আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে নির্বিরোধী ছেলেটির নাম ইয়াসির

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি
লিখেছেন রকিবুল ইসলাম কমল [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২৫/০১/২০১৫ - ১:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
বাসায় ফিরে রাতে অনলাইনে পত্রিকা পড়ছিলাম। আমার এখানে রাত হলেও দেশে এখন ভোর সকাল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পত্রিকায় এত বেশি নৃশংসতা যে, দেশটাকে ইদানিং যুদ্ধক্ষেত্র মনে হয়। অমানুষের দল আজকে আবার একটি বাসে পেট্রল বোমা মেরেছে। এবারের ঘটনা যাত্রাবাড়ীতে। সে বোমায় ২৮ জন আগুনে পুড়ে গেছে। তাদের মুখ, শরীরের চামড়া, শ্বাসনালী ঝলসে গেছে। পত্রিকার পাতায় বীভৎস ছবি গুলোর বিভিন্ন জায়গা ঝাপসা করে দেয়া আছে। তবু ছবি গুলোর দিকে তাকাতে পাড়ি না। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া মানুষের ছবি দেখার মত সাহস আমার নেই। তাই ছবি গুলো এড়িয়ে কোন রকমে খবরটা শুধু পড়ি। যাত্রাবাড়ী নামটা শুনে বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছিলো। এখানে আমার ভাই-বোন-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনরা থাকে। এই এলাকার রাস্তা দিয়ে তাদের প্রতিদিন আসা যাওয়া.....

খবরের কাগজে খারাপ খবর গুলো পড়লে। মনখারাপ হয়, দুঃখ লাগে। এখানে সেখানে অসহায় নিরপরাধ মানুষ গুলোকে পুড়িয়ে মারছে মানুষরূপী শয়তানের দল। ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে পৈশাচিক উন্মাদনার এই নৃশংসতা দেখে। জেদ লাগে সরকার দৃঢ়তার সাথে এগুলো প্রতিরোধ করে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে না বলে।

কিন্তু নৃশংসতার স্থান যখন যাত্রাবাড়ী বা নিজের বাসার কাছাকাছি কোন জায়গা হয়; তখন আর মন বিষিয়ে উঠা বা জেদ লাগার ব্যাপার থাকে না। তখন চারিদিক হঠাৎ করে নিস্তব্ধ হয়ে আসে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। একটা অজানা শঙ্কা গলা চেপে ধরে শ্বাস বন্ধ করে দিতে চায়। তড়িঘড়ি করে দেশে ফোন করে সেখানে রেখে আশা প্রিয়জনদের কণ্ঠস্বর না শোনা পর্যন্ত এই অস্থিরতা কিছুতেই কাটে না।

দেশে ফোন করি ছোট ভাইয়ের ফোনে। রিং হয় কিন্তু ফোন ধরে না। আমি ফোন করেই যাই। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ছোট ভাই অপরপাশ থেকে হ্যালো বললে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কথা বলি। বকাঝকা করি। বাসার সবাই ঠিকঠাক আছে বুঝতে পারি। বোন পাশের ঘরে কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত। আমি আমার শঙ্কার কথা বলতে পারি না। শুধু বলি, বাইরের পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাসে উঠার দরকার নাই । খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাইরেই যাবার দরকার নাই।

ফোনে কথা শেষ হলে আবার পত্রিকাটি নিয়ে বসি, এবার সাহস করে করে ছবি গুলোর দিকে তাকাই। না পরিচিত কারো মত মনে হয় না। পুড়ে যাওয়া মানুষ গুলোর নাম পড়ি।

শরীফ খান
তকবীর ইসলাম
সালাউদ্দিন পলাশ
সালমান
মোশারফ হোসেন
জয়নাল আবেদীন
ইয়াসির আরাফাত
ইয়াসির আরাফাতের স্ত্রী শাহীদা ফাতেমা
রাশেদুল ইসলাম
নূর আলম
রফিকুল ইসলাম
তানভীর
জাবেদ
মোজাফফর
শাহাজাহান

