জননী ও জন্মদিন

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি
লিখেছেন রকিবুল ইসলাম কমল [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ৩১/০১/২০১৪ - ১১:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার কোন জন্মস্মৃতি নেই। এই স্মৃতি কোন মানুষেরই থাকে না। কেন থাকে না তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই নিউরোলজিস্টরা দিতে পারবেন। আমার সেই ব্যাখ্যা জানা নেই, জানতে ইচ্ছেও করে না, শুধু আফসোস লাগে। মনে হয়ে সেই স্মৃতিটুকু থেকে আমাকে কোন ভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। ভীষন অন্যায় করা হয়েছে আমার উপর।

ছোট বেলার প্রতিটি স্মৃতি আমার কাছে মণিমুক্তা খচিত ঐশ্বর্যের মত, গল্প করার প্রধান বিষয়। কিন্তু শিশু বয়েসের অপরিণত মস্তিস্কের নিউরনগুলো সে সময়টার অনেকখানি অংশই স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেনি। জেদ লাগে এটা ভেবে যে, অপরিণত ব্রেইন নিয়েই যখন জন্মাতে হবে তাহলে দশ মাস ধরে মায়ের পেটের ভেতর থেকে করলামটা কী কচু!

প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনের মত যদি ভূমিষ্ঠ হবার দিনটির কথা মনে থাকতো। যদি স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারতাম আমাকে দেখে আমার মায়ের সুখী মুখের ছবিটা। কী আফসোস আমার সে সময়ের কোন স্মৃতি নেই!

আমি যদি একবার কোনভাবে দেশের হর্তাকর্তা গোছের কিছু হয়ে যাই। তাহলে প্রতিটি হাসপাতালের মেটার্নিটি ওয়ার্ডে একটি করে ক্যামেরা বরাদ্দ করে দেব। ভুমিষ্ঠ শিশুকে প্রথমবার মায়ের কাছে নিয়ে আসা মাত্র অন্তত একটি ছবি তুলে রাখা বাধ্যতামুলক থাকবে। আত্মীয়-স্বজনরা সেই ছবি মনের ভুলে হারিয়ে ফেললেও শিশুটি বড় হয়ে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে তাকে কোলে নিয়ে তোলা তার সুখী মায়ের ছবিটি নিয়ে যেতে পারবে।

আমার মা অফিসিয়ালি ´মা পদ মর্যাদা´য় উন্নিত হয়েছে আমার জন্মের সারে তিন বছর আগে, যখন তার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। তারপরও আমার মা, আমার নিজের মা হয়েছে তো আমার জন্মের মাধ্যমেই। কাজেই আমার জন্মদিন মানে আমার মায়েরও জন্মদিন! সাথে সাথে আমার বাবারও।

জন্মেই দেখতে পেলাম পৃথিবীতে আরেকটি শিশু যে কিনা আমার বড় বোন। সে তার বড় বড় চোখ মেলে কৌতূহল নিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সেও তখন স্মৃতিতে কোন তথ্য জমাতে শেখেনি, আমার তো প্রশ্নই উঠেনা। সে দৃশ্যটিও না জানি কত সুন্দর ছিল। অথচ হতচ্ছাড়া নিউরন গুলো কিচ্ছু মনে রাখতে পারেনি!

জন্মেই কত গুলো মানুষের সাথে নানান সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম। কেউ মামা, কেউ চাচা, খালা, ফুপু, নানা, নানি, দাদা, দাদি কত কিছু! আমার জন্মদিন মানে এই সম্পর্ক গুলোরও জন্মদিন।

আম্মু ছোট বেলায় কেক কেটে আমার জন্মদিন পালন করেছে বাসায়। অনেক উপহার পেয়েছি মামা, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে। তবে প্রাইমারী স্কুল শেষ করার পর জন্মদিন পালনের ঘনঘটা কমে আসলো। একটা সময় আসলো যখন খেয়ালই করতাম না বছরের কোন দিক দিয়ে জন্মদিন এসে আবার চলেও গেছে। বই মেলা চলে এলেই বুঝতে পারতাম, সে এসেছিলো বাতাস তা বলেনি! কেউ মনে রাখেনি বলে সেটা নিয়ে কখন মন খারাপও লাগেনি বরং মনে রাখলেই কেমন লজ্জা লাগত!

