বাংলা বিতর্ক, ক্যাডেট রায়হান এবং কিছু বিরক্তিকর প্যাচাল

রায়হান আবীর এর ছবি
লিখেছেন রায়হান আবীর (তারিখ: বুধ, ২৪/০৯/২০০৮ - ৬:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্যাডেট কলেজে ক্লাস এইটে থাকার সময়কার একটা কথা এখন আমার স্পষ্ট মনে আছে। ভলিবল কম্পিটিশনের শেষের দিন। গেমস টাইমের ব্রেক অফের পর হাউসে ফিরে যাচ্ছি। তখন হঠাৎ করে এই বিশাল কলেজে আমার নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। হাউস ভেস্ট পড়ে থাকা নিজের ক্লাসের কয়েকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ঘরে ফেরা কয়েকজন বীর সৈনিক। আহারে একবছর হয়ে গেল আমি এখনো কিছুই করতে পারলাম না। কি প্রচন্ড হীনমন্যাতাযে আমাকে গ্রাস করেছিল তা বলে বুঝানো যাবেনা।কলেজে আসার আগে আমার কো কারিকুলার একমাত্র activity ছিল আমি আগের স্কুলে মাঝে মাঝে বিতর্ক করতাম। খুব সিরিয়াস কিছু না। একজন স্যার ছিলেন উনি মাঝে মাঝে ক্লাসের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন; এই টাইপ বিতর্ক। যাইহোক ক্লাস এইটে পাওয়া প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতাটাকে আমি লুফে নিলাম যুদ্ধে সৈনিক হবার জন্য, নিজেকে যোগ্য প্রমানের জন্য। প্রায় এক মাস আগে থেকে script লেখা শুরু করে দিলাম। বিষয় ছিল “আমাদের চেয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা বেশি সুখি ছিলেন”। আমি বিষয়ে পক্ষে। সারাদিন খালি বিতর্ক নিয়ে চিন্তা করতাম। script লিখতাম আর কাটতাম। এভাবে দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো এক মাস। এসে গেলো আমার জীবনের প্রথম stage compition. স্টেজে বসলাম। আমি ছিলাম ৫ম বক্তা। অন্য কারও কথা মাথায় ঢুকছেনা। ঢুকার দরকারও তেমন নাই। কারণ জুনিয়ার গ্রুপে যুক্তি খন্ডনের কোন বালাই নেই। খালি নিজেরটা ঠিক মতো বলে আসতে পারলেই চলে। আমার পালা চলে আসলো দেখতে দেখতে। আদনান ভাই (তখনকার কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট) বলছিল স্টেজে উঠে নার্ভাস না হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্দিষ্ট কারও মুখের দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। বক্তব্য শুরু করলাম। আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবাণীতে কোন কিছু ভুল না করে কিভাবে কিভাবে যেন শেষও করে ফেললাম। জুনিয়ার গ্রুপের পর সিনিয়ার গ্রুপ। আমি নিচে নেমে সবার সাথে বসলাম। ক্লাসমেটরা সবাই খুব প্রসংশা করলো। হটাৎ করে নিজেকে খুব boss boss মনে হচ্ছিল। এরপর ফলাফল ঘোষণা। আমি জুনিয়ার গ্রুপে সেকেন্ড। কি উফ! কি যে ভালো লাগার একটা অনুভুতি বলে বোঝানো যাবেনা। আমার কলেজ জীবনের প্রথম স্মরনীয় দিন ছিল সেটা।আমাদের হাউসমাষ্টার তখন ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান ওরফে টাল বাবা (পরবর্তিতে আমার অসংখ্য টিজ নামের একটা হয়ে যায় টাল)। আমার চেহারার কারণেই হোক অথবা অন্য কোন কারনেই হোক উনি আমাকে একদমি দেখতে পারতেন না। বিতর্কে প্রথম হবার পর থেকে তার কাছে আমার দাম বেড়ে গেলো। ততদিনে জুনিয়ার আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আমি roomleadership পেলাম। শুধু তাইনা, সব রুমে দুইজন হলেও একটা রুমে থাকবে তিনজন জুনিয়ার। টালবাবা আমাকে সেই রুমের দায়িত্ব দিলেন। জুনিয়ার আসার কয়েক মাস পরে অবশ্য উনি নিজেই কোন কারণ দর্শানো ছাড়া আমার রুম লিডারশীপ সিজ করে ক্লাসমেটদের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আরেক ইতিহাস।