আরো নাম আছে। একই নামের অনেক মানুষ থাকে, সে হিসেবে অনেকগুলো নামই পরিচিত। যেমন: তানভীর আমার মামাতো ভাইয়ের নাম, মোজাফ্ফর আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজনের নাম। দেশে থাকতে ওর সাথে আড্ডা দেই না এমন কোন দিন হয়তো খুজে পাওয়া যাবে না। ইয়াসির আরাফাত আমার আরেক বন্ধুর নাম। আমরা একই সাথে চার বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরেছি। মোশারফ হোসেন আমার মেঝ মামার নাম। শাহজাহান আমার এক কাকার নাম।

আমি একে একে দগ্ধ হওয়া সব গুলো মানুষের নাম পড়ি। এত পরিচিত নাম গুলো পড়েও আমার চেনা কোন মানুষের মুখ ভেসে উঠে না মনে। আমার মত আমার আশে পাশের মানুষ গুলোও অতি সাধারণ। এদের নাম আমি পত্রিকায় দেখে অভ্যস্ত না। অথবা আমার অবচেতন মন চায় না এখানে আমার কাছের কোন মানুষের নাম খুজে পেতে। আমার আশেপাশের পরিচিত নাম নিয়ে, এরা সবাই আমার অপরিচিত মানুষ এটা ভেবেই হয়ত আমি নিশ্চিন্ত থাকতে চাই। কিন্তু এই মানুষ গুলো কারো বন্ধু, আত্বীয়, স্বজন। তাদের জায়গায় নিজেকে ভেবেও মনটা অস্থির হয়ে যায়।

ক্লান্ত-করুণ মন নিয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। আমার এখানে রাত গভীর হয়। বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে যাই। আধো-জাগরণে মনে হয়, দূর থেকে কারো কান্নার শব্দ ভেসে আসে। তীব্র যন্ত্রনায় কে যেন বিলাপ করে কাঁদছে,

আমি বাঁচবো না বাবা। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে বাবা। আমি সহ্য করতে পারছি না।

এ দুই হাতে কামাই করে আমি বৌ-বাচ্চারে খাওয়াই। আমি সংসারের উপার্জনকারী। আমার সব শেষ। আল্লাহ তুমি বিচার কর।

এই লাইন গুলো পত্রিকার পাতায় লেখা ছিল। অগ্নিদগ্ধ শোকবিহ্বল মানুষের বিলাপ। এই বাক্য দুটি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি।

২।

সকালে উঠে মোবাইলে দেখি বেশ কয়েকটি ম্যাসেজ। সবার ম্যাসেজে একই কথা লেখা, 'কমল, ইয়াসির আরাফাত এবং ওর বউ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি। অবস্থা ভালো না ওদের জন্য দোয়া করিস।'

আমি গতকাল প্রচার করা টেলিভিশনের সংবাদ গুলোর ভিডিও গুলো খুজে বের করি। ঝলসে যাওয়া ইয়াসির আরাফাত কে দেখতে পাই কয়েক সেকেন্ডের জন্যে!

ইয়াসিরের সাথে নানান স্মৃতি মনে পরতে থাকে। পত্রিকার খবর, টিভি নিউজ আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না! আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে নির্বিরোধী ছেলেটির নাম ইয়াসির আরাফাত....


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

সেরে উঠুন ইয়াসির আরাফাত, তার স্ত্রী আর বাকি সবাই -এটাই প্রত্যাশা করি।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ঠিক একই অনুভূতি নিয়ে সকালে পত্রিকা পড়ি, ঘর থেকে বের হই, ঠিক একই হাহাকার বুকে করে ঘুমাতে যাই। আল্লাহ সবাইকে নিরাপদে রাখুন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ
ভাল হয়ে উঠুন ইয়াসির আরাফাত।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি দূরদেশে থাকেন তাতে এতো ঝলসে যাওয়া অনুভূতি কাজ করে যে আপনার বাকরুদ্ধ হয়ে আসে আর আমাদের চোখের সামনে বদমাইশের বাচ্চারা ঝলসে দিচ্ছে মানুষকে আর আমরা কিছুই করতে পারি না ।তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে।

--------------
রাধাকান্ত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।