দৃষ্টিহীন ভালোবাসা

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৭/২০০৭ - ৫:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ সন্ধ্যায় বাজারে যাচ্ছিলাম বাসে করে (বরফ থেকে আর গাড়ি বের করতে পারিনি, তাই)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যামিলি হাউজিংএ থাকি বলে অনেক সুবিধা আছে, তার একটা হলো সন্ধ্যা বেলাতে ছোট আকারের ভ্যানে করে আশে পাশের বাজারে নিয়ে যায়। ফোন করে বললে বাসা থেকে নিয়ে আসে। এটা শুধু আমাদেরই না, নিকটবর্তী বাড়িঘরে যারা থাকে, তাদেরকেও নিয়ে থাকে।

সাধারণত মার্কিনীরা এই ছোট বাসে চড়ে না, কারণ তাদের নিজেদের প্রায় সবারই গাড়ি থাকে। কিন্তু আজকে বাসটা সরাসরি দোকানে না গিয়ে ঘুরে এক গলিতে ঢুকে এক বাড়ির সামনে থামলো। আমার কৌতুহল হলো, এখানে কে আবার বাস ডেকেছে?

বাইরে বরফ, পিছলা হয়ে আছে, তার মধ্যে দেখি আস্তে আস্তে এক মহিলা আসছেন। কাছে আসতেই দেখি গাইড ডগ (পথ প্রদর্শক কুকুর) নিয়ে এক মহিলা আসছেন। চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম দৃষ্টি শক্তি নেই তাঁর। এদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এরকম প্রশিক্ষিত কুকুর পাওয়া যায়।

যাহোক, মহিলার আস্তে আস্তে বাসে উঠে আসলেন। পেছনে আরেকজনকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধহয় পৌছে দিতে এসেছেন মহিলাকে। কিন্তু না, তাকিয়ে দেখলাম সাদা ছড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক বৃদ্ধ আসছেন। তিনিও জন্মান্ধ।

বাসে উঠে এই দুইজন দৃষ্টি শক্তিবিহীন মানুষ পরম মমতায় পাশাপাশি বসে হাতে হাত ধরলেন। মহিলা আর তাঁর স্বামী, দুজনেই সম্পূ্র্ণভাবে দৃষ্টি শক্তিহীন। কিন্তু তা থামিয়ে রাখেনি তাঁদের পথচলা। কারো করুণায় নয়, বরং নিজেদের যতটুকু শক্তি আছে, তা নিয়েই স্বাবলম্বী হয়ে পথ চলছেন। বাসে করে যাচ্ছেন শুধু গাড়ি নিজেরা চালাতে পারবেন না বলে।

মাঝে মাঝেই তাঁরা একে অন্যের দিকে ফিরছিলেন। দেখতে পান না, কিন্তু তার পরেও ফিরে দেখা একে অন্যের দিকে, হয়তো বা মনের চোখে দেখা ...

কিছু পথ চলে এই দম্পতি তাঁদের বাড়ির সামনে এসে গেলেন। তার পর হাত ধরাধরি করে আস্তে আস্তে সেই পিছল বরফের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন বাড়ির ভিতরে। পথ চলার সঙ্গী কেবল সেই কুকুরটা।

[ঘটনাটা বাস্তব। লেখাটি সামহয়ারইনব্লগে ২০০৭/২/১৬ তারিখে, ও আমার ব্লগ বঙ্গবাণীতে ২০০৭/২/২০ তারিখে প্রকাশিত।]


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

পশ্চিমের এই একটা ব্যাপার আমাকে ভীষন মুগ্ধ করে ।
'এদের কোন পরিবার নেই, পারিবারিক আবেগগুলো নেই, মা-বাবার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই'- এই সব মুখস্থ অভিযোগ আমরা আউড়ে যাই ।
এইসব দেশে একজন অন্ধ,একজন প্রতিবন্ধী যেরকম স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ পায়, অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার পায়- মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই ।
আমরা একজন অন্ধ কিংবা প্রতিবন্ধীকে ঠাট্টা তামশা করতে দ্বিধা বোধ করিনা ।
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জার্মানীতে জবের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার। এরপর নারীদের। এরপর অন্যান্য। ট্রাম-বাস-ট্রেনে প্রতিবন্ধীদের জন্য বাড়তি সুবিধা।

দেশে বসে উন্নত বিশ্ব সম্পর্কে অনেক চরম ধারণা নিয়ে পাবলিক বসে থাকে। ভাবে, এরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে আর পথে ঘাটে যার তার সাথে সেক্স করে। পারিবারিক বন্ধনের যে শিথিলতা আমাদের চোখে পড়ে তার সবটা না হলেও অনেকটাই ব্যস্ত জীবনপদ্ধতি, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বী হওয়া থেকে উদ্ভূত।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অমিত আহমেদ এর ছবি

জাতিগত ভাবেই আমরা যারা আমাদের মতো না, যাদের বুঝতে পারি না, তাদেরকে অপছন্দ ও অনেকাংশে ঘৃণা করি। ভালো ব্যাপারগুলো চোখে পড়ে কম। সময় আর শিক্ষার সাথে এটা কখনো বদলাবে হয়তো।

ঝরাপাতা এর ছবি

হুম।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।