এভাবে ঘটনা প্রবাহে কেটে যেতে থাকলো সময়। ক্লাস নাইনে আবার বিতর্কে গেলাম। এবার আমি লিডিং ব্যাচ। টপিক মনে নাই, কিন্তু ফার্স্ট হইয়েছিলাম এইটা মনে আছে। তারপর candidate থাকার সময় আবার সেকেন্ড এবং ক্লাস টুয়েলভয়ে ফার্স্ট। এবং ICCLM এ যাবার সুযোগ। তখনো আমার বিতর্কের উৎসাহের ভাটা পড়ে নাই। LM এর অনেক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করালাম। কলেজে অনেক বোরিং অডিশনের ধীরে ধীরে সময় ঘনিয়ে আসলো। রওনা দিলাম রংপুর ক্যাডেট কলেজের উদ্দেশ্যে।

আমার কম্পিটিশন ছিল দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চের ঠিক আগে (ভুল হতে পারে)। আমাদের কলেজের টিম অতটা ভালো ছিলনা। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেনো সবাই যার যার ইভেন্টে খুব ভালো করে ফেলল। আমারটার আগে আমাদের কলেজের স্থান ছিল দুই নাম্বারে। এইবার আমার পালা। স্টেজে বসলাম। প্রথম বক্তা ছিল গার্লস ক্যাডেটের অর্চি। ও বলল, এভাবে একে একে সবাই যেতে লাগলো। স্টেজ থেকে একটা জিনিস খেয়াল করলাম কেউ যখন বক্তব্য দিতে জায় তখক বিতর্কের মাঝখানে হোক কিংবা শেষে হোক তার নিজের কলেজ বাদে আর কেঊ তালি দেয় না। কারণটা খুব সহজ। যাই হোক আমি বক্তব্য শুরু করলাম। আমার স্প্রিপ্টে অনেক মজার মজার উপমা ছিল। এই যেমন “……তাতে করে উন্নয়নের আন্ডা চিরজীবন আন্ডাই থেকে যাবে; কোনদিন বাচ্চা হয়ে বের হবেনা না” টাইপ। আমি দেখলাম আমার বক্তব্যে সবাই খুব মজা পাচ্ছে; আরও অবাক হয়ে খেয়াল করলাম আমাকে সবাই হাততালি দিচ্ছে। আমি অনেকের চেহারা লক্ষ্য করলাম। দেখলাম তারা সবাই আমার সাথে আছে। MGCC পর্যন্ত। সময় ফুরিয়ে এলো। আমি ছিলাম ৫ম বক্তা। আমার পরে আরও পাঁচ জন। আমার জীবনে আমি যতো প্রতিযোগিতায় এর আগে গিয়েছিলাম এবারের মতো আমি ফলাফল নিয়ে নিশ্চিন্ত কখনো হোইনি। নিজেকে প্রথম ছাড়া আর কিছু কল্পনাও করতে পারছিলাম না। জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের সপ্নে আমি তখন বিভোর। মেডেল নেবার সপ্ন, কলেজে ফিরে part মারার সপ্ন। সত্যি মধুর অনুভূতি। বিতর্ক শেষ হোল। নীচে নেমে আসলাম। সবার কলেজের সবার মুখ আনন্দিত কারণ অবশ্যম্ভাবী আরেকটা ফার্স্ট এবং ১০ পয়েন্ট। রাকিব স্যার বললেন “রায়হান তুমি ফার্স্ট হবানা, রংপুর ফার্স্ট হবে আর তুমি হবা দ্বিতীয় “। রেজাল্ট দেবার সময় ঘনিয়ে আসলো। ১০ম FCC এর শাওন। সবাই খুব খুশী। কারণ ওরে আমাদের কলেজের কেউ দেখতে পারেনা। তারপর ৯ম…ক্যাডেট রায়হান; বরিশাল ক্যাডেট কলেজ।

