প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনীতি

মাহবুব রানা এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব রানা [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/০৩/২০১২ - ১০:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের একখন্ড উপকূলীয় বনভূমির দাম কত? প্রশ্নটা সিরিয়াসলিই করছি, একটু ভেবে দেখুন।

সেই সাথে চলুন দুটো কেস্ স্টাডি দেখি।

কেস্ স্টাডি ১
নিউ ইয়র্ক শহড়ের ব্যবহার্য পানির একটা বড় অংশের উত্স হচ্ছে ক‌্যাটস্কিল জলাভূমি (Catskill watershed)। দীর্ঘকাল ধরেই এটা নিরাপদ পানির উত্স হয়ে ছিলো। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বর্জ্য, ভূমিক্ষয়, রাসায়নিক দূষন ইত্যাদি নানা কারনে জলাশয়ের পানি দুষিত হচ্ছিলো, আর তাতে করে পানি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছিলো। ১৯৯৬ সালের দিকে এসে সিটি কর্তৃপক্ষের সামনে দুটি অপশন খোলা থাকে।এক, পানি শোধনের কৃত্রিম অবকাঠামো নির্মাণ; দুই, ক্যাটস্কিলের প্রতিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে একে আদি অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। সিটি কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয়টিই বেছে নিয়েছিলো, কারণ কৃত্রিম পানি শোধন অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের (যা কি-না ৬ থেকে ৮ বিলিয়ন ইউএসডি) চেয়ে জলাভূমি উন্নয়ন ও রক্ষনাবেক্ষন ব্যয় ( যা ১ থেকে দেড় বিলিয়ন ইউএসডি) বেশি কস্ট এফিসিয়েন্ট ছিলো। প্রকৃতি থেকে বিনামূল্যে পাওয়া সেবার আর্থিক মূল্য কত হতে পারে তা ব‌্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্যাটস্কিল এখনও ক্লাসিক উদাহরন হিসেবে আলোচিত হয়।

কেস্ স্টাডি ২
Wyoming বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক বার্বিয়ার (E.B. Barbier) এবং সহ-গবেষকরা উষ্নমন্ডলীয় ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে গবেষণা করছিলেন দক্ষিন থাইল্যান্ডে। সেখানে তারা প্রচুর চিংড়ি ঘের দেখতে পান যেগুলো ম্যানগ্রোভ বন কেটে বানানো। অর্থনৈতিক বিশ্লেষন থেকে তারা জানতে পারেন হেক্টর-প্রতি বন থেকে লাকড়ি ও অন্যান্য বনজ দ্রব্য বাবদ আয় হয় ৫৮৪ টাকা, অথচ সমপরিমান বন কেটে চিংড়ি ঘের করলে তা থেকে ৯,৬৩২ টাকা আয় করা সম্ভব। কাজেই বন কেটে চিংড়ি ঘের করার পেছনে অর্থনৈতিক যুক্তি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং স্পষ্ট।
কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে দেখা যায়, এই ৯,৬৩২ টাকা লাভের ৮,৪১২ টাকাই আসলে স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে কোনো না কোনো উপায়ে পাওয়া সাবসিডি।তার মানে দাঁড়াচ্ছে, চিংড়ি আর বনের থেকে লাভ আসলে ১,২২০ টাকা ও ৫৮৪ টাকা, যথাক্রমে। এরপরও কিন্তু (অর্থাত্ সাবসিডি ছাড়াও) দেখা যাচ্ছে চিংড়ি ঘের করা লাভজনক।
গবেষনা আরো অগ্রসর হতে থাকে। এবার অর্থনীতির এই গবেষক দল ম্যানগ্রোভ বনের অদৃশ্য সেবাগুলো র (যেমন- ভূমিক্ষয় রোধ, ঝড়ের হাত থেকে সম্পদ রক্ষা, সামুদ্রিক মাছের আবাস ও প্রজনন ইত্যাদি) একটা বাজার মূল্য বের করেন এবং লাভের খাতায় যোগ করে দেখেন, ৫৮৪ টাকা নয়, ম্যানগ্রোভ বন থেকে প্রাপ্ত সেবার বাজার মূল্য হওয়া উচিত ১২,৩৯২ টাকা। আর এতদিন চিংড়ি চাষের ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য (অর্থাত্, লবনাক্ততা বৃদ্ধি, রাসায়নিক দুষন ইত্যাদি নির্মূল করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে যে খরচ) প্রায় ১১,১৭২ টাকা।

গবেষনা শেষে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান- বন কেটে চিংড়ি ঘের করে ৯,৬৩২ টাকা লাভ নয়, আসলে ২৩,৫৬৪ টাকা (১১,১৭২ টাকা +১২,৩৯২ টাকা) ক্ষতি প্রতি হেক্টরে। কাজেই, চিংড়ি চাষ থেকে সাদা চোখে যেটা লাভ দেখা যাচ্ছে সেটা আসলে বড় ধরনের নেট আর্থিক ক্ষতি (Net economic loss)।

