আল্লাহ তুমি কার!

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০১/২০১০ - ১:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ
তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষত।
জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি
ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ী রূপে
ক্রমশঃ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগের প্রকোপ"

রাজনৈতিক ইসলামের স্বরূপ উন্মোচন করে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই কথাগুলো লিখেছিলেন কয়েক দশক আগে তার 'ধর্মান্ধের ধর্ম নেই' কবিতাটিতে। সেই কথাগুলো আজও প্রযোজ্য আমাদের দেশে এবং যেমন ধরুন মালয়েশিয়ায়। সেই দেশটি আমাদের দেশের মত ব্রিটিশ কলোনি ছিল এবং ১৯৬৩ সালে স্বাধীন হবার সময় ব্রিটিশ আইনকে উত্তরাধিকার হিসেবে পায়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের এই দেশে মোল্লাদের প্রভাব ছিল শুধু মসজিদের ভেতরেই। এর প্রথমদিককার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। সাথে সাথে মালয়েশিয়ায় প্রচুর চৈনিক এবং ভারতীয় শ্রমিক আসে কাজ করতে। সরকার তাদের ভোটাধিকার দেয় এবং তারাও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতায় আসতে বিরত রাখে। মালয়রা এমনিতে শান্তি প্রিয় জাতি, তাই বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান ছিল এতদিন কোন বড় ঝামেলা ছাড়াই।

বর্তমান সমৃদ্ধ মালয়েশিয়ার রুপকার মাহাথির মোহাম্মাদ নিজে খুব আধুনিক হলেও মালয়েশিয়ার মুসলমান পরিচয়টি আগে বাড়িয়ে রেখেছিলেন এবং ইহুদী ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি সমালোচনায় তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। তবে সেটি কখনই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় নি এবং অনেকে বলে যে তার এই টোনটি ছিল বিরোধী দলকে মোকাবেলায় মুসলমান ভোট টানার চেষ্টার ফসল। তবে বিগত দশকে মুসলমান মালয়রা (৬০%) সবকিছুর মধ্যে বেশী পরিমাণে ধর্মীয় অনুশাষণকে টেনে এনেছে।

বাংলাদেশের মত মালয়েশিয়াও মুসলমানদের ফ্যামিলি কোর্টের ব্যাপারস্যাপারগুলো - বিয়ে, বিচ্ছেদ, শিশু অধিকার ইত্যাদি শরিয়া আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। তবে মালয়েশিয়ায় কিছু ফৌজদারী আইনও শরিয়া আইন দ্বারা নির্ধারিত - যেমন মদ্যপান, রোজা না রাখা, বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক ইত্যাদি।

উদাহরণস্বরূপ মদ্যপানের শাস্তি জরিমানা বা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে জেল বা বেত্রাঘাত। সেদেশে মদ বিক্রি করার সময় কিন্তু সাধারণত পরীক্ষা করা হয়না আসলেই ক্রেতা মুসলমান কিনা এবং এতদিন পর্যন্ত এটি ঢিলাঢালা ভাবেই ছিলি এবং সর্বোচ্চ জরিমানার কথা শোনা গেছে। তবে গত বছরে মালয়েশিয়ার এক মডেল খবরের হেডলাইনে চলে আসে কারণ তাকে বিয়ার পানরত অবস্থায় দেখা যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে বেত্রাঘাত এর শাস্তি দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার ইসলামী শাসন হার্ডলাইনে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় গত আগষ্টে ব্ল্যাক আইড পিজ এর কনসার্টে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। সরকার কারণ দেখিয়েছে যে আইরিশ বিয়ার প্রস্তুতকারী গিনেস এর স্পনসর - তাই তারা এটি মুসলমানদের জন্যে নিষিদ্ধ করেছে।

উপরের যুক্তিটি কি আপনি মানতে পারছেন? দাঁড়ান, আপনার জন্যে আরও চমক অপেক্ষা করছে। তিন বছর আগে মালয়েশিয়ান সরকার অমুসলিমদের আল্লাহ কথাটি ব্যবহার নিষেধ করে দেয়। হেরাল্ড উইকলি নামক পত্রিকা অনেক দীর্ঘ আইনী লড়াই শেষে সম্প্রতি কোর্ট থেকে রায় পায় যে সে দেশের অমুসলিমরা আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে। কোর্ট যুক্তি দেখায় যে মালয়েশিয়ার সাবাহ এবং সারাওয়াক আদিবাসী খ্রীষ্টানরা বহু শতক ধরে আল্লাহ বলে আসছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নাজিবের সরকার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপীলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

auto

এই ব্যাপারটি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু না। গত রবিবার থেকে মালয়েশিয়ার বেশ কয়েকটি চার্চে আক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। আজ আলজাজিরায় ইনসাইড স্টোরী অনুষ্ঠানে এই নিয়ে বিভিন্ন জনের মতামত শুনছিলাম। মালয়েশিয়ার ইয়থ মুভমেন্টের একটি সুট পরা যুবক তোতা পাখির মত আউরে যাচ্ছে যে আল্লাহ শুধু মুসলমানদের, খ্রীষ্টানদের কোন অধিকার নেই আল্লাহ বলার। তার বক্তব্য খ্রিষ্টানরা আল্লাহ বলে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে দিতে চাইছে। ৯% খ্রিষ্টান ৬০% মুসলমানদের কিভাবে বিভ্রান্ত করবে জিজ্ঞাসা করা হলে কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি। আরেক বিশেষজ্ঞ বললেন এটি হচ্ছে রাজনৈতিক ইসলামের খেলা। ইচ্ছে করে মাঠ গরম করা হচ্ছে সরকারী দল দ্বারা নির্বাচনে বিরোধী দলকে রুখতে।

এই বিষয়টি নিয়ে লেখার একটি উদ্দেশ্য আছে আমার। মালয়েশিয়ার মত বহু ধর্মীয় গণতন্ত্রের দেশে (বর্তমানে অমুসলিম প্রায় ৪০%) যখন এই অবস্থা, আমাদের দেশে (প্রায় ৮৮% মুসলমান) পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াতে পারে ভবিষ্যৎে? ভেবে দেখেছেন কি?

বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের (১৯৭২) ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে ছিল:

"কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন, ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সংগঠন করা যাবে না।"

এই কথাগুলো ১৯৭৭ সালে পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বাতিল করে দেয়া হলে বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর মত দলগুলো পুনরায় আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়। এর ফলশ্রুতি স্বরূপ আজকে আমাদের দেশেও ক্ষয়রোগের আভাস দেখা যাচ্ছে, যা দ্রতই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

সম্প্রতি আদালত নির্দেশ দিয়েছে পঞ্চম সংশোধনীকে বাতিল করার। এটি সফল হলে আমরা এই ক্ষয়রোগ সারাতে পারব। না হলে আর বেশী দেরী নাই শরীরে পচন ধরার। তখন অঙ্গহানির মত মারাত্মক ঘটনাও ঘটতে পারে। সাধু সাবধান।

ছবি, দি ফাউন্ড্রির সৌজন্যে


মন্তব্য

মামুন হক এর ছবি

জরুরী একটা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন রেজওয়ান ভাই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আজান দিয়ে নিষিদ্ধ করা উচিৎ। ধর্ম থাকবে মানুষের হৃদয়ে, ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারে, কিন্তু এর খোলসে রাজনীতি বা ক্ষমতা দখলের জারিজুরী বা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ চলবে না, চলতে পারেনা।

'৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাবার মতো বলস সরকারের থাকলে তো আর কথাই ছিলনা।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

চলুক
শুধু ধর্র্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই চলবে না , যথার্থ সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের নিমিত্তে লেজেহুমো এরশাদ যে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মই বানিয়ে দেন সংবিধানে কাঁচি চালিয়ে তা' বাতিল করতে হবে । সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সেক্যুলারিজম পরিপন্থি ।

ধর্ম যার যার কিন্তু রাষ্ট্র হোক সবার

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

চলুক

খুবই দরকারী কথা। আপনি আমি তো ভাবছিই। তাতে কি কার্যোদ্ধার হবে?! যাদের ওইসব ফিরে যাওয়া বা বাতিল করার জুরিসডিকশন, তাদের তো, ওই যে, মামুন ভাই যেইটা বললেন, বল্স নাই, আছে অন্য অনেক অনেক গুপ্তকেশী হিসাবনিকাশ! স্যরি। মন খারাপ

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবীটা জোরালো করতে হবে।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

সংবিধানের মুসলমানী করে যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে তারাও ধর্ম ব্যবসায়ী। মুসলমানী reverse করতে গেলে লাগবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিশাল ঘটনা । কোর্টের আদেশে মনে হয় হবে না। আওয়ামী সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করলেও বিএনপি এসে আবার তুলে আনবে তাদের।

মালয়শিয়ার ঘটনা জানতাম না।

পাকিস্তান থেকে কি কেউ শিক্ষা নেয় না?

###তাসনীম###

সাফি এর ছবি

ঐতিহ্যগত ভাবেই আমরা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে মিলেমিশে থেকে এসেছি। সেকারণেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এদেশে পুরোপুরি ব্যর্থ। সুতরাং ৮৮% মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ে ওরকম চরমের দিকে আমরা যাবনা বলেই আমার বিশ্বাস।

সাফি এর ছবি

শিরোনামের ব্যাপারে একটা ঘটনা মনে পড়ল। খুব ছোট থাকতে একবার জুম্মার নামায পড়তে গেছি কোন এক মসজিদে, যেখানে ইমাম আল্লাহ কে তুই তুই করে মোনাজাত করেছিল। ছোট্ট আমি তাতে খুবই মাইন্ড খাই এবং পরের দিনই আমাকে যিনি কুরআন পড়ানো শিখাতেন সেই হুজুরের কাছে বিচার দেই। তখন তিনি বলেছিলেন এরকম কিছু কথা - "আল্লাহ সবার নিজের কাছে, তাই যে যার খুশি তাকে তাই বলে ডাকতে পারে, কিন্তু ডাকাটাই আসল"

যাই হোক আরেকটা ব্যাপার অবাক করা, ইসলামে যেখানে ইহুদি বা খ্রীষ্টান ধর্মকে স্বীকৃতি দেয়া (অন্তত বিয়ে করার ব্যাপারে) সেখানে তারা আল্লাহ বললে তো আরও ভাল!

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

এমনিতেই বরাহবাহিনীর যে আস্ফালন, বর্তমানের মতো ঢিলেতালে দেশ চললে মৌলবাদিদের তীর্থস্থান হয়ে উঠবে বাঙলাদেশ। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক, অন্তত অন্য দেশগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি আমরা।
লেখার জন্য ধন্যবাদ।

==============================
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।