিভিউ লেখার সময় বইটি পড়ার পরে আমি কী ভেবেছিলাম সেটাই লিখে দিয়েছি। তোমার সাথে বা কারো সাথে আলোচনা করে যতটা প্রভাবিত হয়েছি তা এখানে আসতে দেইনি হাসি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ওহ! আচ্ছা..., মনে পড়েছে।
ঠিক আছে... এবং থ্যাঙ্কু!

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কিছু জানতে পারছি,,,খুব ভালো লাগছে

সুমিন শাওন

তুলিরেখা এর ছবি

চমৎকার।
রিভিউ পড়ে বইটা পড়তে ইচ্ছে করছে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ছোট্ট করেই বলি- 'কৃতজ্ঞতা'

একজন সামান্য লেখকের জন্য এ যে কি বিশাল প্রাপ্তি!
কেউ একজন তার সময় বিনিয়োগ করে আমার লেখা পড়েছেন, সেই লেখা আবার লিখেছেন- 'ভাঙ্গাচোরা জীবনটাকেই হঠাৎ লাগে ভালো':)
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

পুস্তকটা নিয়া চিন্তাভাবনা জব্বর হইসে।
-----------------------------------

--------------------------------------------------------

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুণ রিভিউ। বইটা পড়ে আমার কাছে মনে হইছে কিছু কিছু জায়গায় আরেকটু বিস্তারিত থাকলে ভাল হতো। তবে পুরা বইটাই যে অসাধারণ এক কাব্যিক ঢঙে লেখা হয়েছে, সেইটা উল্লেখ করতেই হয়। আর শেষদিকে যে টানটান উত্তেজনা, সেটা কখনোই ভোলার না।

দারুণ বই। আরেকবার বলি, দারুণ রিভিউ। (পিপি'দার রিভিউ এক্কেবারে মাস্টারমশাইদের মতো হইছে) দেঁতো হাসি

কীর্তিনাশা এর ছবি

পিপি'দার রিভিউ লাজওয়াব হয়েছে।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

বইটা কেনা হয়েছিল মেলা থেকেই, পড়া হয়নি এই অব্দি।
তবে, রিভিউ পড়তে অনেক ভালো লেগেছে পিপিদা'। সাবজেক্ট টেকস্ট না প'ড়েও বলতে পারছি, বলছি- বিশ্লেষণ-পর্যালোচনা বেশ সূক্ষ্ম সুন্দর নিষ্ঠ সুচারু হয়েছে।
ধন্যবাদ। হাসি
___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।