এরপর আমার স্পষ্টভাবে আর কিছু মনে নাই। খালি মনে আছে সবাই এসে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। DIG আসলো, আসলো আমাদের ভয়ঙ্কর Adju নুরুল আলম। অনেকে…

আমার জীবনের অন্যতম সুখের এবং একি সাথে দুঃখের দিন ছিল সেটা। পরে ভেবে দেখলাম ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড না হওয়াতে একদিক দিয়ে ভালই হইয়েছিল। অনেকেই আমাকে ওই একটা কারণে চিনে। ভালো……

ও সেদিন বিচারক হিসাবে থাকার কথা ছিল কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের। তিনি উপস্থিত না থাকাতে বিচারক হিসাবে দ্বায়িত্ব পালম করেছিলেন আভিনেতা খাইরুল আলম সবুজ। এবং আমাকে ৯ম স্থান দেবার কারণ আমাদের adj তাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন আমার বক্তব্য ছিল অশ্লীল…সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র।।

রায়হান আবীর

গড় রেটিং

(০ ভোট)

Trackback URL for this post:
http://www.sachalayatan.com/trackback/11660

লিখেছেন রায়হান আবীর (তারিখ: শনি, ২০০৮-০১-১২ ০৩:১৩)
উদ্ধৃতি | রায়হান আবীর এর ব্লগ | ৩টি মন্তব্য | পছন্দের পোস্টে যুক্ত | আপত্তি জানান | ১৮৭বার পঠিত

Views or opinions expressed in this post solely belong to the writer, রায়হান আবীর. Sachalayatan.com can not be held responsible.

১ | কনফুসিয়াস | শনি, ২০০৮-০১-১২ ০৫:৪৪

রায়হান,
আপনার জন্যে সহানুভুতি রইলো। ভুল লোকের হাতে বিচারের ভার পড়লে এরকমই হয়।
---------
লেখাটা আরেকটু সহজবোধ্য করলে ভালো হত। অথবা লেখার শেষে একটা পরিশিষ্ট যোগ করলেও চলে। যেমন-
১। ICCLM= ইন্টার ক্যাডেট কলেজ লিটারেচার এন্ড মিউজিকাল কম্পিটিশান। (নাকি শুধু 'লিটারেচার মিট?)
২। MGCC= ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ।
৩। candidate= এস এস সি পরীক্ষার পুর্ববর্তী সময়।
৪। adju= এডজুটেন্ট।
ইত্যাদি ইত্যাদি।
------
ধন্যবাদ।

-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

উদ্ধৃতি | ঘ্যাচাং | reply | আপত্তি জানান | লেখককে মেসেজ

২ | কিংকর্তব্যবিমূঢ় | সোম, ২০০৮-০১-২৮ ০২:৪৫

এই লেখাটা আগে পড়ছিলাম ... ব্যস্ততায় কমেন্টানো হয় নাই ...

ভাল্লাগছে পইড়া ...

আইইউটিতে কোন হলে ছিলা? নর্থে?

উদ্ধৃতি | ঘ্যাচাং | reply | আপত্তি জানান | লেখককে মেসেজ

৩ | অতিথি লেখক [অতিথি] | সোম, ২০০৮-০২-০৪ ১২:০০

ছিলাম না আছি। তবে সাউথে।

রায়হান আবীর

উদ্ধৃতি | ঘ্যাচাং | reply | আপত্তি জানান


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।