এবার বলুন, আমাদের উপকূলে একখণ্ড বনভূমির দাম কত? আমার ধারণা কেউ যদি উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন, তাঁর মনে প্রশ্নই বরং জেগেছে বেশি। যেমন- বনের ভূমির পরিমান কত? বনটা কোথায়? সেখানে জমির বাজার দর কেমন? বনে কি গাছ আছে? কাঠের বাজার দর কত? ইত্যাদি, ইত্যাদি। লক্ষ করে দেখুন, আমাদের মাথায় যে প্রশ্নগুলো আসার কথা তার সবই বাজার কেন্দ্রিক। কিন্তু বাজার কি সবকিছুর দাম বলে দিতে পারে? সবকিছু কি বাজারে কেনাবেচা হয়? বাজারে কেনাবেচা না হলে কি জিনিসের দাম থাকতে নেই? যে জিনিস আমরা বিনামূল‌্যে পাই তার কি কোনো মূল্য নেই? ফসলের ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের জন্য যে রাসায়নিক কেনা হয় তার হিসাব লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষনে আসে, কিন্তু একটি পাখি পোকামাকড় খেয়ে 'বিনামূল্যে' যে সেবাটুকু দিচ্ছে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষনে সেটার কোনো দাম নেই। এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষনটা কি তাহলে ত্রুটিহীন হলো? এবার ক্ষতির দিকটা ভাবুন। আপনি যখন নদীতে বাঁধ দিলেন বিদ্যুত উত্পাদনের জন্য, লাভের হিসাবটা বাজার বলে দিচ্ছে (কি পরিমান বিদ্যুত উত্পন্ন হবে, আর বিদ্যুতের বাজার দর কি তা থেকে), কিন্তু এই বাঁধ বানাতে গিয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর যে প্রভাব পড়ছে তার আর্থিক মূল্য কি প্রচলিত বাজার/অর্থনৈতিক বিশ্লেষন থেকে আসছে? ক্ষতির এই হিসাবটা বাজার দিতে না পারার ব্যার্থতার কারণেই অনেক বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প (শুধু বাংলাদেশে না, সারা বিশ্বেই) লাভের মূলা দেখিয়ে ব্যাপক পরিবেশ/ প্রতিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি পাশ কাটিয়ে যেতে পারছে।

আমাদের উপকূলে একখন্ড ম্যানগ্রোভ বনের দাম কত? উত্তর আসছে পরের পর্বে।

------------------------------------

*নি:সংকোচে ভূল বানান ধরিয়ে দিন
** অধ্যাপক বার্বিয়ারের সংস্লিষ্ট গবেষনার বিস্তারিত পাবেন তাঁর পেজ থেকে
***টাকা = ইউএসডি

ছবি: 
10/01/2009 - 10:50অপরাহ্ন

মন্তব্য

দুর্দান্ত এর ছবি

কিছু হিসাবে টাকার অঙ্কে আরো প্রকট করে বোঝা যায়। খুব সুন্দর একটা পোস্ট।

মাহবুব রানা এর ছবি

ধন্যবাদ।
লাভটা যখন টাকায় পরিমাপ করা হয়, ক্ষতিটাও টাকাতেই হওয়া উচিত, কোনো কোয়ালিটেটিভ ইনফরমেশনের সাথে না।

হিমু এর ছবি

আমরা কিন্তু বাংলাদেশের পরিবেশটাকে "মাইনিং" করে চলছি প্রতিনিয়ত। চামড়া শিল্পের কথাই ধরুন। চামড়া বেচে লাভের অঙ্কটাই শুধু দেখানো হয় আমাদের, কিন্তু চামড়া শিল্পের দূষণের ক্ষতিটাকে কোয়ানটিফাই করা হয় না। একই কথা খাটে পোশাক শিল্প সম্পর্কেও। পানির দরে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি পায় তারা, কিন্তু কোনো কর দেয় না, উপরন্তু ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির করা দূষণ নদী ও কৃষিজমিকে অকেজো করে দেয়। এই ক্ষয়ক্ষতিগুলো ধনী দেশ গরীব দেশের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, আর আমরা কামড়াকামড়ি করছি কে কত সস্তায় দেশের কত বড় পোঙা মেরে তাদের সেই বাজার ধরতে পারবো।