স্কুল জীবনের শেষ ভাগে নানান উৎসব পালনের রেওয়াজ শুরু হল। এভাবেই একদিন আবার জন্মদিনটি একটি বারতি উপলক্ষ হিসাবে ফিরে এলো। বন্ধুরা মনে রেখে উপহার দিত। সবাই মিলে ধরত রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো উদ্দীপনা আরেক কাঠি বেশি। কিছুদিন পরপরই কারো না কারো জন্মদিন থাকত। হইচই, খাওয়া, ঘুরাঘুরি, এবং আড্ডাই ছিল জীবন।

নানান সংযোজন বিয়োজনে উৎসবের এই উপলক্ষটির মাঝ থেকে ধীরে ধীরে আমার মায়ের অধিকার কমে গেলো। উৎসব উদযাপনের সঙ্গীসাথি হলো কাছাকাছি বয়সি ভাইবোন এবং বন্ধুরা। দেখা যেত সহপাঠীরা সবই হয়ত আমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য ক্লাসে একটি কেক নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে সুর করে গান গেয়ে হাসি ঠাট্টার মাঝে কেক কেটে সারাদিন-ব্যাপি জন্মদিন পালন শুরু হত।

আমার বন্ধু-ভাগ্য বরাবরই ভালো। প্রতিবছরই কেউ না কেউ জন্মদিনটিকে বিশেষ ভাবে স্মরনীয় করে রাখার মত এমন কিছু একটা করত যে, আমি যারপর-নাই অবাক হয়ে যেতাম।

এই দিনের যে কাজটি ছিল সব চেয়ে সাধারণ এবং অনেকটা রুটিন কাজের মত সেটি হল, `আজ আমার জন্মদিন´ বলে আম্মুর পা ছুয়ে সালাম করা। আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে কপালে একটা চুমু দিয়ে দিত। রাতের খাবারে আমার প্রিয় কিছু একটি রান্না করত। বেশির ভাগ সময় যেটা ছিল বিরিয়ানী।

কৈশোর-যৌবনের চিরায়ত ব্যস্ততা আর বন্ধু-বান্ধবের অফুরন্ত শুভেচ্ছার মাঝে আম্মুর কাছ থেকে পাওয়া ঐ দু´মিনিটের আদরটা কোনদিন আলাদা কিছু মনে হয়নি। আট-দশটা অভ্যাসবসত করা কাজের মত এটাও ছিল বিশেষত্বহীন।

সে উচ্ছল সময়টাতে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, একটি সময় আসবে যখন প্রতি বছর এই দিনে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আড়ালে চোখ মুছতে হবে সেই বিশেষত্বহীন ঘটনাটিকে কোন ভাবে আবার ফিরে পাবার অসম্ভব আশায়।

Screen Shot 2014-01-30 at 5.49.48 PM


মন্তব্য

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল কমল ভাই। মন খারাপ
জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল। ভাল থাকবেন সবসময়।
আপনার জীবন আলোয় আলোয় ভরে উঠুক।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

মন খারাপও সংক্রামক। আপনিও ভালো থাকবেন সবসময়।

অতিথি লেখক এর ছবি

এমনিতেই মন খারাপের দীর্ঘ প্রহর চলছে, আপনার লেখা পড়ে দীর্ঘ প্রহর আরো ভারী হলো। মন খারাপ
জন্মদিনের শুভেচ্ছা কমল ভাই, বহমান জীবনের পথ চলায় থাকুক প্রিয় মানুষের পিছুটান, থাকুক তাদের প্রতি না বলতে পারা ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস। ভালোথাকবেন।

মাসুদ সজীব

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

ঠিকই বলেছেন। প্রিয় মানুষগুলোর মুখ মনের মাঝে এসে যাদের বয়ে চলা জীবনকে এক মুহুর্তের জন্যেও তরঙ্গায়িত করে না তারাই আসল দুর্ভাগা। আপনিও ভালো থাকবেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ
শুভ জন্মদিন, কমল ভাই