মাহবুব রানা এর ছবি

দীর্ঘমেয়াদে এগুলো শুধু পরিবেশগত ক্ষতিই না, অনেক বড় আর্থিক ক্ষতিও। কিন্তু সেটা অদৃশ্যই থেকে যায়। আমাদের পরিবেশ অর্থনীতিবিদদের গবেষনার এই দিকটায় আরো মনযোগী হওয়া দরকার।
ধন্যবাদ।

ফাহিম হাসান এর ছবি

সমস্যাটা, যাকে আদর করে externality বলা হয়, বেশ আগে থেকেই অর্থনীতিবিদদের গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে বেশ কিছু থিওরিটিকাল, এম্পিরিকাল কাজ আছে। (পড়তে চাইলে pigou, coase কে গুঁতো দিন)।

বরং পলিসি লেভেলের লোকজন খুব একটা মাথা ঘামায় না। মনোযোগটা তাদের বেশি করে দেওয়া উচিত।

মাহবুব রানা এর ছবি

পলিসির লোকজনের সমস‌্যা আছে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু পলিসি টেবিলে ট্রেডঅফ বিবেচনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যেরও যোগান থাকতে হবে। উঁচু গলায় 'দুইশ টাকা লাভ' এর বিপরীতে নিচু স্বরে 'দেড় লিটার পানি দুষন' এর তথ্য থাকলে তো হবে না।
পরিবেশ/ন্যাচারাল রিসোর্স এক্সটার্নালিটি নিয়ে থিওরেটিকাল কাজ কাজ যতটুকু হয়েছে, এমপিরিকাল ততটুকু হয় নাই। অন্তত পলিসিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার মত তো নয়ই। বাংলাদেশের অবস্থা আপনি ভালো জানবেন, তবে আমার ধারণা সেরকম কাজ খুব বেশি হয়নি। তাই আমি এই মুহূর্তে পলিসির লোকজনকে দোষ দেয়ার চেয়ে পর্যাপ্ত গবেষনার অভাবকেই (গুণগত/পরিমাণগত উভয়ই) এগিয়ে রাখবো সমস্যা হিসেবে।

সত্যপীর এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। পাঁচতারা পোস্ট।

..................................................................
#Banshibir.

মাহবুব রানা এর ছবি

ধন্যবাদ, কিন্তু অর্থনীতিবিদ (-কাম-ইতিহাসবিদ) শুধু তারা দিয়ে চলে গেলে হবে? হাসি

সত্যপীর এর ছবি

আমি অর্থনীতিবিদও নই ইতিহাসবিদও নই। আবজাব অনুবাদ করি মাত্র। পড়াশুনা করা পোস্ট দেখলে তাই তারা দাগিয়ে যাই হাসি

..................................................................
#Banshibir.

ফাহিম হাসান এর ছবি

শিরোনাম দেখেই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু অসমাপ্ত রয়ে যাওয়াতে একটু হতাশ। এই পর্বেই বাকিটা আসতে পারত। যাই হোক, পরিবেশ নিয়ে আপনার লেখা অব্যাহত থাকুক চলুক

মাহবুব রানা এর ছবি

বাকিটা এটার সাথে সম্পর্কিত হলেও একটু আলাদাই, তাই এখানে দেইনি।
ধন্যবাদ।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

দুর্দান্ত পোস্ট।
খুব প্রয়োজনীয় বিষয়ের অবতারনা করেছেন।
প্রাকৃতিক বিষয়ের বাণিজ্যে আমরা শুধু লাভের ক্ষেত্রেই টাকার হিসাব দেখতে পাই কিন্তু প্রকৃতির ক্ষতি টাকার হিসাবে দেখি না বলে বুঝি না যে আসল ক্ষতির পরিমাণ কত।
পোস্টে পঞ্চতারা।

মাহবুব রানা এর ছবি

সেটাই।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনার সিগনেচারটা পছন্দ হয়েছে।

উচ্ছলা এর ছবি

অধীর অপেক্ষায় আছি পরবর্তি পর্বের জন্য।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপ্নাকে এত দারুন একটা ব্যাপারে আলোকপাত করার জন্য।

মাহবুব রানা এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনার পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় আমিও হাসি

দ্রোহী এর ছবি

এ ধরনের বিষয়বস্তু সমৃদ্ধ লেখা আরো বড় পরিসরে লেখাই উত্তম।

সাড়ে চার বিলিয়ন বছরে যে পৃথিবীর কিছু হয়নি সে পৃথিবীর পুটু মারতে মানবজাতির দুইশ বছরও লাগলো না। মন খারাপ

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

মাহবুব রানা এর ছবি

মানবজাতি বড়ই আশ্চর্যের মন খারাপ
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

শামীম এর ছবি

চমৎকার এবং প্রচন্ড আগ্রহোদ্দীপক লেখা শুরুর জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকলাম।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

মাহবুব রানা এর ছবি

ধন্যবাদ শামীম ভাই। সাথে থাকুন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।