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

ধন্যবাদ সত্যানন্দ ভাই।

এক লহমা এর ছবি

"আমি যদি একবার কোনভাবে দেশের হর্তাকর্তা গোছের কিছু হয়ে যাই। তাহলে প্রতিটি হাসপাতালের মেটার্নিটি ওয়ার্ডে একটি করে ক্যামেরা বরাদ্দ করে দেব। ভুমিষ্ঠ শিশুকে প্রথমবার মায়ের কাছে নিয়ে আসা মাত্র অন্তত একটি ছবি তুলে রাখা বাধ্যতামুলক থাকবে। আত্মীয়-স্বজনরা সেই ছবি মনের ভুলে হারিয়ে ফেললেও শিশুটি বড় হয়ে হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করে তাকে কোলে নিয়ে তোলা তার সুখী মায়ের ছবিটি নিয়ে যেতে পারবে।"
চলুক
জন্মদিনের শুভেচ্ছা, কমল-ভাই!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা আসলে সরকারেরই করা উচিত। জন্মের সাথে সাথে ছবি তোলা, তথ্য সংগ্রহ, জিন-ডিএনএ'র খতিয়ান সব নিয়ে সরকারের মহাফেজখনায় রাখা দরকার। তাহলে কেউ কখনো হারিয়ে গেলে বা পরিচয় গোপন করলেও তার ঠিকুজী বের করে ফেলা যাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

অবশ্যই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা ভাই।

আয়নামতি এর ছবি

বোকারাম ভাইটি আমার! মা তো তোমায় ছুঁয়েই আছেন তাঁর দেয়া তোমার কপালের আদরে,
লুকোনো চোখের জলে, বন্ধুর হল্লাহাটির সব আয়োজনে, তবে বোকার মত মন খারাপ করে আজকের এমনদিনকে
বিষন্ন করছো কেন? এই যে দেখো হুট করেই তোমায় 'তুমি' বলছি সেটা কোন অধিকারে? আরে বোকা সে তো এই জন্মদিনেরই
অজুহাতে ভাইটির বোন হয়ে যাওয়া। তবে আজ আমারও জন্মদিন! ঠিক কিনা বলো? ছায়া সরে গেলেই বুঝি তার মূল্য, কিন্তু মা বাবা'র ছায়া কখনোই আমাদের জীবন থেকে সরে যায় না জেনো! সে কারণেই 'তাঁদের' পাস্টটেন্সে বাসানো আমার সহ্য হয় না কেন জানি! একদম মন খারাপ নয়! আনন্দ কব্জি ডুবিয়ে হালুম হুলুম খাও দেখিনি। দুঃখ/বিষন্নতাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ানোর মত মজা আছে নাকি রে পাগল! মজাতেই কাটুক বরং আজকের সময়টুকু। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। অনেক অনেক শুভকামনা থাকলোশুভ জন্মদিন ভাইয়া!

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

মা তো তোমায় ছুঁয়েই আছেন তাঁর দেয়া তোমার কপালের আদরে,
লুকোনো চোখের জলে, বন্ধুর হল্লাহাটির সব আয়োজনে, তবে বোকার মত মন খারাপ করে আজকের এমনদিনকে
বিষন্ন করছো কেন?

হে হে আয়নামতি, তোমারে আমার পছন্দ হয়েছে, বিশেষ করে তোমার স্পিরিট। তাইত আমিও কেমন চট করে তুমি বলে ফেললাম। হাসি
সেই কমল ভাই, এমন বোন পেলেন আর মুখ গোমড়া কেন তবে?
মা আসলেই আমাদের ছুঁয়েই থাকে, ঘিরেই রাখে সবসময়।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

আয়নামতি এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলা কথা গুলো তোমার এই বোকারাম ভাইটির হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। মা-বাবা কে নিয়ে যে কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করে! লেখায় শুধু পাস্ট টেন্স চলে আসে বলে অসহ্য লাগে।

তোমার প্রতিও শুভ কামনা রইলো।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

মা -

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।